চাকমা রাজপরিবারের গোপন ইতিহাস
হরিশ্চন্দ্র থেকেই মূলত বর্তমান চাকমা রাজাদের ইতিহাস শুরু
♦সৈয়দ ইবনে রহমত♦
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসকে সুপরিকল্পিতভাবে বিকৃত করা হয়েছে। আর এ বিকৃতির মাধ্যমে আড়াল করা হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস। মোগল জমিদারদের চাকমা রাজা হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়ে কলঙ্ক লেপন করা হয়েছে তাদের ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসের উপরেও। ধারণা করা হয়, কলঙ্কময় অতীতকে আড়াল করে ক্ষমতার মসনদ চিরস্থায়ী করতেই ইতিহাস বিকৃতির সূচনা হয়েছিল। আর ইতিহাস বিকৃতির দলিল হিসেবে তৎকালীন প্রভাবশালীদের তত্ত্বাবধানে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল সতীশচন্দ্র ঘোষের ‘চাকমা জাতি’ শীর্ষক গ্রন্থটি। পরবর্তীতে যারাই পার্বত্যাঞ্চল কিংবা চাকমা জাতির ইতিহাস লিখেছেন তাদের প্রত্যেকেই কম বেশি এই লেখকের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, তারা সতীশচন্দ্র ঘোষের সমালোচনা করেও তার লেখা কল্পকাহিনীকে বিনাসংকোচে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ফল যা হবার তা-ই হয়েছে। ইতিহাসের নামে রচিত হয়েছে একের পর এক আজগুবি কাহিনী। কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না। এক্ষেত্রেও সেটা প্রমাণিত হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চাকমা জাতির ইতিহাস রচনার নামে ইতিপূর্বে যেসব আজগুবি কাহিনী রচিত হয়েছে সেসবের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন সত্য অনুসন্ধানী গবেষক জামাল উদ্দিন। দীর্ঘ গবেষণা এবং অনুসন্ধান শেষে তিনি রচনা করেছেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’। যা চাকমা জাতি, চাকমা রাজপরিবার গোপন ইতিহাস এবং পার্বত্যাঞ্চলের প্রচলিত ইতিহাসের ভিত্তিটাকেই নাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রাসঙ্গিক কথা
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক আতিকুর রহমানের লেখা পড়ে চাকমা জাতির ইতিহাস এবং সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বই সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে বিরাজ মোহন দেওয়ান বিরচিত ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত (১৯৬৯)’, সাবেক চাকমা রাজা ভুবন মোহন রায়ের ‘চাকমা রাজবংশের ইতিহাস (১৯১৯)’, মাধব চন্দ্র চাকমা কর্মীর ‘শ্রী শ্রী রাজনামা’, সতীশচন্দ্র ঘোষ প্রণীত ‘চাকমা জাতি (১৯০৯)’, সুগত চাকমার ‘বাংলাদেশের উপজাতি (বাংলা একাডেমী, ১৯৮৫)’, প্রফেসর পিয়ের বেসেইনে প্রণীত Tribesmen of Chittagong Hill Tracts (1957-58) এর অনুবাদগ্রন্থ ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি’ (বাংলা একাডেমী, ১৯৭৭), পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেন টিএইচ লুইন প্রণীত WILLD RACES OF SOUTH-ESTERN INDIA (1870) এর জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা কর্তৃক অনুদিত ‘বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আদিম জনগোষ্ঠী (উসাই রাঙ্গামাটি, ১৯৯৮)’, লে. কর্নেল টিএইচ লুইন প্রণীত A FLY ON THE WHEEL (1912)-এর জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা কর্তৃক অনুদিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ও লুসাই পাহাড় (উসাই রাঙ্গামাটি, ১৯৯৬), শীর্ষক বইসমূহ পড়ে ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি ক্রমেই বেড়েছে। কেননা পার্বত্যাঞ্চলের ইতিহাস বিষয়ক বইগুলো চাকমা রাজবংশের ইতিহাসকেন্দ্রিক রচিত হলেও একটির সাথে আরেকটির বর্ণনার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। চাকমা রাজাদের নাম এবং তাদের ধারাবাহিকতার মধ্যেও গড়মিল স্পষ্ট। এক পর্যায়ে হাতে আসে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অশোক কুমার দেওয়ান রচিত ‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার (১৯৯১)’, বইটি। এই বইটি পড়ে নিশ্চিৎ হই যে, পার্বত্যাঞ্চল বিশেষ করে চাকমা রাজবংশকেন্দ্রিক চাকমা জাতির ইতিহাসের বেশিরভাগটাই ভিত্তিহীন এবং কল্পনা প্রসূত।
অশোক কুমার দেওয়ানের মূল্যায়ন
চাকমা রাজা ভুবন মোহন রায়ের তত্ত্বাবধানে লেখা এবং প্রকাশিত সতীশ চন্দ্র ঘোষের ‘চাকমা জাতি’ শীর্ষক বইটি সম্পর্কে অশোক কুমার দেওয়ান লিখেছেন, ‘সতীশচন্দ্র ঘোষ তাঁর উপরোক্ত পুস্তকে চাকমা জাতি সম্পর্কীত নানা বিষয় অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বর্ণনা করা সত্ত্বেও তাঁর বইটি স্থানে স্থানে নিতান্ত ভ্রমাত্মক বিবরণে পূর্ণ। এ কারণে তিনি তৎকালীন চাকমা সমাজের অনেকেরই বিরাগভাজন হন। তাঁর পুস্তকে সন্নিবিষ্ট অনেক ভ্রমদুষ্ট তথ্য পরবর্তী ইতিবৃত্তকার এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক পন্ডিত ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করেছে। কারণ চাকমাগণের সংগে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সুযোগ যাদের নেই চাকমা জাতি সম্বন্ধে জানার জন্য এ পুস্তকটিই ছিল তাদের একমাত্র অবলম্বন। স্বভাতই এই পুস্তকে পরিবেশিত ভুল তথ্যাদি অন্যদেরকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করে। সতীশ বাবু নিজেও লুইন সাহেবের পূর্ব প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে অনেক কিছুই সত্য মিথ্যা যাচাই না করে গ্রহণ করেন এবং নির্বিবাদে তাঁর বইয়ে চালিয়ে দেন। পরে আবার কেউ কেউ সতীশ বাবুর বই থেকে এগুলি ধার করেন। এভাবে অন্যদের মনে চাকমা জাতি সম্বদ্ধে অনেক মারাত্মক ভুল ধারণার জন্ম দিয়েছে।’ ১৯১৯ সালে প্রকাশিত চাকমা রাজা ভুবন মোহন রায়ের লেখা ‘চাকমা রাজবংশের ইতিহাস’ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘পুস্তিকাটি ক্ষুদ্র; বিবরণাদি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত; সেটিকে বংশ তালিকা ছাড়া ঠিক ইতিহাস পুস্তক বলা যায় না।’ একইভাবে মাধবচন্দ্র চাকমা কর্মী, বিরাজ মোহন দেওয়ান সহ পরবর্তী লেখকদের ভুল-ত্রুটি সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পূর্ববর্তী লেখকদের লেখা ইতিহাস এবং তাদের উল্লেখিত সূত্রগুলির দুর্বলতা এবং প্রামাণ্য হিসেবে সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কেও গবেষণা করেছেন। নানা পর্যালোচনা শেষে পার্বত্যাঞ্চল এবং চাকমা জাতির ভিত্তিহীন ও কল্পনা প্রসূত ইতিহাসের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে অশোক কুমার দেওয়ান লিখেছেন, ‘রূঢ় হলেও মন্তব্য করতে হয় যে, পরবর্তী লেখকগণের অধিকাংশ বিবরণ মূলত সতীশচন্দ্র ঘোষেরই চর্বিত চর্বন।’ তিনি অন্যত্র লিখেছেন, ‘ইতিহাসের পথের রেখা খুঁজে নিতে হবে। সে পথের রেখা যতই ক্ষীণ হউক, যতই অস্পষ্ট হউক, যতই দুর্লক্ষ্য হউক আশা করি প্রয়োজনীয় শ্রম এবং যথার্থ নিষ্ঠা সহকারে অনুসন্ধান চালানো হলে সঠিক পথের রেখা একদিন খুঁজে পাওয়া যাবেই। অলীক স্বপ্ন দিয়ে গড়া মায়ার ভুবনে কৃত্রিম স্ফটিকে নির্মিত মনোহর ভবনে বাস করার চাইতে বাস্তব পৃথিবীর কঠিন মাটিতে পত্র পল্লবে ছাওয়া পর্ণকুটিরে বাস করা অনেক শ্রেয়।’ অশোক কুমার দেওয়ান ইতিহাস বিষয়ে তার সুগভীর পান্ডিত্য এবং যুক্তির কষ্টি পাথরে যাচাই করে চাকমা জাতির প্রচলিত ইতিহাসের ভুল-ভ্রান্তি এবং অলীক গল্পসমূহ অনেকাংশে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের সঠিক ধারা নির্ণয়ের আগেই তার জীবনাবসান হলে সত্য অনুসন্ধানের একটি সম্ভাবনারও মৃত্যু ঘটে।
দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামের কোন অঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল না। আজকের চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমগ্র এলাকা তখন একই সাথে ছিল। যদিও বিভিন্ন সময় এর কিছু অংশ কখনো কখনো ত্রিপুরা রাজার অধীন, কিছু অংশ আরাকান রাজার অধীন, কিছু অংশ মোগলদের শাসনাধীন ছিল। যাইহোক, এই অঞ্চলে জনবসতি এবং সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল তৎকালীন দেয়াঙ বন্দর নামের সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে। যা আজকে আমাদের কাছে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর নামেই পরিচিত। আর এ বন্দরের গুরুত্বের কারণে এক সময় এ অঞ্চল দেয়াঙ পরগণা হিসেবেই খ্যাত ছিল। ‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার’ বইটি পড়ার কিছুদিন পরেই হাতে আসে ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিন রচিত ‘দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস (আদিকাল)’। এই বইটিতে লেখক এমন কিছু মোগল জমিদারের নাম এবং তাদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন, যাদেরকে ইতিপূর্বে অনেক লেখক চাকমা রাজা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ বিষয়ে লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি চাকমা রাজা হিসেবে পরিচিত ফতে খাঁ, শেরমস্ত খাঁ, শুকদেব, শের দৌলত, জান বক্স খাঁ, টববর খাঁ, জব্বর খাঁ, ধরম বক্স খাঁসহ বেশকিছু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সহকারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মোগল জমিদার বলে আখ্যায়িত করেন। একই সাথে তিনি ইতিহাসের এসব অসঙ্গতি লক্ষ্য করে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চাকমা জাতির ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই আগ্রহ এক সময় লেখককে নিয়ে যায় শেকড়ের সন্ধানে। চাকমা জাতির শেকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে এই গবেষক তার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে আরাকানের আকিয়াব, কক্সবাজার, রামু, আলীকদম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, আসামের মিজোরাম এবং রাঙ্গুনিয়ার পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সংগ্রহ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইতিপূর্বে প্রকাশিত পুঁথি, গবেষণাপত্র, বই-পুস্তকসহ অনেক তথ্য-উপাত্ত। রাঙ্গুনিয়ার মোগলবাড়ি থেকে সংগ্রহ করেছেন রাণী কালিন্দী থেকে বৃটিশ শাসনের সমাপ্তিকাল পর্যন্ত জমিদারী নিয়ে দুই পক্ষের মামলা-মোকদ্দমার অনেক ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিলপত্র। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, গবেষকসহ অসংখ্য মানুষের সাথে। প্রায় এক দশক ধরে অনুসন্ধান এবং গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে গবেষক জামাল উদ্দিন রচনা করেছেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’।
চমকপ্রদ কিছু তথ্য
ইতিপূর্বে যারা চাকমা জাতির ইতিহাস লিখেছেন তাদের কেউই চাকমা রাজবংশের ইতিহাসকে হাজার বছরের নীচে নামাতে চাননি। তাছাড়া তাদের বর্ণনায় মতান্তরে বর্তমান চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় পর্যন্ত ৭১ জনের নামের তালিকা রয়েছে। অথচ গবেষক জামাল উদ্দিন ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিলসহকারে প্রমাণ করেছেন, মোগল জমিদার ধরম বক্স খাঁর মৃত্যুর পর তার প্রথম স্ত্রী কালিন্দী রাণী (যিনি চাকমা সম্প্রদায় থেকে জমিদার পরিবারের বধূ হয়ে এসেছিলেন) বৃটিশদের আনুকূল্যে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা লাভের পূর্বে কোন চাকমা ব্যক্তিত্বের পক্ষে এ অঞ্চলে রাজত্ব বিস্তার দূরের কথা জমিদার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন না। আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ১৬৭৯ থেকে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চাকমাদের কাছে রাজা হিসেবে পরিচিত ফতে খাঁ থেকে ধরম বক্স খাঁ পর্যন্ত ১৪ জন জমিদারের প্রত্যেকেই ছিলেন মুসলিম এবং মোগল জমিদার। আর চাকমা রাজবংশের তালিকায় ফতে খাঁ’র পূর্বে চাকমা রাজা হিসেবে স্থান পাওয়া কথিত ৫৭ জন রাজার অস্তিত্ত্ব এবং পরবর্তীদের সাথে তাদের সম্পর্কের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি তিনি খুঁজে পান নি। তবে গবেষক জামাল উদ্দিন সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন ধরম বক্স খাঁ’র সম্পর্কে। ধরম বক্স খাঁ জন্মেছিলেন তার পিতা জব্বার খাঁ’র মৃত্যুর ১৮ মাস পর। এ কারণে তৎকালীন জমিদার পরিবারে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে এবং একই কারণে জমিদারীতে তার উত্তরাধিকার মেনে নিতে পারেনি পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা। কিন্তু একপক্ষ চালাকি করে ধরম বক্স খাঁ জন্ম নেয়ার পরপরই তাকে পরবর্তী জমিদার মনোনিত করে। এই নিয়ে জমিদারীর প্রকৃত হকদার হোসেন খাঁ’র সাথে মতবিরোধ শুরু হয়। এর জের ধরে দুই পক্ষের মধ্যে একাধিকবার সম্মুখ যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। বিভক্ত জমিদার পরিবারে এই যুদ্ধের ফল ছিল পরবর্তী একশ’ বছরের বেশি সময় ধরে আদালতে মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা। ইতিপূর্বে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তাদের কেউ কেউ ধরম বক্স খাঁ’র বিষয়ে আলোকপাত করলেও জমিদার পরিবারের ধারাবাহিক বিরোধের বিষয়টি উল্লেখ পর্যন্ত করেন নি। এমনকি মামলা চলাকালীন সময়ে লেখা ইতিহাসের কোথাও এর ইঙ্গিত পর্যন্ত দেন নি সংশ্লিষ্ট লেখকগণ। গবেষক জামাল উদ্দিন সেই হোসেন খাঁ’র বংশধরদের কাছ থেকে সে সময়ে চলা মামলার দলিলপত্র উদ্ধার করেছেন। আর এসব দলিলপত্রই বদলে দিয়েছে ইতিহাসের গতিপথ।
নতুন এই গবেষণায় দেখা গেছে, মোগলদের সাথে চাকমাদের জমিদার-প্রজা সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক ছিল না। তাছাড়া শুধু চাকমারাই এসব জমিদারদের প্রজা ছিল না। বরং তাদের প্রজা হিসেবে ছিল তঞ্চ্যাঙ্গাসহ অন্যান্য কুকি সম্প্রদায়ের লোকেরাও। আর বর্তমান চাকমা রাজবংশের গোড়াপত্তন হয়েছিল কালিন্দী রাণীর মৃত্যুর পর, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ধরম বক্স খাঁ’র কন্যা মেনকা এবং গোপীনাথ দেওয়ান চাকমার সন্তান হরিশ্চন্দ্র রায়ের ক্ষমতা লাভের মধ্য দিয়ে। আর এই রাজ পরিবারের প্রজা হিসেবে পরিচিত অধিকাংশ চাকমাই আরাকান থেকে এ অঞ্চলে শরণার্থী হিসেবে এসেছিল ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে, বর্মী রাজা বোধপায়া কর্তৃক আরাকান দখলের কারণে সৃষ্ট প্রতিকূল পরিবেশের শিকার হয়ে। এছাড়াও এই বইয়ে স্থান পেয়েছে এ অঞ্চলে বসবাসরত অন্যান্য জনগোষ্ঠী এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার অনেক অজানা ইতিহাস।
গোপন করা ইতিহাসের উপাদান
১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীরজুমলা পিছু ধাওয়া করলে শাহ সুজা তার অনুগত ফতে খাঁ, গোলাম হোসেন খাঁ, শের জব্বার খাঁ, নুরুল্লা খাঁ, শের দৌলত খাঁসহ ১৮ জন সেনাপতি এবং তাদের অধীনে বিপুল সংখ্যক মোগলযোদ্ধাদের নিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে নাফ নদীর তীরে পৌঁছান। কিন্তু আরাকান রাজের শর্ত মোতাবেক সকল যোদ্ধাদের সেখানেই বিদায় জানিয়ে মাত্র ২০০ জন দেহরক্ষী নিয়ে নাফ নদী পারি দিয়ে আরাকানের রাজধানী ম্রোহং-এ উপস্থিত হন শাহ সুজা। কিন্তু আরাকান রাজের বিশ্বাসঘাতকতায় শাহ সুজা ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসেই আত্মীয় স্বজন সহ অত্যন্ত করুণভাবে নিহত হন। এই অবস্থায় নাফ নদীর এপারে থেকে যাওয়া মোগল সেনাপতিগণ তাদের বাহিনী নিয়ে আর কোথাও না গিয়ে অত্র অঞ্চলেই বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। সন্মুখে আরাকান বাহিনী এবং পেছনে মীর জুমলার বাহিনীর ভয় থাকায় মোগল সেনারা অপেক্ষাকৃত দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে তাদের প্রথম দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন। ইরানের শিয়া বংশোদ্ভূ’ত মোগলযোদ্ধারা ঐ এলাকার নামকরণ করেন হযরত আলীর নামানুসারে ‘আলীকদম’। আলীকদমে দুর্গ প্রতিষ্ঠা করে নারীবিহীন মোগলযোদ্ধারা সে সময় অত্র অঞ্চলে উদ্ভাস্তু হিসেবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উপজাতীয় রমণীদের সাথে সংসারজীবনে আবদ্ধ হতে থাকেন। একই সাথে তারা জুমিয়া মগ, চাকমাসহ অন্যান্যদের জুম চাষাবাদে নিয়োজিত করে আলীকদমে প্রতিষ্ঠা করেন জুমিয়া জমিদারী। জুমিয়ারা এসব মোগল জমিদারদের রাজা বলেই মান্য করত। তাদের সিলমোহরে ব্যবহৃত হিজরী সন হিসেবে আলীকদমে জমিদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন যথাক্রমে রাজা ফতে খাঁ, রানী সোনাবি, রাজা শের জব্বার খাঁ, রাজা নুরুল্লা খাঁ, রাজা চন্দন খাঁ এবং রাজা জালাল খাঁ। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন শাহ সুজার সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মাধ্যক্ষ বা সেনাপতি।
বিভিন্ন সময় উত্থান পতনের পর আলীকদম থেকে এই জমিদারী ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে সরে আসে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। আর এখানে প্রথম রাজত্ব করেন শেরমস্ত খাঁ (১৭৩৭-১৭৫৩ খ্রি.)। এরপর যথাক্রমে রাজা শুকদেব (১৭৫৩-১৭৫৮ খ্রি.), রাজা শের জব্বার খাঁ (১৭৫৮-১৭৬৫ খ্রি.), রাজা শের দৌলত খাঁ (১৭৬৫-১৭৮২ খ্রি.), রাজা জানবক্স খাঁ (১৭৮২-১৮০০ খ্রি.), রাজা তব্বার খাঁ (১৮০০-১৮০১ খ্রি.), রাজা জব্বর খাঁ (১৮০১-১৮১২ খ্রি.), রাজা ধরম বক্স খাঁ (১৮১২-১৮৩২ খ্রি.) এবং রাণী কালিন্দী (১৮৪৪-১৮৭৩ খ্রি.) রাজত্ব করেন।
রাঙ্গুনিয়ার এই রাজন্য বর্গের মধ্যে শেরমস্ত খাঁ থেকে রাজা জব্বর খাঁ পর্যন্ত সবাই ছিলেন মোগল সেনাপতি বা তাদের বংশধর এবং এরা সবাই ছিলেন মুসলমান শাসক। কিন্তু এই জমিদার পরিবারে বিপত্তি শুরু হয় ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে রাজা জব্বর খাঁ অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার পর থেকে। আর রাজা জব্বর খাঁর মৃত্যুর ১৮ মাস পর তার স্ত্রীর গর্ভে ধরম বক্স খাঁ’র জন্ম হলে জমিদার পরিবারের ভাগ্যাকাশে নেমে আসে কালো মেঘ। কেননা ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে তব্বার খাঁ’র মৃত্যুর সময় তার পুত্র হোসেন খাঁ (মীর্জা হোসেন) নাবালক থাকায় তারই (তব্বার খাঁ) সহোদর জব্বার খাঁ জমিদারী লাভ করেছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে জব্বর খাঁ অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করায় জমিদারীর প্রকৃত হকদার ছিলেন হোসেন খাঁ (মীর্জা হোসেন)। কিন্তু ধরম বক্স খাঁ’র জন্ম নেয়ার পর জমিদারীর উত্তরাধীকার নিয়ে চক্রান্ত শুরু করে একটি পক্ষ। ফলে একদিকে জৈনক ঢোলবাদক আর জব্বর খাঁ’র স্ত্রীকে জড়িয়ে নানা রটনা আর অন্য দিকে সদ্যভূমিষ্ঠ বিতর্কিত এই শিশুকে ঘিরেই জমিদারীর উত্তরাধীকার প্রতিষ্ঠার নীল নকশা জমিদার পরিবারকে দ্বিধাবিভক্ত করে দেয়।
ধরম বক্স খাঁ’র পক্ষালম্বনকারীরা তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়নে এই সময় বৃটিশদের সহায়তা কামনা করে। আর বৃটিশরাও বিশৃঙ্খলার সুযোগ পেয়ে প্রবেশ করে এই অভিজাত মোগল পরিবারে। মুসলিম এবং মোগলদের কোণঠাসা করতেই ইংরেজরা শিশু ধরম বক্স খাঁ’র পক্ষ নিয়ে হোসেন খাঁ’র পক্ষের উপর চড়াও হয়। দ্বিধাবিভক্ত জমিদার পরিবার একাধিকবার সন্মুখ যুদ্ধসহ মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বৃটিশদের পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় জমিদারীর প্রকৃত হকদার হোসেন খাঁ বঞ্চিত হয় এবং জমিদারী চলে যায় ধরম বক্স খাঁ’র হাতে। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র বিশ বছর বয়সে রাজা ধরম বক্স খাঁ অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করায় কোর্ট অব অডার্সের মাধ্যমে ইংরেজ সরকার মোগল বংশাজাত সুখলাল খাঁকে জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে। কিন্তু চাকমা সম্প্রদায় থেকে আসা ধরম বক্স খাঁ’র স্ত্রী কালিন্দী রাণী এটাকে মেনে না নিয়ে নিজেকে জমিদারীর দাবিদার বলে আদালতে মামলা করেন এবং দীর্ঘ ১২ বছর লড়াই করে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে তার অনুকূলে রায় পান। তারপর থেকে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনা করে মৃত্যু বরণ করেন তিনি। রাণী কালিন্দীর মৃত্যুর পর রাজা ধরম বক্স খাঁ’র কন্যা এবং তার স্বামী গোপীনাথ দেওয়ানের ঔরসজাত সন্তান হরিশ্চন্দ্র রাজা হন। আর এই হরিশ্চন্দ্র থেকেই মূলত বর্তমান চাকমা রাজাদের ইতিহাস শুরু।
রাজা হরিশ্চন্দ্র কালিন্দী রাণীর নির্দেশে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকারকে সহায়তা করার উপহার স্বরূপ রায়বাহাদুর খ্যাতাব লাভ করেছিলেন। এবং তিনিই রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ত্যাগ করে তার জমিদারীকে রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর করেন। রাঙ্গামাটিতে রাজত্ব করেছেন যথাক্রমে হরিশ্চন্দ্র রায় (১৮৭৩-১৮৮৫ খ্রি.), রাজা ভুবন মোহন রায় (১৮৯৭-১৯৩৩ খ্রি.), রাজা নলিনাক্ষ রায় (১৯৩৫-১৯৫১ খ্রি.), রাজা ত্রিদিব রায় (১৯৫৩-১৯৭১ খ্রি.), রাজা কুমার সুমিত রায় (১৯৭২-১৯৭৭ খ্রি.) এবং রাজা দেবাশীষ রায় (১৯৭৭ থেকে বর্তমান পর্যন্ত)।
তবে ধরম বক্স খাঁ’র সময় থেকে শুরু হওয়া জমিদার পরিবারের দ্বন্ধ-সংঘাত আর কোনদিনই শেষ হয়নি। বরং একাধিকবার যুদ্ধের পাশাপাশি এই দুই দলের মামলা চলেছে বৃটিশরা এই দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পূর্ব পর্যন্ত। কালিন্দী রাণীকে বৃটিশদের পাশাপাশি চাকমা, তঞ্চ্যাঙ্গা এবং মার্মারা সহায়তা করায় যুদ্ধে উভয় পক্ষে বহু হতাতহ হলেও জয় হয় কালিন্দী রাণীরই। তবে মামলায় কোন কোন সময় জয় লাভ করেছে হোসেন খাঁ’র পক্ষও। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২২ তালুকের জমিদারী হোসন খাঁ’র হাতে চলে যাওয়ার মামলা। ঐতিহাসিক এই মামলার রায়ের দলিলটিসহ সেসময়ে চলা অনেক মামলার দলিল এবং মোগল জমিদারদের অনেক তথ্য-উপাত্ত আজও রাঙ্গুনিয়ায় মোগল পরিবারের সদস্য মীর্জা মোহাম্মদ সৈয়দ এর কাছে সংরক্ষিত আছে। এমনকি মগী জরিপের ছিটায়ও উক্ত ২২ তালুকের জমিদারীর অকাট্য প্রমাণ নিহিত আছে। মামলায় হেরে গিয়ে তখন হরিশ্চন্দ্র চরম বেকায়দায় পড়ে যান। এমনকি শুধু বসতবাড়ি ব্যতীত স্থলভাগে উত্তরে রাণীরহাট থেকে দক্ষিণে কর্ণফুলীর তীর পর্যন্ত রাঙ্গুনিয়ার ২২ তালুকের জমিদারী হোসেন খাঁ’র (মীর্জা হোসেন) হাতে চলে যায়। আর এ কারণেই তাকে (হরিশ্চন্দ্র) রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ছেড়ে রাঙ্গামাটিতে স-পরিবারে চলে যেতে হয়। কিন্তু রাঙ্গামাটিতে চলে যাওয়ার পরও চলতে থাকে উভয় পক্ষের মামলা-মোকদ্দমা।
হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যুর পর তার পুত্র নলিনাক্ষ রায় জমিদারী লাভ করেন। এক পর্যায়ে নলিনাক্ষ রায় তার প্রতিপক্ষ হোসেন খাঁ’র বংশধর মীর্জা ওয়াজেদ আলী এবং তার বংশধরগণ মোগল বংশীয় নয় বলে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করেন। চট্টগ্রাম আদালতে তৎকালে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই মামলার শুনানিতে মীর্জা ওয়াজেদ আলী আদালতে হাজির করেন ভারতের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর প্রদত্ত এক সনদ। ঐ সনদ এবং তাদের কাছে বংশানুক্রমে সংরক্ষিত অন্যান্য প্রামাণ্য দলিলের উপর ভিত্তি করে অবশেষে চট্টগ্রাম জজ আদালত রায় ঘোষণা করে, রাঙ্গুনিয়া মোগলবাড়িতে বসবাসরত মীর্জা হোসেনের বংশধররা প্রকৃতই মোগল এবং তাদের আদি পুরুষ সুদূর দিল্লীর অধিবাসী ছিলেন বলেও প্রত্যয়ন করা হয় এই রায়ের মাধ্যমে।
ইতিহাস বিকৃতিতে চাকমা রাজপরিবারের ভূমিকা
দুই পক্ষের মামলা এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলা অবস্থায় রাজা ভুবন মোহন রায়ের সময় চাকমা রাজপরিবারের গৃহশিক্ষক সতীশচন্দ্র ঘোষ, চাকমা জাতি এবং চাকমা রাজপরিবারের ইতিহাস বিষয়ে ‘চাকমা জাতি’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটি ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ পায়। যার পত্রে পত্রে- ছত্রে ছত্রে তৎকালীন চাকমা রাজা ভুবন মোহন রায়ের নির্দেশনা রয়েছে বলে সতীশচন্দ্র ঘোষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বইটি তাঁকেই উৎসর্গও করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, তখনো জমিদারী নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মামলা চলমান এবং মোগল মুসলিম জমিদারদের সাথে এই রাজপরিবারের সংশ্লিষ্টতার কোন কিছুই এই বইটিতে স্থান না দিয়ে প্রকৃত ইতিহাস গোপন করা হয়। চাকমা রাজপরিবারের কয়েক শতাব্দীব্যাপী ইতিহাস রচনায় সতীশচন্দ্র ঘোষের প্রধান সূত্র ছিল আরাকান কাহিনী ‘দেঙ্গ্যাওয়াদি আরেদ ফুং’ নামক একটি পুঁথি (অশোক কুমার দেওয়ান অবশ্য তাঁর দীর্ঘ অনুসন্ধানেও কথিত এই পুঁথিটির লিখিত কোন কপির খোঁজ পাননি)। কিন্তু সতীশচন্দ্র ঘোষের উদ্ধৃতি বিশ্লেষণ করে এই সূত্রটির দুর্বলতা সম্পর্কে অশোক কুমার দেওয়ান লিখেছেন, “ইতিহাস হিসেবে পুঁথিটির গুরুত্ব এবং তাতে সন্নিবেশিত তথ্যগুলির প্রামাণ্যতা সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ আছে। — দেঙ্গ্যাওয়াদির কাহিনীকার তুলনামূলকভাবে একেবারে আধুনিক কালের ঐতিহাসিক বিবরণে যে প্রকার অবাস্তব, আজগুবী কাহিনীর অবতারণা করেছেন তাতেই মনে হয় যে এই পুঁথিটি আমাদের দেশে গ্রাম্য কবিগণের রচিত বিবিধ পল্লীগাঁথার অনুরূপ নিম্নমানের একটি পুঁথিমাত্র” (পৃ. ২২)। সতীশচন্দ্র ঘোষের পর ভুবন মোহন রায় নিজেই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘চাকমা রাজবংশের ইতিহাস’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। কিন্তু সেই সময় ভুবন মোহন রায় নিজে মামলায় জড়িত থাকার পরও তার পুস্তিকায় এসব বিষয়কে এড়িয়ে গিয়ে কোন প্রকার সূত্র এবং প্রামাণ্য দলিলের উল্লেখ ছাড়াই নিজেদেরকে কথিত প্রাচীন চাকমা রাজা বিজয়গিরির উত্তরাধিকার হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেছেন। ভুবন মোহন রায় সতীশচন্দ্র ঘোষকে টেক্কা দিয়ে ‘চাকমা জাতি’ গ্রন্থে উল্লেখিত রাজাদের তালিকায় প্রাচীন রাজা বিজয়গিরিরও পূর্বে রাজত্ব করেছেন এমন এক ডজনের বেশি রাজার নাম যুক্ত করেছেন। কিন্তু তিনি এসব রাজাদের নামের তালিকা কোথায় পেলেন তার কোন ব্যাখ্যা বা সূত্র উল্লেখ করেন নি। পরবর্তী ইতিহাস রচয়িতারা এই দুটি গ্রন্থকে প্রামাণ্য হিসেবে ধরেই এগিয়েছেন। কেউ কেউ কিছুটা পরিবর্তন বা পরিমার্জন করে নতুনভাবে লেখার চেষ্টা করেছেন ঠিকই, কিন্তু তারা সত্যের সন্ধান আর পান নি অথবা সযতনেই এড়িয়ে গেছেন সত্যকে। ফলে এতদিন চাকমা রাজপরিবার কেন্দ্রিক রচিত হয়েছে চাকমা জাতির ইতিহাস নামের অনেক জঞ্জাল। অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে বর্তমান রাজপরিবারের সাথে চাকমাদের অতীত কোন যুগসূত্রই নেই। এই সম্বন্ধটা অতিসাম্প্রতিক। চাকমা রাজপরিবারে রক্ষিত ইতিপূর্বে ব্যবহৃত ৯টি সিলমোহরের মধ্যে ৮টিই আরবিতে লেখা, এগুলোর একটিতে ‘আল্লাহু রাব্বি’ লেখা রয়েছে। শেরমস্ত খাঁ থেকে ধরম বক্স খাঁ পর্যন্ত প্রত্যেক জমিদারের নামই মুসলমানি স্মারক, তাদের স্ত্রীদের নামের সাথেও অভিজাত মুসলিম নারীদের অনুরূপ খেতাব উপস্থিত। এছাড়া তাদের কাছে রক্ষিত প্রাচীন সমরাস্ত্রগুলোও জামাল উদ্দিনের এই গবেষণাকে সত্য বলে প্রত্যয়ন করে। যদিও সতীশচন্দ্র ঘোষ এসব নির্ভেজাল ঐতিহাসিক উপাদানের বিষয়কে বিবেচনায় না নিয়ে অনুমান নির্ভর কল্প কাহিনীকে প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তবে এসব প্রমাণের ভিত্তি যে খুবই দুর্বল তা সতীশচন্দ্র ঘোষ নিজেও অনুধাবন করেছিলেন, যা তিনি স্বীকারও করেছেন।
মুসলিম পরিচয় গোপন
চাকমারা মূলত রাণী কালিন্দীর সময় আরাকান থেকে আসা মারমা জনগোষ্ঠীর সাথে ভিক্ষুদের দ্বারা বৌদ্ধ ধর্মের সংস্পর্শে আসে। তাই চাকমাদের ধর্ম পরিচয় সম্পর্কে মারমাদের মূল্যায়নটাও গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাপ্টেন লুইন এবং সতীশচন্দ্র ঘোষসহ অন্যান্য ঐতিহাসিকগণও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আলোকপাত করেছেন। চাকমাদের উৎপত্তি, বিস্তার এবং ধর্ম পরিচয় নিয়ে মারমাদের বিশ্বাস সম্পর্কে ক্যাপ্টেন লুইন-এর বর্ণনা থেকে সতীশচন্দ্র ঘোষ ‘চাকমা জাতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ইহাদিগের উৎপত্তি ও বিস্তৃতিমূলক এরূপ নানাবিধ কিম্বদন্তী শুনিতে পাওয়া যায়। মঘেরা (চাকমা ও অন্যান্যরা মারমাদের মঘ নামেই অবহিত করে থাকে) বলে, ইহারা মেগাল বংশধর। কোন সময়ে চট্টগ্রামের (মুসলমান) উজীর কতগুলি সৈন্য সংগ্রহ করিয়া আরাকান রাজ বিরুদ্ধে অভিযান করেন। তাঁহারা পথিমধ্যে এক বিশুদ্ধচারী ‘ফুঙ্গীর’ (বৌদ্ধ যাজক) কুটীর পার্শ্ব দিয়া যাইতেছিলেন। তখন ফুঙ্গী উজীরকে তদীয় আশ্রমে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিয়া যৎকিঞ্চিৎ আহার্য গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিলেন। কথা রহিল অতি সত্ত্বরেই ভক্ষ্য প্রস্তুত করিয়া দেওয়া হইবে। তাহাতে উজীরও সম্মত হইলেন। কিছুক্ষণ পরে পাকের বিলম্ব দেখিয়া তিনি জনৈক সৈনিককে তত্ত্ব জানিবার জন্য পাঠাইলেন। সে আসিয়া কুটীরে প্রবেশ করতঃ দেখিল, ফুঙ্গী একটি পাত্রে চাউল ও মাংস দিয়া উনানের উপর স্থাপন করিয়াছেন। কিন্তু উনানে কাষ্ঠ দেওয়া হয় নাই। তৎপরিবর্তে ফুঙ্গী পাত্র নিম্নে পদদ্বয় রাখিয়াছেন- অংগুলিসমূহ হইতে অগ্নিশিখা উত্থিত হইতেছে। সে এই অলৌকিক দৃশ্যে অতীব বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া প্রভুকে আসিয়া বিবৃত করিল। ইহাতে তিনি রাগান্বিত হইয়া বলিলেন, তাদৃশ প্রক্রিয়ায় কখনও অন্ন পরিপক্ক হইতে পারে না। অনন্তর তিনি সৈন্যগণকে পুনর্যাত্রার নিমিত্ত আদেশ করিলেন। এদিকে সেই বিশুদ্ধচেতা ফুঙ্গী অতিথিগণকে অভ্যর্থনা করিতে আসিয়া দেখিলেন যে, তাঁহারা চলিয়া গিয়াছেন। ইহাতে তিনি অতিশয় মর্মাহত হইয়া সসৈন্যে উজীরকে অভিশপ্ত করিলেন। তাঁহাদের প্রতি এক জাদুময় তেজঃপ্রেরিত হইল। তাহারই ফলে আরাকান রাজের সৈন্যসম্মুখে উপনীত হইলে তাঁহাদের চিত্তবল বিলুপ্ত প্রায় হইয়া গেল- অনায়াসেই পরাজিত এবং বিপক্ষের হস্তে বন্দীভূত হইলেন। আরাকানেশ্বর এই মোগলগণকে স্থানীয় অধিবাসীদের হইতে পতœী গ্রহণের অনুমতি দিয়া স্বীয় রাজ্যে দাসরূপে স্থাপন করিলেন। ইহারা ক্রমেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া বর্তমান চাকমা জাতিতে পরিণত হইয়াছে” (পৃ. ৫-৬)। এই ঘটনায় ফুঙ্গী ও তাঁর মাংস রান্নার বিষয়টি সম্ভত বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী মারমাদের কাছে অতিভক্তির কারণে বা কল্পিতভাবেই এসেছে। কেননা বৌদ্ধরা নিরামীষভুজি না হলেও তারা প্রাণী হত্যায় বিশ্বাসী না। তবে চাকমাদের মোগল বংশধর হওয়ার বিষয়টির সাথে আধুনিক গবেষণা ফলও সমার্থক। এমনকি এ বিষয়টি সতীশচন্দ্র ঘোষের সময়কালেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে তিনি ঘটনাটি তার পুস্তকে উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “চট্্রগ্রামে মোগালাধিকার স্থায়ীরূপে সংস্থাপিত হইয়াছিল, আড়াইশত বৎরেরও কম; ইহার দেড়শত বৎসর পূর্ব হইতে চেষ্টা আরম্ভ হইয়াছিল মাত্র। পূর্বোক্ত প্রবাদ সত্য হইলে চাকমা জাতির উৎপত্তিকাল তিন শত বৎসরের অধিক হইতে পারে না, সুতরাং ইহা একেবারে অসম্ভব। বোধ হয় চট্টগ্রামে-মুসলামান-প্রাবল্য-সময়ে এই করদ রাজন্যবর্গ এবং সম্ভ্রান্ত পরিবার ‘খাঁ’ ‘বিবি’ প্রভৃতি সম্মানাষ্পদ খেতাব গ্রহণ করিয়াছেন। এমন কি ইহাদের জড় কামানও কালু খাঁ, ফতে খাঁ, প্রভৃতি গৌরব বাচক খাঁ আখ্যা লাভ করিয়াছিল। সেই সঙ্গে দু’ একটি মুসলমানী সংস্কার এবং আদব কায়দাও প্রবেশ লাভ করিয়াছে, ইহা অবশ্য মানিয়া লওয়া যায়” (পৃ. ৬-৭)। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট, যেকোন কারণেই হোক চাকমাদের বিশেষ করে চাকমা রাজ বংশের স্বল্পকালীন ইতিহাসের বিষয়টি লেখকের পক্ষে স্বীকার করে নেয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। তাই তিনি প্রকৃত সত্য অস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। একই কারণে তাদের মুসলমান পরিচয় আড়াল করে কিছু দুর্বল কাহিনী তথা উপকথাকে ব্যবহার করে দীর্ঘ অলীক ইতিহাসের অবতারণা করেছেন।
সূর্যবংশীয় প্রমাণের চেষ্টা
কিন্তু সতীশচন্দ্র ঘোষ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কেন এসব দুর্বল সূত্র ব্যবহার করে একটি জাতির সুদূর অতীতকে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছেন সে বিষয়ে পূর্ণ ধারণা পাওয়া না গেলেও বইটির শুরুতে একটি ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়। যেখানে তিনি লিখেছেন, “উপস্থিত চাকমাজাতির উৎপত্তি, স্থিতি বা পরিব্যাপ্তিমূলক এ যাবত যে সমুদয় বিবরণী প্রাপ্ত হওয়া গিয়েছে, তদ্বারা ইহারা যে অনার্য নহে, তাহা স্পষ্টতঃ প্রতিপন্ন করা যায়। সে সমুদয় বাদ-বিচার যথাক্রমে আলোচিত হইতেছে” (পৃ. ২)। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, সতীশ বাবুর ‘চাকমা জাতি’ রচনার পেছনে চাকমারা যে মুসলিম ও মোগল বংশধর -এই পরিচয় গোপন করে তাদেরকে আর্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটা তাড়না বা উদ্দেশ্য কাজ করেছে। আর এটা তৎকালীন চাকমা রাজা ভুবন মোহন রায়ের অজ্ঞাতে হয়েছে তা ভাবার কোন যুক্তি নেই। কেননা সতীশচন্দ্র ঘোষের বর্ণনামতে ভুবন মোহন রায় এই বই রচনার শুরু থেকে প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এমনকি তিনি নিজে পান্ডুলিপিও দেখে দিয়েছিলেন। তাই ইতিহাস নিয়ে এখানে যে ছেলেখেলা হয়েছে, তা চাকমা রাজপরিবারের আগ্রহেই হয়েছে। যার ফলে সতীশচন্দ্র ঘোষ চাকমা রাজ পরিবারে সংরক্ষিত সিল মোহর, দলিল-পত্র, সমরাস্ত্র, তাদের ভাষা এবং কৃষ্টিকালচারকে বাদ দিয়ে কিছু রূপকথা/উপকথাকে ইতিহাসের সূত্র ধরে এগিয়েছেন এবং রাজপরিবারের গুরুত্ব ও আভিজাত্য বাড়াতে মনের মাধুরী মিশিয়ে একের পর এক কল্পিত রাজার নাম এবং তাদের কীর্তিগাঁথা রচনা করে চাকমা রাজ বংশকে সূর্যবংশীয় তথা আর্যদের উত্তরাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।
বিষয়টি অনুধাবন করে এবং ইতিহাস বিকৃতির এই চরম ধৃষ্টতা দেখে সত্য অনুসন্ধানী গবেষক অশোক কুমার দেওয়ান অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন। আর তাই এ ইতিহাসকে চাকমা রাজাদের ফরমায়েশী ইতিহাস হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি লিখেছেন, “বংশ কেবল প্রাচীন হলেই হয় না, বংশ তালিকা দীর্ঘ না হলেও বংশের মান বাড়ে না, সে কারণে অভিরাজের পূর্বে অগণিত রাজার কথা উল্লেখ আছে, — The history of kings commencing from Maha Thamada upto the time of excellent `Para Gaudama’ there being 334, 569 kings in regular succession. (Capt, C. J. S. Forbes: Legendary history of Burma and Arakan, 1882). যাইহোক, মনে হয় চাকমা রাজ বংশের ফরমায়েসী ইতিহাস রচনাকালেও পূর্বোক্তর্ রাহ্মণ পন্ডিত বিশ্বব্যাপী প্রচলিত এই গতানুগতিক রীতিতে লংঘন করতে পারেননি। শাক্য বংশ থেকে উৎপত্তির কাহিনীটি কবে থেকে প্রচলিত ছিল ঠিক বলা যায় না তবে চাকমা রাজাগণের সূর্যোবংশো™ভূত ক্ষত্রিয়ত্বের দাবী সম্ভবতঃ খুব বেশী দিনের কথা নয়। হাচিনসন তাঁদের চন্দ্র বংশীয় বলে উল্লেখ করলেও সতীশচন্দ্র ঘোষ সে প্রসঙ্গে কিছুই বলেননি বরং ত্রিপুরা রাজবংশের ইতিবৃত্ত ‘রাজমালা’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে পরোক্ষভাবে তাঁদের চন্দ্র বংশীয় বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন- ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা মঘ নরপতিগণ অল্পকালের মধ্যে চট্টগ্রামের ব্রাহ্মণ মহাশয়দিগের কৃপায় চন্দ্র বংশজ বলিয়া অ্যাখ্যায়িত হইয়াছেন’। মনে হয় গ্রহাচার্য প্রমূখ ব্রাহ্মণ মহাশয়গণ প্রথমদিকে তাঁদের চন্দ্র বংশজ বলে দাবী উত্থাপন করে বিশুদ্ধ হিন্দু প্রতিপন্ন করার চেষ্ট করেন, কিন্তু পরে বোধ হয় অন্য কোন ব্রাহ্মণ পন্ডিতের দ্বারা সেই অসংগতি সংশোধন করা হয়। যেহেতু বুদ্ধ শাক্যকুলজাত, শাক্যকুল আবার সূর্য বংশোজাত, সুতরাং এই মতকে প্রচলিত বিশ্বাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া সহজ। তাছাড়া সূর্যবংশের গৌরব চন্দ্রবংশের তুলনায় একটু বেশী হওয়ারই কথা-অতএব ডবল লাভ” (পৃ. ৩২-৩৩)।
রাজপরিবারের ধর্মান্তর
১৬৬০ সালের পর থেকে শাহ সুজার সেনাপতিগণ কর্তৃক বর্তমান বান্দরবান জেলার অন্তর্গত আলীকদমে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম জমিদারীতে তৎকালীন জমিদার এবং তাদের অধিকাংশ প্রজাই ছিলেন মোগল ও মুসলিম। যার প্রমাণ ইতিহাস ছাড়াও চাকমা রাজপরিবার এবং চাকমাদের জীবনাচার, ভাষা ও বিশ্বাসের সাথে এখনো জড়িয়ে আছে। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারীতেও এই জমিদার পরিবার এবং তাদের প্রজাদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক মুসলমান হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে আজ আর সেই অবস্থা বিরাজমান নেই। বর্তমানে এই রাজপরিবার এবং তাদের প্রজাদের অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। মুসলিম জমিদারীতে অন্য ধর্মের প্রভাব কখন থেকে কিভাবে শুরু হয়েছিল তার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রমাণ এখন আর পাওয়া যায় না। তবে রাজপরিবারে রক্ষিত সিলমোহর থেকে রাজা জব্বর খাঁর (১৮০১-১৮১২ খ্রি.) মধ্যে হিন্দু ধর্মবিশ্বাসীদের নিকট পুঁজিত দেবী কালীর প্রতি ভক্তির প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায়। এরপর রাজা ধরম বক্স খাঁর (১৮১২-১৮৩২ খ্রি.) সিলমোহরেও দেবী কালীর প্রতি ভক্তির নিদর্শন অব্যাহত থাকে। রানী কালিন্দীও (১৮৪৪-১৮৭৩ খ্রি.) প্রথমে হিন্দু ধর্মের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। পরবর্তীতে তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। এ সম্বন্ধে সতীশ ঘোষ ‘চাকমা জাতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, “… এক সময় আরাকান হইতে সংঘরাজ এবং হারবাঙের গুণামেজু নামক প্রসিদ্ধ ভিক্ষুদ্বয় আসিয়া তাঁহাকে বৌদ্ধধর্মে প্ররোচিত করেন (কেহ কেহ এ সম্বন্ধে সিংহলে অধীতবিদ্যা হরিঠাকুর নামক জনৈক চট্টগ্রামবাসী ভিক্ষুর দাবিই অগ্রগণ্য বলিয়া থাকেন।) তাঁহাদের প্রমুখাৎ ভগবান সম্বুদ্ধের চরিতামৃতকাহিনী শ্রবণ করিয়া তিনি বিমুগ্ধ হইলেন এবং অনতিকালবিলম্বে শুভদিনে যথাবিধি তদধর্ম্মে দীক্ষাগ্রহণ করিলেন। পরে ইহাদেরই উপদেশে রাজানগর রাজভবনের পূর্ব পাশে সুরমা ও লঙ্কাদেশের নানাভিক্ষুকে নিমন্ত্রণপূর্বক মহাসমারোহে বাঙ্গালা ১২৭৩ সনের ৮ চৈত্র দিবসে আরাকানের অনুকরণে ‘মহামুণি’ স্থাপন করেন।” (পৃ. ১১১-১১২)। বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে এরপর থেকে রানীর পৃষ্ঠপোষকতায় জমিদার পরিবার এবং প্রজাদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবল প্রচার শুরু হয় এবং ক্রমেই বিস্তার লাভ করে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখা যায় এ মুসলিম জমিদারীতে এক সময় অভিজাত হিন্দুদের প্রভাব তৈরিতে ইংরেজরা সহায়তা করেছিল। ব্রিটিশরা কোন কোন সময় এ জমিদারীতে খাজনা আদায়ে হিন্দুদের ইজারাদারও নিয়োগ করেছিল। ধারণা করা হয় এসব ইজারাদার এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সংস্পর্শে এসে রাজা জব্বর খাঁ (১৮০১-১৮১২ খ্রি.) তাদের পুঁজিত দেবী কালীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। মাধব চন্দ্র চাকমা কর্তৃক রচিত ‘শ্রীশ্রী রাজনামা’ গ্রন্থে এর ইঙ্গিত রয়েছে। গ্রন্থটিতে গ্রহাচার্য শঙ্করাচার্য নামে প্রভাবশালী একজন পণ্ডিতের নাম উল্লেখ রয়েছে যার প্রতি রাজার যথেষ্ট শ্রদ্ধা-ভক্তি থাকারও প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এটা বোঝা যায় যে, রাজা জব্বর খাঁর মাধ্যমে জমিদার পরিবারে হিন্দু ধর্মের প্রভাব শুরু হলেও তা পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই কালিন্দী রানী বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
মুসলিম জমিদার পরিবারে প্রথম হিন্দু ধর্মের প্রভাব এবং পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার লাভ করলেও তা কখনোই পুরো পরিবারকে প্রভাবিত করতে পারেনি। বরং এটা ক্ষমতাকেন্দ্রিক একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অপরদিকে রাজা জব্বর খাঁর (১৮০০-১৮০১ খ্রি.) পুত্র হোসেন খাঁ (মীর্জা হোসেন)-এর নেতৃত্বে জমিদার পরিবারের বৃহৎ অংশ তাদের মুসলিম ধর্মবিশ্বাসে সদা অবিচল ছিলেন এবং রাঙ্গুনিয়া ও তার আশাপাশ এলাকায় ছড়িয়ে থাকা তাদের বংশধরগণ এখনো সম্ভ্রান্ত মুসলমান হিসেবেই সর্বজন মান্য হয়ে বসবাস করছেন। এক পর্যায়ে জমিদার পরিবারের এই দুই অংশের দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং তৎপরবর্তী মামলায় ২২ তালুকের জমিদারী লাভ করলে বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত রাঙ্গুনিয়া, রাজানগর, রাউজান, রানীর হাটসহ বিশাল এলাকার ওপর হোসেন খাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় যা আজো মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বর্তমান। এবং তখন অভিজাত এবং সম্ভ্রান্ত মুসলমানগণ হোসেন খাঁর নেতৃত্বে এ অঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করেন। অপরদিকে তৎকালীন জমিদার হরিশ্চন্দ্র রায় রাজানগরের জমিদার বাড়ি ব্যতীত এ অঞ্চলের বিরাট অংশের ওপর কর্তৃত্ব হারিয়ে বেকায়দায় পড়েন। ফলে রাজানগর থেকে রাজবাড়ি সরিয়ে রাঙ্গামাটির গভীর জঙ্গলে নিয়ে যান। জমিদার পরিবারের দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করে একাধিক ঐতিহাসিক জমিদার পরিবারে ধর্মান্তরের বিষয়ে ধারণা করেন যে, হিন্দু ইজারাদার এবং পণ্ডিতদের সংস্পর্শ জব্বর খাঁর মধ্যে কালী ভক্তির জন্ম নেয়। জব্বর খাঁর মৃত্যুর ১৮ মাস পর তার স্ত্রীর গর্ভে ধরমবক্স জন্ম নেয়ার কারণে তিনি পরিবারে ‘আঠার মাস্যা ধরমবক্স’ হিসেবে নিন্দিত ছিলেন। যার কারণে সম্ভ্রান্ত মোগল মুসলিম পরিবারে তাকে মেনে নেয়ার কোন যুক্তি ছিল না। আর ধরমবক্স খাঁ (১৮১২-১৮৩২ খ্রি.) তার জন্মের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিজেও সন্দিহান ছিলেন। ফলে তিনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি জমিদার হলেও অভিজাতগণের আনুগত্য এবং তাদের নিকট থেকে সম্মান লাভ কোনদিনই সম্ভব না। তাই তিনি সামাজিকভাবে অনেকটা নিঃসঙ্গই ছিলেন। মুসলমানদের নিকট নিন্দিত হয়ে তাকে হিন্দুদের প্রভাবে থেকে জমিদারী পরিচালনা করতে হতো, অল্পবয়সী হওয়া এবং শুরু থেকেই জমিদারী নিয়ে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে তিনি জব্বর খাঁর (১৮০১-১৮১২ খ্রি.) অনুকরণে সিলমোহরে কালী ভক্তির নিদর্শন অব্যাহত রাখেন। তাছাড়া মাত্র বিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করায় তার পক্ষে ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে খুব বেশি চিন্তার সুযোগও ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে পরিণত বয়সে জমিদারী লাভ এবং দীর্ঘ সময় ধরে জমিদারী পরিচালনা করার কারণে রানী কালিন্দী (১৮৪৪-১৮৭৩ খ্রি.) এ বিষয়ে ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ পেয়েছিলেন। তাই তিনি প্রথমে হিন্দু ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাকলেও পরে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। এক্ষেত্রে ধারণা করা হয়, অন্য ধর্ম থেকে এসে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হয়ে জাতে ওঠার কিংবা অভিজাত হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের কোন সুযোগ না থাকার কারণে সুচতুর কালিন্দী রানী বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকতে পারেন। যার ধারাবাহিকতায় আজ চাকমারাও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তবে ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই জমিদারীতে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার পরম্পরায় হিন্দু ধর্ম এবং পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব তৈরির বিষয়টিকে রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরে তৎকালীন জমিদার বাড়ির সীমানায় মসজিদ, মন্দির এবং কেয়াং-এর বিদ্যমান স্মৃতিচিহ্ন আজো সাক্ষ্য বহন করছে। আর এই তিন ধর্মের কিছু না কিছু বিশ্বাস চাকমাদের মধ্যে এখনো বিদ্যমান। বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও স্রষ্টার একক সত্তার প্রতি যেমন বিশ্বাস আছে; তেমনি কালী পূজা, লক্ষ্মী পূজা এবং সরস্বতী পূজাসহ হিন্দু ধর্মের নানা আচার-অনুষ্ঠানও তারা ভক্তিসহকারে পালন করে থাকে।
স্বাধীনতাবিরোধী রাজপরিবার
মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর থেকে জমিদারীতে ইংরেজ এবং প্রভাবশালী হিন্দুদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া ভারতবর্ষজুড়েই মোগলরা ইংরেজদের চক্ষুশূলে পরিণত হওয়ায় এখানেও তার প্রভাব পড়ে। বিচক্ষণ রানী কালিন্দীও এটা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন বিধায় তিনি ইংরেজদের সহায়তায় ঐতিহ্যবাহী এই জমিদারীর প্রকৃত হকদার মোগলদের বঞ্চিত এবং নির্মূল করে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে পেরেছিলেন। বিনিময়ে ইংরেজদেরকে খুশি করতেও তাকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। রানী কালিন্দী তখন ব্রিটিশদের মনোতোষণের জন্যই স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক সিপাহীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদের গ্রেফতার করে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেন। মোহাম্মদ ওয়াজিউল্লাহ তার ‘আমাদের মুক্তি-সংগ্রাম,’ ১৯৬৭, পৃ.-১০৩-এ লিখেছেন, রানী কালিন্দীর পূর্বে প্রত্যক্ষভাবে চাকমাদের সাথে ব্রিটিশ কোম্পানির তেমন কোন বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। বিচক্ষণ রানী কালিন্দী আনুগত্য লাভে ব্রিটিশ সরকারকে বিশেষভাবে সহযোগিতা প্রদান করেন। এমনকি চট্টগ্রামে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহকালে বিদ্রোহী সৈনিকরা পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করলে, রানী কালিন্দী তাদেরকে ধৃত করার জন্য সরকারকে সহযোগিতা করেছিলেন।
সিপাহী বিদ্রোহের পলাতক সৈনিকদের বিরুদ্ধে এহেন দায়িত্ব পালনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে রানী কালিন্দীকে বার্ষিক ১১৪৩ টাকা কর্ণফুলী নদীর বার্ষিক জলকর মওকুফ করে দেয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময়ে কিছু উপজাতীয় নেতা রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। পাকিস্তানের স্বাধীনতা বিরোধিতায় তৎকালীন চাকমা রাজা সরাসরি নেতৃত্ব না দিলেও অনেকে ধারণা করেন, এতে রাজপরিবারের ইন্ধন ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিবিদ রায় নিজেই রাজাকার বাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানী হানাদারদের পরাজয় ঘনিয়ে এলে ত্রিদিব রায় তার পরিণতি আঁচ করতে পেরে নভেম্বর মাসে মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান এবং আজ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার না করে পাকিস্তানেই বসবাস করছেন। এ প্রসঙ্গে গত কয়েক বছর আগে প্রকাশিত তার বিতর্কিত বই The Departed Melody -তে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে তিনি (রাজা ত্রিদিব রায়) তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী, মোঃ হজরত আলী এবং আরো কয়েকজন বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাসহ চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টার-এর পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তানীদের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে আসা আরো কয়েকজন ঢাকা থেকে আসা জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে করে কাপ্তাইয়ে যাবেন। ঠিক সেদিনই বিকেলে কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকটি লঞ্চ এবং স্পিডবোট নিয়ে রাঙ্গামাটি আসে এবং বিনা প্রতিরোধে দখল করে নেয়।’ ত্রিদিব রায়ের নেতৃত্বে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত তৎকালীন রাজাকার বাহিনী এবং তাদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে একাধিক গণহত্যা চালানো হয়েছিল। কিন্তু এ কারণে আজ পর্যন্ত রাজা ত্রিদিব রায় কোন প্রকার অনুতাপ স্বীকার করা তো দূরের কথা বরং মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করে তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ The Departed Melody -তে লিখেছেন, Increasing lawlessness and violence of the rebel Bengali forces promised no safety to anyone (Page-214) In Rangamati, from 26 March onward, Awami League cadres, in league with the rebel police and tha East Pakistan Rifles, began rounding up the Biharis (Page-216) . There was a constant supply of food and firearms in commandeered trucks to the Mukti Bahini, comprising rebel EBR (East Pakistan Regiment), EPR (East Pakistan Rifles), and the police. These elements were fighting the The Army at Chittagong and elsewhere. People were forced by Awami League cadres to pay money and rice under threat of violence. Many shopkeepers had closed shop and run away. ( Page- 217)
রাজা ত্রিদিব রায়ের উত্তরসূরি তার সন্তান তথা বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীস রায়-এর কর্মকান্ড কতটুকু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে তাতে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বরং শুরু থেকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে সক্রিয় থাকা, শান্তি বাহিনীর সাথে যোগাযোগ এবং তাদের অপকর্মে নীরব সমর্থন, বর্তমানে ‘আদিবাসী’ ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীবিরোধী বক্তব্য এবং অব্যাহত অপপ্রচার তারই সাক্ষ্য বহন করে। চাকমা রাজপরিবারের প্রধানদের ধারাবাহিক এসব কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, তারা সব সময়ই এদেশ এবং এদেশের মুক্তিকামী মানুষের আবেগ ও প্রত্যাশার বিরোধী ছিল এবং এখনো তারা তাই আছে। অতএব চাকমা রাজপরিবারের ইতিহাসকে স্বাধীনতাবিরোধিতার ইতিহাস বললেও অত্যুক্তি হবে না মোটেও।
রাজাকার রাজা ত্রিদিব রায়
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ন্যাশনাল এসেম্বলী ইলেকশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশের মুক্তিকামী জনতার পাশে না দাঁড়িয়ে যোগ দেন পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে। চাকমা রাজা হিসেবে তার প্রভাবাধীন হেডম্যান-কারবারীদের ব্যবহার করে চাকমা যুবকদের দলে দলে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করেন। তাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিয়ে লেলিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী জনতার বিরুদ্ধে। এসময় ত্রিদিব রায় এবং তার রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একাধিক গণহত্যা পরিচালনা করে। এতে নির্মমভাবে শহীদ হন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তায় মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। বাংলাদেশ এবং বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব ও কার্যক্রমের পুরস্কার স্বরূপ ‘পাকিস্তানের জাতীয় বীর’ খেতাব এবং আজীবন মন্ত্রীত্ব নিয়ে আজো তিনি পাকিস্তানেই বসবাস করছেন। অপরদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের রেখে যাওয়া রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) গড়ে তোলে সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী। এ প্রসঙ্গে ১৩৯২ বাংলা সালে কলিকাতা, নাথ ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘প্রসঙ্গ: পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক গ্রন্থে সিদ্ধার্থ চাকমা লিখেছেন, … ‘উপজাতীয় রাজাকাররা এ সময় গভীর অরণ্যে পালিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তারা সশস্ত্র ও সংগঠিত হয়ে শান্তিবাহিনী নামে সংগঠন গড়ে তোলে (পৃ. ৪৬)।’ গত তিন যুগের বেশি সময় ধরে যাদের হাতে নিহত হয়েছে হাজার হাজার নিরীহ পাহাড়ি বাঙালি জনগণ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। এদেরই উত্তরসূরিদের হাতে এখনো অব্যাহতভাবে চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং খুনের শিকার হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অসহায় মানুষগুলো।
২০০৩ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক বই The Departed Melody -তে ত্রিদিব রায় নিজেই রাজাকার হিসাবে তার কর্মকাণ্ড বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করেছেন এবং এসব অপকর্মের কারণে তিনি অনুতপ্ত তো নয়ই বরং গর্ব প্রকাশ করেছেন তার বইয়ে। একই সাথে মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ব্যঙ্গ করার পাশাপাশি পাকিস্তানী হানাদারদের গুণকীর্তন করেছেন। তার বইয়ে পাক হানাদারদের প্রশংসা করতে গিয়ে ত্রিদিব রায় লিখেছেন, On the way back, at Ranirhat, 18 miles from Rangamati, a number of very frightened people asked us when the army was going to take over these areas. They said they were suffering at the hands of the Mukti Bahini. We told them that the army would be coming at any moment. That evening at dusk the army, in launches and speedboats made a sort of miniature Normandy landing (the Allied landing in France of 6 June 1944) at Rangamati and swiftly took command of the situation (page-221).
ঢাকার তাম্রলিপি প্রকাশনা থেকে ফেব্র“য়ারি, ২০০৯-এ প্রকাশিত ডা. এমএ হাসানের বই ‘যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ’-তে রাজাকার রাজা ত্রিদিব রায়ের সিরিয়াল এবং তার পরিচয় হিসাবে উল্লেখ রয়েছে, 948. Mr. Raja Tridiv Roy, Father Late Raja Nalinakhya Roy, Village Rajbari Rangamati, Thana Kotowaly, Chittagong (page- 152). আইন ও সালিস কেন্দ্র থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত বই ‘যুদ্ধাপরাধ’ এর ৮২ পৃষ্ঠাতে অনেকের পাশাপাশি রাজাকার রাজা ত্রিদিব রায়ের নামও উল্লেখ রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বের হওয়া হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র’ (সশস্ত্র সংগ্রাম-১) নবম খণ্ডের (জুন, ২০০৯) ৯৩ পৃষ্ঠায় মে.জে. মীর শওকত আলী (বীর উত্তম) লিখেছেন, ‘চাকমা উপজাতিদের হয়ত আমরা সাহায্য পেতাম। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়।’ অন্যদিকে ১৯৭১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) এইচটি ইমাম তার বই ‘বাংলাদেশ সরকার-১৯৭১’-এর (মার্চ, ২০০৪) ২৬০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় প্রথম থেকেই নির্লিপ্ত এবং গোপনে পাকিস্তানীদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন।’
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক)-এর বই ‘মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের বীর উত্তম’ (ডিসেম্বর, ২০০৮)-এর ৬৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মার্চ মাসের প্রথম থেকেই রাজা ত্রিদিব রায় এবং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কোনো কারণে মুক্তিকামী বাঙালিদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন।’ ১৯৭১ সালে রাজাকার ত্রিদিব রায়ের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে বলাকা প্রকাশনী থেকে ২০১১ সালের একুশে বই মেলায় প্রকাশিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’ এর ৩৭৯-৩৮০ পৃষ্ঠায় গবেষক জামাল উদ্দিন লিখেছেন, ‘‘…অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাক দালাল খ্যাত চিহ্নিত এক উপজাতীয় নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) বিশ্বাসঘাতকতায় ওই দিনই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী রাঙ্গামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এ দলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাঙ্গামাটির আবদুল শুক্কুর, এসএম কামাল, শফিকুর রহমান, ইফতেখার, ইলিয়াস, অবদুল বারী, মো. মামুন ও আবুল কালাম আজাদ। ধৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র আবুল কালাম আজাদ ও ফুড ইন্সপেক্টর আবদুল বারী ছাড়া অন্যদের পাকবাহিনী নির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়ে মানিকছড়িতে নিয়ে হত্যা করে।’’ অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে ২০০৬ সালে প্রকাশিত শরদিন্দু শেখর চাকমা তার ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক বইয়ের ২৬-২৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘রাঙ্গামাটি মহকুমা সদরের এসডিও আবদুল আলী কয়েকজন মুুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে দুটি স্পিডবোটে করে মহালছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি আসেন। — স্পিডবোটে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এস এম কালাম, আবদুল শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, মামুন, সামসুল হক মাস্টার এবং রাঙ্গামাটি হাইস্কুলের তদানীন্তন হেডমাস্টার রহমান আলীর ছেলে ইফতেখার। — এর মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য আবদুল আলীকে রাঙ্গামাটিতে পুলিশ লাইনের এক ব্যারাকে আটক করে রেখে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড়ে দেয়া হয়েছিল। এরপর সেসব জায়গায় লবণ দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া তাকে একটি জিপের পেছনে বেঁধে টেনে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছিল।’ একই বইয়ের ৩০-৩১ পৃষ্ঠায় শরদিন্দু শেখর চাকমা লিখেছেন, ‘ আমি তাকে (রাজা ত্রিদিব রায়কে) বলি, আমার তো মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে এবং তার পক্ষে স্রোতের বিপরীতে যাওয়া ঠিক হয়নি। রাজা ত্রিদিব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে না, যদি ভারত পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে না পারে। আর ভারত পাকিস্তানকে পরাস্ত করতে পারবে না, কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে চীন এবং আমেরিকা রয়েছে। তারা কোনদিন পাকিস্তানকে ভারতের নিকট পরাজিত হতে দেবে না। রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি তিনি তখন পাকিস্তানিদের চেয়ে বেশি পাকিস্তানী হয়েছেন।’
‘ইফতেখার ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া প্রথম ব্যাচের সদস্য ছিলেন তিনি। তার বাবা যেহেতু রাঙ্গামাটি স্কুলের হেডমাস্টার, তাই রাঙ্গামাটি গিয়ে বাড়ির সবাইকে দেখবেন এবং যুদ্ধ করে তাদের মুক্ত করে আনবেন এমন ইচ্ছায় টগবগ করছিলেন তিনি।’ নিজের ছাত্র ইফতেখার সম্পর্কে ‘আমার একাত্তর’ (সাহিত্য প্রকাশন, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৪৮) বইতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এভাবেই স্মৃতিচারণ করেছেন। ত্রিদিব রায়দের সহায়তায় পাকিস্তানীরা পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আবদুর রবসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই হত্যা করেছে। যার অনেক প্রামাণ্য দলিল এখনো সংরক্ষিত আছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকায় ত্রিদিব রায়
রাজা ত্রিদিব রায় সম্পর্কিত বিভিন্ন দলিল ও গবেষণা পত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তায় মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে ওই বছরই ব্যাংকক প্রেরণ করে।
জাতিসংঘের ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত জেনারেল এসেম্বলীতে বাংলাদেশের সদস্য পদ প্রদানের প্রসঙ্গ আসলে পাকিস্তান সরকার-এর বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং করার জন্য ত্রিদিব রায়কে প্রধান করে এক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। বিষয়টি অনুধাবন করে ত্রিদিব রায়কে নিবৃত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ত্রিদিব রায়ের মাতা বিনীতা রায়কে এক প্রতিনিধি দলের সাথে জাতিসংঘে পাঠানো হয়। রাজ মাতা বিনীতা রায়সহ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল ত্রিদিব রায়কে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা না করে তার মাতৃভূমিতে ফিরে আসার আহ্বান জানালেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ত্রিদিব রায়ের লবিংয়ের কারণে চীন ভেটো প্রয়োগ করে, ফলে সেবার বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তানের পক্ষে তার এই সফলতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং তার মন্ত্রিসভা জাতিসংঘ ফেরত ত্রিদিব রায়কে ‘জাতীয় বীর’ খেতাব দিয়ে লাল গালিচা সংবর্ধনা প্রদান করে। ১৯৭২ সালের জাতিসংঘের মিশনে বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা পালন করেই ত্রিদিব রায় ক্ষান্ত হননি। বরং তিনি ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে, প্রবন্ধ লিখে, বই লিখে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। গত ২০০০ সালের ৪ অক্টোবর পাকিস্তানি ইংরেজী দৈনিক ডন পত্রিকায় ‘চিটাগং হিল ট্র্র্যাক্ট : লেট জাস্টিস বি ডান’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধ এবং ২০০৩ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ The Departed Melody তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। সোসাইটি ফর ন্যাশনাল রিসার্চ এন্ড প্রোগ্রেস (এসএনআরপি) কর্তৃক গত ১ নভেম্বর ২০১১ তারিখে মেঘনা প্রিন্টার্স, ঢাকা থেকে ‘প্রেক্ষাপট : পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়’ শীর্ষক প্রকাশিত এক গবেষণা পত্র থেকে জানা যায়, শুরু থেকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা চাকমা রাজপরিবারের সদস্যসহ বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাব সম্পন্ন অন্যদের মধ্যে কখনো প্রত্যক্ষ কখনো পরোক্ষভাবে যোগাযোগ ও সমন্বয়কের ভূমিকাও রক্ষা করেছেন ত্রিদিব রায়। যার পুরস্কার স্বরূপ ত্রিদিব রায় পাকিস্তানে আজীবন মন্ত্রিত্বের পদমর্যদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ফেডারেল মন্ত্রী, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত পর্যটন ও সংখ্যালঘু বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকার ৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত করে আর্জেন্টিনায় প্রেরণ, ১৯৯৫ সালের মে মাস থেকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় ‘এ্যাম্বাসেডর এ্যাট লার্জ’ হিসেবে নিয়োগ, ২ এপ্রিল ২০০৩ থেকে পাকিস্তানের দপ্তর বিহীন ফেডারেল মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
সার্কেল চীফ দেবাশীষ রায়
রাজা ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার কারণে ১৯৭২ সালে চাকমা সার্কেলের পরিচালক হিসেবে কুমার সুমিত রায়কে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ত্রিদিব রায়ের সন্তান দেবাশীষ রায় সাবালক হলে ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি চাকমা সার্কেল চিফ হিসেবে অভিষিক্ত হন। তিনি এখনো চিফের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ব্যক্তি জীবনে দেবাশীষ রায় একজন আইন ব্যবসায়ী। ১৯৯১ সালে প্রথমে ঢাকা জেলা আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং ১৯৯৮ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে কর্মরত আছেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (২০০৭-০৮) আমলে প্রধান উপদেষ্টার স্পেশাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
সোসাইটি ফর ন্যাশনাল রিসার্চ এন্ড প্রোগ্রেস (এসএনআরপি) কর্তৃক গত ১ নভেম্বর ২০১১ তারিখ ঢাকা, মেঘনা প্রিন্টার্স থেকে প্রকাশিত ‘প্রেবাপট: পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়’ শিরোনামের গবেষণাপত্রের তথ্য মতে ছাত্র জীবনে ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। শান্তিচুক্তির ফলে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযাগ সৃষ্টির প্রেক্ষিতে তিনি শান্তিচুক্তির পক্ষে অবস্থান নেন। চাকমা জাতীয়তাবাদের দৃঢ় সমর্থক দেবাশীষ রায় পার্বত্য অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনেরও অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে প্রতীয়মান। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তনচৈঙ্গ্যা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমী, চাক এবং খিয়াং -এ ১১টি জনগোষ্ঠীকে পার্বত্য চুক্তিতে উপজাতি হিসেবে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও সাঁওতাল, নেপালি, রোহিঙ্গা, গারো, মনিপুরি, কুকি, ভুটানী, আসামী, রিয়াং, সেন্দুজ নামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন পার্বত্যাঞ্চলে বসবাস করলেও তাদের স্বীকৃতির কোন উদ্যোগ আজো কোন পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়নি। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত এসব জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চাকমারা সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী (কোন কোন ক্ষেত্রে সমতলে বসবাসকারী দেশের মূল জনগোষ্ঠী বাঙালিদের চেয়েও বেশি সুবিধাভোগী) এবং প্রাধান্য বিস্তারকারী হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার বিবদমান তিনটি সংগঠনের মাধ্যমে সশস্ত্র তৎপরতার মূলেও চাকমারাই এককভাবে দায়ী। (যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর কিছু কিছু লোককে ব্যক্তিগত সুবিধা দিয়ে এসব সংগঠনে রেখে বা তাদের জড়িত করে সংগঠনের সার্বজনীনতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়ে থাকে।) তাই চাকমা সার্কেল চিফ হিসেবে ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের ওপর এসব সশস্ত্র জনগোষ্ঠীগুলোকে আলোচনার টেবিলে এনে সমস্যা সমাধানের পথ বের করার নৈতিক দায় কিছুটা হলেও বর্তায়। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক বিবেচনায় একজন সুবিধাবাদী শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব এবং একতরফাভাবে চাকমা রাজবংশের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত থাকায় সবসময়ই এসব ব্যাপারে নিরবতা পালন করে থাকেন। একই কারণে পাহাড়ে ইউপিডিএফ এবং জেএসএস এর মধ্যে ধারাবাহিক সংঘর্ষে অসহায় নারী-শিশুসহ সাধারণ পাহাড়ি নাগরিকগণ নিয়মিত চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুম এবং হত্যার শিকার হলেও তিনি কখনো এসবের বিরোধীতা করে জোড়ালো ভূমিকা রাখেন না। এমনকি তার পক্ষ থেকে পাহাড়ে বিবদমান দুই পক্ষের (বর্তমানে ইউপিডিএফ, জেএসএস-সন্তু লারমা এবং জেএসএস-এমএন লারমা এ তিন পক্ষের) সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধের বিষয়েও কখনো কোন উদ্যোগ নেয়ার নজির আজো দেখা যায়নি।
পাহাড়ে বিবদমান সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং পারস্পরিক হানাহানি বন্ধে কোন ধরণের ভূমিকা না নিলেও চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় এসব সংগঠনের তৎপরতার কারণে নিজের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ পেলে কৌশলে তা লুফে নিতে কার্পণ্য করেন না। বরং তিনি তার যথাযথ সদ্ব্যবহারে সক্রিয় থাকেন। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ১৯৯৭ সালে জেএসএস এর সাথে সরকারের আলোচনা শেষে শান্তিচুক্তি প্রণয়নকালে দেবাশীষ রায়ের কৌশলী তৎপরতা। শান্তিচুক্তির ‘খ’ খণ্ডের অনুচ্ছেদ ১২ এর মাধ্যমে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা আইনের ২৬ নং ধারায় বর্ণিত খাগড়াছড়ি ‘মং চীফ’ এর পরিবর্তে ‘মং সার্কেল চীফ এবং চাকমা সার্কেল চীফ’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করার কথা তিনি সর্বপ্রথম উল্লেখ করেন। যার ফলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার আইনে মং চীফ-এর স্বার্থহানি ঘটেছে এবং চাকমা সার্কেল চীফের প্রভাব বিস্তারের আইনি ভিত্তি তৈরি করেছে। একই সাথে রাঙ্গামাটিসহ খাগড়াছড়ির চাকমা অধ্যুষিত এলাকায় চাকমা সার্কেল চীফের প্রভাব বৃদ্ধি করেছে।
এছাড়াও বাঙালি বিদ্বেষী এবং চাকমা আধিপত্যে বিশ্বাসী দেবাশীষ রায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে নানা উপায়ে বাঙালিদের পার্বত্যাঞ্চল ছাড়া করার মত বৈরি পরিবেশ তৈরির অভিযোগও রয়েছে। আর একাজে পার্বত্য চট্টগ্রামের যে অঞ্চলে যে সংগঠনের প্রভাব রয়েছে সে অঞ্চলে তাদেরকেই ব্যবহার করে থাকেন তিনি।
দেবাশীষ রায়ে কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শুরু থেকেই দেশে-বিদেশে পার্বত্যাঞ্চলের প্রকৃত অবস্থা আড়াল করে নানা অপপ্রচারের মাধ্যমে বিশ্বজনমত গঠনে কাজ করছে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠন। এমনি একটি অপপ্রচার প্রসঙ্গে গত ১২ জুলাই ২০১১ তারিখে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক কলামে ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী লিখেছেন, ‘‘৮০’র দশকের শেষ দিকে একদিন বিবিসি বাংলা বিভাগে কাজ করছি। ইংরেজিতে পাঠানো সংবাদ কিছু কাটছাঁট করে বাংলায় অনুবাদের কাজ। একটু পরেই ট্রান্সমিশন। সামনে একটা আইটেম দেখে চমকে উঠলাম- ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবৎ আড়াই লাখ চাকমাকে বাঙালিরা হত্যা করেছে!’ তখন সম্ভবত পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের মোট সংখ্যাই ছিল আড়াই লাখ। আমাকেই ওটা সম্প্রচার করতে হবে! আর মাত্র ১০ মিনিট পর। ছুটে গেলাম পাশের রুমে, বিভাগীয় প্রধানের কাছে। পিটার ম্যানগোল্ড তখন বাংলা বিভাগের প্রধান। বললাম, ‘পিটার, এটা কোথা থেকে এসেছে? আড়াই লাখ চাকমা মেরে ফেললে তো সেখানে আর কোন চাকমা থাকে না। সমস্যাই খতম। তোমরা অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকায় যেমন করেছ।’ পিটার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সব্বোনাশ! হাতে একদম সময় নেই। হারি আপ! ওটা বাদ দিয়ে তুমি অন্য কোন আইটেম দিয়ে ট্রান্সমিশন শেষ করো।’
ট্রান্সমিশন শেষ হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সবাই বসলাম। পিটার আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘কিন্তু ওটা তো এসেছে খুব বড় জায়গা থেকে!’
জানলাম ওই দিনই সকালে বিবিসি বুশ হাউসের পাশের দালানে অবস্থিত একটি দূতাবাসে নেদারল্যান্ডস থেকে কয়েকজন এসেছিলেন একজন চাকমা ‘নেতা’কে সঙ্গে নিয়ে। তাদের প্রেস ব্রিফিং থেকেই এই ‘রিপোর্টে’র উৎপত্তি। এভাবেই চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণহত্যার নিরন্তর প্রচারণা।”
ড. ফেরদৌস আহমদের এ অভিজ্ঞতার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের গণহত্যা এবং অন্যান্য বিষয়ে অপপ্রচারের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। যার সাথে জড়িত রয়েছে দেশের এবং বিদেশের কিছু কুচক্রী মহল। ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের নামেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিরোধী প্রচারণার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানে বসবাসকারী তার পিতা রাজাকার ত্রিদিব রায় এবং তার অন্যান্য আত্মীয় স্বজন যারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছেন তারাও তাকে উৎসাহ ও নানাবিধ সহায়তা করে যাচ্ছেন। আমাদের পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে নানা কারণে আগ্রহী বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাধ্যমে অপপ্রচারে দেবাশীষ রায়ের সম্পৃক্ততা নিয়ে অনেক আগে থেকেই অভিযোগ ছিল। তবে ১৯৯২ সালে বিদেশ (তাইওয়ান) যাওয়ার প্রাক্কালে হজরত শাহ জালাল (রহ:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে) পার্বত্য চট্টগ্রামের পানছড়ির লোগাং-এ গত ১০ এপ্রিল ১৯৯২ তারিখে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ক্যাসেট, ছবি ও অনেক বিতর্কিত কাগজপত্র দেবাশীষ রায়ের নিকট হতে উদ্ধার করা হয়।
দেবাশীষ রায় ১৯৯৮ সালে ‘টংগ্যা’ নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৯৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে বাঙালি বিদ্বেষী ব্যক্তিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য এনজিওগুলোর সমন্বয়ে হিল ট্র্যাক্ট এনজিও ফোরাম (এইচটিএনএফ) নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। এর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি নিজেই। সংগঠনটির বাঙালি বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড এবং পাহাড়ে জাতিগত বৈষম্য তৈরিতে ভূমিকা রাখার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরবর্তীতে দেবাশীষ রায় একই উদ্দেশ্যে এএলআরডি নামে এইচটিএনএফ’র সদস্যদের নিয়ে নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। একইভাবে এইচটিএনএফ এর আদলে প্রতিষ্ঠা করা হয় এইচটিএনএন নামের আরো একটি সংগঠন। অভিযোগ রয়েছে, যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর ২০০৫ সালে নির্মিত ‘কর্ণফুলীর কান্না’ শীর্ষক একটি ডকুমেন্টারীর পৃষ্ঠপোষক এবং ডকুমেন্টারীতে অন্যতম বক্তা ছিলেন দেবাশীষ রায়। যা পরবর্তীতে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
দেবাশীষ রায়ের কিছু বিতর্কিত উদ্যোগ
দেবাশীষ রায় ডেনমার্ক ভিত্তিক বিতর্কিত উন্নয়ন সংস্থা ডানিডা’র সহায়তায় ইতোধ্যে ‘ম্যালেইয়া ফাউন্ডেশন’, নিবন্ধন নম্বর এস-৭২৫৩ (৪৪২) ০৭ নামের আরো একটি নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, ম্যালেইয়া ফাউন্ডেশন এর পৃষ্ঠপোষক ‘ডানিডা’ দেবাশীয় রায় কর্তৃক ইতিপূর্বেকার প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য সংগঠনেরও পৃষ্ঠপোষক ছিল। আর এই ডানিডা’র বিরুদ্ধে ইসলাম এবং মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকার অভিযোগ অনেক পুরোনো। তাই ম্যালেইয়া ফাউন্ডেশন এবং ডানিডা’র এই যুগসূত্রকে পার্বত্যাঞ্চলে মুসলিম এবং বাঙালি বিদ্বেষী একটা ষড়যন্ত্র হিসেবেই অনেকে বিবেচনা করছে।
অপর দিকে ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের কর্তৃত্ব হ্রাস করে নিজের প্রভাব বৃদ্ধিতে কৌশলী প্রচরাণা অব্যাহত রাখছেন বলেও অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন সেমিনারে দেয়া বক্তৃতা এবং পত্রপত্রিকায় লেখা নিবন্ধে পার্বত্যাঞ্চলে সরকারের কোন খাস জমি নেই বলে অপপ্রচার চালিয়ে থাকেন। তাছাড়া তিনি বাঙালিদের ‘সেটেলার’ বলে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে নিজেদের ‘আদিবাসী’ বলে পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি ও শাসন ব্যবস্থার উপর কর্তৃত্বারোপের পাঁয়তারা করছেন বলেও প্রতীয়মান। ইতোমধ্যে পার্বত্য শান্তিচুক্তি এবং চুক্তির আলোকে রচিত জেলাপরিষদ আইন ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনের মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলের তিনটি সার্কেল তথা চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল এবং মং সার্কেলের অধীন ভূমির উপর পাহাড়িদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে পার্বত্যাঞ্চলের এই তিনটি সার্কেলের সম্মিলিত ভূমির পরিমাণের চাইতে বেশি আয়তনের ভূমি বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে সংরক্ষিত বনানঞ্চল হিসাবে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ থেকেই সরকারের পরিচালনাধীন রয়েছে। আর পার্বত্যাঞ্চলের সশস্ত্র সংগঠনগুলো ইতিপূর্বে সরকারের সংরক্ষিত এ বনাঞ্চল নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথার কথা কখনো কোথাও বলেন নি। যার ফলে ১৯৯৭ সালে সাক্ষরিত শান্তিু চুক্তিতেও এসব বনাঞ্চলের বিষয়টি বিবেচনার বাইরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু দেবাশীষ রায় পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুযায়ী তিনটি সার্কেলের ভূমির উপর কর্তৃত্ব পেয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই তিনি ইতোমধ্যে সরকারি সংরক্ষিত এসব বনাঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অভিযোগ আছে, যে ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের চক্রান্তের কারণে দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্যাঞ্চলের সংরক্ষিত বনানঞ্চলের কোন উন্নয়ন করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারি বনানঞ্চলের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে না পারার কারণে বনবিভাগ সেই অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছে। সোসাইটি ফর ন্যাশনাল রিসার্চ এন্ড প্রোগ্রেস (এসএনআরপি) কর্তৃক গত ১ নভেম্বর ২০১১ তারিখ ঢাকা, মেঘনা প্রিন্টার্স থেকে প্রকাশিত ‘প্রেক্ষাপট: পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়’ শিরোনামের গবেষণাপত্রের তথ্য মতে, “পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যক সামনে রেখে তিন পার্বত্য জেলার ৩৬০০ হেক্টর সংরক্ষিত বনাঞ্চল, ২১০ হেক্টর ব্যক্তিগত ভূমি ব্লক প্ল্যানটেশন এর আওতায় এবং ৯০ কি.মি. রোডসাইড ভূমি স্ট্রিপ প্ল্যানটেশন এর আওতায় এনে ‘পার্বত্যাঞ্চলে অংশগ্রহণমূলক সামাজিক বনায়ন’ শীর্ষক ৫ বছর মেয়াদী (জুলাই ২০০৮ হতে ২০১৩ জুন পর্যন্ত) একটি প্রকল্প বিগত ২০০৮ সালের মাঝামাঝি দিকে অনুমোদন দেয়া হয়। বর্ণিত প্রকল্পের প্রাক্কালিত ব্যয় ধরা হয় ১৭ কোটি ৩৮ লক্ষ ৮৩ হাজার টাকা।
উল্লেখিত প্রকল্পটি সরকারের পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক অনুমোদন লাভের পর চূড়ান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবশে ও বন মন্ত্রণালয়ের বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের নিকট উপস্থাপন করা হয়। এ সময় তিনি (রাজা) অনুমোদন দেয়ার পূর্বে প্রধান বন সংরক্ষককে তার দফতরে তলব করেন এবং রাজা (ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়) তার নিকট জানতে চান যে, ‘তাকে না জানিয়ে কিভাবে এ ধরনের প্রকল্প পাশ করা হলো?’ এর জবাবে সিসিএফ জানান, ‘প্রকল্পটি তার (রাজা দেবাশীষ রায়) মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণের অনেক আগেই নেয়া হয়েছিল।’ তখন ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বেশ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সিসিএফকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘প্রকল্পের ধাপগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করুন।’ রাজা দেবাশীষ রায় এক পর্যায়ে সিসিএফকে বলেন, ‘এই প্রকল্পটি কি বাস্তবায়ন করতে পারবেন? সেরকম পরিবেশতো এখনও হয়নি।’ উল্লেখিত একই পন্থায় ব্যারিস্টা দেবাশীষ রায় গত ১২ জুলাই ২০০৮ তারিখে রাঙ্গামাটিতে অবস্থানকালীন বনবিভাগ, রাঙ্গামাটি সার্কেলের তৎকালীন বন সংরক্ষক (সিএফ) জনাব রতন কুমার মজুমদারকে তলব করেন এবং একইভাবে তাকেও জিজ্ঞাসা করেন, ‘কাজটি কি করতে পারবেন? উত্তর দিকে (রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা নির্দেশ করে) সমস্যা, দক্ষিণ দিকে (বান্দরবানের রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা নির্দেশ করে) করতে পারবেন?’ এক পর্যায়ে তিনি (রাজা) সিসিএফকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আপাততঃ প্রকল্পটি বন্ধ রাখেন’।”
বনবিভাগের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিকল্পিতভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার পাশাপাশি পার্বত্যাঞ্চলের বনবিভাগের উপর একছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ওই সময় বিদ্যমান বনজ দ্রব্য চলাচল আইন পরিবর্তন করে একটি খসড়া ‘বনজ দ্রব্য পরিবহন (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৮’ প্রণয়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিলেন। অন্যদিকে পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে বন বিভাগকে জেলা পরিষদে হস্থান্তরের কথা না থাকলেও রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর এই সংরক্ষিত বনাঞ্চল জেলা পরিষদে হস্তান্তরের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়নসহযোগীদের সাথে দেখা করে পার্বত্যাঞ্চলের যেসব উন্নয়ন কর্মে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব নয় সে সব উন্নয়ন কর্মে সহায়তা না দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বাধাগ্রস্থ করেছেন বলেও দেবাশীষ রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। এছাড়াও দেবাশীষ রায়ের বিরুদ্ধে ‘আদিবাসী’ ইস্যুসহ নানা বিষয়ে অপপ্রচার এবং পার্বত্যাঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডকে বাঁধাগ্রস্থ করার অভিযোগ বরাবরই ছিল।
ইতোমধ্যে দেবাশীষ রায় বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত চাকমাদের মধ্যে নিজের কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ না রেখে বরং তা ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, অরুনাচল, মেঘালয় ও মিজোরামে বসবাসরত চাকমাদের সাথে সম্মিলিতভাবে বৃহত্তর শক্তির জন্ম দিতে কাজ করে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ আছে। একাধিকবার সফর করে ভারতের উক্ত পাঁচটি রাজ্যে বসবাসরত চাকমাদের যৌথ সংগঠন ‘চাকমা অটোনামাস ডিস্ট্রিক কাউন্সিল (সিএডিসি)’ এর সাথে সংস্কৃতিক ও ভাবের আদান-প্রদানের নামে দেবাশীষ রায় ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনা করছেন বলেও তথ্য রয়েছে ‘প্রেক্ষাপট: পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে।
সাধারণ পাহাড়িদের শিক্ষা লাভে বাধা
বৃটিশ আমল থেকেই সরকারগুলো ধারাবাহিকভাবে পার্বত্যাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে বাধার সন্মুখীন হয়ে এসেছে। প্রথম দিকে বৃটিশরা তাদের শাসন কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে কিছুসংখ্যক পাহাড়িকে শিক্ষিত করার উদ্যোগ নিয়ে চাকমা রাজপরিবার কেন্দ্রিক অভিজাতদের বাধার মুখে পড়ে। ফলে তারা এটা শুধু মাত্র অভিজাত পাহাড়িদের মধ্য সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়। ইতিহাসের চরম সত্য হলো বৃটিশরা ১৯৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা দান চালু করেও এই পাহাড়ি নেতাদের আন্দোলনের কারণেই তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। একইভাবে রাঙ্গামাটি হাই স্কুলও সাধারণ পাহাড়িদের শিক্ষিত করার ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি বরং বর্তমান চাকমা সার্কেল চীফের পূর্ব পুরুষ ভূবন মোহন রায়কে শিক্ষিত করার জন্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৮৯০ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাঙ্গামাটি কলেজ। কিন্তু এটি স্থাপনও সহজ কাজ ছিল না। কারণ তৎকালীন চাকমা সার্কেল চীফ ত্রিদিব রায় রাঙ্গামাটিতে কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি শুধু বিরোধীতা করেই ক্ষান্ত হননি বরং এটি যাতে কোনভাবেই বাস্তবায়িত হতে না পারে সে চেষ্টাও রেছিলেন। এর জন্য তিনি প্রথমে ঢাকার রাজস্ব বোর্ডের সদস্য এস এম হাসানের কাছে এবং পরবর্তীতে তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার করিম ইকবালের কাছে চিঠি লিখে রাঙ্গামাটিতে কলেজ স্থাপনের প্রয়োজন না থাকা সত্বেও তার জমি (যদিও জায়গাটি চীফের জন্য নির্ধারিত জমির মধ্যে ছিল না) জোর করে নিয়ে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার সিদ্দিকুর রহমানের দৃঢ়তায় শেষ পর্যন্ত কলেজটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাধারণ পাহাড়িদের শিক্ষিত করে সচেতন নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ নেন জেনারেল জিয়া। জেনারেল জিয়ার সভাপতিত্বে ১৯৭৬ সালের ২৫ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনা হয়। এ সভায় উপজাতীয়ছাত্রছাত্রীদের জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা বরাদ্দ এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি প্রদানের সিদ্ধন্ত গৃহীত হয়। এর আলোকে ১৯৭৮ সালে বৈদেশিক বৃত্তি প্রদানের জন্য উপজাতীয়দের মধ্য থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হলে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা চাকমারাজ মাতা বিনীতারায় ৭ জনের একটি লিস্ট জমা দেন। এই ৭ জনের প্রত্যেকেই ছিলেন চাকমা রাজপরিবারের সদস্য। কিন্তু যোগ্য এবং সাধারণ উপজাতীয়দের বাদ দিয়ে এই লিস্ট জমা দেয়ার কারণে রাজমাতার একান্ত সচিব শরদিন্দু শেখর চাকমা এর বিরোধীতা করেন। কিন্তু রাজ মাতা বিনীতা রায় তার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় শরদিন্দু শেখর চাকমা তার একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে অন্যত্র বদলির আবেদন করেন। চাকমা রাজপরিবার কর্তৃক সাধারণ পাহাড়িদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের পথে অন্তরায় সৃষ্টির আরো অনেক নির্মম ইতিহাস পাওয়া যাবে অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে ২০০২ সালে প্রকাশিত শরদিন্দু শেখর চাকমার আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আমার জীবন (প্রথম খন্ড)’ এর পাতায় পাতায়।
ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার
বিরাজ মোহন দেওয়ান বিরচিত ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ (২০০৫)-এর প্রকাশের সময় বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় অভিমত দিয়েছেন, যা বইটির শুরুতেই গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়েছে। দেবাশীষ রায়ের লিখিত অভিমতটির তৃতীয় প্যারাতে আছে, ‘ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি চাকমারা একদিন একটি স্বাধীন জাতি ছিল এবং বৃটিশদের আগমনের প্রাক্কালে পার্বত্য অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থায় মোঘল সাম্রাজ্যের কোন সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল না। ক্রমে চাকমাদের মূল আবাসভূমি পার্বত্য অঞ্চলটিকে বৃটিশ শাসনাধীন একটি জেলাতে পরিণত করা হয়। বর্তমানে চাকমারা মূলত রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে বসবাস করে। তবে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যক চাকমা বার্মা, ভারতের অরুণাচল, মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বসবাস করেন।’
দেবাশীষ রায় এখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। বিষয়গুলো হলো- ১) চাকমারা একদিন স্বাধীন জাতি ছিল, ২) বৃটিশদের আগমনের প্রাক্কালে পার্বত্য অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থায় মোগল সাম্রাজ্যের কোন সরাসরি হস্থক্ষেপ ছিল না এবং ৩) ক্রমে চাকমাদের মূল আবাসভূমি পার্বত্য অঞ্চলটিকে বৃটিশ শাসনাধীন একটি জেলাতে পরিণত করা হয়।
প্রথমত, বার্মা কিংবা অন্য কোন অঞ্চলে চাকমারা স্বাধীন জাতি হিসেবে ছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও গবেষক জামাল উদ্দিনের গবেষণায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলে কখনোই স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল না। তাছাড়া চাকমাদের মধ্যে কখনো কেউ এই অঞ্চলে রাজত্ব করা তো দূরের কথা এই অঞ্চলে তাদের মধ্যে কেউ জমিদারীও করেনি। দ্বিতীয়ত, বৃটিশদের আগমনের প্রাক্কালে এই অঞ্চলের জমিদারী মোগলদের হাতেই ছিল। তৃতীয়ত, মোগল পরিবারে জমিদারীর প্রকৃত হকদার হোসেন খাঁকে বঞ্চিত করার জন্য এই পরিবারের একটি পক্ষই বৃটিশদের ডেকে এনে এই অঞ্চকে তাদের শাসনাধীনে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছিল। দেবাশীষ রায় একজন উচ্চ শিক্ষিত এবং রাজপরিবারের উত্তরাধিকার হিসেবে এইসবের কিছুই জানেন না, এটা ভাবা বোকামীই হবে। আর তিনি যে ইতিহাস পাঠের কথা উল্লেখ করেছেন, তাও রচিত হয়েছিল চাকমা রাজপরিবারের অন্দর মহলের তত্ত্বাবধানেই। তাই শুধু ইতিহাস পাঠের দোহাই দিয়ে সত্যকে আড়াল করাও ধোপে টেকে না। কেননা যে জমিদারী নিয়ে শতাধিক বছর ধরে প্রতিপক্ষের সাথে মামলা-মোকদ্দমা চলেছে, চলেছে যুদ্ধ-বিগ্রহও সেসবের কিছুই তিনি জানেন না এটা ভাবার কোন যুক্তি নেই। তাই ধরে নিতে হবে যে তিনি জেনে শুনেই প্রকৃত ইতিহাসকে গোপন করে উপরোক্ত মিথ্যাচার করেছেন। আর এই মিথ্যাচারের জন্য তিনি একা দায়ীও নন, পূর্ব পুরুষ ভুবন মোহন রায়ের সময় থেকে ইতিহাস নিয়ে যে মিথ্যার অবতারণা করা হয়েছিল অধস্তন পুরুষ হিসেবে ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় তার প্রতিধ্বনিই করেছেন মাত্র।
উপসংহার
চাকমা রাজবংশের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিনের মিথ্যাচার, ত্রিদিব রায় ও তার আত্মীযস্বজনদের বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা এবং বর্তমান রাজার বিভিন্ন কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করলে দেবাশীষ রায়ের অভিলাষ সম্পর্কে ধারণা করা কারো পক্ষে অসম্ভব কিছু না। তাই বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই ভাবতে হবে এবং সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া ইংরেজ এবং তৎকালীন প্রভাবশালী হিন্দুদের কারসাজিতে জমিদারীর প্রকৃত হকদার হোসেন খাঁ (মীর্জা হোসেন) কে বঞ্চিত করে দেয়া ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের রায়কে পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকলে সেব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়ার দাবী রাখে। আর চাকমা রাজপরিবারের গোপন করা ইতিহাস ঘেঁটে এটা করতে পারলে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চাকমা জাতি এবং চাকমা রাজবংশের প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটনের পাশাপাশি ঐতিহাসিক একটা অন্যায়ের সুরাহাও সম্ভব হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
Who are “indigenous peoples” and “settlers” in CHT?
Who are the “indigenous peoples” (the first peoples) of CHT–Jummas or non-Jummas (Bengali Muslims and others)? The easiest and the most scientific answer to this question is found in the census report/demographic statistics of this region. During the partition of the Indian Sub-continent in 1947, the ratio of Jumma and non-Jumma population of CHT was 98:2, that is out of every 100 persons 98 were Jummas and 2 were non-Jummas. There was not even a single non-Jumma (permanent resident) in CHT when the region was brought under the British colonial rule in 1860. Therefore, who are the indigenous peoples of CHT? The answer is the Jummas. For this very reason, Bengali Muslims of CHT are called “settlers”.
পার্বত্য চট্টগ্রামে কারা “আদিবাসী” আর কারা “স্যাটলার”?
পার্বত্য চট্টগ্রামে “আদিবাসী” (প্রথম যারা এই এলাকায় বসবাস করতে শুরু করেছিল) কারা–জুম্ম না মুসলিম বাঙ্গালী? এই প্রশ্নের সবচেয়ে সহজ ও সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত উত্তর পাওয়া যায় এই এলাকার জনসংখ্যা সংক্রান্ত তথ্যে। 1947 সালে এই এলাকার জুম্ম ও অজুম্ম (মুসলিম ও অন্যান্য) জনসংখ্যার অনুপাত ছিল 98:2, অর্থাৎ প্রতি 100 জনের মধ্যে জুম্ম ছিল 98 জন আর অজুম্ম 2 জন। 1860 সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম যখন ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের অধীনে আনা হয় তখন এই এলাকায় একজনও অজুম্ম ছিলনা। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী কারা? উত্তর হোল জুম্মরা। এই জন্যই পার্বত্য চট্টগ্রামের মুসলিম বাঙ্গালীদেরকে “স্যাটলার” বলা হয়।
We (Jummas) are “indigenous peoples” and they (Bengali Muslims) are “settlers” in CHT.
Sub-continent: Historical Timeline
1. Vedic (Hindu) period: 1500 BCE – 6th century BCE.
2. The Buddha was born in 563 BCE.
3. Buddhist period: 6th century BCE – 12th century CE.
4. Muhammad founded Islam in the 8th century CE in Arab and his army (‘jehadis’) invaded the Sub-continent (Afghanistan, Pakistan, India and Bangladesh together) from the 9th century CE to the 13th century CE and founded Mughal Empire in parts of the Sub-continent and forcibly converted Buddhists and Hindus to Islam. The Mughal Empire collapsed with the defeat of Sirajudollah, Nawab of Bengal, to the East India Company (the British) at the Battle of Palasi in 1757. There is no more surviving Mughal in the Sub-continent except their ruins.
Bengali Muslims of Bangladesh are decedents of Buddhist and Hindu population of the Sub-continent with kamar (iron tool-making), (pottery-making), chamar (shoe-making), dom (fishing) etc professions. They were forcibly converted into Islam and made subjects of the Mughal Empire. They have nothing to do with the Mughal line of blood. So the history of the Bengali Muslims cannot be linked with the Mughals.
One does not need to be an intelligent person or a great historian to understand the answer to the question: who are the sons of soil or indigenous peoples in CHT? The easiest and the most scientific answer to this question is found in the census report/demographic statistics of this region. During the partition of the Indian Sub-continent in 1947, the ratio of Jumma and non-Jumma population of CHT was 98:2, that is out of every 100 persons 98 were Jummas and 2 were non-Jummas. There was not even a single non-Jumma (permanent resident) in CHT when the region was brought under the British colonial rule in 1860. There is no archaeological or literary evidence or otherwise that suggests the presence of Bengali Muslims in Chittagong Hill Tracts before 1750. While the Jummas have been living in greater Chittagong Hill Tracts (CHT, Chittagong and Cox’s Bazaar together) since 7th century CE. Therefore, who are the indigenous peoples of CHT? The answer is the Jummas.
ধর্ম ও সভ্যতা
ব্রাহ্মনধর্ম (আজকাল যাকে ‘হিন্দুধর্ম’ বলা হয়) হোল ভারতবর্ষে প্রথম প্রতিষ্ঠিত প্রাতিস্থানিক ধর্ম। ভারতবর্ষে এই ধর্মের প্রভাব খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১৫০০ বছর থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ বছর পয্যন্ত লক্ষ্য করা যায়। বুদ্ধ (৫৬৩-৪৮৩ খ্রিস্ট পূর্ব) তাঁর ধর্ম প্রচারের ফলে এই ধর্মের প্রভাব সমাজে অনেকটা নিস্প্রভ হয়ে পড়ে। শুরু হয় ভারতবর্ষে সামাজিক বিপ্লব ও বৌদ্ধ সভ্যতা।
বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের জন্ম (নেপালের লুম্বিনি উদ্যান) যীশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৫০০ বছর আগে, অর্থাৎ আজ থেকে (২০১৩ + ৫০০=) ২৫১৩ বছর আগে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন হয়।
খ্রিস্টানধর্মের প্রবর্তক যীশু খ্রিস্টের জন্ম (বর্তমান ইসরাইলের বেথ্যালহেম শহর) হয়েছিল আজ থেকে ২০১৩ বছর আগে, অর্থাৎ আজ থেকে ২০১৩ বছর আগে খ্রিস্টানধর্মের প্রবর্তন হয়।
ইসলামধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহম্মদের জন্ম (বর্তমান আরবের মক্কা শহর) যীশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর পরে, অর্থাৎ আজ থেকে (২০১৩–৬০০=) ১৪১৩ বছর আগে ইসলামধর্মের প্রবর্তন হয়। অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মের (২৫১৩–১৪১৩=) ১১০০বছর পরে ইসলামধর্মের আবির্ভাব হয়।
যীশু খ্রিস্টের জুন্মের ৫০০ বছর আগ থেকে ১২০০ শতাব্দী পয্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ১৭০০ বছর (কম সময় নয়) ছিল ভারতবর্ষে বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিহাস। এই সময় ভারতবর্ষের (বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল বৌদ্ধ। হিন্দু ও জৈনরা ছিলেন ধর্মীয় সংখ্যালগু। এখানে একজন মুসলিমও ছিলনা। ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্ম মধ্য এশিয়া (বর্তমান আফগানিস্থান, উজবেকস্থান, কাজাকস্থান, দক্ষিন রাশিয়া, মধ্য প্রাচ্যের কিছু দেশ–যেমন ইরাক, ইরান, সিরিয়া ইত্যাদি), পূর্ব ইউরোপ, তিব্বত, চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, যাবা, সুমাত্রা ও বর্ণীয়ও দ্বীপপুঞ্জ (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া ও মালএশিয়া), বার্মা ও শ্রীলঙ্কায় বিস্তার লাভ করে। এর পেছনে সবচেয়ে বেশী কাজ করেছিলেন সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী) এবং অগণিত শান্ত ও সোম্য বৌদ্ধভিক্ষু ও পণ্ডিত। এই ধর্ম প্যৃথিবীর যেদিকে গেছে সেদিকে মানুষকে সভ্য করে তুলেছে, দিয়েছে শান্তি, মৈত্রী, করুণা, প্রেম ও প্রজ্ঞার আশ্বাস এবং সঠিক জীবনের অর্থ।
১২০০ সালে বখতিয়ার খিলজি বর্তমান বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ভারতবর্ষে প্রকৃত মুসলিম সাম্রাজ্য। আরব দুনিয়া থেকে মুহম্মদের আর্মি “এক হাতে তলোয়ার এক হাতে কোরান” নিয়ে এসে জেহাদ (অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ) করতে করতে বর্তমান আফগান্তিস্থান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ আক্রমণ করে বেদখল করে নেয়। বৌদ্ধ, হিন্দু ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের গণহত্যা করে। কেও মারা গেল, কেও পালিয়ে গেল আর যারা বাকী ছিল তাদেরকে জোরপূর্বক ইসলামধর্মে ধর্মান্তরিত করল। নয়তলা এবং ৩০০০ বৌদ্ধ শিক্ষক ও ছাত্র বিশিষ্ট বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দাসহ, বিক্রমশীলা, তক্ষশীলা এবং ভারতবর্ষের সমস্ত বৌদ্ধ মন্দির, শিক্ষা প্রতিস্থান, শিল্পকলা, কারুকায্য ও সভ্যতা ধ্বংস করে দিল। কথিত আছে তাদের আক্রমনে বৌদ্ধধর্মের এত ক্ষতি হয়েছিল যে ভারতবর্ষের মাটীতে বৌদ্ধধর্মের একটা পুস্তকও পাওয়া যায়নি; আজকাল আমরা বৌদ্ধধর্মের যে বই পড়ছি সেগুলো সব তিব্বতী, চীনী, সিংহলী ভাষা থেকে প্রথমে ইংরেজি ও পরে অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা গ্রন্থ থেকে পড়ছি। আজকাল আফগানিস্থান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে যারা নিজেদেরকে ‘মুসলিম’ বলে পরিচয় দিচ্ছে তাদের পূর্বসুরীরা সবাই বৌদ্ধ বা হিন্দু বা জৈন ছিলেন। আজকাল বাংলাদেশের মুসলিমরা যে ভাষায় কথা বলছেন ও যে লিপিতে লেখা লেখছেন তার উৎস হোল তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মীয়গুরু দ্বারা লিখিত ও ভাষিত চর্যাপদ (১০ম শতাব্দী)…পাহাড়পুর, পণ্ডিত বিহার, ময়নামতি সব বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন। আজ তারা ইসলামের কুপ্রভাবে—ধর্মীয় গোঁড়ামির কারনে–তাদের জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার উৎস ভুলে গেছেন—জানেন না বা জানলেও তা অস্বীকার করেন! বর্তমান যুগে ধর্মীয় নিয়ম দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা হয়না। কিন্তু তারা এখনও তাই করছেন! এখনও সেই মধ্যযুগীয় জেহাদ ও বর্বরতা!এটাই তাদের সঙ্গে অন্যান্য সভ্য সমাজের সমস্যার মূল কারণ। তারা পৃথিবীতে একটা অদ্ভুত স্পেসিস! অন্যান্য সমাজ ও সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা!
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে মুসলিম সাম্রাজ্যবাদ খ্রিস্টান (ব্রিটিশ) সাম্রাজ্যবাদের কাছে পরাজিত হয়। অর্থাৎ প্রায় ৫০০ বছর পর ভারতবর্ষে মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের অবসান হয়। ভালই হয়েছে। কারণ খ্রিস্টান সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষে না আসলে আজ সেখানে কোন বৌদ্ধ, হিন্দু ও জৈন সভ্যতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেতনা; খ্রিস্টান সাম্রাজ্যবাদের কারনে বৌদ্ধ, হিন্দু ও জৈন ধর্মাবলম্বী জনতা ও তাদের সভ্যতা মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের জেহাদ থেকে রক্ষা পেল, যেমনটি খ্রিস্টান সাম্রাজ্যবাদের মানবতা বা মানবাধিকার আইনের কারনে জুম্মরা পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের কড়াল গ্রাস বা জেহাদ থেকে রক্ষা পেয়ে আসছে।
খ্রিস্টান (ব্রিটিশ) সাম্রাজ্যবাদের সময় (১৭৫৭-১৯৪৭) মোটামুটি ১৮৮০–১৯৪০ সালের মধ্যে পুরাতত্ত্ব ও ভারততত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম, জেমস প্রিঞ্চেপ, রিডস ডেভিড (স্বামী-স্রী যারা লন্ডনে “পালি টেক্সট সোসাইটি” স্থাপনা করে পুরো ত্রিপক ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করেন),এডউইন আরলন্ড (‘The Light of Asia’-র লেখক যার কাব্যগ্রন্থ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে “গীতাঞ্জলী লেখতে অনুপ্রেরণা যোগায়), ওলডেনবাগ, মাক্সমুলার, উইন্টারননিজ, লা ভিলা পুসিন, সেল্ভিন লেল্ভি, এইচ কার্ন, স্পেঞ্চ হার্ডি, পল চারুস (খ্রিস্টান ফাডার), ফাসবল, শ্রীলঙ্কার অনাগারিক ধর্মপাল, বাংলার রাজেন্দ্রালাল মিত্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহারাষ্ট্রের আম্বেদকর প্রমুখ মনিষীগণ না হলে আজও বুদ্ধধর্ম তার জন্ম ও কর্মভুমি ভারতবর্ষের ধ্বংসস্তূপে শায়িত থাকতো–পুনরাবির্ভাব হতে পারত না। তারা না হলে আজ আমরা লুম্বিনি, বুদ্ধগয়া, সারনাথ, কুশিনগর, সাচিস্তূপ, অজন্তা-এলোরা ইত্যাদি কি এবং কোথায় কিছুই জানতাম না। হলিউড ও অনেক হলিউড তারকারা না হলে আজ বৌদ্ধধর্ম এত পশ্চিমাদেশে জনপ্রিয় হতো না। আজ পশ্চিমে যারা খ্রিস্টান তারা নতুন করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করছেন।
বস্তুতঃ খ্রিস্টান হৃদয় খুব উন্মুক্ত, উদার ও মানবিক। এই হৃদয় শুধু শাসন-শোষণ করেনা–কিভাবে সভ্য হতে হয় ও সভ্য শাসন কায়েম করতে হয় তাও শেখায়। তারা পৃথিবীর যেদিকে গেছে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে এবং মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছে–যেমন হংকং (প্রাক্তন ব্রিটিশ কলোনি), মেকাউ (প্রাক্তন পরতুগিস কলোনি), প্রেসিডেঞ্চি কলেজ (কলকাতা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমান ভারত-বাংলাদেশ রেল যোগাযোগ ব্যাবস্থা, আইন-ব্যাবস্থা ইত্যাদি। তাই তারা আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে উন্নত, উদার, মুক্ত, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুজাতিক সমাজ। মুসলিম সমাজ আমাদেরকে কি শিখাচ্ছে আর কি দিচ্ছে? শুধু গনহত্যা, নারীধর্ষণ, ভূমি-বেদখল ও জেহাদি শিক্ষা।
Apnar Lekhar Sathe Ekmot Hote Parlam NA. Apni Islam Somporke Ja Janen Bhul Janen. Kono Dhormo Somporke Kisu Bolte Hole Sei Dhormoke Age Bhalo Kore Jante hoy. Na hole Bolata Asar Hoy. Apnar Prati Anurudh Bhalo Kore Na Jene Montobbo Likha Sudhu BOKARAI Kore.
You are a paid agent. You see what we were before Islam. We were the slave under the caste system of Hinduism. We are tortured in every field. Islam showed the path of living as a human being. Buddhism came in response to the oppression but did not withstand due its own fault.You are talking and favouring your illegal father of East India Company. Yes you can find many similarities among them due to your blood but all Indians know what they were and their devil activities. On Islam, a fool can not comment because it is too high for imagination.
History of Chittagong
Historically, Chittagong and Cox’s Bazaar belong to the Jumma people. Places like Chakmakul, Rajanagar, Ranirhat etc and ruins of Buddhist temples, like Pandit Vihara still witness to this fact. Pandit Vihara of Chittagong flourished in the 10th century AD was a great seat of Tantrik Buddhist learning. Many Chakma Raulis or Luris (tantrik priests) are believed to have lived in this temple.
Chittagong was conquered by an Indian origin Buddhist king of Arakan (Myanmar), Sola Sinha Chandra, in 953 AD [Ahidul Alam, 1982, p.2]. In order to commemorate his victory over the region, he erected a pillar inscribed with these words: “chit-tou-goung”, i.e. a place gained by war [Natun Chandra Barua, 1986, p. 29], the name that has given birth to what is now called “Chittagong”. According to Mahbabul Ul-Alam, “chit-tou-goung” means “it is unfair to fight”. Chittagong went to the control of the king of Tripura, Dhanya Manikya, in the 15th century AD (Kaliprasanna Sen, 1336 Tripura Era, P. 32). The Arakanese king again took over the region from the Tripura king in the same century. The Portuguese’s control over the region in the 16th century was short-lived. Chittagong became a part of the Mughal Empire in 1666 when the Nawab of Bengal, Shaista Khan, invaded it. This was the very period when Jummas of Chittagong started moving towards Chittagong Hill Tracts to avoid the atrocities of the Mughal ruler and the famous Chakma ballad “Chadigang Chhara Pala” [Migration (of Jummas) from Chittagong] was composed. Chittagong Hill Tracts was never a part of the Mughal Empire for its geographical and strategic advantages. The British colonized Chittagong and Chittagong Hill Tracts respectively in 1760 and 1860 following the defeat of Nawab Sirajuddaula of Bengal at the Palasi Battle in 1757.
You may remember in the recent past, the Bangladesh delegation at the UN was rebuked and disgraced for making a self-embarrassing attempt to come up with a unilateral definition of “indigenous peoples”. Bengali Muslim writers have been trying to distort the history of CHT. While doing so, they identify Bengali Muslim settlers to be “son of soil” or “indigenous people” and the Jumma indigenous people to be migrants from Arakan, Myanmar in the region. They do not know Chittagong and Cox’s Bazaar too, historically, belong to the Jumma people or to the kings of Arakan, Myanmar. What they say “history” (of CHT) is not at all history in the true sense of the term but raping of the history. It is an academic conspiracy to indoctrinate and legitimize Bangladeshi brutal colonial regime and jehad against the Jumma indigenous people.
Muslim Bengalis should know that before the 12th century CE there was not even a single Muslim in the Indian Sub-continent. The ancestors Bengali Muslims were either Buddhists or lower caste Hindus during the Buddhist period (6 century BCE – 12th century CE) in the Sun-continent. They were forcefully converted to Islam by the jehadis of Muhammad of Arab in the 13th century when they arrived here.
The total population of Bangladesh were about 7 crore, including 30% non-Muslims, in 1971; now the figure has gone up 18 crore within 41 years—an increase of 11 crore in 41 years! With polygamy and illiteracy, they turned out to be a man-producing factory! In the light of this fact, I assume, as there is no demographic data, the total population of Bengali Muslims of what was then called “Bengal”, including parts of what is now called West Bengal, would have not been more than 50-60 lakh in 1860—153 years ago from today. They were basically concentrated in Dhaka, Murshibadbad and its peripheries. Control of Buddhist Chittagong went from the kings of Arakan to the Nawab of Bengal in 1666. It was only from that time Bengali Muslims started moving towards Chittagong and Cox’s Bazaar hitherto populated by mostly the Chakmas and the Maramas. That is why historically, Chittagong and Cox’s Bazaar belong to the Jummas or to the kings of Arakan. So I will not wonder if Myanmar reclaims Chittagong and Cox’s Bazaar as their territories from Bangladesh sometime in future.
Dada, comment choto diyen. Ta na hoile poron jaina. Ar boro korite chaile pora likhi kori ekta rochona upload kori felen.Amra sobai upokrit hoyam:-)
জামাতি বাঙালরা চাকমাদের বদলে দিতে চায় ,ক্রেডিট নিতে চায় যে চাকমারা মুসলমান মোগলদের বংশধর ! আরে ছাগল বেশি মেহে মে করছ ক্যান ?আমি বলব মোগলরাই চাকমাদের বংশধর বিশ্বাস না হলে মোগলের জন্মদাতা চেঙ্গিস খান আর কুবলাই খানের চেহেরা ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলান দেখতে তাঁরা চাকমার মত না বাঙালদের মত ! তোরা ইতিহাস পাল্টিয়ে চাকমাদের মুসলমান হিসাবে প্রমান করতে পারলে কি নাফ্ফি ,শুয়োর খাওয়া রোধ করতে পারবে ?উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমন কত ক্রিস্টাব্দে আর বাঙালিকে কোন দেন্ডা কোরান শিখাইছে সেই হিসাবটা আগে কর ! তার পর অন্যের ইরিহাস তুইল্যা ধরিছ !
Mogolra jokhon ekhae ase sathey female chilona, dada ei kotha vule gechen. Ar juddhey here jokhon Suzar bahini ei onchole agomon kore tokhon female niye asa jouiktik o na. Tahole tara ki koreche dadara……….deken giye apander kotojon mughal der moto dekhte. Are etihaser kicchu janen na. Mughal der title ekhono namer sese jure anonde pulokito hote ektuo charen na….onek sikhte hobe dada…..etihase ekdom sishuuuu apniii
Gobeshok, Pak-Bharot Etihash Prokolpo
আসলে মূল সমস্যাটা হচ্ছে–জেহাদীরা পৃথিবীর যেদিকে গেছেন সেইদিকে রক্তপাত ঘটেছে। তারা রক্তপাতের মাধ্যমে অন্যান্য অমুসলিম সমাজের সব ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকৃত ও ধ্বংস করে দিয়েছেন। ধর্মান্ধ বলে তারা আইনও মানেনা, মানবতাও বুঝেনা, সভ্যতাও চিনেনা।
Ekdom Vul….sekhanei shanti borshito hoyechey. peace tv dekhen protydin koto manus islam dhorme dikkhito hocchey.
Dekhte Paschi-to Pakistan, Afghanistan, Syria, Egypt…Sobkhane-i Shanti Borshito Hosche..Aar CHT-te Shanti-r Phool Phutaschen aapnara..
kusilob bai
Asole “Shanti” artu ta ki Islam dristi te kemo. at ki sababik babe amra Shanti bolte jeta busi tar teke anno?
I mean, what is “Peace” (shanti)in the eyes of Islam. Dose it different from general meaning of Peace?
জেগেউঠ হে বাংলার অধিপতি !
হে বাংলার অধিপতি !
সুনতে কি পাও আরাকানে বাঙালীদের আকুতি ?
ভরে গেছে সীমান্তে লাশের গন্ধে,
আরাকানের আকাশে আজ নেমেছে সন্ধে ,
অগ্নিদগ্ধ চার দিক ,
কোন দিকে যাবে ওরা পাচ্ছেনা ঠিক ।
অসহায় শিশু, মুমূর্স নর নারী ,
আসছে তোমারি সাহায্যের পানে দিয়ে পায়ে চারি ।
অতি সহজেই সবে জেতে চায় জান্না ,
কে সুনে হায় সন-ভ্রম হারানো মা বোনের কান্না !
দোহাই আল্লাহ্র ! দেখ তুমি একবার ফিরে !
মায়া ভরা লাখো মুখ নাফ নদীর তিরে ।
নিজ দেশে আজ ওরা প্রবাসী ,
বাংলার তরে প্রাণ দিয়ে গেলো হাসি ,
সুধু তোমাকে ফিরিয়ে দিতে বাংলার আরাকান ।
ওরা বির, ওদের তুমি করো সম্মান ।
খুলে দাও সীমান্ত !
আরাকান চিরকাল বাংলার প্রান্ত ।
শান্তির দূত পাঠিয়ে বন্ধ কর আজি এ দাঙ্গা ।
আমরা সবে ভাই ভাই বাঙালি, রাখাইন, রোহিঙ্গা ।
দস্যুর হাত থেকে তুরুস্ক রক্ষা করেছে সাইপ্রাছ
জিবন দিয়ে সমাধি গড়েছে আর্জেন্টিনীয়ান তবু ছেরে জায়নি মালভিনাছ
তাই আজই বঙ্গোপসাগরে তরি ভাসিয়ে চলো দক্ষিণ পূর্বে নির্ভয়ে !
পদাতিক তুমি চল ককসেসবাজার আর বান্দরবন দিয়ে আরাকান হিমালয়ে !
বার্মাতে গিয়ে বল সুধু আরাকান বাসির অধিকার টুক দাও !
নাহয় তোমাদের মৃত্যুর পয়য়গাম নাও ।
ভারতে গিয়ে বল রক্তপাতের কি দরকার দিয়ে সীমান্তে প্রহরী ?
হিন্দুস্তান ত হিন্দুস্তানই রাহেগিয়া হে মুহরি ।
মানচিত্র খণ্ডিত হয়েছে জখন ,
হৃদয় তখনো হয়নি , কখনওই হবেনা খণ্ডন ।
আরাকানের মানুস আর ভারতবর্ষের মানুস এক, জানে মাওলা ;
সাক্ষী তুমি কোথায়, হে কাবলিওয়ালা !
জেগে উঠ ইতিহাসের পাতা থেকে !
আরাকানকে বাঁচাতে এক হতেই হবে ভারতবর্ষকে ।
কে আছো তুমি নবাবকে পৌছে দাও এ বানি !
বাঙ্গালিরা আজো বয়ে জাচ্ছে পলাশীর সেই পরাজয়ের গ্লানি .
আরাকানে শান্তি ফিরিয়ে আনবোই ইনশাআল্লাহ্ হোক এ মোদের প্রতুসছ্রুতি .
ঘুমিয়ে থেকনা আর! জেগেউঠ হে বাংলার অধিপতি !
উপজাতি তথা নিখিল চাকমা গংদের বিশ্বাস বাংলায় মুসলমাদের আর্বিভাব ১২০০-১৩০০ সালের দিকে। কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা।
আনুমানিক ১২০৫ খ্রিঃ বখতিয়ার খিলজী নদীয়া আক্রমন করেন আর তখন থেকেই বাংলায় মুসলমানদের ইতিহাস শুরু কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। কেননা তারও আগে থেকে চট্টগ্রামে আরব বণিকদের যাতায়াত ছিল ব্যবসায়িক কাজে। তারা ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা,জাভা,মালেশিয়া হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছতো ব্যবসায়িক লেনদেন সেরে একই পথে গন্তব্যে ফিরে যেত।
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮ মার্চ ২০০৮ প্রকাশিত বাংলায় ইসলাম প্রচার নিবন্ধে সূত্রটি নিম্নরুপ-
—
আরব বণিকদের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ অতি সুপ্রাচীন তা আরাকান রাজবংশীয় উপাত্থান “বাজদাতুয়ে” বলা হয়েছে, “কানরাদজাগীয় বংশীয় আরাকান রাজা মহতইঙ্গত চন্দয়ত এর রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০ খ্রিঃ) কয়েকটি বিদেশী জাহাজ রনবী) (অধুনা-রামরী) দ্বীপের কাছে বিধৃস্ত হলে মুসলমান আরোহীগণকে আরাকান পাঠান হয়”।
সার্বিক তথ্যাদি ও আলোচনার ভিত্তিতে নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, ইসলাম পূর্ব ও প্রাথমিক পর্যায় হতে আরব বণিকগণের অবাধ বাণিজ্যিক যাতায়াত বঙ্গ দেশে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
সূত্রঃ http://www.al-shia.org/html/ben/maqalat/maqalat/004/01.htm
আবার ১২০০ শতকের আগেও কিছু মুসলিম সুফী সাধকের ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগমনের সুনির্দিষ্ট সন তারিখ নিয়েও একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যায়ঃ
—-
বাংলায় মুসলিম বিজয়ের পূর্বে যে সকল সুফীগণ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এদেশে আগমন করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেনঃ-
শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমীঃ বাঙ্গালার সুবাদার শাহসুজার সনদপত্রে উল্লেখিত হয়েছে যে, শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী ১০৫৩ সালে তাঁর মুর্শিদ সৈয়দ শাহ সুখখুল আনাতিয়াসহ ময়মনসিংহ জেলার মদনপুরে আসেন। মদনপুরেই তাঁর মাজার বিদ্যমান।
শাহ সুলতান বলখী মাহী সাওয়ারঃ তিনি প্রথমে ঢাকার হরিরামপুর নগর এবং পরে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে ইসলাম প্রচার করেন। মৎস্যাকৃতি নৌকায় সমুদ্রপথে বাংলায় আগমন করার কারণে তিনি মাহী সাওয়ার ওলী নামে খ্যাত।
বাবা আদম শহীদ: রাজা বল্লাল সেনের শাসনামলে (১১৫৮-৭৯) তিনি ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার আব্দুল্লাহপুর গ্রামে ইসলাম প্রচার করতে আসেন। যুদ্ধে তিনি শহীদ হন এবং এখানেই তাঁর মাযার অবস্থিত।
—–
সূত্রঃ http://www.shobdoneer.com/shibly/7117
http://www.somewhereinblog.net/blog/jamesbondbd/28955393
http://www.somewhereinblog.net/blog/jamesbondbd/28950322
আবার উইকিপিডিয়াতে কি লিখা আছে আমরা একটু দেখি-
খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগে আরব বণিক সম্প্রদায়ের ভারতে আগমনের সূত্র ধরে ভারতবাসী ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হন। আরব ও উপমহাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অবশ্য আরবে ইসলামের প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই বজায় ছিল। সেযুগে মালাবার অঞ্চলের বন্দরগুলিতে আরব বণিকদের প্রায়শই যাতায়াত ছিল। কারণ এই বন্দরগুলি ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরগুলির প্রধান যোগসূত্র। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রথম মুসলমান পর্যটকরা নৌপথে ভারতীয় উপকূলভাগে অবতরণ করেন। সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে আরব মুসলমানরা প্রথম ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আরব জাতি বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এরপর আরব বণিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিশ্বের সর্বত্র তাঁদের নতুন ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।[৭]
৬২৯ সালে মুহাম্মদের (৫৭১–৬৩২ খ্রি.) জীবদ্দশাতেই ভারতে প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়। চেরামন পেরুমল নামে জনৈক ধর্মান্তরিত মুসলমানের নির্দেশে কেরলের ত্রিসূর জেলায় মালিক বিন দিনার এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, পেরুমলকেই প্রথম ভারতীয় মুসলমান মনে করা হয়।[৮][৯][১০]
সূত্রঃ
http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87_%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE
সুতরাং ১২০০-১৩০০ শতকে বাংলায় মুসলিমদের প্রারম্ভিক কাল বা সুচনাসময় হিসেবে ধরাটা ইতিহাস,গবেষণা আর যুক্তির বিচারে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মানুষ অযাচিত ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
নিখিল চাকমা গংদের আক্রোশের শিকার মুসলিম বাঙ্গালী হল মিশ্র বা সংকর জাতি আর আর অপরাপর যেসব বাঙ্গালী(হিন্দু বা অন্যান্য ) তারা শতভাগ বিশুদ্ধ। কিন্তু সত্যিকার বিষয় হল- একজন বাংগালী হিন্দুর ছেলে বা মেয়ে আর বাংগালী মুসলিমের ছেলে বা মেয়েকে পাশাপাশি রাখলে কারো সাধ্য নেই বলার – কে মুসলিম বা কে হিন্দু বংশদ্ভুত।
আমরা যদি নিখিলের কথা মেনেও নিই, তাহলে মুসলিমদের মধ্যে যে পরিমাণ সংকরায়ন হয়েছে তা তাদের সামগ্রিক জাতি সত্ত্বায় অতি নগণ্য। আর যদি এর ব্যত্যয় ঘটত তাহলে এই জাতিকে আলাদা ভাবে চেনা যেত এই মুলুকে।
আবার আমরা যদি ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই-উত্তর বা উত্তরপূর্ব ভারতের লোকজনের গাত্রবর্ণ অনেকখানি গৌর,উন্নত-নাসা সমৃদ্ধ আর অধিক উচ্চতার আর পক্ষান্তরে দক্ষিণ ভারতের লোকজন গাত্রবর্ণ ঘোর-কৃষ্ণ, উচ্চতা অনধিক। প্রশ্ন হল কেন ?
কারণ- উত্তর বা উত্তর পূর্ব ভারতে পশ্চিম পারস্যের যে আর্যরা এসেছিল তাদের সাথে সিন্ধু,পাঞ্জাবের অববাহিকায় বাসরত কৃষিজীবি দ্রাবিডদের সংকরায়ন হয়েছে ব্যাপক হারে আরে দক্ষিণের দিকে আর্যরা যায়ইনি। আর সংকরায়ন চলেছে সরাসরি দক্ষিণ বাদ দিয়ে অনেকটা দক্ষিণ পশ্চিমে মানে আমাদের বাঙলা দেশ অবধি। তাহলে সামগ্রিক বিবেচনায় সারা ভারত বর্ষজুড়ে কে আদিবাসী ? অবশ্যই সেই দক্ষিণ ভারতের কৃষ্ণকায় লোকজন যারা আদি অস্ত্রাল বা প্রোটো অস্ট্রালয়েড। চাকমাদের ভুল অভিযোগ- বাঙালরা তাদের মোঘল বংশদ্ভুত বলে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল-মানুষ তাদের রাজাদের দিকেই অংগুলী তুলে। কিন্তু বস্তুত তারাই ভুল বোঝে । কারণ স্বল্প সংখ্যক মোঘলদের পক্ষে তৎকালীন সকল উপজাতীয় চাকমা মহিলা বা মেয়েদের তাদের উত্তর প্রজন্মের মাতা বানানো সম্ভব হয়নি।
চাকমা রাজারা যদিও মোঘল বংশদ্ভুত তা নিয়েও সম্যক বিতর্ক আছে সে কাহিনী অন্যদিন। আর একজন রাজা বা রাজপুত্র তো আর সামগ্রিকভাবে একক কোন জাতিসত্ত্বার নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বহন করে না। কারণ রাজপুত্ররা স্বভাবতই হয়ে থাকেন বিভিন্ন বংশ ,জাতি, ধর্ম, বর্ণের সেতুবন্ধন কারণ তাদের মায়েরা আসেন নানা বংশের,ধর্মের আর গোত্রের থেকে, কখনো কখনো রাজ্য জয়ের বা বিদ্রোহ দমনের রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে। যেমন- মহামতি আকবর রাজপুতদের সাথে যখন কোনক্রমেই পেরে উঠছিলেন না তখন তিনি এক ছলনার আশ্রয় ছিলেন চিরশত্রু রাজপুত সম্প্রদায়ের রাজকুমারী যোধা বাঈকে নিজের রাজমহিষী করে নিলেন। আর তাতেই কেল্লা ফতে। এমনকি শেষ মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের মাও ছিলেন হিন্দু। সূত্রঃ
http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0_%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B9_%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%B0
http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%B0
আর্যদের সহিত দ্রাবিড় সংমিশ্রণের পর অন্যান্য যে নগণ্যসংখ্যক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এ দেশে এসেছিল তাদের মিশ্রণ শুধু অতি অভিজাত পরিবারে সীমিত পর্যায়ে হয়েছে আর তা সাধারণ বাংগালীর নৃতাত্ত্বিক সত্ত্বায় ধর্তব্য নয়।
আর তাই আদিবাসী প্রশ্নে হিন্দু-মুসলিম-পাহাড়ী-মোঘল চর্তুমাত্রিক প্রসংগ না টেনে বরং বাংগালী(মিশ্রিত দ্রাবিড়) -পাহাড়ী(মঙ্গলয়েড) বিতর্কটাই যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক।
এখন প্রশ্ন পাহাড়ী আর বাংগালীর মধ্যে কে এই অঞ্চলের আদিবাসী। বাঙ্গালীদের বসবাস সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে যার কোন প্রামাণিক দলিল নেই, কোন সন তারিখ জানা নেই যারা অনাদিকাল থেকে এই অঞ্চলে চাষাবাদ করে ,ভুমি আবাদ করে টিকে আছে –যারা এ অঞ্চলের প্রকৃত হকদার বা ভূমিপুত্র। আর বেশিরভাগ পাহাড়ী বা উপজাতির আগমনের ইতিহাস ২০০ বা সোয়া দু’শ বছর যারা আরাকান রাজ বোধপোয়া কর্তৃক বিতাড়িত হয়েছিল সদলবলে ১৭৮৩ সালে আবাস গড়েছিল চট্টগ্রামে। যদিও তখন কিছু যাযাবর কুকি বা তৎবর্গীয় উপজাতি ঘুরে বেড়াত পাহাড় জুড়ে। কিন্তু তাদের স্থায়ী নিবাস গড়ে উঠে নি। আর পাহাডীদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক সাংস্কৃতিক,ভাষিক অমিল আর নেই কোন যুগোপযোগী যোগাযোগ সেতুবন্ধ-যেমন ভাষার লিখিতরুপ, বর্ণমালা বা ব্যাকরণ । অর্থাৎ তাদের হাজার বছরের এক জায়গায় বসতির ইতিহাস নেই –তাইতো গড়ে ওঠেনি কোন সাধারণ ভাষিক প্লাটফর্ম পক্ষান্তরে যেমনটা ঘটেছে – হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালী জাতির ক্ষেত্রে, তাদের রয়েছে হাজার বছরের বর্ণমালা তথা ভাষা প্রকৃতই ভূমিপুত্র হবার সুবাদে, সুবিশাল বিস্তীর্ণ আসাম,পশ্চিমবংগ,পুর্ববাংলা,মিজোরাম আর মেঘালয়ে সুপ্রাচীন কাল হতে বসবাসের দীর্ঘ ঐতিহ্যে।
সূত্রঃ http://www.bd-pratidin.com/2013/09/01/13939
http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%9A%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%A6
তাই এ অঞ্চলের প্রকৃত আদিবাসী কে, প্রশ্নটা পাঠকের কাছেই রেখে দিলাম… …।।
এর পরবর্তীতে ব্রিটিশরা জুম্ম ,অজুম্ম ভাগ করে অর্থাৎ সেই ডিভাইড এন্ড ক্যোনকার রুল। এইবার পাহাড়ীদের আন্তঃসংঘাত নিরসনে ব্রিটিশরা সি,এইচ,টি এক্ট-১৯০০ পাশ করে তাদের মধ্যে তিনটি সার্কেল করে-চাকমা,মং আর বোমাং সার্কেল। তারপর পাকিস্তান আমলের ইতিহাসতো সবার জানা-কাপ্তাই নদীতে বাঁধ ওদের ক্ষোভের সঞ্চার। আর বিস্ফোরণ ঘটল বাংলাদেশ আমলে স্বাধীনের অব্যবহিত পরেই।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এই পাহাড়ীরাই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন অপরাজনীতির পুজারী ছিল। ক্ষমতা আর সুবিধাবঞ্চিত হবার ভয়ে স্রোতের বিপরীতে কখনো হাঁটেনি। আর তার পুরোভাগে ছিল চাকমা সম্প্রদায়। ব্রিটিশদের সময় ধর্মবক্স খাঁর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী চাকমা রানী কালিন্দী আর তার সৈন্য-সামন্ত দিয়ে আর পাকিস্তান আমলে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় আর বাংলাদেশ আমলে তার সুযোগ্য পুত্র রাজা দেবাশীষ রায়।
ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস প্রায় দু’শ বছর আর পাকিস্তান আমল মাত্র ২৪ বছর প্রায়।
তারও পূর্বে মুসলিম এই ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিহাস প্রায় সাড়ে ১১শত বছর (৭১২ সালে মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় হতে ১৮৫৮ বাহাদুর শাহ জাফরের শেষ নবাবী পর্যন্ত ) বা তার কিছু কম। ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনের ইতিহাসে রাষ্ট্রীয়ভাবে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার গল্প কখনো শোনা যায়নি । তাই যদি হত তবে এ ভারত বর্ষে কোন হিন্দু-শিখ-জৈন থাকত না। কিন্তু আশ্চর্য সত্য হল- ভারতবর্ষ সুদীর্ঘ হাজার বছরে মুসলিম শাসনাধীন থাকলেও এই উপমহাদেশে মুসলিমদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩.৪%। সূত্রঃ
http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87_%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE
তাই বলা যায় – এ অঞ্চলে যারা মুসলমান হয়েছে তারা ইসলামের সৌন্দর্য্য দেখেই হয়েছে কারো তরাবারী বা রক্তচক্ষুর ভয়ে নয়। অতএব-এই নিখিল চাকমার মুসলিমদের জোরপূর্বক সাধারণ মানুষকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার কাহিনী গালগল্প ছাড়া কিছুই নয়।বস্তুত এ সুদীর্ঘ সময়ে কোন হিন্দু-মুসলিম বা শিখ,জৈন-মুসলিম কোন দাঙ্গার ঘটনাও জানা যায় না।
কিন্তু যত সমস্যার শুরু ব্রিটিশ আমল থেকে তারা দেশীয় বেঈমানদের ব্যবহার করে পলাশী নাটক মঞ্চস্থের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনত হরণ করে। নীলচাষে করের বোঝা চাপিয়ে দেয় আর বাঙ্গালীদের গরু,শুয়োরের চর্বির ধুয়া তুলে তৎকালীন আধুনিক সমরাস্ত্র রাইফেল ব্যবহারে অনীহা জাগায় শেষ-মেষ সিপাহী বিপ্লবে প্রহসনের বিচারে হাজার হাজার বিপ্লবীর ফাঁসি দেয় । শেষে ১৯৪৬ এ হিন্দু-মুসলিম দাংগা বাধায় আর গান্ধীর অবিভক্ত ভারতের স্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দুটি চির-বৈরী দেশের জন্ম দেয়। আবার ভাষাগত , সাংস্কৃতিক, আচরণগত সকল অমিল সত্ত্বেও গোজামিলের পাকিস্তান রেখে যায়।
পক্ষান্তরে – সেন শাসন আমলেই বৌদ্ধ ধর্ম এই ভারত বর্ষ থেকে চিরতরে বিতাড়িত হয়েছিল কিন্তু একসময় এ অঞ্চল বৌদ্ধ অধ্যুষিত ছিল পাল আমলে বিশেষ করে মহামতি সম্রাট অশোকের হাত ধরে , মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লালামাই বৌদ্ধবিহার তার স্মৃতি বহন করছে আজো। সহস্র বছরের হিন্দু-মুসলিম সমান্তরাল বসবাসকে চ্যালেঞ্জ করে ব্রিটিশরাই প্রথম দাংগা বাঁধিয়েছিল কারণ তাদের পলিসিই ছিল ডিভাইড এন্ড ক্যোনকার , মানুষ মরলে তাতে তাদের কিইবা যায় আসে যার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে ভারত আর পাকিস্তান এখনও । আর এখন খ্রিস্টান মিশনারীদের কল্যাণে পাহাড়ীরা তাদের ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দিচ্ছে প্রতিনিয়তই । হয়তো কয়েক দশক পরে মাইক্রোসকোপের নিচে তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে দেখাও না যেতে পারে । অথচ সে দিকে নেতৃত্ত্বস্থানীয় সুফলভোগী চাকমা সম্প্রদায়ের কোন উদ্যোগ বা ভ্রক্ষেপ ও নাই আছে শুধু নেতৃত্ত্বের ঝান্ডা কখন হাতে পাবে, কিভাবে সরকারী সকল সুবিধা কুক্ষিতগত করবে অপরাপর পাহাড়ী সম্প্রদায়ের হক মেরে সে ধান্দায়।
উপজাতি কোটা পুর্নমূল্যায়ন আর পুনর্বন্টন এখন সময়ের দাবী –অগ্রসর,সুবিধাভোগী চাকমা সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে যাতে অনগ্রসর অপরাপর উপজাতি সম্প্রদায়গুলো এগিয়ে আসতে পারে শিক্ষা-দীক্ষা,চাকুরি বা মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তিতে,আর এ বিষয়ে সরকার বা যথাযথ কতৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ অত্যাবশ্যক ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।
পাহাড়ীদের আদিবাসী হবার অন্যয় আবদার ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সমাধানের পথে হাটতে হবে যুক্তি আর ইতিহাসের পথ ধরে ।অতি লোভী মনোবিকার ও উচ্চাভিষী হবার দরুন নিজেদের সাংস্কৃতিক,ভূ-রাজনৈতিক পরিচয়ও ধূসর হয়ে উঠছে ক্রমশঃ দেব থেকে ডেভিড, তনয় থেকে টমাস হয়ে উঠছে তাদের আত্নপরিচয়।সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে তাদের আন্তঃসংঘাতে(জে,এস,এস আর ইউ,পি,ডি,এফ আদর্শগত লড়াইয়ে)নিপতিত হওয়ায়। যতই দিন যাবে সমস্যা আরো ঘনীভুত হবে, নানা রাজনৈতিক সমীকরণে বিভিন্ন গোত্রের বহুধাবিভক্ত ভাবী মতাদর্শের লড়াই হয়তো আরো প্রকট হবে । আন্তঃসীমান্ত সংঘাত নিরসনে বদ্ধপরিকর ভারত এল,টি,টি এর সন্ত্রাসবাদী মদদ যার জন্য বুমেরাং হয়ে এসেছিল সেও মুখ ফিরিয়ে নিবে পলাতক অপরাধী বিনিময়(যে প্রক্রিয়া সাম্প্রতিক শেষ হয়েছে অনুপ চেটিয়া হস্তান্তরে )প্রটোকল চুক্তিবলে ও দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হারাবার ভয়ে।
ভালো চাইলে সবিশেষে সমাধানের পথে আসতেই হবে বাংগালী বা বাংগালী মুসলিমের প্রতি হীনমনোবৃত্তিক অযাচিত বিষোদগার পরিহার করে , অন্যথায়- প্রলম্বিত সমস্যার আধারে চলবে – পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচাল আর তাতে সংঘাত অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে । ফলাফল খারাপ বৈ ভালো হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মুলনিবাসী বা আদিবাসী কারা?
পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলনিবাসী বা আদিবাসী কারা–এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য কাওকে বড় মাফের ঐতিহাসিক বা বুদ্ধিজীবি হওয়ার দরকার নেই। এই অঞ্চলের জনসংখ্যাগত পরিসংখ্যান হোল এই প্রশ্নের সবচেয়ে সহজ ও বিজ্ঞানসম্মত উত্তর। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় এই অঞ্চলে জুম্ম ছিল শতকরা ৯৮.৫ জন আর অজুম্ম (মুসলিম বাঙ্গালী ও অন্যান্য) ১.৫ জন। ব্রিটিশরা যখন ১৮৬০ সালে এই অঞ্চল অধিকার করেছিলেন তখন এই অঞ্চলে একজনও স্থায়ী বাসিন্দা অজুম্ম ছিলনা। ১৭৫০ সালের আগে এই অঞ্চলে কোন অজুম্মের অস্তিত্ব পাওয়া যায়না। অন্যদিকে জুম্মরা সপ্তম শতাব্দী থেকে চট্টগ্রাম, কক্স বাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু কিছু এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন। চাকমা ও মারমারা মুলত তাদের রাজাদের অধীনে চট্টগ্রাম ও কক্স বাজার এলাকায় বসবাস করছিলেন। চট্টগ্রাম ও কক্স বাজার আরাকান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অনেক এলাকা সম্ভতঃ ” no man’s land’ ছিল। ১৬৬৬ সালে বাংলার নবাব আরাকানের রাজাদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম দখল করেন। তখন থেকে মুলতঃ মুসলিম বাঙ্গালীরা ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে চট্টগ্রামের দিকে আসতে থাকেন। তাদের জেহাদ থেকে বাঁচার জন্য এবং ভ্রাম্যমান জুম্মচাষের কারনে চাকমা ও মারমারা ধীরে ধীরে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এই সময় চাকমাদের ‘চাদিগাং ছাড়া পালা’ রচিত হয়।
মুসলিম বাঙ্গালীদের সঙ্গে মুঘলদের কোন রক্তের বা ইতিহাসের সম্পর্ক নেই। মুসলিম বাঙ্গালীদের পূর্বপুরুষরা হলেন বৌদ্ধ ও হিন্দু। ১২০০-১৩০০ শতাব্দীতে তাদেরকে জোরপূর্বক ইসলামধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয় যখন মুহম্মদের জেহাদীরা আরব থেকে ‘এক হাতে কোরান আর এক হাতে তলোয়ার’ নিয়ে এসে ভারতবর্ষ অধিকার করে নেয়।
Nissondehe Chottogramer Bangalira. Ar apnara burmese der pituni kheye ekhane dukechen. karon tokhonto kono boundry chilona…
যদি মুসলিম বাঙ্গালীরা তাদের ইতিহাসকে ভারতের বৃহত্তর বৌদ্ধ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন তাহলে তারা বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ (indigenous people)। আর যদি তারা তাদের ইতিহাসকে মুঘলদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন তাহলে তারা কেওই বাংলাদেশে আদিবাসী নয়–সেটলার বা কোলোনাইজার। কারণ মুঘলরা বিদেশী আক্রমণকারী। প্রকৃত ইতিহাস হোল– মুসলিম বাঙ্গালীরা একটা শঙ্কর বা মিশ্র জাতি। তাদের পূর্বপুরুষরা সবাই বৌদ্ধ বা হিন্দু ছিল। ১২০০-১৩০০ শতাব্দীতে তাদেরকে মুসলিমরা জোরপূর্বক ইসলামধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিল। তারা মুঘলদের প্রজা মাত্র।
your right.
One more important point that deserves to be mentioned here is that the title ‘khan’ is not Islamic in origin. It was first used by Mongol rulers like Chengis Khan, Kublai Khan of Mongolia and warlords of Central Asia. Khan means leader or warrior. Muslim rulers adopted the title following the Mongol rulers, who were shamanists or later Buddhists in faith. It is synonymous to the title of raja or maharaja of India.
Bengali Muslim Settlers: A Political Instrument of Bangladesh to Sabotage Jumma Indigenous People’s Right to Self-determination
Historically, CHT is not part of Bangladesh. Bangladesh was born in 1971. CHT had existed from 6th century CE. It was illegally made part of East Pakistan (now Bangladesh) in 1947. That means Bangladesh got CHT as an illegal legacy from Pakistan.
Who are the “indigenous peoples” (the first peoples) of CHT — Jummas or non-Jummas (Bengali Muslims and others)? The easiest and the most scientific answer to this question is found in the census report/demographic statistics of this region. During the partition of the Indian Sub-continent in 1947, the ratio of Jumma and non-Jumma population of CHT was 98:2, that is, out of every 100 persons 98 were Jummas and 2 were non-Jummas. There was not even a single non-Jumma (permanent resident) in CHT when the region was brought under the British colonial rule in 1860. Therefore, who are the indigenous peoples of CHT? The answer is the Jummas. For this very reason, Bengali Muslims of CHT are called “settlers”.
Some Bengali Muslim writers identify Bengali Muslim settlers to be “indigenous people” in CHT and the Jumma indigenous people as “tribe” with reference to “research” done by anthropologists on CHT, as they say. Such research is not research at all in the true sense of the term, but an academic conspiracy to indoctrinate and legitimize the Bengali Muslim colonial rule in CHT or over the Jumma indigenous people.
No national and international “conspiracy” is required for CHT to gain its independence. CHT will emerge an independent state, like Bangladesh — not to mention of South Sudan or East Timor — as per international law mentioned below:
United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples: Article 3 — Right to Self-determination: Indigenous peoples have the right of self determination. By virtue of that right they freely determine their political status and freely pursue their economic, social and cultural development.
The Govt. of Bangladesh brought over a half million Bengali Muslim settlers from Bangladesh into the land of the Jumma indigenous people, CHT in the 1980s and 1990s and thus deprived them (Bengali Muslim settlers) of their due rights in their country. They cannot claim any right to land in CHT. In fact, they have, as per CHT law, no political and economic right in CHT, as they are “settlers’, “illegal infiltrators” in the region. Jummas should, however, consider the educational rights of their children until they are repatriated to their previous places in Bangladesh.
Settlers are creating a lot of political, economic, social and environmental problems in CHT because of their poor educational, social and economic background. They are not getting proper education except radical Islamic education imparted for political purpose. They basically live on ration supplied by the Govt. of Bangladesh. So they are unproductive in CHT. They commit crimes like arson attack, murder, rape, illegal land encroachment, religious violence etc against peace-loving and simple local indigenous people. They are getting involved in arms training with Rohingiyas linked with Al-Qaeda, Taleban and other jehadi groups and fomenting terrors in CHT and its neighbourhood.
The Govt. of Bangladesh should take immediate steps to repatriate settlers from CHT and rehabilitate them in their previous places in Bangladesh for their peace, security and development and for restoration of the Jumma indigenous people’s right to self-determination and peace and development in CHT.
গবেষক মহোদয়কে বলছি, আপনি আর একটু কষ্ট করে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের প্রকাশনা ’বৈচিত্রের ঐকতান’পুস্তকটি পড়ুন। ঐ পুস্তকে চাকমা জাতির ইতিহাসের সারাংশ পাবেন। আর আপনার গবেষণার সাথে তুলনা করতে পারবেন। গবেষণা করা অত্যন্ত ভালো, তবে সেটি যেন নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক পর্যায়ে থাকে এবং গবেষণা করার যেসকল স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে তা যথাযথভাবে অনুসৃত হয়।
চাকোমাস- নামে একটি অঞ্চল প্রাচীন ম্যাপে দেখা যায়। সেটি কী? আর চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণ কীভাবে-কোথা থেকে হয়েছে?
লেখাটি পড়ার পর বুজতে পারলাম এটি একটি উদ্দেশ্য প্রনোদিত লেখা। জামাত শিবির গং যেরকম ভাবে সমাজে বিভ্রান্তি সৃস্টির অপ উদ্দেশ্যে গোয়েবলসিয় অপপ্রচার চালায় এটি ও সেই ধারার একটি লেখা। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুর্ব সময় পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে মঙ্গোলয়েড রেসের উপজাতিয় ছিলো ৯৯% বাঙ্গালী রেসের মুসলমান হিন্দু ইত্যাদী ১%। জিয়াউর রহমানের সেটেলার থেরাপি পার্বত্য অঞ্চলে শুরু হওয়ার পর যে অশান্তি শুরু হয়েছে তা এখনও বিদ্যমান। সেটেলার থেরাপির মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের মুল অধিবাসিদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিনত করা হয়েছে। সংখ্যালঘুতে পরিনত হওয়া উপজাতীয় দের মধ্যে চাকমারা শক্তিশালী এদের রাজা ব্যরিস্টার দেবাশিষ রায় একজন শিক্ষিত সজ্জন উপজাতীয়দের দ্বারা সম্মানিত ভালো মানুষ। যে ভাবে তার চরিত্র হরনের চেস্টা করা হয়েছে তা অবশ্যই একটি দুস্কর্ম। ইতিহাস এরকম ধিক্কারজনক অপপ্রচার কারিদের কখনও ক্ষমা করবে না।
Dear Writer,
This is indeed a very interesting script that u have written on Chittagong Hill Tracts vis a vis Chakma Dynesty. It was in fact not known to many of us who operated in that area . In my youth I was deployed in Chittagong hill tracts for three years and we lost lot of life and passed a very hard life there. Ur this information will help for pacification operation whic is still going on CHT by military and civil administration . It is a very enlighten script on Chakma Dynesty and need to by the other people of Bangladesh. Thanking you . Maj Afser(Retd)
right….
আমি সব পড়তে সময় নেই. কিন্তু আমি কিছু লেখার 100% ভুল এই বলতে চাই. আমি কিছু লেখার উপর, Marma Gusti আরাকান রাজ্য থেকে আসা দেখতে ছিল. আমরা জানা প্রয়োজন, Marma Gusti সম্পর্কে কোনো আরাকান ইতিহাস নেই. Marma Gusti শুধুমাত্র বাংলাদেশ থেকে. এবং Marma বাংলাদেশ জন্মগ্রহণ. এখন আরাকান কোন Marma নেই. আরাকান শুধুমাত্র Rakhine ছিল. এবং এখন Rakhine আছে. কোনো Marma যান আরাকান, সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে Rakhine করছে.
o nak kiusu janlam.thanks…………
Sukorer jjat bangali! aro ki ki na bolbe !
The writer should do more home work and research while touching or writing history about other nation or people – here it is 80% with wrong information, and totally branded with Bengali hegemonism and dominator. History has always been written by the winner, and in Bangladesh, you Bengali people are the winner thus you narrate the history as you like. Look at back your own history – the history of Bangladesh, and the history of Bengali people and origin. Instead digging about our identity issue, please read the history of ancient Bangla, and the origin of your own Bengali nation. I believe it will help you to respect others.
Brother, your protest against this writing does not reveal the true history of your race. It would be wise to highlight the real history from your subjective view. Once you have expressed your difference of opinion with this writing, naturally you have a realistic and factual answer to remove confusions from the minds of the readers. Distorting history is a heinous crime. I hope you will make it clear with supported references and proofs. Thus we all would be benefited and our mutual trust will be restored on a firm base.
এটা অত্যন্ত বাজে কাল্পনিক একটা লেখা। একে ইন্টারনেট থেকে মুছে ফেললে ভালো হয়। যিনি লিখছেন তিনি অত্যন্ত জাতি বিদ্বেষী একজন মানুষ বলে আমার মনে হয়। এমন অযৌক্তিক কাল্পনিক লেখা মানুষকে বিভ্রান্ত করবে বলে আমার বিশ্বাস।
এই লেখাটা আগেও পড়েছিলাম৷ ২০১৪ সালের কোনো এক সময় গুগল সার্চে এসেছিল৷ তখন ক্লাস সেভেন এ ছিলাম৷ সবটুকুই মন দিয়ে পড়েছি৷ তখন খুবএকটা ভালোভাবে বুঝতে পারিনি৷ আজও পড়লাম একদম নতুন করে পড়ার মতো৷ মূল লেখাটার অনেকাংশেই একমত হতে না পারলেও কমেন্টগুলোর দিকেই আমার আকর্ষন সবচেয়ে বেশী৷ Nikhil Chakma এর কমেন্টগুলো প্রতিটিই যুক্তিসঙ্গত এবং পড়ে বেশ ভালো লাগল, অনেককিছু জানলাম৷ ধন্যবাদ Nikhil Chakma.
ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের মুসলিম ও মুসলিম বাঙালিরা যে পূর্বে সকলেই মহান বৌদ্ধ, হিন্দু অথবা জৈন, শিক প্রভৃতি ধর্মের অনুসারী ছিল তা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না৷ বিশেষত বাঙালিদের এক বড় অংশ এখনো শান্তিপূর্ণভাবে বৌদ্ধ ধর্ম পালন করে আসছে, তারা হল- বড়ুয়া পদবীধারী বাঙালীরা৷ ত্রয়োদশ শতকে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের ফলে ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের বহুসংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করে মূলত তিনটি কারণে-
(১)নতুন অধ্যুষিত ধর্মবিদ্বেষী রাজ্যাভিলাষী অত্যাচারী মুসলিম শাসকরা তৎকালীন প্রধানধর্ম বৌদ্ধদের বিহার, চৈত, ধর্মস্তুপ, ধর্মীয় বইপুস্তক ও বৌদ্ধরাজাদের ধর্মীয় স্মারকলিপি এবং হিন্দুসহ অন্যান্যদের মন্দির-মূর্তি ধ্বংস করেছিল, সম্ভবত বৌদ্ধভিক্ষুদেরও হত্যা করেছিল৷ ফলে বৌদ্ধরা হতাশ, সর্বহারা হয়ে নিজের ধর্মীয় আচার, বিশ্বাসকে দীর্ঘকাল ধরে রাখতে অসমর্থ হয়৷ পরবর্তীতে তারা নিজের ধর্মকে প্রায়ই ভুলে যেতে বসেছিল৷ একদম ভুলে গিয়েছিল বলা চলে৷ যার সাহিত্য এবং ধর্মচর্চার প্রাণকেন্দ্রকেই ধ্বংস করা হয় তার তো এরূপ সর্বনাশা অবস্থা হবারই কথা!!
(২)দখলীকৃত রাজ্যের উগ্রপন্থী শাসকদের জোরজুলুমের ভয়ে অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করায় বৌদ্ধ, হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষেরা ক্রমে ধর্মান্তিরত হয়েছিল৷
(৩) বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের বিশুদ্ধ ও অনেকের কাছে ‘কঠিন’ হিসেবে গণ্য ধর্মীয়নীতিকে বাদ দিয়ে ইসলামের বিপরীতমুখী যাকে তুলনামুলক সুবিধার ভেবেছিল সেই ধর্মজীবনের দিকে অজ্ঞতাবশত অনেকেরই কৌতুহল জন্মেছিল৷ যেমন, বৌদ্ধ-জৈন এবং কিছু ধর্মে প্রাণীহত্যা একদমই নিষিদ্ধ যা মহাপাপ হিসেবে ধরা হয়৷ কিন্তু অন্যদিকে ইসলামে এধরণের বিশেষ কোনো নীতি বা নিষেধাজ্ঞা নেই যাতে প্রাণীহত্যাকে মহাপাপ বলা হয়৷ প্রতিবছর এরা যে লাখ লাখ পশু কোরবানীর সময় নির্মমভাবে হত্যা করে ধর্মীয় উৎসব করে তা এর বাস্তব উদাহরণ৷ এসব কারণেও বিশেষ সংখ্যক ধর্মজ্ঞানহীন মানুষ অনায়াসে ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী হয়েছিল৷
বিশুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ ধর্মাচারে বিশ্বাসী বৌদ্ধশাসকরা রাজ্যবিস্তারের লোভ কিংবা সামরিক শক্তিমত্তা বাড়ানোর দিকে তাদের জোঁক ছিল না যার জন্য তাৎক্ষণাৎ বহির্শক্তির আক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো অবস্থা ধরে রাখা তাদের সম্ভব হয় নি৷ মহামতি সম্রাট অশোক কলিঙ্গ বিজয়ের পর যুদ্ধে নিহত লাখলাখ মৃতদের দৃশ্য দেখার পর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তারপর বৌদ্ধধর্মের মাহাত্ম্যে প্রভাবিত হয়ে সংকল্প করেন কখনো যুদ্ধ করবেন না।
এদের দাবী খিলজির আক্রমণের আগে থেকেই ইন্ডিয়ায় নাকি ইসলাম ছিল!? এটা ভুয়া কথা। কেননা ইন্ডিয়ার বণিকদের সাথে যে শুধুই আরব- ইরাক- ইরান প্রভৃতি দেশের বণিকদের আসা যাওয়া ছিল তা নয় বরং সুদূর পাশ্চাত্যের সাথেও ইন্ডিয়ার যোগাযোগ ও ব্যবসায় বজায় ছিল যাদের প্রধান ধর্ম খ্রিস্টান। আর তার সূত্রেই যদি ইসলাম এদেশে আসে তবে খ্রিস্টানরা আসল না কেন??! মুহম্মদ খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ এরও অধিক সময় পর আরবে ইসলাম প্রচার করেন। তার মানে পুরো দশম শতকের আগে তা বহির্বিশ্বে এতখানি ছড়িয়ে পড়বে তার কোনোপ্রকারেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
আরএকদিক থেকে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশের বাঙালি মুসলিমরা যে সংকর এবং প্রকৃতপক্ষে দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের(খিলজির আক্রমণ) পরেই এই বাঙালি মুসলিম জাতির সূত্রপাঠ তা নিঃন্দেহে সত্য। এর কারণ বলছি-
খিলজি আক্রমণের পর তার অংশবংশ সাঙ্গপাঙ্গরা রাজ্যহারা হিন্দু-বৌদ্ধ ও অন্যান্যদের ধর্মের ওপর আঘাত হানার পাশাপাশি নিজেদের বংশধর বাড়ানোয় প্রক্রিয়া শুরু করে। তারা বিশেষত অনেক সংখ্যক এদেশীয় নারীদের বিয়ে করে পিতৃসূত্রে সন্তানাদিদের ধর্ম হয়ে যায় ইসলাম। আর এরা যে একেকজনে পাঁচ-ছয়টা বিয়ে করত(বহুবিবাহ) এবং এখনো অনেকে করে তা সবার জানা। ফলত: যেমন তেমনভাবেই এরা এক বড় অংশে নিজেদের ধর্মের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে আর একই সাথে বাঙালি নামক এক সংকর জাতির সূচনা করে। অধিকসংখ্যক বাংলা শব্দ যে আরবি,ফার্সি,তুর্কি,সংস্কৃত, হিন্দিসহ বিভিন্ন ভাষার শব্দ তা তার স্পষ্ট প্রমাণ। ব্যাকরণে উল্লিখিত ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে বাংলা ভাষার যে পাঁচপ্রকার শব্দের বিদ্যমানতার কথা এরা বলে, আসলে মৌলিক বিচারে সবগুলো শব্দই বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় ও বিদেশী শব্দ থেকে সংকরজাত শব্দ।
শুদ্ধভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায় এরা অর্থাৎ বাঙালিরা তাদের ইতিহাসকে ১২০০ শতক এ বখতিয়ার খিলজির আসার আগের দিকে আর সঠিক জানে না। এরা নিজেদের ভাষার ইতিহাস হিসেবে সর্বশেষ রেফারেন্স করতে পারে বৌদ্ধধর্মানুসারী পাল রাজাদের আমলে রচিত পান্ডুলিপিগুলোকে। মোটামুটি সেই ভাষাভাষী এবং তৎপরবর্তীদের বিবর্তি রুপ বখতিয়ার খিলজির আসার পর সংকর বাঙালিদের মধ্যে আলাদা একটি ভাষায় পরিণতি লাভ করে। যা বর্তমানে বাংলা ভাষা।
এসবের পরও এরা নিজেদের আদিবাসী বলে সম্বোধন করে!! যাদের জাতিগত সূত্রপাতের শুরুতাই হয় মাত্র কয়েক শতাব্দি আগে, এবং সংকর জাতিতে!!
আজকাল ৮ ক্লাস পাস করলেই সব সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে। চেঙ্গিস খান যে মুস্লিম সাম্রাজ্য মাটির সাথে মিশায় দিসিলো সেই খেয়াল আছে? পুরান ইতিহাস ঘেটে যে এরা একটু মাল ফেলবে, সেই উপায়ও চেঙ্গিস খান রাখে নাই। এখন বানোয়াট ইতিহাস বানায়া পোলাপানরে বুঝ দিতাসে, আমরা মেলা কিছু হনু।