“কক্সবাজারে মূলত বর্ষা মৌসুম আসলে নিরাপদ অবস্থানে যাওয়ার মাইকিং আর লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা।”

বর্ষা আসছে, পাহাড় ধসের আশঙ্কা বাড়ছে: চরম ঝুঁকিতে রোহিঙ্গারা

fec-image

ভারি বর্ষণ হলেই পাহাড়ি জনপদে মানুষের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। গভীর ঘুমের মধ্যেও আঁতকে উঠে মন। এই বুঝি পাহাড় ধসে মাটি চাপায় অকালে ঝরবে প্রাণ! বর্ষা আসছে। পাহাড়ে বসবাসকারী ও রোহিঙ্গাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বাড়ছে।

বাড়ছে পাহাড় ধসের মৃত্যুর আশঙ্কা। বাড়বেই না বা কেন, প্রতি বছরই তো পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকে। সেই মিছিলে স্বজনহারাদের কান্নার আওয়াজে ভারি হয় সবুজ পাহাড়ের আকাশ। লাশের সারি আর পাহাড়ি বসবাসকারী ও রোহিঙ্গাদের গগণবিদারী আওয়াজে শোকে স্তব্ধ হলেও কান্নার আওয়াজ পৌঁছায় না পাহাড় খেকোদের কানে। তাই তারা নিজেদের হীনস্বার্থে নির্বিচারে পাহাড় কেটেই চলে। ক্ষমতা, টাকা আর পেশি শক্তির কাছে জিম্মী হয়ে পড়ে স্থানীয় প্রশাসন। দেখেও না দেখার ভান করে তারা।

অপরদিকে বর্ষা যতই ঘনিয়ে আসছে ততই উদ্বেগ বাড়ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে। যাদের বসবাসের জন্য পাহাড় কেটেই তৈরি করা হয়েছে ঘর। যার ফলে পাহাড়ি ঢল ও ভূমিধসের ঝুঁকিতে রয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।

কক্সবাজারে মূলত বর্ষা মৌসুম আসলে নিরাপদ অবস্থানে যাওয়ার মাইকিং আর লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা। ফলে বর্ষা এলেই পাহাড় চাপা পড়ে শত শত মানুষ। অথচ পাহাড় গিলে খেয়ে ফেলছে পুরো কক্সবাজার। একদিকে স্থানীয় লোকজন অপরদিকে রোহিঙ্গারা।

গেল কয়েকবছর ধরে কক্সবাজার, মহেশখালী, রামু ও টেকনাফে স্থানীয় মানুষ পাহাড়ে বসবাসকারী মারা গেলেও নতুন করে যুক্ত হয়েছে উখিয়া-টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাহাড়ের ঢালুতে বসবাসকারীরা। গতবছরও অনেক রোহিঙ্গা শরনার্থী পাহাড় ধসে মারা গেছে। তারপরেও বসবাস থেকে একটুর জন্যও সরে আসেনি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কুতুপালং ক্যাম্প ১৭ এর বিভিন্ন অলি-গলির পাহাড়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের বসবাস। তারা চরম ঝুঁকিতে বসবাস করলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও এনজিওদের কোন কর্নপাত নেই বললেই চলে। মূলত বর্ষাকালে মানুষ মারা গেলে সেই লাশ নিয়ে দেন দরবার ও ত্রান সহায়তা নিয়ে ছুটাছুটি করে। এভাবেই কক্সবাজার শহর ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারীদের অবস্থা।

ক্যাম্প ১৭ এর ৭৭ নং ব্লকের আবদুর রশিদ বলেন-আসলে এখানে বসবাস করছি কোথাও জায়গা না পেয়ে। বাধ্য হয়ে এখন পাহাড়ের ঢালুতে কোনরকম আছি কিন্তু বর্ষাকাল আসছে এখন থেকে বুক কাঁপছে। এখন থেকে মৃত্যুর ভয় কাজ করছে।

একইভাবে সমস্ত রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় পাহাড় খেকোদের আতাতে মাসিক ভাড়ায় লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের পাহাড়ের ঢালে অবৈধ বসবাস রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

আরো দেখা গেছে, অনেক এলাকায় পাহাড় একদম ন্যাড়া হয়ে গেছে। সেখানে কোন গাছপালা নেই। আছে শুধু ঘর-বাড়ি। যার ফলে পাহাড় আর গাছপালা কেটে বসবাস করায় পাহাড় ধসের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী এইসব রোহিঙ্গাদের কারণে বর্ষা মৌসুমে মারাত্মক বিপর্যয় ও পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কক্সবাজার পিপলস ফোরামের মুখপাত্র সাংবাদিক এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজারে পাহাড় ধসের মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু পাহাড় খেকো আর পাহাড়ে বন উজার করে গাছ কাটা অমানুষদের দৌরাত্ম কমে না। প্রশাসন বর্ষা মৌসুম আসলে লোক দেখানো অভিযানে যায় নামেমাত্র। কিন্তু পুরো বছর আর খবর থাকেনা। আমরা এটা দেখতে চাইনা। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের পুনর্বাসন করাও দরকার।

আবার ক্ষমতার দাপটে পাহাড়খেকোরা গড়ে টাকার পাহাড়। সেই দাপটে নির্মম মৃত্যুর শিকার হন সাধারণ মানুষ। মৃত্যুপরী হয় পাহাড়ি জনপদ। প্রতি বছর ঘটে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা। গত বছরও শহরের লাইটহাউস এলাকায়সহ পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা আরও ভয়াবহ এবং মর্মান্তিক। এভাবে বছর যাচ্ছে আর পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে।

তিনি আরো বলেন-স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশঘেরা যে সুন্দর পাহাড় রয়েছে তাও রোহিঙ্গাদের জন্য কেটে ফেলা হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে সমস্ত গাছগাছালি।

অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, কক্সবাজারসহ পাহাড়ি জনপদে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে হাজার হাজার মানুষ। বলতে গেলে কক্সবাজার জেলা ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী এসব মানুষের প্রকৃত সংখ্যা জানা নেই।

সামনে ভারি বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের বড় ধরণের শঙ্কা রয়েছে। তার সাথে নতুন করে এ বছর যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গাদের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। এই বর্ষায় রয়েছে মারাত্মক বিপর্যয় ও ভূমিধ্বসের আশঙ্কা। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতনে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা পাহাড়ের ঢালে বসবাস করছে। তারা পাহাড় ও গাছ কেটে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে বসবাস করায় পাহাড়কে ক্রসেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। তাদের কারণে স্থানীয়রাও রয়েছে ঝুঁকিতে। রোহিঙ্গাদের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে দ্রুত সরিয়ে নেয়া না হলে বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্ষা যত ঘনিয়ে আসছে উখিয়া-টেকনাফে বসবাসরত রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বাড়ছে। সবুজ পাহাড়ে রোহিঙ্গারা পাহাড়ের চূড়া, ঢালু বা নিম্নাঞ্চল বসবাস করছে, ভারি বর্ষণে সেসব স্থানে ভূমিধস ও বন্যায় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে রোহিঙ্গারা। ঝুঁকিতে আছেন পাহাড়ি জনপদের লাখো মানুষ।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটিস ফোরামের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক ফজলুল কাদের বলেন-পাহাড় ধস এই প্রাণহানি কি কেবলই প্রাকৃতিক দুর্যোগ! না শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে রয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগও। পাহাড়খেকোদের দৌরাত্ম বন্ধ করতে হবে। বর্ষার আগেই রোহিঙ্গাদের পাহাড় থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণস্থানে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরানোর পাশাপাশি নতুন করে বসতি, বর্ষা মৌসুমের পূর্বেই পাহাড়ের পাদদেশ এবং ঢালে বসবাসকারীদের অস্থায়ীভাবে অন্যত্র আশ্রয়ের ব্যবস্থা এবং ব্যবসায়িক স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করা, পাহাড় কাটা ও ধসের সঙ্গে যে সকল প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলেই কিছুটা স্বস্তি পাবে মানুষ। এমনটাই আশা করছেন সচেতনমহল।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেছেন, পাহাড়ে নানা উদ্যোগ, বৈঠক, সুপারিশ থাকলেও কোনো কিছুরই বাস্তবায়ন হয় না। ফলে পাহাড় কাটায় অভিযুক্তরা থেকে যায় আড়ালে, ধরাছোঁয়ার বাইরে। তদপুরি পাহাড় কাটার সঙ্গে প্রভাবশালী মহল যুক্ত থাকায় প্রশাসনও কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসে না। ফলে রুটিন ওয়ার্কের মত পাহাড় রক্ষায় উদ্যোগ ও সুপারিশ থাকলেও তা আলোর মুখ দেখে না। আবারও আঘাত হানে। কেড়ে নেয় তরতাজা কিছু প্রাণ। তারপরও পাহাড়ের পাদদেশে মানুষের বসবাস থামছে না। থামছে না পাহাড় ধ্বসও।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো: কামাল হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণদের সরাতে মিটিং করা হয়েছে। অতিবৃষ্টি হওয়ার আগে অবশ্যই নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হবে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তিনি বলেন-অতিঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গা এলাকায় তালিকা করা হয়েছে। তাদের মাঝে কাজ করতে স্বেচ্ছাসেবকও প্রস্তুত রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন