মাদ্রাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুদানের নামে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র

fec-image

মাদ্রাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুদানের নামে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। গতবছর একই অভিযোগ উঠলেও প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। এবারো অনুদান প্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যেসব তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাদের অনেকেই উল্লেখিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নয় বলে জানা গেছে। এমনকি শিক্ষার্থীদের নগদ নাম্বারে টাকা পাঠানোর শর্ত থাকলেও তালিকায় শিক্ষার্থীদের নামের পাশে তাদের নগদ একাউন্ট নম্বর উল্লেখ করা হয়নি। এর মাধ্যমেও প্রতারকদের একাউন্টে টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের অনুকূলে বরাদ্দকৃত অর্থ বিতরণের তালিকাসহ একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। গত ২৯ জুন রোববার মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত পরিচালন বাজেটে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এবং ছাত্রবৃন্দের জন্য বিশেষ অনুদান হিসেবে ৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে আর্থিক অনুদান বাবদ অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের নামের পাশে বর্ণিত হারে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস “নগদ লিমিটেড”-কে এ বিভাগের সাথে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সংযুক্ত তালিকা অনুযায়ী নিম্নোক্ত শর্তে বিতরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

উল্লেখ করা হয়েছে, ৪৯৮টি প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে ২৫ হাজার টাকা করে মোট ১ কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
৮৩০ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে ১০ হাজার করে মোট ৮৩ লাখ টাকা। ইবতেদায়ী (১ম থেকে ৫ম) পর্যন্ত ২০৬৮ জন শিক্ষার্থীকে ৩ হাজার টাকা করে মোট ৬২ লাখ ৪ হাজার টাকা। ৬ষ্ঠ হতে ১০ম (দাখিল ও ভোকেশনাল) পর্যন্ত ৭৪৫৬ জন শিক্ষার্থীকে ৫ হাজার টাকা করে মোট ৩ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এইচএসসি (বিএম) আলিম ও ডিপ্লোমা পর্যন্ত ২০৬৯ জন শিক্ষার্থীকে ৬ হাজার টাকা করে মোট ১ কোটি ২৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা। কামিল, ফাজিলসহ তদূর্ধ্ব শ্রেণি পর্যন্ত ৮৮৬ জন শিক্ষার্থীকে ৭ হাজার টাকা করে মোট ৬২ লাখ ২ হাজার টাকা এবং বিশেষ বিবেচনায় মনোনীত ৩ জন শিক্ষার্থীকে ৫০ হাজার টাকা করে মোট ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হবে।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস “নগদ লিমিটেড” এর পক্ষে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নগদ লিমিটেড, ঢাকা মনোনীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের নামের পাশে বর্ণিত হারে এই আদেশ জারির সাত কর্মদিবসের মধ্যে অর্থ বিতরণ করবেন এবং বিতরণ শেষে বিস্তারিত প্রতিবেদন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে দাখিল করবেন; কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থীদের অনুকূলে প্রদেয় অনুদানের অর্থ একটি ব্যাংক হিসাব/মোবাইল নম্বরে শুধুমাত্র একবার প্রেরণ করা যাবে। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক হিসাবে/মোবাইল নম্বরে একাধিক অনুদানের অর্থ প্রেরণ করা যাবে না; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বরাদ্দকৃত অর্থ মনোনীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব নম্বরে প্রদান করবেন; অব্যয়িত অর্থ ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করতে হবে এবং প্রমাণক অত্র বিভাগে প্রেরণ করতে হবে।

অনুদান প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের তালিকায় দেখা যায় রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার গাঁথাছড়া বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া আদর্শ দাখিল মাদরাসার দাখিল পর্যায়ে ৫ এবং এবতেদায়ী পর্যায়ের ১ শিক্ষার্থীর নাম অনুদান পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সুপারিন্টেডেন্ড মাওলানা ফোরকান আহমদ বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী হিসেবে কিন্তু যাদের নাম অনুদানের তালিকায় এসেছে তারা কেউ আমার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী না। এমনকি তাদেরকে আমরা চিনিও না। আমার প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ অনুদানের জন্য আবেদনও করেনি।

রাঙ্গামাটি সদরের বায়তুশ শরফ দাখিল মাদ্রাসার সুপারিন্টেডেন্ড মাওলানা শামসুল আরেফিন জানান, উনার প্রতিষ্ঠানের নাম অনুদান প্রাপ্তির তালিকায় ছিল এবং অনুদানের ২৫ হাজার টাকা গতকাল ৭ জুলাই সোমবার প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক একাউন্টে যোগ হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হিসেবে ৯ জনের নাম এসেছে অনুদানপ্রাপ্তির তালিকায়। কিন্তু তারা কেউ রাঙ্গামাটি বায়তুশ শরফ দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী না। তাছাড়া যেসব শিক্ষার্থীর নাম এসেছে তালিকায় তাদের নামের পাশে নগদ একাউন্ট নাম্বার থাকার কথা। কিন্তু তালিকায় শিক্ষার্থীদের নামের পাশে কোনো নগদ নাম্বারও নেই।

বাঘাইছড়ি উপজেলার কাঁচা লং দাখিল মাদ্রাসা সুপারিন্টেডেন্ড মাওলানা ওমর ফারুক জানান, ‘তালিকায় আমার প্রতিষ্ঠানের ১০ শিক্ষার্থীর নাম এসেছে। কিন্তু যাদের নাম এসেছে এসব নামের কোনো শিক্ষার্থী আমার প্রতিষ্ঠানে নেই। এমনকি আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ আবেদন করেছে বলেও শুনিনি।’

রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার মাইনীমুখ ফাজিল মাদ্রাসার সুপারিন্টেডেন্ড মাওলানা মোহাম্মদ ফেরদৌস আলম জানান, ‘মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী আমাদের প্রতিষ্ঠানের ৫ শিক্ষার্থী অনুদান পেয়েছে। কিন্তু তালিকায় যাদের নাম এসেছে, এই নামে কোনো শিক্ষার্থী আমাদের প্রতিষ্ঠানে নেই।’

এসব অনিয়মের ব্যাপারে মতামত জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলামের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালেয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব সৈয়দ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেনের স্বাক্ষরে এসব অনুদানের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার্থীদের নামের তালিকায় মিল না থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো ‘মাই জব’ ভিত্তিতে করা; ২০ হাজার আবেদন থেকে ১২ হাজার শিক্ষার্থীকে বেছে নেয়া হয়েছে। আবেদনের সময় যেসব শর্ত দেয়া হয়েছিল তারা তো সেই সব শর্ত মেনেই আবেদন করেছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষে তো সবার আবেদনের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব না। তবে কেউ যদি অনিয়মের তালিকা দিয়ে মন্ত্রণালয়ে যাচাইয়ের আবেদন করে তাহলে সেটা খতিয়ে দেখা হবে।

এগুলোর সাথে প্রতারক চক্র জড়িত থাকার আশঙ্কার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এর সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরাও যেমন জড়িত থাকতে পারে, তেমনি মন্ত্রণালয়ের অসাধু কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে। তবে অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শর্ত মতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ জমা হবে নির্ধারিত ব্যাংক একাউন্টে এবং শিক্ষার্থীদের অনুদান জমা হবে তাদের নগদ একাউন্টে। কিন্তু তালিকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামের পাশে ব্যাংক একাউন্ট নম্বর উল্লেখ থাকলেও শিক্ষার্থীদের নামের পাশে তাদের নগদ একাউন্ট নম্বর উল্লেখ করা হয়নি। তাহলে শিক্ষার্থীদের অনুদানের টাকাগুলো কোন একাউন্টে জমা হবে? নাকি প্রতারকচক্র পুরোটাই হাতিয়ে নেবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, একাউন্ট নম্বর অবশ্যই থাকার কথা, না হলে তো টাকা যাওয়ার কথা না।

ইতোমধ্যে প্রতারকচক্র নগদের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়ে থাকলে সেটা ফেরত আনার কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, সেটা নিয়ে নগদের সাথে কথা বলে জানতে হবে। তাদের কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা। গত বছরও এমন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল, তা তিনিও স্বীকার করেন। কিন্তু এরপর প্রতিকারে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সে প্রশ্নের তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: শিক্ষা মন্ত্রণালয়
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন