ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধান: চীনের জিনজিয়াংয়ে মুসলিম বিরোধী সর্বাত্মক লড়াই

উইঘুর মুসলিম

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, পার্বত্যনিউজ:

পবিত্র রমজান হচ্ছে মুসমানদের জন্য রোজা পালন, দান-দক্ষিণা ও আল্লার ইবাদত-বন্দেগী করার মাস। তবে পশ্চিম চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের গ্রাম ও শহরের মুসলমানদের জন্য রমজান মাস হচ্ছে ভয়, নির্যাতন এবং সহিংসতার মাস।

এখানকার বাসিন্দারা বলছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চীনের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে মূলত পশ্চিম চীনের রক্ষণশীল মুসলমানদের বিরুদ্ধে।

পুরো রমজান মাস জুড়েই পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি অভিযান চালিয়ে পবিত্র কুরআন শরিফ, মহিলাদের বোরখা ইত্যাদি খোঁজ করে সেগুলো ছিনিয়ে নেয়। বোরখা পরা মহিলাদের নির্বিচারে আটক করা হয়, সামান্যতম অজুহাতে অল্পবয়স্ক তরুণদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এখানকার বাসিন্দারা জানান, স্কুল কলেজের মুসলিম ছাত্রছাত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের রোজা রাখার পরিবর্তে খেতে বাধ্য করা হয়। শুক্রবারে জুমার নামাজের পরিবর্তে তাদেরকে কাজে যোগদান এবং ক্লাস করতে চাপ প্রয়োগ করা হয়।

ধর্মীয় নির্যাতনের কারণেই এখানে চাপা অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং তা একসময় মারাত্মক প্রতিবাদে রুপ নেয়।

প্রকাশিত এক রির্পোট হতে জানা যায়, আলাকোগা ও ইলিশকো শহরে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পুলিশ ক্ষুব্ধ জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে। এরপর থেকেই চীনা কর্তৃপক্ষ উভয় শহরের অবস্থা নিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জিনজিয়াং প্রদেশে চীনা পুলিশ রমজানের ধর্মীয় আচার পালনে বাধা প্রদানসহ দাড়ি রাখা পুরূষ ও ঘোমটা পরিহিত মহিলাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করে। ইলিশকোর চারপাশে তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হয়েছে।

ওয়াশিংটন পোস্টের একটি টীমকে শাচী জেলার একটি তল্লাশি চৌকি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়, যে তল্লাসি চৌকিটিতে সেনাবাহিনীর কযেকটি ট্রাক অবস্থান করছিল। পরবর্তীতে পুলিশ ও কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদেরকে কয়েক ঘণ্টা আটক করে রাখা হয়। পরের দিন একইভাবে আলাকোগাতেও তাদের আটক করা হয় এবং পরবর্তীতে তাদের ঐ এলাকা থেকে নিকটবর্তী বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

পুরো শাচীতে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। মোবাইলের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বার্তা প্রেরণও বন্ধ। বিদেশিদের চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা আরোপ করা হচ্ছে। কয়েকজন লোকের একত্রে আলাপ অথবা টেলিফোনের মাধ্যমে কথোপকথনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যারা এরূপ করে তাদের উপর নেমে আসে ভয়ানক অত্যাচার।

চাইনিজ মুসলিম

একজন উইঘুর বাসিন্দা বলেন, ‘সমগ্র এলাকাতেই রয়েছে পুলিশি বিচরণ।’ অন্য আরো একজন উইঘুর মন্তব্য করেন, ‘মনে হচ্ছে আমরা কারাগারে বসবাস করছি।’ আরো এক বাসিন্দা জানান যে, তার পরিচয়পত্রটি এতবার পরীক্ষা করা হয়েছে যে এটির ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ এখন আর কাজ করছে না।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) এক রিপোর্ট হতে জানা যায়, গত ১৮ জুলাই শত শত বিক্ষুব্ধ জনতা আলাকোগা শহরের সরকারি দপ্তরের বাইরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। বোরখা এবং মুখের ঘোমটা খুলতে অস্বীকার করায় এখান থেকে যুবতী মেয়েসহ দুই ডজন নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বিক্ষোভকারীরা সরকারি দপ্তরগুলোকে লক্ষ্য করে ইট,পাথর এবং বোতল ছুড়ে মারে। পরে পুলিশের গুলিবর্ষণে অন্তত দুই জনের মৃত্যু হয় এবং আরো কয়েকজন আহত হয়।

আরএফের রির্পোট হতে আরো জানা যায়, ২৮ জুলাই রমজান মাসের শেষ দিনে সংগঠিত ইলিশকোর বিক্ষোভ আরো নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়। শত শত উইঘুর ছুরি, কুড়াল এবং লাঠি নিয়ে একটি পুলিশ স্টেশনে হামলা করলে একইভাবে পুলিশও গুলিবর্ষণ করে। এতে বহু লোক হতাহত হয়।

চীনের সরকার নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানায়, ঐ বিক্ষোভের ঘটনায় পুলিশ ৫৯ জন উইঘুর ‘সন্ত্রাসীকে’ হত্যা করে। যদিও অন্যান্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হয় মৃতের সংখ্যা আরো কয়েকগুন বেশি।

চীনা সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, পরবর্তীতে উত্তেজিত জনতা নিকটবর্তী শহর ও গ্রামগুলোতে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে ৩৭জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে, যাদের অধিকাংশই চীনের হ্যান জাতিগোষ্ঠির। পরে পুলিশ ও সোয়াত টিমের যৌথ অভিযানে দুইশরও বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সন্দেহভাজনদের উপর ড্রোন হামলা চালানো হয়। তারপর থেকেই অঞ্চলটি অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।

মরুভূমি এবং পর্বত দ্বারা বেষ্টিত জিনজিয়াং প্রদেশটি মধ্য এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর পাশে অবস্থিত।

চীনা কর্তৃপক্ষ বলছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচারিত ভিনদেশীয় ধর্মীয় আদর্শ জিনজিয়াং প্রদেশের মানুষকে কলুষিত করে তুলেছে। সৌদি আরবের মৌলবাদী ওয়াহাবী ইসলাম প্রচারের কারণে তাদের অনেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদের লক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা সাম্প্রতিককালের এ ভয়াবহ সহিংসতার জন্য কথিত মৌলবাদী উইঘুর ও আল-কায়েদাকে দায়ী করছে।

গত মার্চ মাসে কুনমিং শহরে একটি ট্রেন স্টেশনে ভয়াবহ ছুরির আক্রমণে ৩৩ জন লোক নিহত হয়। এছাড়াও মে মাসে উরুমকির রাস্তার পাশের একটি বাজারে বোমা হামলায় আরো ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়।

জবাবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সন্ত্রাসীদের দমন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ভূমি থেকে আকাশ পর্যন্ত জাল বিস্তার করে তাদের ধরা হবে, ইঁদুর তাড়নোর মত করে তাদেরকে রাস্তার মধ্য ধাওয়া করা হবে, সবাই চিৎকার করে বলছে ওদের আঘাত কর’।

কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ চীনা অভিযানে অনেক নিরীহ মানুষ ধরা হচ্ছে। উরুমকির উইঘুর জাতির একজন পেশাজীবী বলেন, ‘আপনি দোষীদের গ্রেপ্তার করুন। শুধু সন্দেহের বশে র্নিদোষ কাউকে গ্রেপ্তার করবেন না।’

দৃশ্যত মানুষের ওপর নজরদারি করার জন্য গ্রামগুলোতে দুই লক্ষ কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের নিযুক্ত করা হয়েছে। স্থানীয়রা বলেছে, কমিউনিষ্ট পার্টির এইসব নেতা-কর্মীরা প্রায়ই কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা দেয়ালগুলোর পিছনে অবস্থান নিয়ে উইঘুর জীবনের অনধিকারমূলক নজরদারি করতে অধিক আগ্রহী।

একটি সরকারি নথি হতে জানা যায়, উইঘুরদের ইর্য়ক্যান্ড হিসেবে পরিচিত শাচিতে ২৫,৬৪২ মার্কিন ডলার ব্যয়ে একটি গোপন সংবাদ নেটওয়ার্ক এবং উইঘুরদের কার্যক্রম নজরদারি করার জন্য গোপন ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।

নথিটি হতে আরো জানা যায়, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালিয়ে মুখে ঘোমটা অথবা বোরখা পরিহিত নারী ও লম্বা দাঁড়ি রাখা যুবকসহ কথিত বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসী ও ধর্মীয় চরমপন্থীদের সনাক্ত করা হবে।

কাশগড় শহরে কঠোর তল্লাশি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে যেটিকে কর্তৃপক্ষ নাম দিয়েছে ‘সৌন্দর্য প্রকল্প’। এই ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের অর্থ হল উন্মুক্ত বা খোলা মুখ।

কাশগড়ের প্রধান মসজিদের নিকটে অবস্তিত একটি বড় বিলবোর্ডে মাথায় স্কার্ফ পরা নারীদের ছবি শোভা পাচ্ছিল। কর্তৃপক্ষ বিলবোর্ড থেকে সেটি সরিয়ে দিয়েছে এবং মুখে গোমটা দেয়া এমনকি ঘাড় পর্যন্ত ডেকে রাখাকেও নিষিদ্ধ করেছে।

চীনা কর্তৃপক্ষ বিলবোর্ডের ব্যাপারে কিছু নীতিমালা ঘোষণা করেছে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, এই নিয়ম ভঙ্গকারীদের নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা হবে। এ অবস্থা প্রতিরোধের জন্য কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

ঘোমটা পরা মহিলা এবং লম্বা দাড়ি রাখা পুরুষদের পাবলিক বাসগোলোতে ওঠা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের উপর আক্রমণ অর্থে ‘সন্ত্রাসবাদ’ জিনজিয়াং প্রদেশে একটি নতুন ঘটনা। কিন্তু এখানকার অস্থিরতার পেছনে রয়েছে একটি দীর্ঘ ইতিহাস।

১৯৪৯ সালে কমিউনিষ্ট পার্টি দেশটির দায়িত্ব গ্রহন করার পর থেকেই উইঘুরদের উপর চীনা নির্যাতনে উইঘুররা তাদের ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। উইঘুরদের দমিয়ে রাখতে চীনের সংখ্যাগরিষ্ট হান সম্প্রদায়ের লোকদের এখানে অভিবাসনের ব্যবস্থা করা হয়।

উইঘুরদের উপর চালানো দমনপীড়নে তাদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি পায় এবং এ হতাশা থেকেই তারা চীনা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার সংকল্প করে। এটা রক্ষণশীল ইসলামের বৃদ্ধিতে প্রভাব রাখছে।

এক কিংবা দুই যুগ পর্যন্ত জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমরা হালকাভাবেই তাদের ধর্মকর্ম পালন করতেন। তারা তাদের ধর্মী বিশ্বাসের মধ্য থেকেই নাচতেন, গাইতেন এবং অনেকে মদ্যপানও করতেন। কিন্তু গত দুই দশকে চীনের দমননীতির ফলে ধীরে ধীরে ধর্ম রক্ষণশীলতার দিকে অগ্রসর হয়।

ধর্মকর্ম পালনের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রন আরোপ করা, মসজিদগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা ; হজ করতে গিয়ে গুরুজনদের মক্কা থেকে আরো অধিক সংখ্যক রক্ষণশীল ধ্যানধারণা নিয়ে আসা; উইঘুর যুবকদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বৈষ্যম্যের ফলে তাদের অনেকেই বাধ্য হয়েছে জীবনের নতুন ধারণা বা আদর্শ এবং নতুন পথের অনুসন্ধান করতে। মূলত এখানে ইসলামের উত্থান ছিল সামাজিক বৈষম্য ও আধুনিকতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া।

উইঘুরদের পরিচয় নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণাকারী এবং ইসলাম বিশেষজ্ঞ ব্রিটেনের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালের অধ্যাপক জোয়ান স্মিথ ফিনলে বলেন, ‘চীনা শাসনে যেখানে অন্য কোনো উপায়ে প্রতিরোধ প্রায় অসম্ভব সেখানে ধর্ম তাদেরকে প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।’

তিনি জানান, ১৯৯৭ সালে চীনের গোলজার অঞ্চলের স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হলে কর্তৃপক্ষ গণগ্রেপ্তার এবং নিষ্ঠুরভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মাধ্যমে তা দমন করছিল। তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে এবং তার পরিবর্তে তারা ইসলামকে খুঁজতে শুরু করেছে।’

ইসলামী রক্ষণশীলতায় ক্রমবর্ধমানভাবে ভাটা পরায় উইঘুরদের সবাই যে অখুশি ছিলেন তা না। উইঘুরদের নাটকীয় পতনে হোটান শহরে এলকোহল ও মদ বিক্রির প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। অনেক যুবতী মেয়ে ঘোমটা পরিধান করার বাধ্যবাধকতা থেকে বেরিয়ে আসে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রক্ষণশীল ইসলাম থেকে উইঘুরদের মুক্তি দেবার লক্ষ্যে চীনের চলমান নিষ্ঠুর অত্যাচার ও কুৎসিত প্রচেষ্টা আরো অধিক হারে মানুষকে রক্ষণশীলতা ও মৌলবাদের দিকে ধাবিত করছে।

বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কে দেয়ার অভিযোগে গত জানুয়ারি মাসে জেলে যাবার পূর্বে প্রখ্যাত উইঘুর পণ্ডিত ইলহাম তোহতি (সম্প্রতি তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে) তার লেখা একটি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যদি সরকার ইসলামি রক্ষণশীলদের দমন করার জন্য ক্রমাগত চরমপন্থার পথ অবলম্বন এবং অত্যাচার ও নির্যাতন চালাতে থাকে, তবে এটা শুধু তাদেরকে সন্ত্রাসবাদের দিকেই ধাবিত করবে।’

♦ ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত China’s war on terror becomes all-out attack on Islam in Xinjiang নিবন্ধ। সৌজন্যে- রুহুল আমীন, আরটিএনএন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন