এমএনএফের দাবী

সাত শতাধিক জেএসএস সদস্য মিজোরামে প্রশিক্ষণ নিয়েছে

fec-image

বাংলাদেশ-মিজোরাম সীমান্তবর্তী জেএসএসের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোতে এ পর্যন্ত ৭ শতাধিক জেএসএস সদস্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের একটি সূত্র পার্বত্যনিউজকে জানিয়েছে। সুত্র আরো জানিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জেএসএস সদস্যরা মিজোরামের চাকমা অধ্যুষিত এলাকায় বাড়ি-ঘর দোকানপাট ক্রয় করে ব্যবসা শুরু করেছে। এসবের আড়ালে সশস্ত্র প্রশিক্ষণার্থিদের আশ্রয়দান ও মিজোরাম থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।

উল্লেখ্য গত ২৪ জানুয়ারি মিজোরামের এক সময়ের বিদ্রোহী সংগঠন  মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের(এমএনএফ) একটি শাখা পিস একর্ড এমএনএফ রিটার্নিস এসোসিয়েশন(পামরা) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দাবী করে বাংলাদেশ-মিজোরাম সীমান্তে দুইটি জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ৮টি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির খুলেছে।



পামরার এই বিবৃতির সূত্রে ভারতের ইন্ডিয়া টুডে, আসাম ট্রিবিউন এবং নর্থইস্ট লাইভসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলোতে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদ ও পামরার বিজ্ঞপ্তিতে দাবী করা হয়, জেএসএস নেতা সন্তু লারমা, উষাতন তালুকদার ও ডেভিড লয়াল বমের নির্দেশনায় এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে। তারা আঞ্চলিক অর্থে মিজোরাম থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সামগ্রী ক্রয় করেছে। স্থানীয় এনজিওগুলো জেএসএসের এহেন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে মিজোরাম সরকারকে এগুলো বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।

পামরা সাধারণ সম্পাদক সি লালথেনলোভা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা এটা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। আমাদের জনগণ নিরাপদ নয়। তারা আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে। আমরা মিজোরাম সরকারকে যতদ্রুত সম্ভব এই জেএসএসের সশস্ত্র প্রশিক্ষণার্থিদের কার্যক্রম বন্ধ ও এখান থেকে তাদের সরিয়ে দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছি। যদি সরকার তা করতে ব্যর্থ হয় তবে আমরাই প্রয়োজনে যা করার করবো।

তবে জেএসএসের পক্ষে এসকল সংবাদ ও বিবৃতির ব্যাপারে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়নি। তবে জেএসএস সমর্থিত স্যোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন আইডি ও গ্রুপ থেকে দেয়া পোস্টে বলা হয়েছে, এমএনএফ শান্তিবাহিনীকে ভুল বুঝেছে। শান্তিবাহিনী মিজোরামের কারো জন্য হুমকি নয়। তারা শুধু বাংলাদেশে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে।

এদিকে গতকাল এ সংক্রান্ত সংবাদগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত বিভিন্ন স্যোশাল মিডিয়া আইডি, গ্রুপ ও পেইজে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে পার্বত্যনিউজ এ অনুসন্ধান শুরু করে। মিজোরামের অভ্যন্তরে এবং এমএনএফের বিভিন্ন সূত্রে যোগাযোগ হলে এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য পার্বত্যনিউজের হাতে আসে। সূত্রগুলো তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করলেও পার্বত্যনিউজের পক্ষে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমএনএফের একটি সূত্র জানায়, প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোতে এ পর্যন্ত জেএসএসের প্রায় ৭২০জন সদস্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে।  সুত্র আরো জানিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জেএসএস সদস্যরা মিজোরামের চাকমা অধ্যুষিত এলাকায় বাড়ি-ঘর দোকানপাট ক্রয় করে ব্যবসা শুরু করেছে। কেউ কেউ বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করেছে। এসবের আড়ালে সশস্ত্র প্রশিক্ষণার্থিদের আশ্রয়দান ও মিজোরাম থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। পার্বত্যনিউজ প্রশিক্ষণ এলাকায় কিছু চাকমা সদস্যদের সাথে কথা বললেও তারা কোনো তথ্য দিতে রাজী হয়নি।

এদিকে পার্বত্যনিউজের হাতে আসা মিজোরামের একটি অফিসিয়াল নথিতে দেখা যায়, লংলেই জেলার সালমোরে অবস্থিত জেএসএসের একটি বড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কমান্ডার ফিবির চাকমা। তার মোবাইল নম্বর 9862**2738।

অন্যদিকে মামিত জেলার সিলসুরি গ্রামে অবস্থিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, কোম্পানী কমান্ডার আলো চাকমা এবং অমচারি গ্রামে অবস্থিত ক্যাম্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কমান্ডার বিনান্দ চাকমা।  মামিত জেলার প্রশিক্ষণের সার্বিক দায়িত্বে রয়েছেন প্রবীর চাকমা। তার মোবাইল নম্বর 87988**629)।

উক্ত নথিতে বলা হয়েছে, জেএসএস(সন্তু গ্রুপ) মিজোরামকে ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন জনগোষ্ঠীকে হত্যা ও ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে যাচ্ছে। এতে আরো বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কায় জেএসএস কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর অধিকারের বিরোধিতা করে আসছে। জেএসএস তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিজোরামে চাকমাদের ব্যবহার করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছে।

রিপোর্টে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে সীমান্ত এলাকা থেকে জেএসএস প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলো ধংস করে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ রিপোর্ট পর্যালোচনা করে বোঝা যায়, বাংলাদেশ-মিজোরাম সীমান্তে জেএসএসের সশস্ত্র অবস্থান কেএনএফের আন্তঃসীমান্ত চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

এমএনএফ-জেএসএস বিরোধ

পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট(এমএনএফ) দীর্ঘদিন মিজোরামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র আন্দোলন করে এসেছে। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর তাড়া খেয়ে অনেক সময় তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় গোপনে আশ্রয় নিতো।

কিন্তু অন্য দেশের সীমান্তের ভেতরে অপারেশন চালানো সম্ভবপর না হওয়ায় সুসম্পর্কের জেরে ভারত জেএসএসকে এমএনএফের বিরুদ্ধে কাজে লাগায়। জেএসএসের আক্রমণে বাংলাদেশে তাদের ব্যাপক ক্যাজুয়ালটি হওয়ায় অবশেষে ১৯৮৬ সালে ভারত সরকারের সাথে শাস্তিচুক্তিতে যেতে বাধ্য হয় তারা। সেই থেকে জেএসএস-এমএনএফের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। এমএনএফের বর্তমান অবস্থানে তার প্রভাব পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

এছাড়াও বর্তমানে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়ায় কুকি জাতীয়তাবাদের যে পুণরুত্থানের আভাস দেখা যাচ্ছে তাতে মিজোরাম এ অঞ্চলের কুকি সশস্ত্র গোষ্ঠীর কোকুনে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের কেএনএফ ও কেএনএ মূলত মিজোরামের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও প্রশিক্ষণ পেয়ে আসছে। জাতিগত ও নৃতাত্ত্বিক ঐক্যের সূত্রে এখনো কেএনএ’র শীর্ষ নেতা নাথান বমসহ অধিকাংশ কমান্ডার মিজোরামেই পালিয়ে রয়েছে বলে বাংলাদেশের ধারণা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন