'দেশের জনগণকে সাথে নিয়ে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে প্রতিরোধ করতে হবে'

পার্বত্যচুক্তির ২৫ বছর পর জুম্মল্যান্ডের দাবি এবং যৌক্তিকতা

fec-image

ভারত উপমহাদেশ কখনই একটি দেশ ছিল না। কালের পরিক্রমায় এটি ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়া হয়েছে। ভারত, আফ্রিকাসহ বিশ্বের কলোনীসমূহের দীর্ঘকালীন স্থায়িত্ব দেয়া এবং অধিবাসীদের ধর্মান্তরিত করার তাগিদে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন ইউরোপীয় ও আমেরিকান ঔপনিবেশিক শক্তি ১৮৮৪ সালে বার্লিন কংগ্রেসে বিবিধ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এর মাধ্যমে ইউরোপ ও আমেরিকা সারাবিশ্বে তাদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার জন্য বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে ওইসব ঔপনিবেশিক শক্তি সুদূরপ্রসারী এবং কঠোর দমনমূলক আচরণের মাধ্যমে তাদের স্বঅঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী বিবিধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। এখনও ওইসব দমন নীতিমালা ও পরিকল্পনা হতে ওইসব শক্তি তাদের সুবিধাদি নেয় এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক এবং ধর্মীয় অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এর ফলে পূর্বের ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের নিয়ন্ত্রণ প্রকৃত পক্ষে হ্রাস না পেয়ে, বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ব্রিটিশ ভারতে এই নীতিমালার আলোকে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু এই দুই রাষ্ট্রই হাজার বছর ধরে লালিত ঐতিহ্যকে দূরে সরিয়ে ব্রিটিশ ডোমেনিয়নের মর্যাদা নিয়ে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ধর্মীয় উন্মাদনা, আঞ্চলিকতাবাদ, স্বকৃষ্টিতে উন্মাদনা, সীমানা বিরোধ, আঞ্চলিক বৈষম্য, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ইত্যাদিতে ক্ষতবিক্ষত এবং দ্বিধাবিভক্ত। এর ফলে পাকিস্তান ভেঙ্গে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। কাশ্মীর, খালিস্তান, পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদ, দক্ষিণ ভারতে তামিলদের আন্দোলন ইত্যাদি আঞ্চলিক ও ক্ষুদ্র জাতি সত্তার বিভক্তি ভারতকে করছে দ্বিধান্বিত। স্বাধীন বেলুচিস্থান, সিন্ধু প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন, তালেবান আন্দোলন ইত্যাদি পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করছে। বার্মা (মিয়ানমার) জাতিগতভাবে গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। অর্থাৎ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত ও বার্মা প্রদেশের চঙকঙকখট ঐরষষ ঞৎধপশ, POKOKLU Hill Track, (Chin Hills, Monipur. Lusar Hills, Pokoklu district, Cachar and Jointia) অঞ্চল আজ ১৮৮৪ সালের নাট্যমঞ্চে নতুন নাটিকা হিসেবে মঞ্চস্থ হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পরবর্তীতে অশান্ত পরিবেশ, ভারতের পূর্বাংশে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির জাতিসত্তা প্রমাণের অদম্য ইচ্ছা এবং মায়ানমারের আভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংগ্রাম ও রোহিঙ্গা বিতাড়ন এই নাটিকারই অংশ।

ভারত ও বার্মার স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আকস্মিকতায় ব্রিটিশ সরকার যেসব গোপন পরিকল্পনা করেছিল, তার একটি হলো ভারতবর্ষ ও বার্মার মাঝে খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকায় একটি রাজকীয় কলোনী (Crown Colony) স্থাপন করা, যা সর্বশেষ পরিকল্পনাকারীর নাম অনুযায়ী ‘Coupland পরিকল্পনা’ হিসেবে ধরা হয়। ব্রিটিশ রাজত্বের (১৮৫৭ হতে) দীর্ঘ প্রায় ১৬৫ বছরে বর্তমান ভারতের সাত বোন, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং বার্মার পশ্চিমে অবস্থিত (রাখাইন/আরাকান এবং চিন প্রদেশ) দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের দরিদ্র, অবহেলিত, অশিক্ষিত প্রকৃতি পূজাকারী, বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলমান অধিবাসীদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত ও আধুনিক রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়। সুদূর উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যে, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতে দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে একটি অবিরত জাতিগত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করা হয়, যা ওইসব জাতি রাষ্ট্রের (Nation State) ঔপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক সৃষ্ট কৃত্রিম সীমানা লক্ষ্য করলেই পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। ভারতের সর্বপূর্বপ্রান্তে মুসলিম অধ্যুষিত অবিভক্ত বাংলাদেশ, বিহার, উড়িষ্যা এবং আসামকে খণ্ডিত করে শুধুমাত্র মুসলিম জনবহুল পূর্ব বাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) বা বাংলাদেশকে সৃষ্টি করা হয়। বাংলাদেশ সৃষ্টির বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক সূত্র ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে এর যথাযোগ্য ভিত্তি নিশ্চিত করতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না। ভারতের পূর্ব প্রান্তের পাহাড়ি সাত বোনকে আঞ্চলিক সীমারেখার দ্বন্দ্বে ব্যস্ত রাখা এবং বার্মার পশ্চিম অঞ্চলে জাতিগত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের পার্বত্য পূর্ববর্তী Crown Colonyর অংশ হবার জন্য ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে পুনরায় অস্থির হয়ে উঠেছে। ইউরোপের একটি শ্রেণি আমেরিকার সহায়তায় ১৯১৬ সালে Sykes-picot গোপন চুক্তির মাধ্যমে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে পরিবর্তন, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন এবং ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছে। কোনো শক্তি, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় উন্মাদনা এখন পর্যন্ত এইসব দেশের ভাগ্যলিখনকে খণ্ডাতে পারেনি।

১৯৪১-১৯৪৬ সালে সাম্রাজ্যবাদী ও ধর্মীয় চেতনার অবিরত নীতিমালার আলোকে একটি ধর্মীয় অধ্যুষিত অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা শেষ মুহূর্তে বাতিল বা স্থগিত করা হয়। কিন্তু তাদের চিন্তা ও পরিকল্পনা পুনঃস্থাপন প্রক্রিয়া ১৯৪৭ সালের পর অব্যাহত থাকে। আজ এই অঞ্চলে Coupland পরিকল্পনার বাস্তবরূপ রাজকীয় কলোনী (Crown Colony) অথবা একটি খ্রিস্টীয় রাষ্ট্র স্থাপনের প্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণ। মিয়ানমার (বার্মা) তাদের পশ্চিম অঞ্চলের চিন প্রদেশে যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠির অধিকারকে প্রায় মেনে নিয়েছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবৎ কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশনের স্থবিরতায় ওই অঞ্চলের জাতিসত্তার স্বকীয়তার আবেগ প্রকাশের পরিস্থিতি পুনরায় তৈরি হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে এই অঞ্চলের উপর চীনের সর্বগ্রাসী প্রভাব ও বিচ্ছিন্নতাকারীদের প্রতি অবিরত নৈতিক সমর্থন।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অস্ত্র বিরতি ও শান্তি চুক্তির অন্তরালে ‘জুম্মল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠা করার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রয়াস (প্রথম প্রয়াস ১৯৭২ সালে শুরু হয়) প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে। মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গারা প্রায় ওই অঞ্চলকে জনশূন্য করে বাংলাদেশে চলে এসেছে। খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী চিন প্রদেশে ক্রমান্বয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে। বর্তমানে মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কাসহ বৌদ্ধ অধ্যুষিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের অধিকাংশই বৌদ্ধধর্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত। মিয়ানমারের বঙ্গোপসাগর ও বার্মা সাগরের উপকূলজুড়ে ঐতিহাসিকভাবে মুসলিমদের উপস্থিতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভবিষ্যতে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে মুসলিম উম্মাহর একটি সরলরেখা সৃষ্টি হতে পারে। পূর্ব তিমুরের মতো প্রাক্তন ব্রিটিশ ভারতের প্রস্তাবিত রাজকীয় কলোনী তথা স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র হলে ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিরাট ছন্দপতন হবে। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণে এই রাষ্ট্র যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।

সময় বলে দেবে, এটি দিবা স্বপ্ন কি না। অসৎ পরিকল্পনা সফল হতে পারে না। কিন্তু এইসব অশুভ শক্তি ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির দিন আমেরিকাতে বসে স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের ঘোষণা দিয়েছে। তারা জুম্মল্যান্ডের এলাকা, পতাকা, জাতীয় সংগীত ইত্যাদি নির্দিষ্ট করেছে। বর্তমানে নাথাম বমের নেতৃত্বাধীন Kuki Chin National Front (KNF) বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে, ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অঞ্চল নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছে। অতি সম্প্রতি বান্দরবান জেলার মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে KNF-কে দমন করার জন্য পুলিশ, আর্মপুলিশ ব্যাটালিয়ন, র‌্যাব এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অপারেশন শুরু হয়েছে। শান্তিশৃঙ্খলা অবনতির বর্তমান পরিস্থিতির দায় স্থানীয় রাজনৈতিক দল, অসামরিক প্রশাসন ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর উপর স্বাভাবিকভাবে বর্তাবে। ইউপিডিএফ গত জুন ২০২২ থেকে নতুনভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি সংশোধনের জন্য সরকারকে প্রস্তাব প্রদান করেছে।

ব্রিটিশ ভারতের সময়কার মিয়ানমার (আরাকান), ভারত (ত্রিপুরা) এবং বাংলাদেশ (অবিভক্ত বাংলা) এই আঞ্চলিক শাসকরা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর কর্তৃত্বের চেষ্টা করছে। আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থার কারণ ওই ঐতিহাসিক সংঘাতের মধ্যে নিহিত আছে। মিয়ানমারে ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় এই এলাকার ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা বিবিধ নামে সশস্ত্র সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র করতে চায়, যা দক্ষিণ সুদান ও পূর্ব তিমুরের ন্যায় চলমান প্রক্রিয়া মাত্র। সুদান ও ইন্দোনেশিয়ার ন্যায় ভারত ও মিয়ানমারকে এই বাস্তবতাকে হয়তো মেনে নিতে হবে।

এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত-ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র, ভারত-জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভারত, চীন-মিয়ানমার, ভারত-মিয়ানমার, রাশিয়া-মিয়ানমার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-মিয়ানমার ইত্যাদি অক্ষ বাংলাদেশকে অক্টোপাসের ন্যায় বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে। মিয়ানমার এবং ভারতের জন্য চিন ও আরাকান প্রদেশ এবং ভারতের সাতবোন রাজ্যের সার্বভৌমত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভূরাজনীতির খেলায় এর বিচ্ছিন্নতা সাপেক্ষে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতা (ফেনী নদীর দক্ষিণ অঞ্চল) জীবন মরণের বিষয়। এটি বিচ্ছিন্ন হলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পৃথিবীর মানচিত্র হতে বিলুপ্ত হবে। সুতরাং যে কোনো ভূরাজনৈতিক খেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ হতে হবে ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনি’। অর্থাৎ সম্পূর্ণ দেশের জনগণকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী দল ও শক্তিকে প্রতিরোধ করতে হবে। সেখানে একটাই সত্য ‘হয় জিতো, না হয় মরো’।

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী, বসবাসরত বাংলাদেশিরা এবং সমতল ভূমি হতে আগত সরকারি অসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ দীর্ঘদিন অব্যক্ত বেদনা নিয়ে শান্তিচুক্তির পর দেশের এই অতি গুরত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান রেখেছে। সমস্যাকে দূরীভূত করার যথপোযুক্ত রাজনৈতিক সক্ষমতা এবং দুর্বল ও অতি ধীর বাস্তবায়ন সমগ্র জাতিকে করেছে অবসাদগ্রস্থ এবং সিদ্ধান্তহীন। ইউএনডিপি-সহ বিবিধ উন্নয়ন সহযোগী এই অঞ্চলের উন্নয়ন এবং শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে বলে তাদের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনায় যথাযোগ্য গুরুত্ব দেয়া দরকার। যেকোন ভূরাজনৈতিক সমস্যার পিছনে আভ্যন্তরীণ ও বহিঃশক্তির অশুভ হাত থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন এবং সঠিকতার বিবেচনায় এই অশুভ শক্তিসমূহ সকল সময়ে গোপনে ভূমিকা রেখেছে এবং তা চলমান রয়েছে। জনগণের নিকটে এই পরিবেশের স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন দেশের সামগ্রিক স্বার্থের সাথে সকলের অন্তর্ভুক্তিকরণ। আমরা খবরের কাগজ অথবা বিবিধ উৎস হতে যেসব তথ্য পেয়ে থাকি সার্বিক পরিস্থিতিতে তা নিতান্তই স্বল্প এবং প্রতিটি স্থানীয় নাগরিকের চাহিদার জন্য অপ্রতুল মনে হয়। সুতরাং শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পর বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে নিম্নের সুপারিশ জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারসহ সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি।

ক) জেএসএসসহ সকল রাজনৈতিক দলের নিকট থেকে শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মুচলেকা গ্রহণ।
খ) সকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলসমূহ, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং তিন জন সার্কেল চিফের অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং দায়দায়িত্ব গ্রহণ।
গ) র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান এবং পুলিশের কার্যক্রম জোরদার করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা।
ঘ) সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাত্রা শূন্য করার তাগিদে যথাযোগ্য আইনগত ভিত্তি ও সমন্বয়ের মাধ্যমে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
ঙ) ইউএনডিপিসহ সকল উন্নয়ন সহযোগীর কার্যক্রম ও পরিকল্পনাকে নিবিড়ভাবে তত্ত্বাবধান করা দরকার। তাদের শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশীদারিত্বমূলক সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয় আইনগত ভিত্তি সৃষ্টি করা।
চ) আগামী সংসদ অধিবেশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বাস্তবায়নের সর্বশেষ অবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ে পর্যালোচনা করা।
ছ) দেশ ও বিদেশে গোপনে এবং সরবে সন্ত্রাসীদের সহায়তাকারীদের চিহ্নিতকরণ, অর্থ ও অস্ত্রের উৎস নিরূপণ, নৈতিক ও ধর্মীয় সহযোগিতা চিহ্নিতকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের মূলোৎপাটন।
জ) স্থানীয় জনগণ এবং বিবিধ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সৃষ্ট মনোবল হ্রাসের কারণসমূহ চিহ্নিত করে তা বৃদ্ধির জন্য যথপোযুক্ত বাস্তবভিত্তিক বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তিকে বুদ্ধিমত্তার সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
ঝ) ভারত ও মায়নমারের সাথে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কার্যক্রম ও সমন্বয় বৃদ্ধি করা এবং প্রয়োজনে ড্রোনভিত্তিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
ঞ) আগামী সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিটি রাজনৈতিক দল কর্তৃক শান্তিচুক্তি পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে সংসদে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা।

পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি নাগরিক আমাদের ভাই ও বোন। তাদের সবার সাহায্য ও সহযোগিতায় এই জাতীয় সমস্যার সমাধান করতে হবে। শুধু মুখের কথায় যেমন চিড়া ভিজবে না, তেমনি শুধু রক্তের বদলে রক্ত নিয়েও সমস্যার সমাধান হবে না। প্রতিটি নাগরিককে জাতীয় ও দেশের স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। কেউই যেন হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে Coupland পরিকল্পনাকে সফল করতে না দেই। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় অপরাপর বন্ধু রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান এবং জাতিসংঘের সহযোগিতায় জনগণকে সাথে নিয়ে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে।

ব্রি. জে. মো. নাসিমুল গনি, পিএইচডি, এমডব্লিউএস, এমডিএস, এএফডব্লিউ, পিএসসি (অব.)
[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: জুম্মল্যান্ড, পার্বত্যচুক্তি, শান্তিচুক্তি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন