সেনানিবাসের একটি ভবন ‘সাময়িক কারাগার’ ঘোষণা

fec-image

ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনকে সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা করেছে সরকার। গত রবিবার (১২ অক্টোবর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করে।

গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের খবর সংগ্রহকারী হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রজ্ঞাপনের একটি পিডিএফ সংস্করণ প্রকাশ করেন প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আল নোমান।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯৮-এর ৫৪(১)-এর ক্ষমতাবলে দ্য প্রিজন অ্যাক্ট (কারা আইন), ১৮৯৪-এর ধারা ৩/বি অনুসারে ঢাকা সেনানিবাসের বাশার রোডসংলগ্ন উত্তর দিকে অবস্থিত ‘এমইএস’ বিল্ডিং নং-৫৪-কে সাময়িকভাবে কারাগার হলো। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এই আদেশ জারি করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। রাষ্ট্রপতির মন্ত্রিপরিষদসচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার, কারা মহাপরিদর্শকসহ সরকারের ১৫টি দপ্তরে প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।

কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা সেনানিবাসের ওই ভবনকে ‘সাময়িক কারাগার’ উপযোগী করে তোলা এবং প্রয়োজনীয় লোকবলের বিষয়ে অ্যাসেসমেন্ট চলছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে গুম-অপহরণ করে আটক, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলার ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ গত ৮ অক্টোবর আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। দুই মামলাতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিককে আসামি করা হয়েছে। এই দুজনসহ দুই মামলায় মোট আসামি ৩০ জন।

বাকি ২৮ আসামির ২৫ জনই সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে ১৫ জন সেনাবাহিনীতে কর্মরত। এই ১৫ জন সেনা হেফাজতে আছেন বলে গত ১১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে জানায় সেনা সদর। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনকে সাময়িকভাবে কারাগার হিসেবে ঘোষণা করল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

চিফ প্রসিকিউটর বললেন আর্মির হাতে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা নেই :
এদিকে সোমবার বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসে ‘সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা’ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

তখন পর্যন্ত তিনি বিষয়টা জানেন না বলে জানালেও এক প্রশ্নে বলেন, ‘যদি সরকার কোনো জায়গাকে সাবজেল ডিক্লিয়ার (ঘোষণা) করে, সরকারের সে ক্ষমতা আছে কোন জায়গাটাকে তারা জেল ঘোষণা করবে, প্রিজন অথরিটির (কারা কর্তৃপক্ষের) আওতায় নিয়ে আসবে, এটা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। সুতরাং এইটা আমাদের কনসার্ন হওয়ার কোনো বিষয় না। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, যখন কোনো আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে, যখন এই পরোয়ানাটি তামিল (বাস্তবায়ন) অর্থাৎ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যখন পরোয়ানাটা তামিল করবে, কাউকে গ্রেপ্তার করবে, তখন সরাসরি কিন্তু কাউকে জেলে নেওয়ার কোনো বিধান নেই। আইন হচ্ছে, আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে আনতে হবে। আদালতে আনার পর আদালত যদি ফারদার (পরবর্তী) অর্ডার (আদেশ) দিয়ে বলেন, তাঁকে (গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে) কারাগারে পাঠানো হোক, তখন কারাগার বলতে সেটি কেন্দ্রীয় কারাগারও হতে পারে, সেটা জাতীয় সংসদ ভবনের মধ্যেও হতে পারে, এমপি হোস্টেলও হতে পারে বা অন্য কোনো জায়গাকে যদি সরকার কারাগার ঘোষণা করে, সেই জায়গায় পাঠানো যেতে পারে। সুতরাং কোন জায়গাকে কারাগার করা হচ্ছে, এটা প্রসিকিউশনের বা তদন্ত সংস্থার বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, আইন অনুযায়ী কাজটা করতে হবে। আসামিকে গ্রেপ্তার যদি করা হয়, করামাত্রই উইদিন টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স (২৪ ঘণ্টার মধ্যে) তাঁকে আদালতে আনতে হবে। এটা হচ্ছে মোদ্দা কথা। সেটা সংবিধানে যেমন আছে, আইসিটির আইনে আছে, সিআরপিসিতেও (ফৌজদারি কার্যবিধি) আছে।’

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার পরোয়ানাভুক্ত ১৫ জন কর্মকর্তা সেনা হেফাজতে আছেন। এই হেফাজতে থাকার ব্যাখ্যা কী, এমন প্রশ্নে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি খুব কম কথা বলব। যতক্ষণ পর্যন্ত গ্রেপ্তার দেখানো না হয়েছে, যদি পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে, গ্রেপ্তার করা হলে তখন থেকে তাঁর ওপর আইন প্রযোজ্য হবে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে কোর্টে আনতে হবে। কিন্তু আপনি যদি গ্রেপ্তার না দেখান, তাহলে তাঁর ক্ষেত্রে ওই চব্বিশ ঘণ্টার আইন তো প্রযোজ্য নয়। যখনই গ্রেপ্তার দেখানো হবে, তখন থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই তাঁকে আদালতে প্রডিউস করতে হবে।’

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামিদের আর্মি গ্রেপ্তার করতে পারে কি না—জানতে চাইলে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অ্যারেস্টিং অথরিটি (গ্রেপ্তারকারী কর্তৃপক্ষ) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী মানেই হচ্ছে পুলিশ। আর্মির হাতে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা নেই। এখানে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। এই আদেশটা (ট্রাইব্যুনারের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা) পালনের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসকে অবহিত করা হয়েছে। তাঁরা কিন্তু গ্রেপ্তার করবেন না। অবহিত থাকার অর্থ হচ্ছে, যখন পুলিশ এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করতে যাবে, তারা অবহিত থাকলে এই পরোয়ানা তামিল করতে তাদের সাহায্য করতে পারবেন। সুতরাং অ্যারেস্টিংয়ের পাওয়ার (গ্রেপ্তারের ক্ষমতা) কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর, অন্য কোনো কারো না।

আগের নজির :
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার যদি কোনো বাড়িকে সাবজেল বা উপকারাগার ঘোষণা করে, সেখানে মামলার আসামি রাখতে পারেন। এমন নজির এর আগেও রয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে এক-এগারোর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের পর সংসদ ভবন এলাকায় দুটি বাড়িকে সাবজেল ঘোষণা করে সেখানে রাখা হয়েছিল। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের পর নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএম আদালতে। আদালতে জামিন নামঞ্জুর হলে তাঁকে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত ওই সাব জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই কারাগারে ৩৭২ দিন কাটানোর পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। কারাবন্দি থাকাকালেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। শেখ হাসিনাকে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সুধা সদনের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকেও রাখা হয় সংসদ ভবনে স্থাপিত অস্থায়ী কারাগারে। তিনি ১০ মাস ২৫ দিন পর ২০০৮ সালের ১১ জুন মুক্তি পান।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর বেগম খালেদা জিয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল বিশেষ কারাগার। খালেদা জিয়াকে ওই কারাগারে স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিল কারা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু করোনা মহামারি শুরুর পর ২০২০ সালে তিনি মুক্তি পান। এর পর কয়েক দফায় তাঁর মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। একের পর এক মামলায় খালাস পান খালেদা জিয়া। আর কারাগারে ফেরেননি তিনি। অন্তর্বর্তী সরকার খালেদা জিয়ার জন্য তৈরি করা সেই মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারটিকে নতুনভাবে চালু করেছে। এখানেই রাখা হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেপ্তার আওয়ামী সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতা এবং অন্যন্যরা।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আসামী, ঢাকা সেনানীবাস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন