থামছেনা মানবপাচার: দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ভয়াবহতা
কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির সুযোগ নিয়ে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে সাগরপথে মানব পাচারকারী চক্র। তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে ভালো ও ‘মুক্ত’ জীবন যাপনের টোপ দিচ্ছে।
তাদের প্রলোভনে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া-ইউরোপের স্বপ্নে গন্তব্যহীন ছুটছে রোহিঙ্গারা।
তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। এই তৎপরতার সঙ্গে স্থানীয় কিছু লোক ও প্রভাবশালী রোহিঙ্গা জড়িত বলে জানা গেছে।
পুলিশের কাছে মানবপাচারে জড়িত ইতোমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। করা হয়েছে মামলাও।
কক্সবাজারে কর্তব্যরত গোয়েন্দা সংস্থা ও সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃবৃন্দ বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজর রয়েছে মানবপাচার ও ইয়াবা চোরাচালানিদের দিকে। যে কোনভাবে ইয়াবা ও মানবপাচারচক্রকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দালাল শ্রেনি সৃষ্টি করে তাদের মানবপাচারের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মধ্যম শ্রেণির রোহিঙ্গা সিন্ডিকেটকে শনাক্ত করতে পারলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা। এ কারনে বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে আসল জড়িতরা।
সম্প্রতি উদ্ধারকারী পুলিশ বলছে, দালালরা রোহিঙ্গাদের উখিয়া ও সাগরে ট্রলারযোগে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে থাইল্যান্ডে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে। সেখান থেকে সীমান্ত ডিঙিয়ে মালয়েশিয়ায় পার করছে। পাচারকারী চক্র তাদের দুই-তিন দিন সাগরে ঘুরিয়ে ফের কক্সবাজার উপকূলে এসে জানান দেয় যে, তারা থাইল্যান্ডে এসেছেন।
এভাবে তারা প্রতারিত হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। এরকম অহরহ ঘটনার জন্ম দিচ্ছে টেকনাফ-কক্সবাজারে।
পুলিশ বলছে, টেকনাফ-উখিয়া ক্যাম্পে থাকা মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের কয়েকজনের নাম উঠে আসে। তাদের মধ্যে রয়েছেন-মোহাম্মদ আইয়ুব আলী, হাফেজ ছলিম, আতাত উদ্দিন, মোহাম্মদ আলম, আবদুর করিম, হাফেজ মোহাম্মদ আইয়ুব, আবদুল করিম, মোহাম্মদ ইলিয়াস, মোহাম্মদ কবির, আমির হোসেন, মোহাম্মদ ফয়েজ, নূর হোসেন, মোহাম্মদ নাগু, নুরুল কবির, আবুল কালাম, লাল বেলাল, দিল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ ফারুক, জোবাইর হোসেন, লালু মাঝি, আলী আকবর, মোহাম্মদ ছলিম, মো. কবিরা, মোহাম্মদ শাহ। এদের অনেকের বিরুদ্ধে থানায় মানবপাচারের মামলাও রয়েছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গডফাদার আর চক্র যা বলেন তারা কিন্তু সব সময় অবৈধভাবে মানবপাচারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সে ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা বা প্রশাসনকে আরও সতর্ক থাকা জরুরি।
সূত্রে জানা গেছে, মূলত ২০১৪ সালের শেষের দিকে উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মানবপাচারের ঢল নামে। ২০১৫ সালের এপ্রিলে থাইল্যান্ডের সঙ্কলা প্রদেশের গভীর জঙ্গল ও মালয়েশিয়া সীমান্তে গণকবরের সন্ধান পায় দুই দেশের পুলিশ।
থাইল্যান্ডের গণকবরে ৭০ ও মালয়েশিয়ায় ১৩৯টি মরদেহ উদ্ধার হয়। ওই ঘটনার পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তালিকা তৈরি করে। এতে ২৩ জেলায় ১৭৭ পাচারকারী, ৩৯ গডফাদার এবং থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে অবস্থানরত দুই বাংলাদেশির নাম উঠে আসে।
এর মধ্যে কক্সবাজারেই ৩২ মানবপাচারকারী ও গডফাদার রয়েছে। জেলার মধ্যে মানবপাচারকারীদের শীর্ষে টেকনাফ।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি সত্ত্বেও সাগরপথে মানবপাচার থামানো যাচ্ছে না। গত শনিবার ভোরে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের প্রস্তুতিকালে টেকনাফের বাহারছড়ার কয়েকটি এলাকা থেকে ২১ রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। তাদের মধ্যে ১২ নারী ও ৯ পুরুষ রয়েছে। তারা সবাই বিভিন্ন শিবিরের বাসিন্দা।
আটককৃত জাহেদা বেগম বলেছিলেন, মালয়েশিয়াতে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পরিবারের সদস্যরা মিলে আমাকে স্বামীর কাছে পাঠানোর জন্য দালালের মাধ্যমে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
তিনি আরও বলেন, বৈধপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।
জানা যায়, ট্রলারে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য পাচারকারীরা উপকূলের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ব্যবহার করছে। এগুলো হলো-টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালী, রাজারছড়া, নোয়াখালীপাড়া, জাহাজপুরা, শাহপরীরদ্বীপ, কাটাবনিয়া, মিঠাপানির ছড়া, জালিয়াপালং, ইনানী, হিমছড়ি, রেজুখাল, কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার শহরের খুরুশকুল, চৌফলদি ও মহেশখালী।
এ ছাড়া সীতাকুণ্ড ও মাঝিরঘাট এলাকা হয়েও ট্রলারে মানবপাচার হয়ে থাকে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয়সহ বেশ কয়েক রোহিঙ্গা নেতা। তারা সবাই টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা।
এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী মানবপাচারকারী কয়েক রোহিঙ্গার নামও এর সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, গত ১১ ফেব্রুয়ারি অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ১৩৮ যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। এতে ১৫ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। একই ঘটনায় ৭৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ১৯ দালালকে অভিযুক্ত করে থানায় মামলা করে কোস্টগার্ড। এ মামলায় এ পর্যন্ত নয়জনকে আটক করে পুলিশ।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, মানবপাচার ও ইয়াবা প্রতিরোধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তারপরেও কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী দালালদের মাধ্যমে মানবপাচার করে যাচ্ছে। তাদেরকে যেকোন মূল্যে গ্রেপ্তার করা হবে।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি বেশ কিছু মানবপাচারকারী আটক হয়েছে। যেসব দালাল এখনো পলাতক তাদের খুঁজে বের করা হবে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, যারা মাদককারবারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের একটি অংশ মানবপাচারকারী বা গডফাদার। যাদের অনেকেই রাজনৈতিক পরিচয়দানকারী। এ চক্রকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন বলেন, সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার বন্ধে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড ছাড়াও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।