বাংলাদেশ না মণিপুর?

ভারত নীরবে যে ভূরাজনীতি পছন্দ করছে

fec-image

একটি দেশ কতটা ‘গুরুতর’- তা বোঝার সবচেয়ে কঠিন কিন্তু সহজ উপায় হলো এই প্রশ্নে: সে কি প্রতিদিন নিজের ভূখণ্ডে একটিমাত্র ট্রাক চালাতে পারে, এমনকি যখন সীমান্ত উত্তেজনাপূর্ণ আর রাজনীতি অশান্ত?

২০২৩ সালের ৩ মে মণিপুরে সহিংসতার পর থেকে, আর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন নয়াদিল্লি ঘোষণা করল যে, ভারত-মিয়ানমার ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’ (এফএমআর) বাতিল করে পুরো ১৬৪৩ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া দেবে, তখন থেকেই ভারত সেই প্রশ্নের উত্তর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দিতে পারছে না। বরং এখন দেখা যাচ্ছে- ভারত নীরবে, কিন্তু স্পষ্টভাবে, তার নিজস্ব উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পৌঁছাতে বাংলাদেশের বন্দর ও সড়কগুলোর ওপর নির্ভর করছে। এটি শুধু পরিবহন সহজতার ব্যাপার নয়- এটি একটি ভূরাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

ভারতের পূর্বমুখী যাত্রার এখন দুইটি দরজা আছে। প্রথমটি হলো বাহ্যিক, সহযোগিতামূলক ও স্থিতিশীল দরজা- বাংলাদেশের মাধ্যমে। এখানে মালবাহী কনটেইনার চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরে নামে, বাংলাদেশের মহাসড়ক ধরে ত্রিপুরা, মেঘালয় বা অসমে প্রবেশ করে কোনো জাতিগত চেকপয়েন্ট বা গ্রামীণ সংঘাত ছাড়াই। দ্বিতীয়টি হলো অভ্যন্তরীণ, কৌশলগত দরজা- মণিপুর হয়ে সংঘাতপীড়িত মিয়ানমারে প্রবেশের পথ: ইম্ফল-মোরে-তামু-মান্দালেমে সোত। এটি সেই রুট, যা ভারত গত এক দশক ধরে আসিয়ান ও জাপানকে দেখিয়ে আসছে প্রমাণ হিসেবে যে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ কোনো স্লোগান নয়। একটি দরজা শান্ত ও বিদেশি, অন্যটি আমাদের- কিন্তু ক্ষতবিক্ষত। এখন ভারত ব্যবহার করছে সেই শান্ত, বিদেশি দরজাটি।

কেনো মণিপুর সংকীর্ণ হয়ে গেল?
কারণ ২০২৩ সালের সহিংসতা শুধু জীবন ও ঘরবাড়ি কেড়ে নেয়নি, এটি ‘বিশ্বাসের ভূগোল’ ভেঙে দিয়েছে। উপত্যকা ও পাহাড় আর একসঙ্গে চলার মতো আচরণ করছে না। একটি করিডর বারবার জিজ্ঞাসা করতে পারে না- ‘এখন আমি কার এলাকায় ঢুকছি?’ এর জন্য প্রয়োজন একটানা, রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ভূমি। মণিপুর এখনো তা ফিরে পায়নি। এরপর এল ২০২৪ সালের নিরাপত্তাকেন্দ্রিক সংকেত- ভারত ঘোষণা করল, অবৈধ পারাপার, মাদক ও বিদ্রোহী চলাচল নিয়ন্ত্রণে পুরো সীমান্তে বেড়া দেবে এবং এমএফআর বাতিল করবে। এই সিদ্ধান্তের কারণ যথার্থ- কারণ ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমার গৃহযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু এর ফলে সেই নাগা, কুকিজো ও মিজো সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোই চেপে গেল, যেগুলোর ওপর ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির ভিত্তি দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ, বাণিজ্যের জন্য যে চলাচল বাড়াতে চেয়েছিল ভারত, নিরাপত্তার জন্য সেটিকেই সীমিত করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ, বিপরীতে, ভারতকে দেয় স্থিতিশীলতা, কূটনীতি ও গতি- একই সঙ্গে। ঢাকা চুক্তি সই করতে পারে, তা বাস্তবায়নও করতে পারে। এর রাস্তাগুলো জাতিগত সংঘর্ষের হাতে জিম্মি নয়। প্রতিটি ভারতীয় ট্রাক, যা বাংলাদেশের মহাসড়ক ব্যবহার করে, নিঃশব্দে ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বকে গভীর করে তুলছে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে- যেখানে মিয়ানমার দিক থেকে এখন চীন চাপ বাড়াচ্ছে। ২০২৫ সালের জন্য এটি নিঃসন্দেহে যুক্তিসঙ্গত পছন্দ। কিন্তু যুক্তিসঙ্গত মানেই যথেষ্ট নয়। প্রতিটি কনটেইনার, যা চট্টগ্রাম হয়ে আগরতলা বা ডাউকিতে পৌঁছায়, সেটি তেনৌপালে কোনো চালককে মজুরি দেয় না, মোরেতে কোনো কাজ তৈরি করে না, মণিপুরের উপত্যকা ও পাহাড়কে বোঝায় না যে তারা ভারতের পূর্বমুখী ভবিষ্যতের কেন্দ্রে আছে।

এই ধারা যদি চলতে থাকে, মণিপুর শুধু আহতই থাকবে না- এটি পাশ কাটানো রাজ্য হয়ে পড়বে। আর একটি পাশ কাটানো সীমান্ত অঞ্চল সবসময়ই তিক্ত হয়- আর তিক্ত সীমান্ত অঞ্চল পরে স্থিতিশীল করতে আরও ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। চীন তার ইউনান-মিয়ানমার করিডরকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এমন এক মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে, যা মণিপুরের চেয়েও রক্তাক্ত। তবু তারা কিয়াউকফিউ প্রকল্প ছাড়েনি। ভারত, বরং, কঠিন বাস্তবের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলার বদলে এখন যেন কঠিন বাস্তবকে এড়িয়ে গড়ছে। ব্যাংকক, জাকার্তা বা টোকিওর মতো শহরের পর্যবেক্ষকদের কাছে এটি অস্বস্তিকর বার্তা হতে পারে- ‘বেইজিং যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নির্মাণ করে; দিল্লি দাঙ্গার চারপাশ দিয়ে ঘুরে যায়।’ এটি সেই চিত্র নয়, যা ‘বিশ্বমানের শক্তি’ হতে চাওয়া ভারতের জন্য কাম্য।

তাহলে একটি বিশ্বমানের ভারতকে কী করতে হবে?
এক. ইম্ফল-মোরে অক্ষকে কৌশলগত করিডর হিসেবে ঘোষণা করতে হবে, যেমন সিলিগুড়ি করিডরকে করা হয়েছে। একবার কোনো রাস্তা কৌশলগত হিসেবে স্বীকৃতি পেলে সেটি পায় সুরক্ষা, অর্থ ও রাজনৈতিক মনোযোগ।

দুই. ইম্ফল-মোরে পথে নির্দিষ্ট সময়ে সুরক্ষিত বাণিজ্য কাফেলা চালাতে হবে, সামাজিক পুনর্মিলন যতদিন লাগুক না কেন। বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য গতি নয়, ধারাবাহিকতাই জরুরি।

তিন. মিয়ানমারে প্রবেশের জন্য একাধিক পূর্বমুখী প্রবেশপথ তৈরি করতে হবে, যেন একটি সীমান্ত বন্ধ হলেই ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ পক্ষাঘাতগ্রস্ত না হয়।

চার. মণিপুরকে আগে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে- শুল্ক ইয়ার্ড, ড্রাই পোর্ট, লজিস্টিক প্রশিক্ষণ ও সীমান্ত-বাণিজ্য সেবা সেখানে স্থাপন করতে হবে, যেন মানুষ প্রকৃত অর্থনৈতিক সুফল দেখতে পায় এবং তাই তারা রাস্তাটিকে রক্ষা করে।

পাঁচ. পুরোনো এমএফআর বাতিল হলেও সীমান্তের মানবিক চেতনা জিইয়ে রাখতে হবে- স্থানীয় পাস ও সাপ্তাহিক হাটের মাধ্যমে, যাতে সীমান্তবাসীরা মনে না করে ভারতের উত্থান তাদের জীবনের বিনিময়ে এসেছে। শেষ প্রশ্নটা তাই আসলে ‘বাংলাদেশ না মণিপুর?’ নয়- এটি একটি ভুল প্রশ্ন। সত্যিকারের প্রশ্ন হলো- ভারত কি সেই শক্তি হতে চায়, যে কেবল প্রতিবেশীরা শান্ত থাকলে উত্থিত হয়, নাকি সেই শক্তি, যে নিজের সীমান্তে গোলমাল থাকলেও, প্রতিবেশী যুদ্ধের মধ্যেও এগিয়ে যায়?

মহাশক্তিরা দ্বিতীয়টাই করে। তারা অসম্পূর্ণতার মধ্য দিয়েই নির্মাণ করে। তারা কোনো অস্থায়ী বিকল্পকে কখনও কৌশলগত রাজ্যের স্থায়ী প্রতিস্থাপন হতে দেয় না। যদি ভারত চায়, বিশ্ব তাকে শুধু বড় বাজার হিসেবে নয়, বরং বিশ্বস্ত মহাদেশীয় শক্তি হিসেবে চিনুক। তবে এটাই সেই মানদণ্ড, যা তাকে পূরণ করতে হবে।

(অনলাইন কাউন্টার কারেন্ট থেকে অনুবাদ)

লেখক : ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, রেজিস্ট্রার, খোংনাংথবা বিশ্ববিদ্যালয়, ইম্ফাল, মণিপুর।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: প্রবন্ধ, বাংলাদেশ, ভারত
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন