অস্ত্র সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় জেএসএস-ইউপিডিএফ: শান্তির আন্দোলন ব্যর্থ

এস বাসু দাশ

বান্দরবান, ১২ সেপ্টেম্বর: পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)সহ বিবাদমন সংগঠনগুলো অস্ত্র ভান্ডারে বলিয়ান হচ্ছে।

আদর্শিক রাজনীতি থেকে সরে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতিকে আরো ব্যাপক ভাবে অস্ত্র নির্ভর করে আধিপত্য ধরে রাখতে নতুন মিশন নিয়ে তারা মাঠে নামছে । ফলে, পাহাড়ে শান্তির জন্য বিভিন্ন উদ্দ্যেগ গ্রহন করলেও কার্যত তা ব্যর্থ হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ে শান্তির জন্য নাগরিক কমিঠি নামে একটি প্রেসার গ্রুপ আড়াই বছর আগে কাজ শুরু করে। তাদের ডাকে সাড়া দেয় ইউপিডিএফ অন্যদিকে জেএসএস এই ব্যাপারে সাড়া দেয়নি। চলতি বছর পিসিপির দুই যুগপূর্তী অনুষ্ঠানে উভয় দলের নেতারা একে অপরকে যে কোন মূল্য প্রতিরোধের ঘোষনা দেয়।

আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা নেতারা দলের কর্মীদের উজ্জীবিত করতে ফের প্রকাশ্যে বেড়িয়ে এসেছে। কারন, সামনের দিনগুলোতে পাহাড় আরো অশান্তের জন্য পূর্বাভাস হিসাবে দেখছে স্থানীয়রা।

এ বছর দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে এসে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত খীসা বলেন, আন্দোলনের সামনে দিনগুলো হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ, আসতে পারে মনুষ্য সৃষ্ট বাধা, সকল প্রকার বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে।

অন্যদিকে এর পাল্টা জবাব হিসাবে রাঙামাটিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ) `চুক্তিবিরোধী শক্তি` উল্লেখ করে। তাদের নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে প্রয়োজনে সোজা আঙুল বাঁকা করার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সন্তু লারমা সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) নেতারা।

kk

সংঘাতের শুরু যেভাবে :

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, বিশেষ অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়ার দাবি এবং পাহাড়িদের বাঙালি হিসেবে জাতীয় পরিচয়ের প্রতিবাদে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

অধিকার আদায়ে সশস্ত্র আন্দোলন করার পর সংগঠনটি ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তিতে আদিবাসীদের মুক্তি মিলবে না, কালো চুক্তি উল্লেখ্য করে প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর থেকে মূলত চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থানকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে আধিপত্য ধরে রাখতে একে অপরকে ঘায়েল করতে মাঠে নামে সংগঠন দুটি।

শান্তির আহ্বানে সাড়া নেই: তিন পার্বত্য জেলায় আদিবাসীদের গড়া নাগরিক কমিটি জেএসএস ও ইউপিডিএফ এর সংঘাত বন্ধ করে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করে উভয় সংগঠনকে শান্তির পথে আসার জন্য আহব্বান জানালে ইউপিডিএফ স্বাগত জানালেও জেএসএস এর কোন জবাব মেলেনি।

বান্দরবান নাগরিক কমিঠির আহবায়ক রাজপুত্র নু শৈই প্রু বলেন, সংঘাতময় কর্মকান্ড পার্বত্য জেলাসহ দেশের জন্য ভাল নয়, দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ পাহাড়ে শান্তি চায়।

তিনি আরো বলেন, সহিংসতার দিক কেউ পছন্দ করে না, আমর বিশ্বাস তারা বিষয়টি অনুধাবন করবে, তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনবে।

পাহাড়ে অপহরণের রেকর্ড:

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির লংগদু থেকে ৫২  আদিবাসীকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে ১৫ জনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও অন্যদের কোন হদিস নেই। ইউপিডিএফকে দায়ী করা হলে তারা তা অস্বীকার করে। অন্যদিকে তাদের উদ্ধারে প্রশাসনের কোন উদ্দ্যেগ না থাকা এবং উভয় দলের নমনীয়তার অভাবে অপহৃতরা বেঁচে আছে কিনা সেই ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছে পার্বত্যবাসী।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি একই জেলার কুতুকছড়ি এলাকা থেকে গ্রামীণফোনের একজন প্রকৌশলীসহ দুই কর্মচারী অপহৃত হন ইউপিডিএফ সমর্থিত সন্ত্রাসীদের হাতে। এরপর গ্রামীনফোন তিন জেলায় তাদের অফিস গুটিয়ে নেয়। খাগড়াছড়ির পানছড়ির ধুধুক ছড়া সন্ত্রাসীরা প্রায় ৪০ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ৮ জুলাই রাঙামাটি থেকে সরকারি মোবাইল অপারেটর টেলিটকের পাঁচ কর্মকর্তাকে অপহরণ করে দুর্বত্তরা পরে মুক্তিপনের মাধ্যমে তারা ছাড়া পায়।

শান্তিচুক্তির পর হত্যা-অপহরণ:

সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকে জেএসএসের ৩ শতাধিক, ইউপিডিএফের ২৪৭ জন, ও জেএসএস এমএন লারমার ২৪ জন নিহত এবং অপহরণ হয়েছে ১ হাজারের ও বেশি। পরস্পর সংঘাতে প্রাণ গেছে আদিবাসীদের।

পাহাড়ে শান্তির ডাক প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বান্দরবান জেলা সভাপতি মিল্টন ত্রিপুরা বলেন, নাগরিক কমিঠি জেএসএসকে শান্তির জন্য কোন আহব্বান জানায়নি, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অস্পষ্ট।

আসছে অস্ত্র:

ইউপিডিএফ ও জেএসএসের মধ্যে ১৯৯৭ সাল থেকে যে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে তা বন্ধে সাড়া দিচ্ছে না দলগুলো। সংঘাত বন্ধে দুটি দলের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগও বার বার ভেঙে যাচ্ছে। পাহাড়ে প্রতিদিন অপহরণ, চাঁদাবাজি, খুন-গুমের ঘটনা ঘটছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা থেকে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে বিভিন্ন সূত্রে।

ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ অন্য দৈনিকগুলো তাদের খবরে জানায়, গত ৮ মার্চ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করে মিজোরাম পুলিশ ও আসাম রাইফেলস। অভিযানে ৩১টি একে-৪৭ রাইফেল, একটি এলএমজি, একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ৮০৯টি গুলি ও ৩৩টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। এ চালানের মন্তব্য ছিল পার্বত্য জেলা।

এ সময় সবুজ চাকমা ওরফে অংশুমান চাকমা (রাঙামাটি), রবি চাকমা ওরফে রুপেন্দু খিসা (খাগড়াছড়ি)ও মণি ত্রিপুরা ওরফে অজিত ত্রিপুরা (খাগড়াছড়ি)। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের চেয়ে তারা একে অপরকে ঘায়েল করতেই সংঘাত বাড়িয়ে দেবার কারণে মরছে মানুষ, নি:স্ব হচ্ছে ক্ষোধ আদিবাসীরা।

আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রসিত প্রকাশ্যে:

প্রসিত খিসা, আত্মগোপনে থেকে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দেন। সরাসরি দেখা দূরে থাক, ফোনে কথা বলাটায় যেন ঢাকা ও পাহাড়ের সাংবাদিকদের জন্য দুস্কর।

পাহাড়ের এই অন্তরালের রাজনীতিবীদ ইউপিডিএফের কর্নধারকে ২০০১ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রকাশ্যে দেখা গেলেও দীর্ঘ এক যুগ পর বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)-এর প্রতিষ্ঠার দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে  এ বছর খাগড়াছড়িতে বক্তব্য রেখে প্রকাশ্যে আসেন। পাহাড়ের এই আত্মগোপনে থাকা নেতা ফের প্রকাশ্যে আসার কারনে অনেকে মনে করছে, নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে ও নিজেদের শক্তির জানান দিতেই তার এই প্রকাশ্যে আসা।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর প্রচার বিভাগের প্রধান নিরন চাকমা বলেন, জেএসএসকে অনেকবার শান্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সন্তু লারমা চাচ্ছেনা শান্তি আসুক, চাচ্ছেনা পাহাড়ে দ্বন্ধ-সংঘাতের সমাধান হোক।

সৌজন্যে: রাইজিং বিডি

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “অস্ত্র সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় জেএসএস-ইউপিডিএফ: শান্তির আন্দোলন ব্যর্থ”

  1. আদিবাসী শব্দটি যেখানে সরকারী স্বীকৃতি নেই সেখানে কোন নিউজ,বুলেটিন বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এই শব্দের ব্যবহার অবাঞ্চনীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন