ছাত্রলীগের কমিটিতে থাকার কথা স্বীকার করলেন হেমা চাকমা


অবশেষে হেমা চাকমা এক ফেসবুক পোস্টে ছাত্রলীগের কমিটিতে থাকার কথা স্বীকার করলেন। একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলের অনলাইন সংস্করণে বলা হয়- ‘ডাকসু নির্বাচনে আওয়ামী ছাত্রলীগ থেকে বামজোটে হেমা চাকমা।’ আসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচনে ডাকসুতে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনসমূহের জোট ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ থেকে সদস্য পদে লড়ছেন হেমা চাকমা।
এর আগে তিনি ছিলেন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের সাংস্কৃতিক উপ-সম্পাদক। ছাত্রলীগের অফিস প্যাডের ছবিসহ এমনই এক তথ্যযুক্ত সংবাদ আজ ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হয়েছে স্যাটেলাইট চ্যানেল বাংলাভিশনের অনলাইন সংস্করণে।
এদিকে বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর হেমা চাকমার সাথে যোগাযোগ করেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বলেছেন, পরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের ডেকে প্রেস ব্রিফিং করে জানাবেন। এ ঘটনার পর পর তিনি ছাত্রলীগে সংশ্লিষ্ট থাকার কথা স্বীকার করে ফেসবুকে পোস্ট দেন।
নিচে ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
”ছাত্রলীগ ট্যাগ ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমার অবস্থান স্পষ্ট করা নিয়ে বক্তব্য
———-
আমি হেমা চাকমা, আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে প্রতিরোধ পর্ষদ থেকে কেন্দ্রীয় সদস্য পদে নির্বাচন করছি।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, আমি নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলাম। সবার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, আমাকে ছাত্রলীগের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও ছাত্রলীগের কোন কাজে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে আমি জড়িত ছিলাম না। আমি ওপেন চ্যালেঞ্জ করছি, কেউ যদি এমন কোন প্রমাণ দিতে পারে যে, আমি ছাত্রলীগের দলীয় সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলাম, তাহলে আমি আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকব।
আরো বলতে চাই, ২০২২ সালে পাহাড় থেকে বহু সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অনেক সিনিয়র এবং বন্ধুরা প্রস্তাব দেয় ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হতে। তখন সবে ১ম বর্ষ ও রাজনৈতিকভাবে অসচেতন ছিলাম, সেজন্য কমিটিতে থাকা নিয়ে আপত্তিও করিনি, যেটার মেয়াদ ২০২২ সালে শেষ হয়ে যায়। তাই কমিটিতে থাকা বিষয়ে আমি কখনো গুরুত্ব দিইনি।
১ম বর্ষ থেকেই ছাত্রলীগের অনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আমি হলে থাকতে পারতাম। কিন্তু আমার পারিবারিক অভাব-অনটন সত্ত্বেও ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে ৩য় বর্ষের শুরুর দিক পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছি। এরপর নিতান্তই না পারতে ৩য় বর্ষে গণরুমে উঠি। নিশ্চয়ই জানেন, ৩য় বর্ষে একটা মেয়ে কোন অবস্থায় থাকলে গণরুমে উঠে। এরপর আমি শামসুন্নাহার হলে উঠেছি। নিজের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পাহাড় থেকে পণ্যে এনে বিক্রিসহ উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেছি।
আমার বিবেকবোধ সবসময় দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিতে যুক্ত হতে বাধা দিয়েছে। কারণ, ফ্যাসিস্ট হাসিনা পার্বত্য চুক্তি করে আমার পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, আমার জাতিগত পরিচয়কে স্বীকৃতি না দিয়ে সংবিধানে বাঙালি বানিয়েছে, পাহাড়-সমতলে সারা দেশের জনগণের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়েছে। এই অবস্থায় একজন সুস্থ বিবেকবোধ ও নৈতিকতা সম্পন্ন কারোর ছাত্রলীগ করার কোন প্রশ্নই আসে না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন:
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আমি ঢাকায় ছিলাম না, ১৫ জুলাই সকালে আমি হল থেকে চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিলাম এরপর খাগড়াছড়ি বাড়িতে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আমার অংশগ্রহণ ছিল না তা সত্য, তবে আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আমার নৈতিক সমর্থন রয়েছে। এ কারণে শামসুন্নাহার হলে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হওয়ার পরে শিক্ষার্থীদের ঘোষণা শেয়ার করা, প্রোফাইল লাল করা, পাহাড় থেকে সমতলে সকল বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার দাবী তোলা থেকে শুরু করে বহু কিছুই শেয়ার করেছি।
জুলাই অভ্যুত্থানে রাজপথে অংশগ্রহণ না করলে অভ্যুত্থানবিরোধী হয় না। আমার মত দেশের অনেকে জুলাইয়ে অংশগ্রহণ না করেও আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছিল। যারা আমাকে ছাত্রলীগ ট্যাগ ও অভ্যুত্থানে আমার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাদের আমি বলবো, এটি পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের মত ট্যাগিং কালচার। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে নিজের সম্পত্তি মনে করত। জুলাইয়ে আমার ভূমিকার প্রশ্ন তুলে আপনারা একই পথে হাঁটছেন। আমি মনে করি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কারো একার নয়, এটি দেশের সকল আপামার জনগণের।
উপরি-উক্ত বিষয়ে আমার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইতিমধ্যে আমাকে চরম মাত্রায় সাইবার বুলিং থেকে শুরু করে স্লাটশেমিং করা হচ্ছে। আমাকে বলা হচ্ছে যে, আমি ভারতপন্থী, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থী। বিশেষত মহান মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ নিয়ে মিথ্যাচারের জোর জবাব দিয়েছি দেখেই একটা মহল থেকে এই পুরনো জিনিস খুঁজে বার করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃতি ও হীনভাবে উপস্থাপনে আমার প্রতিবাদ জারি রাখায় ডাকসু নির্বাচনের আগে এসব ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি।
আমি বরাবরই বলেছি, মহান মুক্তিযুদ্ধ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার। এখানে যেমন বীরত্বের সঙ্গে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছে, ঠিক তেমনি চাকমা, ত্রিপুরা, মারমা, গারোসহ এদেশের জাতিসত্তার জনগণ অংশগ্রহণ করেছে। ৭১ এবং ২৪-কে আমি ধারণ করি এবং এসব সংগ্রামে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
ডাকসুকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈচিত্র্যমূলক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে সহায়ক কন্ঠস্বর হিসেবে গড়ে তুলতে আগামী ০৯ সেপ্টেম্বর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এগিয়ে আসুন। আসুন, আমরা একটি বহু জাতি ও সংস্কৃতির অংশগ্রহণে একটি বৈষম্যহীন সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় বুকে নিয়ে এগিয়ে যায়। ধন্যবাদ।”