অন্তবর্তী সরকারের অর্থনীতি : বাড়ছে রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ


বেড়েই চলছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ। যা অন্তবর্তী সরকারের অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ বর্তমানে ৩১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। ৩০ জুন রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স রিজার্ভ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বার্ষিক ভিত্তিতে ৭ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা জুনের ২৮ দিনে ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। গত বছরের একই সময়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক আরো জানায় যে, চলতি অর্থবছরে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ২৮ জুন পর্যন্ত সময়ে প্রবাসীরা ৩০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৩ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর উপদেষ্টা পরিষদে নিয়োগ দেয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দীন আহমেদকে। আর অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিযুক্ত করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরকে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশেষ করে খাদের কিনারা থেকে দেশের ব্যাংকিং খাতকে টেনে তুলে সার্বিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বারোপ করে অন্তবর্তী সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয় বৈধ চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য। ড. ইউনূসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোয় যে বিশেষ অবদান রেখে চলছেন তাতে দ্রুতই ঠেকানো সম্ভব হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন। সরকারের নানামুখী উদ্যোগে অল্প সময়ের ব্যবধানেই বাড়তে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ।
তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন যে বৈশ্বিক অস্থিরতা ও দেশীয় সংকটের চাপ এখনো পুরোপুরি কেটে যায়নি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বৈশ্বিক অস্থিরতা ও দেশীয় সংকটের চাপ কাটিয়ে এখনো উঠতে পারেনি অর্থনীতি। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
তবে অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান স্বীকার করেন যে, প্রবাসী আয় রিজার্ভে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। তবে রাজস্ব ঘাটতি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক ঋণ প্রত্যাশিত হারে আসছে না, অথচ সুদ পরিশোধের ব্যয় বেড়েছে। এতে নিয়মিত সরকারি কার্যক্রম ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হবার আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। ব্যাংক খাতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনে অন্তবর্তী সরকার সফল হতে পারলেও তারল্যসংকট ও বিনিয়োগ অনিশ্চয়তা কাটেনি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
কেবল রাজস্ব আয়ে ঘাটতির দুশ্চিন্তাই নয়, বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ায় উৎপাদন খাতেও স্থবিরতা চলছে। এ সংকট কাটিয়ে তোলা সম্ভব না হলে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পার হবে সরকারকে।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার ভঙ্গুর অর্থনীতির দায়িত্ব নিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও এখনো কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা আসেনি। বরং বহুমাত্রিক সংকট, অবকাঠামো ঘাটতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও নীতিনির্ধারণের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে। তবে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিলে এই সরকারের পক্ষেই সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
সমস্যাগুলো থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি? জানতে চাওয়া হয় অর্থনীতিবিদদের কাছে। তারা বলছেন, দেশের যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে সেটিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দিতে হবে। ক্রেতা-ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর জন্য বাজেট ও উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে অন্তত মধ্যমেয়াদে স্থিতিশীলতা আনতে হবে। এতে অর্থনীতিও গতি পাবে বলে মনে করছেন তারা।