চাকমা জাতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের কয়েকটি অধ্যায়
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতবাদ অনুসারে চাকমাগণ বর্তমান নেপালের প্রাচীন শাক্য বংশ হতে উদ্ভূত। শাক্য বংশ নেপালের লুম্বিনী প্রদেশের কপিলাবস্তু নগরী হতে আগত এবং চাকমাগণ ঐতিহ্যগতভাবে নেপালের লুম্বিনী প্রদেশে প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্মের সাথে নিজেদেরকে চিহ্নিত করেন। চাকমা জাতির গোড়াপত্তন প্রাচীন নগরী চম্পকনগর হতে বলে ধরা হয়। ইতিহাসে এ পর্যন্ত ৪টি স্থানে চম্পকনগরের অস্তিত্ব ধারণা করা হয় এবং চম্পকনগরের প্রকৃত অবস্থান নির্ণয় তর্কসাপেক্ষ। বিখ্যাত চাকমা ব্যক্তিত্ব কামিনী মোহন দেওয়ান এর ভাই প্রখ্যাত চাকমা ঐতিহাসিক বিরাজ মোহন দেওয়ান তাঁর ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের ৫৯ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “এক্ষেত্রে হিমালয়ের পাদদেশস্থ ভৌগোলিক অবস্থান চম্পকনগরই জাতির আদি উৎসরূপে গ্রহণযোগ্য।” বর্তমান দিনের চাকমা জনগোষ্ঠী এক সময় হালের মায়ানমার এর আরকানে রাজত্ব স্থাপন করে বসবাস করেছে এবং শাসন করেছে। অনেক নৃতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, চাকমারা ইন্দো-তিব্বতীয় বা মন-খেমার মানব গোষ্ঠীর বংশধর। তবে তাদেরকে দেখলে শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও গড়নের ভিত্তিতে প্রথম দৃষ্টিতে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র হতে জানা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে (১৬১২ সালে) আরাকানে পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসে চাকমারা চট্টগ্রামের “আলিকিয়াংদং” (বর্তমান আলিকদম) এ রাজধানী স্থাপন করে। তবে চাকমা ঐতিহাসিক বিরাজ মোহন দেওয়ান তাঁর বইয়ে আরাকান হতে চাকমাদের চট্টগ্রামে আগমনের সময়কাল ১৪১৮ খ্রীস্টাব্দ বলে দাবি করেছেন। তিনি আরাকান হতে চাকমাদের বিতাড়িত হয়ে আসার করুণ কাহিনী বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন তাঁর বইয়ে। এ প্রসঙ্গে বর্ণনায় তিনি চট্টগ্রামের তৎকালীন মুসলিম সুবেদার কর্তৃক ১২টি গ্রামে চাকমাদের বসতি স্থাপনের অনুমতি দেওয়ায় তাঁর প্রতি চাকমা জাতির পক্ষ হতে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।
বিতাড়িত হয়ে চট্টগ্রামে আসার বর্ণনা সমাপ্ত করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “অতঃপর তাঁহারা দূর্গম গিরি বনানী পথে বহু কষ্টে আরাকান পরিত্যাগের পর এই চট্টগ্রামে উপস্থিত হন। এবং ধীরে ধীরে উপনিবেশ স্থাপনের মনোযোগ প্রদান করেন। পাঁচ শতাব্দীর পূর্বে ১৪১৮ খৃষ্টাব্দের এই করুণ কাহিনী এখনও ইতিহাসের পৃষ্ঠা বহন করিয়া আসিতেছে (চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, পৃষ্ঠা ৯৩-৯৪)।” বিরাজ মোহন দেওয়ান এর বর্ণনা মোতাবেক চাকমা রাজা মানেকগিরি বা মারেক্যাস মগদের বহু অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আরাকান হতে দেশান্তরী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং পালিয়ে আসার সময় পথিমধ্যে তাঁর এক পুত্র যুদ্ধে নিহত হন। পরিস্থিতির নিষ্ঠুরতার কারণে পুরো চাকমা জনগোষ্ঠী আরাকান হতে পালিয়ে আসতে পারেনি এবং কিছু অংশ পথিমধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ও অনেকে আরাকানে রয়ে যেতে বাধ্য হন। চাকমা জাতি প্রসঙ্গে অনেকে আবার পর্তুগিজ পর্যটক জাও ডি বারোস এর ম্যাপের কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। বিখ্যাত পর্যটকদের মানচিত্র ইতিহাসের সহায়ক উপাদান। একজন দর্শক/শ্রোতা হিসেবে পর্যটকরা প্রায়ই ভুল বুঝেন এবং স্থানীয় শব্দ বা নামের বানান ভুল করেন। যদি দর্শনার্থীর দাবি ঐতিহাসিক প্রমাণ এবং বিশিষ্ট ইতিহাসবিদদের দ্বারা সমর্থিত হয়, তবে তার মতামত বা রেকর্ড কিছুটা ঐতিহাসিক মূল্য লাভ করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, আহমদ শরীফের “চট্টগ্রামের ইতিহাস” নামক বইটিতে তিনি চট্টগ্রামের বিষয়ে বিখ্যাত পর্যটকদের অনেক মানচিত্রের যুক্তি তুলে ধরেছেন এবং ঐতিহাসিক প্রমাণের সাথে সেগুলোর পার্থক্য/বিচার করেছেন। চাকমা বিজগ (জাতির প্রাচীন মৌখিক ইতিহাস), বিভিন্ন চাকমা রাজা ও চাকমা ঐতিহাসিকদের লিখিত নথি/ইতিহাস, আরাকান বা বার্মার ইতিহাস, ত্রিপুরা রাজপরিবারের ইতিহাস জাও ডি বারোসের মানচিত্র নিয়ে অতিরঞ্জিত দাবি সমর্থন করে না।
প্রিয়জিত্ দেবসরকার তাঁর ‘দ্য লাস্ট রাজা অফ ওয়েস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে পর্তুগিজ জার্নাল কর্তৃক ১৬১৭ সালে প্রকাশিত ম্যাপে কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীরে Chacomas নামে জনবসতি চিহ্নিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। অতএব, এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় জাও ডি বারোস হয়তো ভুল করে মগ বা কুকিদের চাকোমাস নামে চিহ্নিত করেছেন, না হয় বর্তমানে কেউ কেউ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে জাও ডি বারোস এর ম্যাপের প্রকাশকাল নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন। কালের পরিক্রমায় চাকমারা ক্রমেই চট্টগ্রামের গহীন বনাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, এক সময়ের নদী তীরবর্তী জীবন যাপন এর পরিবর্তে পাহাড়ি জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ১৮৬৯ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে চাকমাদের রাজধানী পার্বত্য রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তরিত হয়। প্রিয়জিত্ দেবসরকারের বর্ণনার মূলভাব ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন এর ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত বই The Hill Tracts of Chittagong and The Dwellers Therein এর বর্ণনার মূলভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবুও বিরাজ মোহন দেওয়ান রচিত ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ এর বিশুদ্ধতা যেহেতু নিশ্চিত করেছেন বর্তমান সম্মানিত চাকমা সার্কেল চিফ (রাজা) দেবাশীষ রায়, তাই আমরা সেটাকে তাঁদের কর্তৃক স্বীকৃত সবচেয়ে বেশি গবেষণালব্ধ ইতিহাস হিসেবে আলোচনার ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে বিরাজ মোহন দেওয়ান রচিত বইটি আসলেই ব্যাপক নৃতাত্ত্বিক গবেষণা এবং গভীর পারিবারিক শিক্ষার ফসল। সে অনুযায়ী বিবেচনা করলেও চাকমা জাতির গোড়াপত্তনকারী রাজাগণের মধ্যে প্রথম দিকের প্রায় দুই তৃতীয়াংশের কারোরই বর্তমান বাংলাদেশের মাটিতে পায়ের চিহ্ন রাখার কোনো নজির নেই। প্রিয়জিত্ দেবসরকারের বর্ণনা মোতাবেক রাজা ত্রিদিব রায় ছিলেন ৫০তম চাকমা রাজা, অর্থাৎ বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় হলেন ৫১তম চাকমা রাজা।
কাপ্তাই হ্রদ
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০৬ সালে প্রথম কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। তবে সমীক্ষায় লাভজনক হবে না প্রমাণিত হওয়ায় পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। এরপর তৎকালীন সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি হাতে থাকার পরও ১৯২৩ সালে আবারও সমীক্ষা চালিয়ে পরিকল্পনা বাতিল করে ব্রিটিশরা। ভারতভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরপরই পাকিস্তানি প্রশাসন অতি দ্রুত কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য তড়িঘড়ি শুরু করে। প্রথমে পরিকল্পনা করা হয়েছিলো বরকল-এ বাঁধ দেওয়া হবে। তবে সীমান্তের অতি নিকটবর্তী এলাকায় বাঁধ দিলে ভারতীয় ভূমি প্লাবিত হবে এবং নিরাপত্তা হুমকি বেশি হওয়ায় ঐ পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে বরকল থেকে প্রায় ২০ মাইল নিম্নে চিলারদক-এ বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করা হয় এবং অজ্ঞাত কারণে এ পরিকল্পনাও বাতিল করা হয়। এরপর ১৯৫১ সালে কাপ্তাই এর চিতমরম-এ বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সেচ বিভাগের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী খাজা আজিমুদ্দিন এর নেতৃত্বে বাঁধ নির্মাণের স্থান নির্বাচন করা হয় এবং সেই সাথে অলিখিতভাবে ঐ স্থানের উজানে বসবাসকারী সবার অজান্তেই তাদের উদ্বাস্তু জীবন নির্ধারণ করে দেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের “উথাহ ইন্টারন্যাশনাল” নামক প্রতিষ্ঠানকে বাঁধ নির্মাণের কাজ দেওয়া হয় এবং ১৯৫৭ সালে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বাঁধের ফলে সৃষ্ট জলাধারে প্রায় ৫৪০০০ একর প্রথম শ্রেণির কৃষি জমি ডুবে যায়।
১৯৬০ সালের মধ্যে বেঁচে থাকার সকল অবলম্বন হারিয়ে প্রায় ৪০,০০০ চাকমা জনগোষ্ঠী ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৯৬১ সালের মধ্যে পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে যায় রাঙ্গামাটিস্থ চাকমা রাজবাড়ী এবং ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কমিশনের প্রধান হিসেবে প্রাক্কলন করেন ৫০,০০০ লোকজন এবং ২০০ বর্গমাইল ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বাস্তবতা ছিলো প্রায় ১ লক্ষ লোকজন এবং ৪০০ বর্গকিলোমিটারের অধিক জমি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি না হয় বাদই দিলাম। ক্ষতিগ্রস্তদের ৯০ শতাংশের মতো ছিলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, যার সিংহভাগ হলো চাকমা এবং ১০ শতাংশের অধিক হলো বাঙ্গালি, যাদেরকে হালের সাম্প্রদায়িক পাহাড়ি নেতাগণ ‘পুরান বসতি বাঙালি’ বলে দলে টানার চেষ্টা করেন। সেই সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য বিশ্ব ব্যাংক ৫.৫ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা প্রদান করেছিলো। যার মধ্য হতে মাত্র ৪০ লক্ষ ডলার খরচ করে বাকি অর্থ রাজা ত্রিদিব রায় এর সাথে যোগসাজশে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আত্মসাৎ করেছিলো বলে অভিযোগ আছে। মুষ্টিমেয় যে কজন সরকারি কর্মকর্তা এই চরম অমানবিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদেরকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। অর্থাৎ কাপ্তাই বাঁধ বির্পযয়ে রাজা ত্রিদিব রায় বাস্তবে তাঁর জনগণ ও নিজ সম্প্রদায়ের জন্য কিছু করার পরিবর্তে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দোসর হয়েছিলেন।
অত্যন্ত একরোখা চাকমা জাতি তখনই ঐক্যবদ্ধভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ করার দ্বারপ্রান্তে ছিলো। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব, প্রশাসনিক সুবিধার অপ্রাপ্তি, নিজেদের রাজার জাতি বিরোধী কর্মকান্ড এবং ভারতের অনীহার কারণে তাঁরা এই অপমান ও অন্যায় সহ্য করে নিয়েছিলো সাময়িকভাবে। ভারত সম্ভবত চীনের সাথে আসন্ন সীমান্ত সংঘর্ষের কারণে (১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ) তাত্ক্ষণিকভাবে সশস্ত্র মদদ দেওয়া হতে বিরত থাকে। বিপরীতে প্রায় সকল শরণার্থীকে অরুণাচলে সাময়িকভাবে পুনর্বাসিত করে চীনের বিরুদ্ধে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী দল গঠনের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি প্রশিক্ষণ এলাকা/সেফ হাউজ তৈরিতে মনোযোগী হয়েছিলো বলে প্রতীয়মান! ভারতভাগের পর ভারতে স্বইচ্ছায় দেশান্তরী চাকমা নেতা স্নেহ কুমার চাকমা রাঙ্গামাটির চাকমা নেতাদের জাতীয় বেঈমান বলে বক্তৃতা দিয়ে ভারতে আগত শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। কাপ্তাই বাঁধই মূলতঃ চাকমাদের অন্তরে জ্বালিয়ে দেয় তুষের আগুন। যেটার জন্য স্পষ্টভাবে দায়ী তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত সরকার ও চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বাঙ্গালিরা আইন ও দেশের সরকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিক হিসেবে সরকারের সকল সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলো। আজ পর্যন্ত কাপ্তাই বাঁধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বাঙ্গালিরা সেই বিনিময়ে সহানুভূতি চেয়েছে বা সেটার জন্য দেশ ও জাতি বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে বলে কোনো নজির নেই। তাই গত ছয় দশকের বেশি সময় ধরে কোনো লেখক বা ঐতিহাসিক কাপ্তাই বাঁধের করুণ ইতিহাস লেখার সময় পার্বত্য বাঙ্গালিদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করেননি!
সরকার কাপ্তাই বাঁধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি আনুপাতিক হারে ভূমি পুনঃ বরাদ্দ দিয়েছিলো। এ প্রেক্ষিতে ভূমির স্বল্পতা হেতু রিজার্ভ ফরেস্ট রক্ষার জন্য হিল রেগুলেশনে সংশোধনী এনে একক ব্যক্তির নামে ভূমি বরাদ্দ প্রাপ্তির পরিমাণ সর্বোচ্চ দশ একর করেছিলো। এরপরও কেন সকল ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি পায়নি, কীভাবে কাপ্তাই বাঁধের ভূমি পুনঃ বরাদ্দ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা তখনই অনেক জটিল করে ফেলেছিলো সেটা নিয়ে লিখবো পৃথক আরেকটি নিবন্ধ। এই নিবন্ধের দ্বিতীয় পর্বে থাকবে প্রয়াত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এর বর্ণাঢ্য ও সমালোচিত জীবন বৃত্তান্তের সারসংক্ষেপ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের বেশ কয়েক বছর আগেই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান জনগোষ্ঠী চাকমাদের মধ্যে চরমভাবে প্রতারিত ও নির্যাতিত হওয়ার ন্যায্য ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়েছিলো। পাশাপাশি সামন্তবাদ নিয়ন্ত্রিত পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই বাঁধের ভূমি পুনঃ বরাদ্দ ব্যাপক জটিলতা নিয়ে আসে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৯ সালে কিছু সংখ্যক বাঙ্গালি ভূমিহীনদের পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি খাস ভূমিতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া মিলিয়ে ভূমি সমস্যা আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। যে সমস্যার গভীরতা জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া ব্যতিত কারো পক্ষে কখনো পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব নয়। সকলের ঐক্যমত তৈরির মাধ্যমে রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ করে একটি সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছানো তখনই সম্ভব হবে, যখন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থান হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার মূল কারণসমূহ চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।
তাছাড়া পুনর্বাসিত বাঙ্গালি পরিবারগুলোর অধিকাংশ সরকার কর্তৃক প্রতিশ্রুত ভূমি এখনো বুঝে পায়নি এবং শান্তিচুক্তি মোতাবেক বেশ কয়েক হাজার পাহাড়ি ভূমিহীনকে পুনর্বাসিত করতেও সরকার দায়বদ্ধ। কয়েক দশক আগেই দেশে ব্যক্তি মালিকানায় ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বন্ধ করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সমবায় সমিতি, কেয়াং/প্যাগোডা, গীর্জা, মনোঘর/অনাথালয়, বৃহৎ বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা রাবার বাগান স্থাপনের আড়ালে সরকারি খাসভূমি সুকৌশলে ব্যাপকভাবে আয়ত্তে নিয়ে ফেলেছে পাহাড়ি এলিট সমাজ। কথিত সহজ সরল সম্প্রদায়গুলোর কারো কারোর আয়ত্তে হাজার একর এর বেশি ভূমিও হয়তো আছে, আবার দাবি করা হচ্ছে হাজার হাজার পাহাড়ি নিতান্তই ভূমিহীন! এটি আসলেই ব্যাপক আইনগত অনুসন্ধানের দাবি রাখে। বাস্তবতা হলো এই পাহাড়ি এলিটগণ শত শত একর ভূমিতে নিজস্ব অযৌক্তিক ও বেআইনী কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনায় কল্পিত প্রথা ও গোত্রগত ঐতিহ্য কার্যকর করার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার সমাধান হতে দিচ্ছে না। ইদানিং তো পরিলক্ষিত হচ্ছে এই পাহাড়ি এলিটগণের সহায়তায় দেশের সমতল এলাকাসমূহের বহু জাতীয় শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিবাজ এবং লুটেরা ব্যক্তিরাও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশাল বিশাল ভূমি খন্ডে নিজস্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। আগেই বলেছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা ও সমাধান নিয়ে বিস্তারিত লিখবো কোনো একদিন পৃথক আরেকটি নিবন্ধে। যদিও বস্তুনিষ্ঠ বিচার বিশ্লেষণ এবং সঠিক তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি সহকারে সেটা করা হবে অত্যন্ত জটিল একটি কাজ।
লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম গবেষক
সূত্র:
১। দেওয়ান, বিরাজ মোহন ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’
২। Debsarkar, Priyajit ‘The Last Raja of West Pakistan’
৩। ‘Life Span of Storage Dams’ published in www.waterpowermagazine.com on March, 2010। (প্রবেশকালঃ ২৫ অক্টোবর ২০২৪)
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে:
পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়েও সেরা পাকিস্তানি- চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়