আজ কুমিল্লাটিলা, শুকনাছড়ি, দেওয়ান বাজার, সিংহপাড়া ও তাইন্দং নৃশংস গণহত্যা
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্বে অথাৎ ১৯৭৯ সাল থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত ছিল পার্বত্য এলাকা এক ভয়ঙ্কর জনপদ। যদিও ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম.এন লারমা)-এর নেতৃত্বে তথাকথিত শান্তিবাহিনী গঠন করা হয়। কিন্তু জেএসএস দাবি করছে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারী শান্তিবাহিনী গঠন হয়! এরপর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত। ১৯৭৯ সালে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী পুনর্বাসন করার পর থেকেই শুরু হয় বাঙ্গালীদের পাহাড় থেকে বিতাড়নের গভীর ষড়যন্ত্র। যা গণহত্যার রূপ নেয়। এখানে তখন বাঙ্গালী নিধনের অংশ হিসেবে গণহত্যা চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আধিপত্য ও এ অঞ্চলে বাঙ্গালীদের অস্তিত্ব মুছে ফেলা।
hbf এর তথ্য অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ছোটবড় ৪৬টি গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই গণহত্যা গুলোর নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতার সে নারকীয় দৃশ্য মনে পড়লে এখনো ঘুমাতে গেলেই দুঃস্বপ্নে ভেঙে যায় ঘুম। তখনকালীন গণহত্যার ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষকরা বা বেছে ফেরা বাঙ্গালী প্রবীণরা এখন গণহত্যার বর্ণনা দিতে গেলে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। ইতিহাসের একটি নিষ্ঠুরতম গণহত্যা ছিল ১৯৮৬ সালের ১৮ মে দিবাগত রাতটি। পার্বত্য বাঙ্গালীরা এই গণহত্যাটি ভুলে গেছেন! বাঙ্গালী সংগঠন এই গণহত্যার সঠিক তথ্য ইতিহাস জানেনা।
বাঙ্গালী নেতৃত্বের দূর্বলতা, লেখক ও বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী না থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালী গণহত্যার সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়নি। hbf নিজ উদ্দেশ্যে কিছু গণহত্যার ইতিহাস ও তথ্য সংগ্রহ করেছে। তবে এই ইতিহাস ও তথ্য একদম সীমিত এবং এর নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই। ঘটনা সত্য স্বাক্ষী দূর্বল! এসব গণহত্যা গুলো নিয়ে স্থানীয় বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতা ও প্রবীণলোকেরা কথা বলতে চাননা। কেননা জাতীয় রাজনৈতিক দলের উপজাতি নেতারা অখুশি হবেন বলে সবাই নিশ্চুপ থাকেন। ধারণা করা হয় বয়োবৃদ্ধ লোকেরা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলে বর্তমান প্রজন্ম গণহত্যাকে স্মরণ করাতো দূরের কথা, তৎকালীন বাঙ্গালীদের আত্মত্যাগ পর্যন্ত মুছে ফেলবে। যেমনটি এখনই প্রকাশ পাচ্ছে। এই গণহত্যা গুলোর ৩৫/৪০ বছরে মধ্যেই সব ইতিহাস মুছে গেছে। গণহত্যাগুলো নিয়ে কেউ স্মরণ সভাও করছে না। ৪৬টি গণহত্যায় নিহত হওয়া বাঙ্গালীদের নাম-পরিচয় ও তালিকাও নেই রাষ্ট্রের কাছে!
স্থানীয়রা জানায়, ১৯৮৬ সালের ১৮ মে দিবাগত রাত আনুমানিক ৩টায় গভীর ঘুমে আচ্ছন বাঙ্গালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তথাকথিত শান্তিবাহিনী। পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ির ইউনিয়নের কুমিল্লাটিলা, শুকনাছড়ি, দেওয়ান বাজার, সিংহপাড়া ও তাইন্দং গণহত্যা ২০টি গ্রামে সংঘটিত করে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা।
৩৮ হাজার বাঙ্গালীর হত্যাকারী খুনি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এর সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা এই নৃশংসতা চালিয়েছে।
জানা যায়, প্রায় ৩৬৫ জনের অধিক নারী, শিশু, আবাল বৃদ্ধ বনিতা ও নিরস্ত্র নিরীহ বাঙ্গালীকে নৃশংস ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। বাঙ্গালী নারীদের গণধর্ষণ পূর্বক হত্যা ও আহত করা হয়েছে। আরও প্রায় ২৮২ জনের অধিক, অপহরণ ও গুম করা হয়েছে।
তাছাড়াও কুমিল্লাটিলা, শুকনাছড়ি, দেওয়ান বাজার, তাইন্দং এর সংলগ্ন বিডিআর ক্যাম্পে আক্রমণ করে শান্তিবাহিনীর আনুমানিক ৬৫ জনের একটি সশস্ত্র টিম।
খুনি সন্তু লারমার নির্দেশে জেএসএস সশস্ত্র কমান্ডার বিভাস চাকমা এই গণহত্যা পরিচালনা করে।
গণহত্যায় নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে শুধু সীমাবদ্ধ ছিল না শান্তিবাহিনীর জানোয়াররা, তারা বাঙ্গালীদের ধনসম্পদ লুটপাট করার একপর্যায়ে গৃহপালিত গবাদিপশু ও ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বেঁচে যাওয়া মো. জামশেদ জানান, ১৮ মে গণহত্যার দিন কয়েক আগে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা ২০/২৫ জনের একটি টিম গ্রামে এসে সবাইকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে। এবং জীবনের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী ভালো ভালো খাবার খেতে বলেন। এধরণের একটি হাতের লেখা চিঠি শুকনাছড়ি গ্রামে দিয়ে যান। এরপর থেকে আমরা আতঙ্কিত হয়ে যায়। ঘটনাটি তৎকালীন বিডিআর ক্যাম্পকে অবগত করি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করে নির্দেশন দেন, ভিডিপি সদস্যদের সমন্বয়ে কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাসহ রাত জেগে ডিউটি করার। আমরা সে মোতাবেক ৫/৬ দিন পাহারা বসায়। পরবর্তীতে তারা আসবেনা ভেবে আমরা পাহারা বন্ধ করে দিই। পাহারা বন্ধ করার ২ দিন পরেই গভীর ঘুমে আচ্ছন বাঙ্গালী জনপদের উপর অস্ত্র, তীর-ধনুক, দা-চুরি ও রামদা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন শান্তিবাহিনীর হায়েনা সন্ত্রাসীরা। সেদিন ১৮ মে, ঘন অন্ধকার রাত্রেই গুলির শব্দ আর নারী-পুরুষ এ শিশু-কিশোরদের কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। একটি টর্চলাইট হাতে নিয়ে পাহাড়ের উপর ঘর থেকে বেরিয়ে একটু নিচে নেমেই দেখি গ্রামের রেবেকা খাতুন নামের এক ২৮/৩০ বয়সের গৃহবধূকে শান্তিবাহিনীর দুইজন হায়েনা জোরপূর্বক হাত চেপে ধরে রেখেছে আর একজন ধর্ষণ করতেছে! এইরকম আরো কয়েকটা দৃশ্য চোখে পড়লো। অন্ধকার রাত আর দূরত্ব বেশি হওয়াতে তাদের কাউকে চিনতে পারিনি স্পষ্টভাবে।
তিনি জানান, শান্তিবাহিনীর বাকী সদস্যরা কেউ গুলি করে, কেউ দা-চুরি ও রামদা দিয়ে নারী, শিশু, আবাল বৃদ্ধ বনিতাকে হত্যার মিশন চালিয়ে যাচ্ছে। গুলির শব্দ আর কান্না শব্দ যেনো এক ভয়ংকরুপ ধারণ করেছে জনপদে। আশপাশ তাকিয়ে দেখলাম কারো গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ পড়ে আছে রক্তভেজা আবার কারো কারোই শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। কেউ অন্ধকার রাত্রে দিশেহারা হয়ে পালানোর চেষ্টা করছে। মনে হলো যেনো পুরো গ্রাম ঘিরে রেখেছে শান্তিবাহিনীর হায়েনারা। গ্রামের ঘরগুলো বেছে বেছে প্রবেশ করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। মেধাবী আর সামর্থ্যবান বাঙ্গালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বেশি। হায়েনারা সুন্দরী সুদর্শন নারী আর কিশোরী মেয়েদেরকে দিয়েই যৌন খায়েশ মিটানো শেষেই কয়েক সেকেন্ড ব্যবধানে গুলি করে বুক ঝাঁঝরা ঝাঁঝরা করে পৃথিবী থেকে বিদায় করে অনেক নারী ও কিশোরীকে। এই নৃশংস, লোমহর্ষক ও বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতার নারকীয় দৃশ্য দেখে আমি আর নিজেকে সামাল দিতে পারিনি৷ জোর চিৎকার দিয়ে গ্রামবাসীদের যার ঘরে যা কিছু আছে তা নিয়ে উপজাতি নরপশুদের পাকড়াও করতে বলি৷ আমার ডাকে হায়েনার ভয়ে কেউ বের হয়ে আসেনি৷ হায়েনারা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মত কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়লেও আমাকে ভেদ করতে পারেনি। আমি দ্রুত সরে গেলাম। পাহাড়ের উঁচু স্থানে আমার ঘর তাই তারা আর এইদিকে এগিয়ে আসেনি। রাত্র শেষ হলে গ্রামবাসীদের থেকে শুনি সে রাত্রে প্রায় ২০টি গ্রামে তারা নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল। কেউ তাদেরকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। যে বিডিআর তাদেরকে প্রতিরোধ করবে সে বিডিআর ক্যাম্প শান্তিবাহিনী আক্রমণ করেছে।
এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন, প্রত্যক্ষদর্শী ও সেদিন বেঁচে যাওয়া মো. জামশেদ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ও বৃহৎ গণহত্যা সংঘটিত করে শান্তিবাহিনী নামক হায়েনারা। এসব গণহত্যার ঘটনার দিন তারিখ, সময় ও তথ্য প্রমাণসহ সঠিক ইতিহাস দামাচাপা পড়ে আছে। কেউ জেগে ঘুমালে তার ঘুম ভাঙানো কঠিন। বাঙ্গালীরা এখন জেগে জেগেই ঘুমাচ্ছে!
লেখক: হান্নান সরকার, লেখক, ব্লগার ও মানবাধিকার কর্মী।
সূত্র: হিল চ্যাপ্টার