পাহা‌ড়ে খেজুর গাছ ও রস সংকট, মাটির হাঁড়ির স্থলে প্লাস্টিকপাত্র

fec-image

ঋতু চ‌ক্রের আব‌র্তে এখন শীতকাল। শীতের সকাল মানেই ঘন কুয়াশা ভেদ করে খালি পা‌য়ে শিশির ভেজা ঘাস মা‌ড়ি‌য়ে গা‌ছি‌দের খেজুর রসের হাঁক গ্রাম বাংলার ঐতিহ‌্য এখন আর আ‌গের মত চো‌খে প‌ড়ে না। দু একটা এলাকায় যা-ও দেখা মেলে তাতেও নেই মাটির হাঁড়ি। হাঁড়ির জায়গায় বসেছে প্লাস্টিক পাত্র।

উঠা‌নের এক কো‌নে, চুলোর ধোঁয়া আর নতুন চালের পিঠার মিষ্টি গন্ধে ঘুম ভাঙে গ্রামের মানুষের। এরপর পিঁড়ি পেতে বসে কাঁচা রস কিংবা ঘন রসে ডুবানো পিঠা শীতকালের এই দৃশ্য যেন গ্রামবাংলার এক অমূল্য স্মৃতি। কিন্তু সেই স্মৃতির ছবি যেন কিছুটা বদলে গেছে। প্রযু‌ক্তির কল‌্যা‌ণে মাটির হাঁড়ির জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিকের বোতল।

মাটিরাঙ্গা উপ‌জেলার নতুন পাড়া এলাকায় শেষ বিকেলে প‌শ্চিমাকা‌শে ঢ‌লে পড়া সোনালী রঙের আলতো রোধ পড়া খেজুর গাছের গায়েশোভা পা‌চ্ছে প্লাস্টিক বোতল। এ‌তে গাছের উপরিভাগ থেকে গড়িয়ে পড়া রসের ‘টুপটাপ’ শব্দ,মি‌ষ্টি ঘ্রাণ আর মৌমা‌ছির বনবন গান এক অপরূপ পরি‌বেশ সৃ‌ষ্টি ক‌রে। পাহা‌ড়ে প্রায় বিলুপ্ত খেজুর গা‌ছের এমন দেখা যায় খায়ের মিয়ার বাড়ির পাশে এক সারি খেজুরগাছে।

গা‌ছি খায়ের মিয়া বললেন, আ‌গের মত বাজা‌রে মা‌টির হা‌ড়ি পাওয়া যায়না। তা ছ‌াড়‌া হাঁড়ির দাম বে‌শি টেকে কম। আবার অনেকে দূর থেকে ঢিল ছুড়ে ভেঙে দেয়। তাই বাধ্য হয়েই বোতল ব্যবহার করছি।

প্লাস্টিক সহজলভ্য ও বহন সুবিধাজনক হ‌লেও সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে উদ্বেগও। প্লা‌স্টি‌কের বোতল কতটুকু স্বাস্থ‌্য সম্মত তা প্রশ্ন থে‌কেই যায়। তবে খেজুরের রস সংগ্রহের পাত্র নিয়ে এত ভাবনা,যদি খেজুরের গাছই না থাকে তাহলে পাত্র দিয়েই বা কি হবে?

দিনদিন খেজুরগাছ হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে কেউ গাছ লাগাচ্ছেন না। দামও বেড়েছে অঞ্চলভেদে প্রতি কেজি খেজুরের কাঁচা রস ৪০-৫০ টাকা, যেখানে এক সময় কেজি প্রতি ৫ টাকায় বিক্রি হতো। আর ঘন রসের প্রতি কেজি বিক্রি হয় ২৫০-৩০০ টাকায়।

আ‌গের মত এখন সা‌রি সা‌রি খেজুর গাছ দেখা যায়না। জেলার বিভিন্ন উপ‌জেলায় বসতবাড়িতে দু-একটি খেজুরগাছ চো‌খে প‌ড়ে। মা‌টিরাঙ্গা গোম‌তি ও বড়নাল ইউনিয়নের মাষ্টারপাড়ায় কিছু খেজুরগাছ কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে চলতে থাকলে ভ‌বিষ‌্যৎ প্রজন্মকে খেজুরগাছ চিনিয়ে দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়বে।

স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষক আবুল হা‌শেম জানান, মনে যেন সেই হারানো স্বাদের হাহাকার

“হাঁড়ির রসের মতো সুবাস আর পাই না। বোতলের রসে যেন একটা অচেনা গন্ধ থাকে।”
প্রবীণ সংবাদকর্মী ম‌জিবুর রহমান ভূইয়া জানান,এক সময় পাহা‌ড়ের অ‌নেক খেজুর গাছ দেখা গে‌লেও এখন দেখা যায় না। দুই একটা দেখা গে‌লেও চা‌হিদা বে‌শি থাকায় অ‌নে‌কেই খে‌তে পা‌রেনা। আগামী প্রজ‌ম্মের কথা চিন্তা ক‌রে সক‌লের বা‌ড়ি আ‌ঙ্গিনা বা পুকরে পা‌ড়ে ২/১ টি ক‌রে গাছ লাগা‌নো উ‌চিৎ ক‌লে ম‌নে ক‌রেন তি‌নি।

মাটিরাঙ্গা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মিল্টন ত্রিপুরা জানান, “প্লাস্টিক সাধারণত একবার ব্যবহারের জন্য তৈরি। বারবার ব্যবহার করলে বা তাপ পেলে বিসফেনল বা মাইক্রোপ্লাস্টিক বের হয়ে রসে মিশতে পারে। এতে পেটের সমস্যা থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।”

তাঁর মতে, খেজুর রস এমনিতেই খুব স্পর্শকাতর। সময়মতো না রাখলে ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয় দ্রুত। তাই পাত্রের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তবে, এই পরিবর্তন শুধু স্বাদ, স্বাস্থ্যের বিষয়কেই প্রভাবিত করছে না; এর আঘাত লাগছে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও।

মা‌টিরাঙ্গা উপ‌জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. সে‌লিম রানা বলেন, “যতদূর সম্ভব ঐতিহ্যবাহী মাটির কলসি কিংবা হাঁড়িতেই খেজুর রস রাখা উচিত। এটা শুধু স্বাস্থ্যসম্মতই নয়, রসের আসল মান-স্বাদ-ঘ্রাণও অটুট রাখে।

খেজুর রসের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় গাছ থেকে নামার প্রথম ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে। এরপর প্রাকৃতিক ফার্মেন্টেশন শুরু হয়। মাটির পাত্রে এই প্রক্রিয়া খুব ধীরে ঘটে, তাই মিষ্টতা ও স্বাভাবিক ঘ্রাণ দীর্ঘক্ষণ থাকে। কিন্তু প্লাস্টিক বোতলে অক্সিজেন বেশি থাকায় ফার্মেন্টেশন দ্রুত হয় মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অ্যালকোহল বেড়ে গিয়ে স্বাদ পুরোপুরি বদলে যায়।

স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও আমাদের শীতের এই ঐতিহ্যবাহী পানীয়ের মান বজায় রাখতে নিরাপদ ও উপযুক্ত পাত্র ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তাদের মত একই দিকে সুবিধার জন্য প্লাস্টিক ব্যবহার ঠিক আছে, কিন্তু স্বাদ, নিরাপত্তা ও ঐতিহ্যের প্রশ্নে মাটির হাঁড়ির বিকল্প এখনও তৈরি হয়নি।

শীতের সকালের সেই টুপটাপ শব্দ, মাটির হাঁড়ির ঠাণ্ডা রস আর পিঠাঘ্রাণ—সব মিলিয়ে যে ছবি, তা শুধু খাবারের নয়; গ্রামীণ জীবনের এক অংশ। কিন্তু প্রযু‌ক্তির উদ্ভাবনে প্লাস্টিকের সহজলভ্যতা ঐতিহ্যকে সরিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

খেজুর রসের স্বাদ ও নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি গ্রামের শিল্প–অর্থনীতি বাঁচাতে চাইলে হয়তো আবারও ফিরে তাকাতে হবে সেই পুরোনো মাটির হাঁড়ির দিকে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মাটিরাঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন