আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও নৃগোষ্ঠীসমূহের প্রাপ্তি

fec-image

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, যে দিন ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন আমাদের ভাষা শহিদরা। এ দিনটির প্রতি ও পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে প্রস্তাবটি পাশ হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে।

এ গৌরবময় স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা ও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মনে হতে পারে যে, এ সবকিছুই ঘটে গেছে রাতারাতি। কিন্তু এ দিনটিকে ইউনেস্কোর কাছে তুলে ধরতে, তাৎপর্য বোঝাতে, বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নিতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে যে কত প্রতিকূলতা পার হতে হয়েছে, কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কতটা কাজ করতে হয়েছে তা অনেকেরই অজানা।

২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন কানাডার দুই বাঙালী প্রবাসী- রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। তবে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বেসরকারি ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেনি। অনুরোধ/প্রস্তাব একটি সদস্য রাষ্ট্র থেকে জমা দিতে হয়েছিল। তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এই বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন, তখন হাতে ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। আওয়ামী লীগ সরকার তখন প্রবাসীদের নেতৃত্বাধীন ‘মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’র সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং প্রস্তাবনাটি ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউনেস্কোর কাছে প্রেরণ করে। জরুরিভিত্তিতে আমাদের মিশনগুলোকে অন্যান্য সদস্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল; পাশাপাশি এই প্রস্তাবটির জন্য তাদের সমর্থন চাওয়া হয়েছিল। এরপর তৈরি হলো ইতিহাস।

বিশ্বের প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ আনুমানিক ৬০০০টি ভাষায় কথা বলেন। এর মধ্যে মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে আছে প্রায় ৪২টি ভাষাভাষীর মানুষ। বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫০টি, এদের প্রায় সবার নিজস্ব ভাষা থাকলেও বর্ণমালা আছে অল্প কয়েকটি নৃগোষ্ঠীর। চট্টগ্রামের পার্বত্য জেলাগুলোতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, খুমী, খেয়াং, লুসাইসহ রয়েছে ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। বর্তমান সরকার নৃগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে।

পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের ভাষা ও বর্ণমালা সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০১৭ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিজ নিজ মাতৃভাষার বই পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্য বই হিসেবে বিতরণ করে আসছে। সপ্তাহে একদিন পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিদ্যালয়ে নিজ মাতৃভাষার এসব বই পড়তে ও জানতে নিজস্ব বর্ণমালা শেখানো হচ্ছে।

২০২২ সালে বছরের প্রথম দিন পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি নিজ মাতৃভাষার বই পেয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ৩২ হাজার ৬৪৯ জন শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়েছে নিজ মাতৃভাষার বই। বছরের প্রথম দিন নিজ মাতৃভাষার বই পেয়ে আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত এসব মানুষ।

নৃগোষ্ঠীগুলোর নিজ ভাষার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি করেছে সরকার। এর মাধ্যমে নৃগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরি হচ্ছে। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য সরকারকে পাশাপাশি সহযোগিতা করে কাজ করে যাচ্ছে পার্বত্য জেলা পরিষদ।

বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি উন্নয়নে বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে সরকার। এসব প্রকল্প হাতে নেবে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ। এ লক্ষ্যে আগামী এপ্রিলের মধ্যে বৈসাবির (পার্বত্য অঞ্চলের নৃগোষ্ঠীগুলোর ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব) আগে সাতটি সম্প্রদায়ের সাতটি ভাষা শিক্ষার অভিধান তৈরি, বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রাচীন অলংকার, ঐতিহ্যবাহী পোশাক সংরক্ষণ এবং ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান প্রশিক্ষণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা পেশ করতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠনগুলোর প্রতি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সংরক্ষণে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলা হয়, সরকার বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পার্বত্য জেলা পরিষদকে ক্ষমতা দিয়েছে। এ লক্ষ্যে রাঙামাটি জেলা সদরে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলাসহ ভাষা ও সংস্কৃতি উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য আহ্বান জানানো হয়।

একটি জাতির যখন নিজ ভাষায় শিক্ষার সুযোগ থাকে না তখন তারা এমনিতেই পিছিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়টি সর্বপ্রথম অনুধাবন করেছিলেন। স্বাধীনতার পরপরই তিনি পার্বত্য অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর দেন।

পার্বত্য অঞ্চলে স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে মাত্র ৪৮ কিমি রাস্তা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে নির্মাণ করেছে প্রায় ৩০০০ কিমি রাস্তা, অসংখ্য ব্রিজ ও কালভার্ট। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ও উদারতার ধারা অব্যাহত ছিল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে। পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে শ্রীমতি সুদীপ্তা দেওয়ানকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। তিনি চাইলে যেকোনো বাঙালি নারীকেও তা দিতে পারতেন।

জাতির পিতার শাসনামলে এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৈদেশিক বৃত্তি মঞ্জুর করা হয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীয় ছাত্র-ছাত্রীকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি, কিউবা এবং ভারতে পাঠানো হয়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীয় ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহারের জন্যে পাকাদালান বরাদ্দ করা হয়। মূলত পাহাড়ের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপের ফলে, যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৬১ সালে শিক্ষার হার ছিল ১২.৭৯%, ১৯৭৪ সালে তা ১৯.৪৮% এ উন্নীত হয়।

সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও তার সরকার। বর্তমানে যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষার হার ৫৯.৮২ শতাংশ সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ এবং লক্ষণীয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের শিক্ষার হার ২৩%। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ ছিলো না। বর্তমান সরকার সেখানে ১টি বিশ্ববিদ্যালয় (আরও একটির কাজ চলমান) এবং ১টি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছে। আশির দশকে যেখানে উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১১টি সেটা এখন ৪৭৯টি, প্রায় প্রতিটি পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার হার ২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৪.৬২ শতাংশে এ পৌঁছেছে। এর বাইরেও নিয়মিতভাবে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদানের কার্যক্রম চলছে।

এছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১টি থেকে ৩টি করা হয়েছে, হাসপাতালের সংখ্যা ৩টি থেকে ২৫টিতে উন্নীত হয়েছে। যেখানে কোনো খেলার মাঠ ছিলো না বর্তমানে সেখানে ৫টি স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। কলকারখানা, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ১৯৩টি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১৩৮২টিতে উন্নীত হয়েছে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি স্থল বন্দর নির্মাণ এবং টেলিযোগাযোগের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বাণিজ্য এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ফলে সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এককালের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভূত উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অসাম্প্রদায়িক ঐক্যবদ্ধ চেতনা ও তার পিতার সমান উদারতার ফলেই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাহাত্ম্য বুঝতে হলে এই উন্নতিগুলোর দিকে তাকাতে হবে। এটি শুধু বাঙালির জন্য গৌরবের নয়, এই নৃগোষ্ঠীসমূহের মানুষগুলোরও গৌরব। নিজ ভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছে বলেই তাদের অগ্রযাত্রা এখন টেকসই ও অপ্রতিরোধ্য। সব ভাষাভাষী মানুষকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, এগিয়ে যাচ্ছে— “আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।”

লেখক: হামজা রহমান (অন্তর); কলামিস্ট, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও ছাত্রনেতা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন