বিশ্ব শরণার্থী দিবস ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা
আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবস (World Refugee Day)। বিশ্বব্যাপী আজকের এ দিনটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়। ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া আন্তর্জাতিক রিফিউজি কনভেনশনে স্বাক্ষরিত দেশগুলোর পাশাপাশি যারা স্বাক্ষর করেনি এবং ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে অনুস্বাক্ষর করেনি, সেরকম অনেক দেশও বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন করে। আবার যেসব দেশ সরকারিভাবে বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন করে না, সেসব দেশে বেসরকারিভাবেও এই দিবস পালন করা হয়। একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শরণার্থী একটা বড় সমস্যা হয়ে উঠছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নানান ধরনের রাজনৈতিক সংকট, বিভিন্ন অঞ্চলের আন্তরাষ্ট্রীয় সংকট এবং নানান আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক বহুমাত্রিক হিসাব-নিকাশের কারণে বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যা ঊর্ধ্বমুখী। যার ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালনের গুরুত্ব ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে লেখা বাহুল্য, ২০০১ সালের ২০ জুন থেকে বিশ্বব্যাপী বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালিত হয়ে আসছে।
১৯৫১ সাল রিফিউজি কনভেনশন স্বাক্ষরের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০১ সাল থেকে বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন করা শুরু হয়। এখানে আরও উল্লেখ্য, ২০০০ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্ব শরণার্থী দিবস অনুমোদন হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিবছর জুন মাসের ২০ তারিখ মূলত আফ্রিকার শরণার্থী দিবস হিসেবে পালিত হতো। পরবর্তী সময়ে এটা বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসেবে পরিচিতি পায়।
প্রতিবছর বিশ্ব শরণার্থী দিবসের একটা প্রতিপাদ্য থাকে এবং রীতি মোতাবেক এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘solidarity with refugees’ যার বাংলা করলে দাঁড়ায় “শরণার্থীদের সঙ্গে সংহতি”। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান শরণার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের ডাক দিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এ দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ এক বাণী দিয়ে বলেছে, “solidarity with people forced to flee also means finding solutions to their plight – ending conflicts so they can return home in safety, ensuring they have opportunities to thrive in the communities that have welcomed them, and providing countries with the resources they need to include and support refugees.” যার সরল অর্থ দাঁড়ায়, “যারা বাধ্য হয়ে এক দেশ থেকে পালিয়ে অন্য দেশে শরণার্থী হয়, তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে হবে এবং সংহতির অর্থ হচ্ছে, তাদের দুরবস্থা দূর করার জন্য একটা সমাধানও খুঁজে বের করতে হবে। তাদের নিজ দেশে সংঘাত বন্ধ করে একটা নিরাপদ প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, নিজ দেশের নিজ সম্প্রদায় যাতে তাদের স্বাগত জানায় সেরকম একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়াও শরণার্থীদের সুস্বাগত জানানোর জন্য এবং ফেরত যাওয়া শরণার্থীর প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়, সেজন্য সে দেশকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।” সুতরাং এ সংহতি অর্থ শুধু ‘লিপ-সার্ভিস’ (ঠোঁটবাক্য) নয়, বরং কার্যকর, বাস্তবিক এবং প্রায়োগিক সহযোগিতা নিয়ে শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানো।
জাতিসংঘের বক্তব্যে মোটাদাগে ইঙ্গিত করা হয়েছে চারটি বিষয়:
এক. নিজ দেশে দ্বন্দ্ব সংঘাতের কারণে মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে।
দুই. যারা ইতোমধ্যে শরণার্থী হয়েছে, তাদের শরণার্থী জীবনের ইতি টানার জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে শরণার্থীরা নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে পারে।
তিন. এই ফেরত যাওয়াটা যাতে স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই নয়, সেজন্য নিজ সম্প্রদায়ের লোকজন যেন প্রত্যাগত এবং প্রত্যাবাসিত শরণার্থীদের আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে এবং স্বাগত জানায়, তার একটা আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
চার. যাতে প্রত্যাগত বা প্রত্যাবাসিত শরণার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে পারে, সেজন্য সেসব দেশকে পর্যাপ্ত আর্থিক, বস্তুগত এবং অন্যান্য সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
সুতরাং আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবসের যে প্রতিপাদ্য সেটা বিশ্ব শরণার্থী সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায়, তারও একটা সংক্ষিপ্ত ফর্মুলা বললে অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু জাতিসংঘ “এটা করতে”, “ওটা করতে হবে” বলেই খালাস; নিজেরা কার্যকর কিছু করতে পারে না। ফলে, বিশ্বব্যাপী শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।
তথাপি, আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রাক্কালে এ ধরনের একটি প্রতিপাদ্য জরুরি গুরুত্ব বহন করে। কেননা, আজ বিশ্বের প্রায় ১২০ মিলিয়ন মানুষকে জোর করে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। এই সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৫ শতাংশ। তন্মধ্যে জন্মস্থান ছেড়ে অন্য দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, অর্থাৎ বর্তমানে বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৫.৩ মিলিয়ন। আর বর্তমানে বিশ্বে স্টেটলেস তথা রাষ্ট্রবিহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ মিলিয়নের অধিক। আমি পত্রিকান্তরে লিখেছিলাম, “১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের নাগরিকত্বের অধিকার আছে। তাহলে যে ১০ মিলিয়নের অধিক মানুষ আজ নাগরিকত্ব না-থাকার কারণে রাষ্ট্রবিহীন হিসেবে পরিচিত, তাদের মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করা হয়েছে। রাষ্ট্রবিহীন মানুষ তো বটেই, কিন্তু যাদের নাগরিকত্ব আছে কিন্তু নিজ দেশেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে, তারা যখন নিজের জীবন বাঁচাতে অন্য দেশের গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং নিরাপত্তা প্রার্থনা করে, তখন তার নিরাপত্তা পাওয়াটা কোনও দয়া বা দাক্ষিণ্য নয়, বরং মানুষ হিসেবে এটা তার অধিকার। জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের শর্ত অনুযায়ী একজন মানুষের যেকোনও দেশে নিরাপত্তা প্রার্থনা করা তার অধিকার।”
তাই, আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য যখন শরণার্থীদের সঙ্গে সংহতি, তখন মানবাধিকারের প্রশ্নটিও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। বিবেচনায় নিতে হবে, ১৯৪৮ সালে স্বাক্ষরিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের মূল দর্শন ও দায়বদ্ধতার প্রতি।
বাংলাদেশে বসে বিশ্ব শরণার্থী দিবসের আলোচনা করার সময় রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ না-আনলে, এ আলোচনার কোনও অর্থই হয় না। আমি পত্রিকান্তরে লিখেছি, “বিশেষ করে ২০১৭ সালের পর একটা বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী (প্রায় সাড়ে ৭ লাখ) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জেনোসাইড থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়ার পর শরণার্থী বিষয়ক আলোচনায় বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশের নামও এখন সমান গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। ২০১৭ সালের আগে রোহিঙ্গারা এ দেশে ছিল না, বিষয়টি তা নয় (প্রায় ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস ছিল)। কিন্তু ২০১৭ সালের পর বিষয়টির তীব্রতা, ভয়াবহতা এবং গুরুত্ব ভিন্ন মাত্রা নেওয়ায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও শরণার্থী বিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশের নাম অনিবার্যভাবে হাজির হয়। কেননা, শরণার্থী বসবাসের ঘনত্বের বিবেচনায় উখিয়ার কুতুপালং এখন সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ের জেনোসাইডের উদাহরণ হিসাবেও রোহিঙ্গাদের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী গণহারে আলোচনা আসে।”
তাই, ১৯৫১ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত আন্তর্জাতিক রিফিউজি কনভেনশনে বাংলাদেশ কোনও স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হয়েও এবং শরণার্থী বিষয়ক ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর না-করেও (প্রকৃতপক্ষে ১৯৫১ সালে এবং ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশ নামক কোন রাষ্ট্রও ছিল না), বাংলাদেশ প্রায় ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সহায়তায় এদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে। তাছাড়া, বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির বাংলাদেশে অবস্থিত। কাজেই বাংলাদেশ না-চাইলেও বিশ্ব শরণার্থী দিবসের আলোচনায় বাংলাদেশের নাম আসাটা অনিবার্য। বরং, বাংলাদেশ এ দিবসকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগাতে পারে। বাংলাদেশে অবস্থিত জাতিসংঘসহ সব বিদেশি মিশনের প্রতিনিধিদের চায়ের দাওয়াত দিয়ে প্রায় ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সমস্যার কীভাবে সমাধান হতে পারে, তা নিয়ে একটি কার্যকর, ফলপ্রসূ এবং গঠনমূলক আলোচনা সামনে আনতে পারে। ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ কী কী ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, সেটাও তুলে ধরতে পারে। এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত এবং তাদের কার্যকর সহযোগিতা কামনা করতে পারে। যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বাংলাদেশ, তাই বাংলাদেশকেই আওয়াজ দিতে হবে। “না-কাঁদলে মা-ও যে বাচ্চাকে দুধ দেয় না”, এটা আমাদের কারও অজানা থাকার কথা নয়।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: বাংলাট্রিবিউন