এগারো অদৃশ্য প্রকল্প দেখিয়ে বিলাইছড়িতে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য আত্মসাৎ

courruption-220x118

আলমগীর মানিক,রাঙামাটি:
রাঙামাটি জেলার প্রত্যন্ত বিলাইছড়ি উপজেলার  বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ পাওয়া লাখ লাখ টাকার খাদ্যশস্য লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত  উপজেলার শীর্ষ জনপ্রতিনিধি ও শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। একইভাবে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের তিন পার্বত্য জেলায় বরাদ্দকৃত হাজার হাজার টন খাদ্যশস্যও হরিলুট।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়ে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন পার্বত্য জেলার আর্থ-সামাজিক ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নসহ দারিদ্র বিমোচনের লক্ষে প্রতি বছর বর্ষা ও শুস্ক মৌসুমে হাজার হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়। তিন পার্বত্য জেলাপরিষদ ও ২৫টি উপজেলায় পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ কর্মসুচী আওতায় এ বরাদ্দ করা হয়।
তার ধাবাহিকতায় বিলাইছড়ির বিভিন্ন ইউনিয়ন, ওয়ার্ডে মেম্বার ও প্রবীণ ব্যক্তিদের মুঠোফোনে কথা বলে জানা গেছে, এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমুলক প্রকল্পের নামে লাখ লাখ টাকার খাদ্যশস্য বরাদ্দ আনা হলেও বিপরীতে কোন রকম কাজ না করেই সেগুলো কালোবাজারে বিক্রি করে আত্মসাত করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে প্রকাশ, পার্বত্য চট্রগ্রাম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের অনুমোদনক্রমে ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ‘বিশেষ প্রকল্প কর্মসূচি’ থেকে বিলাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বিলাইছড়ি এর নিকট (৭০মে.টন চাল ও ৩০ মে.টন গম) সর্বমোট ১শত মে.টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। ১১টি শর্ত সাপেক্ষে পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়-১ শাখা স্মারক নং ২৯.০০.০০০০.২২৩.০২০.০৫.১২-১১৯ তারিখ ০৯/০৬/২০১৩ খ্রিঃ এর প্রেক্ষিতে সহকারী সচিব মোঃ নুরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত পত্রমূলে উক্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। বরাদ্দ পত্রটির ৭ নম্বর শর্তে ৩০ জুন ২০১৩খ্রিঃ তারিখের মধ্যে বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য দ্বারা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন করার  এবং ১১ নম্বর শর্তে বিলাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিলাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেয়ার উল্লেখ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, উল্লেখিত ১শত মে.টন খাদ্যশস্যের অনুকূলে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিত ১৪টি প্রকল্প হতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ১১টি প্রকল্প গ্রহণ করে। তৎমধ্যে বিলাইছড়ি ইউনিয়নে ২টি, কেংড়াছড়ি ইউনিয়নে ১টি ও ফারুয়া ইউনিয়নে ৮টি প্রকল্প নেয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়,প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য খাদ্যগুদাম থেকে নির্দিষ্ট সময়ে উত্তোলন করার পরেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো রহস্যজনক ভূমিকার কারণে প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করেনি।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলায় পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১০০ মে.টন খাদ্যশস্যের ১৪টি প্রকল্প থেকে নেয়া ১১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় কর্তৃপক্ষের রহস্যজনক ভুমিকার কারণে প্রকল্পের কাজের কোন অগ্রগতি নেই।
পার্বত্যমন্ত্রণালয় বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের স্বাক্ষরিত ১৪টি প্রকল্পের কোন হদিস নাই। ৩নংফারুয়া ইউনিয়নের ছাবাতলী হতে মন্দিরাছড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার বরাদ্ধ ৯ মে.টন,১নং বিলাইছড়ি শালবাগান হতে লতাপাহাড় পর্যন্ত সংস্কার ৭ মে.টন, ৩নংফারুয়া ইউনিয়নের মন্দিরাছড়া পশ্চিম পাড়া হতে পুর্ব মন্দিরাছড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ৭ মে.টন, ৩নংফারুয়া এগুজ্যাছড়ি পাড়া কমিনিটি সেন্টারের ভিটার জঙ্গল পরিস্কার করণ ৭মে.টন, ১নং বিলাইছড়ি তিন কোনিয়া ত্রিপুরা পাড়া হতে ঝান্ডমোন পাংখোয়া পাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ৮ মে.টন,৩নংফারুয়া বড়হার থেকে রাইমংছড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ৮মে.টন, ৩নংফারুয়া এগুজ্যাছড়ি জাংবিল এলাকার জনসাধারণের জলীয় উৎসবের বাধঁ সংস্কার ৮ মে.টন, ৩নংফারুয়া বড়থলির টাইগার পাড়া হতে এসমপাড়া যাওয়ার রাস্তা সংস্কার ৭মে.টন,২নং কেংড়াছড়ির বেগেনাছড়ি মোন হতে পরীখোলা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ৭মে.টন, ৩নংফারুয়া বড়থলির ধুপ পানি ছড়া হতে ত্রিসীমানা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ৭ মে.টন,৩নংফারুয়া বড়থলির বড় পুবুর পাড় ত্রিপুরা পাড়া হতে রাস্তা সংস্কার ৬মে.টন, ৩নংফারুয়া বড়থলির সেপ্রু পাড়া হতে চারজিং পাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ৭ মে.টন, ৩নংফারুয়া পুর্ব মন্দিরাছড়া বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ সংস্কার ৬ মে.টন ও ৩নংফারুয়া পশ্চিম মন্দিরাছড়া বৌদ্ধ বিহারের মাঠ সংস্কার নামে এসব অদৃশ্য প্রকল্প দেখিয়ে আত্বসাত করার অভিযোগ উঠেছে। এই বিষয়ে প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়া না হয় তাহলে অতিদ্রুত এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে মামলার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।

শালবাগান হতে লতাপাহাড় পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার হয়েছে কিনা জানতে চাইলে লতাপাহাড় এলাকার গ্রাম প্রধান রামলিয়ান পাংখোয়া প্রতিবেদকে জানান আমি এইসব বিষয়ে অবগত নই।
প্রকল্পের জন্য কত মে.টন বরাদ্দ পেয়েছেন এবং এজন্য কার নিকট থেকে টাকা গ্রহণ করেছেন এবং কত টাকা পেয়েছেন এ প্রসঙ্গেও তরুণ কান্তি হেডম্যান জানান, আমাকে যাই দিয়েছে তাই দিয়ে একটি প্রকল্পের কথা বলতে পারি সব গুলো প্রকল্পের বিষয়ে জানি না।
কেংড়াছড়ি ইউনিয়নের বেগেনাছড়ি মোনপাড়া হতে পরীখোলা মোনপাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের কাজ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান অমরজীব চাকমা জানান আমি এই বরাদ্দের বিষয়ে জানি না। তবে এলাকাবাসী জানিয়েছে এখানে কোন ধরনের রাস্তা সংস্কার করা হয়নি।  
এবং পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রকল্প কর্মসূচি উপজেলা চেয়ারম্যানের পরামর্শক্রমে নেয়া ১০০ মে.টন প্রকল্পের বরাদ্দ সম্পর্কেও জানেন কিনা জানতে চাইলে অমরজীব চাকমা জানান, আমি বরাদ্দের বিষয়ে কিছু জানি না ।
পার্বত্যমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত তালিকা সুত্রে  জানাগেছে,ফারুয়া ইউনিয়নে ৮টি প্রকল্প যথাক্রমে ছাবাতলী হতে মন্দিরাছড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ,মন্দিরাছড়া পশ্চিম পাড়া হতে পূর্ব মন্দিরাছড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ,এগুজ্যাছড়ি পাড়া কমিউনিটি সেন্টারের ভিটার জঙ্গল পরিষ্কারকরণ,বড়হার থেকে রাইমংছড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার,এগুজ্যাছড়ি জাংবিল এলাকার জনসাধারণের ব্যবহার্য জলীয় উৎসের বাঁধ সংস্কার,বড়থলি টাইগার পাড়া হতে এসমপাড়া যাওয়ার রাস্তা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার,পূর্ব মন্দিরাছড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরমাঠ সংস্কার ও পশ্চিম মন্দিরাছড়া বৌদ্ধবিহারের মাঠ সংস্কার এসব প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা এপ্রসঙ্গে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অমর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা জানান, এই বিষয়ে আমি জানি না আমাকে কোন চিঠিপত্র দেয়া হয়নি। তবে ফারুয়ার লোকজনের কাছে শুনেছি  ফারুয়া ইউনিয়নে ৮টি প্রকল্প কোনটি বাস্তবায়ন হয়নি।      

                                    
 বিলাইছড়ি উপজেলা হেডম্যান সমিতির সভাপতি শান্তি বিজয় চাকমা জানান, আমাদেরকে জানানো হয়নি এবং আমার জানামতে এই ধরণের কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় নাই। এসব বিশেষ কর্মসূচির উপজেলা চেয়ারম্যানের পরামর্শক্রমে নেয়া প্রকল্প সম্পর্কে ফারুয়া ইউপি চেয়ারম্যান তেজেন্দ্র লাল তঞ্চঙ্গ্যা জানান,ফারুয়ার ৮টি প্রকল্পের কোনটার কাজ হযনি।
্সাবেক রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রবীন্দ্র লাল চাকমা  উল্লেখিত প্রকল্পের কাজ না হওয়া প্রসঙ্গে জানান, এসব প্রকল্প বিন্ধুমাত্র বাস্তবায়ন হয়নি। মুলতঃ র্দুগম এলাকা হওয়ার কারণে এসব খবর কেউ জানে না। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার (পিআইও) মনিরুল ইসলাম প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন না হওয়া  এবং এনিয়ে কোন জটিলতা আছে কিনা জানতে চাইলে জানান, তিনি দুর্গম এলাকার দোহাই দিয়ে কাজ এখনো চলছে বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান।                                    
বিলাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান জয়সেন তঞ্চঙ্গ্যার নিকট বিশেষ কর্মসূচি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন না হওয়া এবং উক্ত প্রকল্পগুলোয় তার ভুমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, প্রকল্প অনেক আগে বাস্তাবায়ন হয়েছে। প্রয়োজনে আপনারা এসে দুর্গম এলাকার প্রকল্পগুলো সরেজমিনে দেখে যান।                               
বিলাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুরুল ইসলামের নিকট এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার রহস্য কী? জানতে চাইলে তিনি জানান, বিলম্বে বরাদ্দ পাওয়ার কারণে দুই কিস্তিতে কাজ চলছে। এক পর্যায়ে তিনি বলেন মন্ত্রীর নিদের্শে কমিটি গঠন করে দিয়েছি দুর্গম এলাকার প্রবল্প প্রজেক্ট কমিটির লোকজন ও উপজেলা চেয়ারম্যান বলতে পারবেন।
উল্লেখ্য জুন মাসে পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় থেকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি পৌরসভায় ২শ টন, উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১শ টন, জুরাছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১শ টন, বিলাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যাকে ১শ টন, কাপ্তাই উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১শ টন, কাউখালী উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১শ টন, রাজস্থলী উপজেলা চেয়ারম্যানকে ১শ টন কওে উন্নয়নের নামে নির্বাচনী বরাদ্দ দিয়েছে। বাঘাইছড়ি পৌরসভার ২শ টন বরাদ্দ মেয়রের নামে দেয়ার কথা থাকলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্যানেল মেয়র এবং আ্ওয়ামীলীগ নেতা আব্দুস শুক্কর ওরফে মিয়ার নামে। অভিযোগ উঠেছে ওই নেতা ডিও ব্যবসায়ী হওয়ায় নিজের ইচ্ছামত বরাদ্দ ভাগ বাটোয়ারা করেন এবং যাদের নামে বরাদ্দ দিয়েছেন তাদের কাছ থেকে অল্প মুল্যে ডিও কিনে নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এই বিষয়ে পার্বত্য বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের সাথে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ থাকায় পিএ জাকের হোসেন চৌধুরীকে ফোনে অবগত করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন