বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী (পর্ব- ৩)

ত্রিপুরা জাতির ইতিহাস বিচার

fec-image

বাংলাদেশের আদিবাসী নিরূপণে আমার ধারাবাহিক রচনা ও গবেষণা কর্ম প্রকাশের প্রথম থেকেই  ত্রিপুরা উপজাতির কিছু মানুষ নিজেদেরকে বাংলাদেশে আদিবাসী হিসেবে দাবী করে বিভিন্নভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছিলো। প্রমাণ হিসেবে তারা কুমিল্লার প্রাচীন নাম ত্রিপুরা থাকা, কুমিল্লার বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ব স্থানের দৃষ্টান্ত এবং রাঙামাটি জেলাকে প্রাচীন ত্রিপুরার রাজধানী বলে দাবী করে আসছিলো। তাদের দাবী ত্রিপুরা রাজাগণ একসময় কুমিল্লা পর্যন্ত দখল করে রাজ্য বিস্তার করেছিল। সেকারণেবাংলাদেশের আদিবাসী বিতর্কের সমাধানে বাংলাদেশে ত্রিপুরা জাতির আগমনকাল নিরূপণ করা অত্যন্ত জরুরী। সেইসাথে উক্ত দাবী সমূহের ঐতিহাসিক ভিত্তি কতটুকু এবং এসবের সাথে ত্রিপুরা উপজাতির সম্পর্ক কতখানি তা বিবেচনা না করে এ প্রশ্নের মিমাংসা হতে পারে না। এসকল প্রশ্নের মিমাংসার জন্য প্রথমেই ত্রিপুরা রাজ্যের ও ত্রিপুরা উপজাতির প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করা জরুরী।

বাংলাদেশের যেসকল লেখক ও গবেষক ত্রিপুরা উপজাতি নিয়ে গবেষণা করেছেন তাদের সকলেই উৎস হিসেবে বাংলা ভাষায় রচিত ত্রিপুরা রাজাদের বংশগাঁথা রাজমালাকে উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এসব লেখক বা গবেষকদের ত্রিপুরা জাতির এই প্রাচীন গ্রন্থ রাজমালার বস্তুনিষ্ঠতা বা ঐতিহাসিক মূল্য পরীক্ষা করে দেখার প্রবণতা দৃশ্যমান হয়নি। তাই এক্ষেত্রে ভারতীয় ও ত্রিপুরা রাজ্যের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষক ও ঐতিহাসিকদের রচনার সাহায্য নিতে হয়েছে। আমি আমার এ অধ্যয়নে ত্রিপুরার দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করি। বিভিন্নভাবে ভারত ও ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত কিছু ঐতিহাসিক আকড় গ্রন্থ পর্যালোচনা করি এবং সেসবের নিত্তিতে ত্রিপুরা উপজাতি সম্পর্কে বহুল প্রচারিত মতবাদগুলো যাচাই করে দেখার চেষ্টা করি।


এই সিরিজের আগের পর্বগুলো পড়ুন এখান থেকে


যেহেতু প্রাচীন ত্রিপুরা রাষ্ট্র ও রাজ্যের প্রাচীন ইতিহাসের প্রধান সূত্র রাজমালা। সেকারণে রাজমালার বস্তুনিষ্ঠতা কতোটা, ঐতিহাসিক মূল্যে এটা কতোটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সেটা যাচাই করে নিতে চাই। এখানে বলে নিতে চাই, রাজমালা কিন্তু ত্রিপুরা জাতির বংশগাঁথার উপর রচিত বাংলা ভাষার প্রথম পুস্তক নয়। তারও আগে রাজাবলী নামে আরো একটি গ্রন্থ একই বিষয়ে বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছিল। বলাবাহুল্য, সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও আমি এই রাজাবলী গ্রন্থ সম্পর্কে অবগত ছিলাম না।

রাজাবলী: বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম গদ্যগ্রন্থ

বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীন গ্রন্থ কোনটি- এই প্রশ্নে সকলে একবাক্যে বলে থাকেন চর্যাপদ। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে আমিও সেটাই জেনে এসেছি। নেপালের রাজ দরবারে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই গ্রন্থটি আবিস্কার করেছিলেন। বহু বিতর্কের পর গবেষণার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন, এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীনতম গ্রন্থ। তবে ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে চর্যাপদের সমকালীন আরেকটি গ্রন্থের নাম ত্রিপুরার বিভিন্ন পুস্তকে দেখতে পেয়েছি। উক্ত গ্রন্থের নাম ‍‍”রাজাবলী”। গবেষকদের মতে, বইটি ৯০০ বছর পূর্বে লেখা হয়েছিল। চর্যাপদ নামক বৌদ্ধগানের রচনার সময়কাল নিয়েও ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতো কিছু গবেষকের মতে, চর্যার পদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত। কিন্তু ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো কিছু গবেষক এই সময়কালকে আরও ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে চর্যার রচনাকাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মতপ্রকাশ করেছেন। সে হিসেবে “রাজাবলী” গ্রন্থটি চর্যাপদের প্রায় সমকালে রচিত হয়েছিল। এটি মূলত ত্রিপুর রাজাদের বংশতালিকা ও বংশগৌরব গাঁথা নিয়ে রচিত হয়েছিল।



এই পুস্তক প্রসঙ্গে আগরতলা থেকে প্রকাশিত একটি গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে, ‌’বাংলা ভাষায় লেখা ত্রিপুরার প্রাচীনতম গ্রন্থের নাম ‘রাজাবলী’। প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. রাজেন্দ্র লাল মিত্র দ্বারা এই গ্রন্থটি এশিয়াটিক সোসাইটির পুস্তক আলোয় আবিষ্কৃত হয়েছিল। এটি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গদ্যগ্রন্থের অন্যতম এবং ত্রিপুর বংশীয় রাজাদের বিবরণে পূর্ণ। ড. রাজেন্দ্র লাল মিত্র ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ পত্রিকায় বাংলা ভাষার উৎপত্তি বিষয়ক এক প্রবন্ধে এই গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয়ও তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বিষয়ক প্রস্তাব’ প্রবন্ধে এই গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। ড. রাজেন্দ্র লাল মিত্র গ্রন্থটিকে প্রায় ৯০০ বছরের পুরনো বলে স্থির করেছেন। তবে বর্তমানে বইটি পাওয়া যায় না, এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তা হারিয়ে গেছে। এই বইটি প্রসঙ্গে উমাকান্ত একাডেমির প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শীতলচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর ‘ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘পরম পূজ্যপাদ মদধ্যাপক পন্ডিত মহা মহোপাধ্যায় প্রসন্নচন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয় তদীয় “সাহিত্য প্রবেশ ব্যাকরণ” নামক পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থে ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিহাস’ নামক সুলিখিত ও অনুসন্ধান বহুল গ্রন্থে উল্লিখিত পুস্তক সম্বন্ধে যে আলোচনা করিয়াছেন তাহা এখানে উদ্ধৃত করা একান্তই কর্তব্য বলিয়া মনে করি। তিনি লিখিয়াছেন- যাহা হউক, এক্ষণ হইতে ৯০০ বছর পূর্বে “ত্রিপুরা রাজাবলী” নামক একখানি বাঙ্গালা পুস্তক রচিত হইয়াছে। উহা ত্রিপুরা রাজবংশীয় দিগের বিবরণে পরিপূর্ণ এবং ৯০০ বছরের প্রাচীন বলিয়া কথিত। অতএব একপ্রকার স্থির করা যাইতে পারে যে, প্রায় সহস্র বছর পূর্বে বঙ্গভাষায় একখানি পুস্তক লিখিত হইয়াছিল। …প্রত্নতত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্র “বিবিধার্থে সংগ্রহ” নামক পুরাতন মাসিক পত্রে “বঙ্গভাষার উৎপত্তি” বিষয়ক প্রবন্ধে উক্ত পুস্তকের নাম নির্দেশ করিয়াছিলেন। কোন অনির্ব্বচনীয় কারণে এশিয়াটিক সোসাইটির পুস্তকালয় থেকে ইহা অদৃশ্য হইয়াছে বলিয়া কথিত। অনেক চেষ্টা করিয়া এই পুস্তকখানি আমরা দেখিতে পারি নাই।’

খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে শ্রীহট্টের ভাটেরার তাম্র ফলকে উল্লিখিত ‘দেব’ রাজবংশের পতনের পরই বরাক ও দক্ষিণ শ্রীহট্ট অঞ্চলে ত্রিপুর রাজবংশ শক্তিশালী হয়ে কৌম অবস্থা থেকে বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং তখনই তাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির পরিচয় ঘটে। এই বিশাল অঞ্চলের জনসাধারণের কাছে বংশ গরিমা ও প্রাচীনত্বের মাধ্যমে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতার প্রয়োজনেই এই ‘রাজাবলী’ গ্রন্থের সৃষ্টি।’[1]

কলকাতা থেকে প্রকাশিত “রাজাবলী” নামক আরো একটি পুরাতন গ্রন্থ দেখা যায়। এটি লিখেছেন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও সুপ্রীমকোর্টের প্রধান পণ্ডিত স্বর্গীয় মৃত্যুঞ্জয় শর্ম্মণা কৃতা। এই পুস্তকটি পুরাণে উল্লিখিত কলিকালের শুরু থেকে ইংরেজ শাসন পর্যন্ত ভারতীয় শাসকদের ইতিহাস নিয়ে রচিত। কিন্তু ত্রিপুরায় প্রাপ্ত “রাজাবলী” শুধুই ত্রিপুর রাজাদের বংশগাঁথা।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এখানে দাবী করা হয়েছে ‌”রাজাবলী” গ্রন্থটি গদ্য ভাষায় রচিত ছিলো। অথচ আমরা জানি বাংলা গদ্যের বিকাশ ঘটে ইংরেজ আমলে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে। সেসময় ইংরেজদের একটি অংশ বাংলায় খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের উদ্যোগ নেয়। ফলে তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে স্থানীয় ও সহজবোধ্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করা। একই সময়ে ইংরেজরাও রাজকার্য পরিচালনা সহজ করতে স্থানীয় ভাষার গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এ লক্ষ্যেই ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এর দায়িত্ব পড়ে উইলিয়াম কেরি নামক এক খ্রিস্টান পাদ্রির উপর। তিনি স্থানীয় বাঙালি পণ্ডিতদের সহায়তা নেন। তাদের মধ্যে রয়েছে, রামরাম বসু ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। কেরি সহজবোধ্য বাংলাভাষায় “গসপেল অভ ম্যাথু” অনুবাদ করে বাংলায় নাম দেন “মথি লিখিত সুসমাচার”। প্রথম বাংলা গদ্য পুস্তকও কেরি রচনা করেন। তার নাম- কথোপকথন(১৮০১)। একই সময়ে রামরাম বসু “প্রতাপাদিত্য চরিত্র”(১৮০১) নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাই উইলিয়াম কেরিকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। তবে এর বেশ পূর্ব থেকেই বিভিন্ন পত্র ও ডকুমেন্টে গদ্যে বাংলা ভাষা ব্যবহারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু “রাজাবলী” যদি গদ্যে রচিত হয়, তবে উল্লিখিত ইতিহাস বদলে যেতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে “রাজাবলী” ই বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম গদ্য গ্রন্থের মর্যাদা পাবে। যদিও একই লক্ষ্যে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি ত্রিপুরার রাজা ডাঙ্গর ফা ওরফে ধর্ম মাণিক্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং চন্তাই দুর্লভেন্দ্র এর সহযোগিতায় দুই রাজপণ্ডিত বাণেশ্বর ও শুক্রেশ্বর বাংলা পয়ার ছন্দে বাংলা ভাষায় ”রাজমালা” নামক বহুল আলোচিত গ্রন্থের প্রথম খণ্ড রচনা করেন।

আগরতলা, ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত ‘ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস’ গ্রন্থে আরেক ঐতিহাসিক শ্রী শীতলচন্দ্র চক্রবর্ত্তীও রাজাবলীর কথা বলেছেন এবং রাজাবলী যে রাজমালা থেকে প্রাচীন সেই স্বীকৃতিও তিনি দিয়েছেন।[ii]

আমি অত্যন্ত বিস্মিত যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সুনীতি কুমার চট্টপাধ্যায়, আশোক কুমার বন্দোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, গোপাল হালদার প্রমুখ প্রখ্যাত গবেষকগণের গবেষণায় এই ‘রাজাবলী’র নাম অনুপস্থিত।

ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠী ও ত্রিপুরা রাজ্যের উৎস

পূর্বেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ত্রিপুরা রাজ্য বা ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর ইতিহাস রচয়িতাগণ সকলেই রাজমালার বয়ানকে উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু রাজমালা কিম্বা বাংলাদেশের ত্রিপুরা ইতিহাস রচয়িতাগণ ত্রিপুরা রাজ্যের উৎস সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম হয়নি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়: গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরা তার ‘ত্রিপুরা জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ পুস্তকে ত্রিপুরা জাতির উৎস সম্পর্কে ৫টি মত হাজির করেছেন।

তার মতে, ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে দেশী বিদেশী অনেক ঐতিহাসিক বিভিন্ন প্রকার অভিমত ও মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। এসব প্রদত্ত অভিমত ও মতবাদের মধ্যে বর্ণিত পাঁচটি অভিমত পরস্পর সমার্থক বিধায় অতিশয় প্রণিধানযোগ্য।

প্রথম অভিমত:  শ্রীশ্রী রাজামালা মতে, ভারত বর্ষের ইতিহাসে রাজা যযাতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রতিষ্ঠান নগরের রাজা ছিলেন। চন্দ্রবংশীয় এই রাজার দুই স্ত্রী। দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা। দেবযানীর গর্ভে দুইপুত্র যদু ও তুর্বসু। শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিন পুত্র দ্রুহ্য, অনু ও পুরু। এই পাঁচ পুত্রের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ব্যতীত বাকী চারজন পুত্র পিতার অবাধ্য ছিলেন। কথিত আছে, রাজা যযাতি ঋষিকন্যা শর্মিষ্ঠাকে গোপনে বিবাহ করার অপরাধে ঋষি শুক্র কর্তৃক জরাব্যাধিতে অভিশপ্ত হন। এর একমাত্র প্রতিকার ছিল কেউ যদি স্বেচ্ছায় জরাব্যাধি গ্রহণ করে, তবে তাঁর মুক্তি। রাজা যযাতি অতিশয় ভোগবিলাস এর প্রতি আসক্ত ছিলেন। ফলে তিনি পুত্রদের ডেকে তাঁর অভিশপ্ত জরাব্যাধি গ্রহণ করার কথা বললেন। পিতার অভিপ্রায় জেনে সর্ব কনিষ্ঠ পুরু ব্যতীত বাকী চারপুত্র কঠোরভাবে পিতাকে তিরস্কার করলেন। পুরু পিতার জরাব্যাধি গ্রহণ করেন। পুত্রদের অবাধ্যতা দেখে ক্ষুব্ধ যযাতি পুরুকে প্রতিষ্ঠান নগরের রাজ্যভার অর্পণ করেন এবং বাকী চার পুত্রকে স্বীয় রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেন। তৃতীয় পুত্র দ্রুহ্য নির্বাসিত হন “প্রতিষ্ঠান” নগরের উত্তরপূর্ব প্রান্তর সমুদ্র ও গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থল “সগরদ্বীপে”। তিনি অতিশয় মহাবলী ছিলেন। তিনি সগরদ্বীপ থেকে কপিলা নদীর তীর পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে “ত্রিবেগ” নামে রাজ্যপাট প্রতিষ্ঠা করেন।

রাজ মালায় বর্ণিত আছে:

“ত্রিবেগ স্থলেতে দ্রুহ্য নগর করিল।
কপিলা নদীর তীরে রাজ্যপাট ছিল।”
– দ্রুহ্যখণ্ড।

রাজা দ্রুহ্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দৈত্য ত্রিবেগ নগরের রাজা হন। তিনি প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। রাজমালায় বর্ণিত আছে-

“দ্রুহ্য বংশে দৈত্য ত্রিবেগ নগর

অনেক সহস্রবর্ষ হইল অমর।

বহুকাল পরে তান পুত্র উপজিল

ত্রিবেগ জন্ম নাম “ত্রিপুরা” রাখিল।”

-দৈত্য খণ্ড।

দৈত্য রাজার পুত্রের নাম ত্রিপুর। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ত্রিবেগ নগরের রাজা হন। তিনি অতিশয় অত্যাচারী দেবদ্রোহী ও মহাপরাক্রমশালী ছিলেন। এই রাজা ত্রিবেগ নগর থেকে আরো উত্তরপূর্বে ধাবিত হয়ে “কিরাত” ভূমি অধিকার করেন এবং ত্রিবেগ ও কিরাতগণের মধ্যে মহামিলন ঘটান। ত্রিপুর রাজা তাঁর বিজিত রাজ্যের নামকরণ করেন “ত্রিপুরা” এবং স্বীয় প্রজাদের “ত্রিপুরাজাতি” বলে প্রচার করেন। রাজা ত্রিপুরের মহিষীর নাম হীরাবতী।

দ্বিতীয় অভিমত: বিষ্ণু পুরাণে উল্লেখ আছে ভারত সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তরে কিরাতের বাস। কামরূপ (আসাম) ও রাক্ষ্যং (আরাকান) দেশের মধ্যবর্তী স্থানকে প্রাচীন আর্যগণ কিরাত (সুরু) নামে আখ্যায়িত করেন। লৌহিত বংশীয় মানবগণ সেখানে রাজ্যপাট গড়ে তুলেছিলেন। এই ভূখণ্ডটিই মহাভারতের যুগে “ত্রৈপুরা” কখনও বা “ত্রৈপুরী” নামে আখ্যায়িত হয়। ত্রৈপুরা বা ত্রৈপুরী থেকে “ত্রিপুরা” নামের উৎপত্তি। মহাভারতের ৫১ পীঠের মধ্যে ত্রিপুরা একটি। পীঠমালা তন্ত্র এক পঞ্চাশৎ বিদ্যোৎ পংক্তিতে বলা হয়েছে-

“ত্রিপুরায়াং দক্ষপাদো দেবী ত্রিপুরা সুন্দরী।

ভৈরবন্ত্রিপুরেশশ্চ সর্বাভীষ্ট ফলপ্রদ।

তৃতীয় অভিমত:

“হীরাবতীর পুত্র নাম ত্রিলোচন রাজা।

দিব্যকান্তি সৌম্য পুরুষ হএ মহাতেজা।

ত্রিলোচন ঘরে বারপুত্র উপজিল।

বারঘর ত্রিপুরা নাম তার খ্যাতি হৈল।

রাজবংশ ত্রিপুরা সে রাজা হৈতে পারে।

ত্রিপুরা রাজ্যতে ছত্র অন্য নাহি ধরে।

দৈবগতি রাজার না হএ যদি পুত্র।

তবে রাজা হৈতে পারে ত্রিপুরের সূত্র।”

-ত্রিলোচন খণ্ড।

চতুর্থ অভিমতঃ “ত্রিপুরা” নামের সঙ্গে ককবরক ভাষায় দু’টি শব্দ জড়িত আছে। ত্রিপুরাগণ যে ভাষায় কথা বলে তা ভারতবর্ষে ককবরক নামে পরিচিত। ককবরকে “তোয়” শব্দের বাংলা অর্থ হয় ‘জল’ বা ‘নদী’। আর ‘প্রা’ শব্দের বাংলা অর্থ হয় “সংযোগস্থল” বা “মোহনা”। অর্থাৎ তোয়প্রা নামে ত্রিনদীর মোহনাস্থল। ত্রিপুরাগণের সাধারণ বিশ্বাস একসময় তাদের পূর্বপুরুষগণ সাগর সঙ্গম স্থল গঙ্গানদীর অববাহিকায় রাজপাট গড়েছিলেন এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে সম্প্রসারিত হয়েছিলেন। “আইতরমা” গ্রন্থে “ত্রিপুরা” নামক কাব্য রচনায় উল্লেখ আছে-

“ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী হিনৈ-।

তোয় সুকথামনি বপ্রাী রাজধানী তেয়ৈ।

ত্রিপুরানী আদি রাজা প্রজারকনী লাগৈ।….

পঞ্চম অভিমত: ঐতিহাসিকগণের সর্বজন স্বীকৃত অভিমত যে, রোসাঙ(আরাকান), চট্টল(চট্টগ্রাম) ও কমলাঙ্ক(কুমিল্লা) এ তিন অঞ্চল নিয়ে প্রাচীনকালে ত্রিপুর রাজ্য গঠিত হয়েছিল। এ তিনটি অঞ্চলে তিনটি পুর(নগর) ছিল এবং নগরগুলি নদীতীরে অবস্থিত ছিলো। ফলে এ তিনটি পুরের অধিবাসীগণকে ইতিহাসে ত্রিপুরা নামে অভিহিত করা হয়েছিল।[iii]

ত্রিপুরা জাতির বংশ পরিচয় সম্পর্কে প্রভাংশু ত্রিপুরা আরো বলেছেন, পৃথিবীর সকল জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রত্যেক জাতি বা জনগোষ্ঠীর পৃথক পৃথক বংশ পরিচয় রয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠে আমরা জানতে পারি যে, মৌর্য ও গুপ্ত বংশীয় রাজাগণ নিজেদের সূর্য্য বংশজ, বঙ্গদেশের সেন ও পাল বংশীয় রাজাগণ চন্দ্রবংশজ, রাজপুতনার মিবার রাজাগণ নিজেদের সূর্য্যবংশজ, উড়িষ্যার কেশরী রাজাগণ নিজেদের চন্দ্রবংশজ, রাজস্থানের রাজাগণ নিজেদের সূর্য্যবংশজ, কপিলাবস্তুর রাজাগণ শাক্যবংশজ, মনিপুরের রাজাগণ নিশাপতি বংশজ, আসামের অহোম রাজাগণ ইন্দ্রবংশজ, কোচ বিহারের রাজাগণ রুদ্রবংশজ বলে আখ্যায়িত হন এবং সগৌরবে স্ব-স্ব রাষ্ট্রীয় শাসনে ও প্রতীকীতে বংশ চিহ্ন উৎকীর্ণ করেন। অধিকন্তু, অতীতে আরবের জনগণ উম্মাইয়াও কোরাইশ বংশীয় দু’নামে আখ্যায়িত হতেন। বর্তমান বার্মা (মায়ানমার) দেশের জনগণ নিজেদের চন্দ্রবংশজ, থাইল্যান্ড, জাপান, ভিয়েতনাম, কম্পুচিয়া প্রভৃতিও তদ্রুপ। … দুঃখীদের কাতর প্রার্থনায় শিব আবির্ভূত হয়ে ত্রিপুর রাজাকে নিধন করেছিলেন। এখানে আরও লক্ষ্যণীয়, নিঃসন্তান রাজা ত্রিপুর নিহত হওয়ার পর যযাতির বংশধর তথা আর্য শাসনের অবসান হয়েছে। স্বামী নিহত হবার পর রানী হীরাবতী বংশরক্ষা এবং ত্রিপুরা রাজ্য শাসন নিমিত্ত শিবের নিকট পুত্র সন্তান প্রার্থনা করেন। শিব বর প্রদান পূর্বক আশীর্বাদ করে বলেছিলেন যে, অচিরেই হীরাবর্তীর গর্ভে একপুত্র সন্তান জন্ম নেবে এবং ত্রিপুরা রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। বলাবাহুল্য, রানী হীরাবতী শিবের বরে পুত্র সন্তান লাভ করেছিলেন। প্রকারান্তরে, শিবের ঔরসে পুত্র লাভ করেছিলেন। সন্তানের নাম রাখা হয়েছিল “ত্রিলোচন”। এ বিষয়ে রানী হীরাবতী কীভাবে শিবের বর পেয়েছিলেন, কীভাবে ত্রিলোচনের জন্ম হয়েছিল, এবং বংশ পরিচয় বা কী হবে ইত্যাদি রাজমালায় তার বিস্তর- বর্ণনা রয়েছে। এখানে এই অংশটুকু উদ্ধৃত করা হলো।

শিবের বর প্রদান,

তোমা সবে দিব আমি মহারাজা।

আমার তনয় হৈয়া পালিবেক প্রজা।

আমার সমান হবে আকৃতি প্রকৃতি।

চন্দ্রবংশ খ্যাতি হবে শাসিবেক ক্ষিতি।

ত্রিপুরা রমণী আছে হীরাবতী নাম।

আরম্ভ করুক পূজা করি পুত্রকাম।

চৈত্র মাসের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে।

আরম্ভ করুক পূজা ব্রহ্মচর্য মতে।

প্রতি শুক্লা দ্বাদশীতে পূজা নিরন্তর।

নিরামিষ একাহার শুচি কলেবর।

দ্বিতীয়ে করিয়া ব্রত বায়ুপুত্র আশে।

আমার আজ্ঞায় পুত্র হইবে বিশেষ।

তিনচক্ষু হইবেক পুরুষ প্রধান।[iv]

প্রভাংশু ত্রিপুরা এখানেই থামেননি। তিনি আরো এগিয়ে বলেছেন, মহারাজা ত্রিলোচন মহাভারতের পান্ডবপুত্র ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সমসাময়িক ছিলেন। ত্রিলোচন রাজা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রে আর্য রাজন্যবর্গের যুদ্ধ সমাবেশে এই অনার্য রাজার উপস্থিতি ছিল ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ঘটনা। এর কারণ হলো ত্রিপুরা মহারাজা ত্রিলোচন যদি কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে অবতীর্ণ না হতেন তাহলে ত্রিপুরাজাতির জনপদ ও সার্বভৌমত্বের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে লোকে অজ্ঞাত থাকত এবং ত্রিপুরাজাতি সম্বন্ধীয় তথ্যাদি মহাভারতে স্থান পেত না। ত্রিপুরা রাজা ত্রিলোচন পাণ্ডব পক্ষাবলম্বন করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এ বিষয়টিও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পান্ডবগণ ক্ষেত্রজ সন্তান ছিলেন। পান্ডবদিগের পিতা পান্ডু, নপুংসক বিধায় পাণ্ডুস্ত্রী কুন্তী ক্ষেত্রজ সন্তান ধারণ করেছিলেন। যেমন: যুধিষ্ঠির যমরাজ পুত্র, ভীম পবনপুত্র, অর্জুন ইন্দ্রপুত্র, নকুল ও সহদেব অশ্বিনী কুমারদ্বয়ের পুত্র। তদনুরূপ, ত্রিপুরা রাজা ত্রিলোচনও ক্ষেত্রজ সন্তান। তিনি শিবপুত্র। যা হোক, রাজা যুধিষ্ঠির ত্রিপুরা মহারাজা ত্রিলোচনকে বিহিত সম্মান প্রদর্শন পূর্ব্বক অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজ পক্ষাবম্বন করেছেন জেনে কুরুপ্রধান দুর্যোধন অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন, “বাহুবলে ত্রিপুরেশ্বরে জিনিব নিশ্চয়”।[v]

এসকল মত অনুসরণ করে প্রভাংশু ত্রিপুরা ত্রিপুরা জাতির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল খ্রিস্টজন্মের আড়াই হাজার বছর পূর্বে। ইতিহাসবেত্তারা এ অভিমত পোষণ করেন। এ হিসেবে ত্রিপুরা সিংহাসনের বর্তমান বয়স প্রায় ৫ হাজার বছর।[vi] ত্রিপুরা রাজ্য ও জাতির উৎস সম্পর্কে সকল ঐতিহাসিকগণ এই ৫টি মতের এক বা একাধিক মত সমর্থন করেছেন।

কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বা মহাভারতের কাহিনী বা ঘটনা নিখাঁদ ইতিহাস ভারতীয় ঐতিহাসিকগণের বলে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ঐতিহাসিক, নৃবিজ্ঞানী ও পুরাতত্ত্ববিদগণ গ্রহণ করেননি। এদের মধ্যে, ১৯৭৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত সরকারের প্রাক্তন চিফ এপিগ্রাফিস্ট ড. ডি.সি, সিরকর বার্তা সংস্থা ইউএনআইয়ের কাছে মহাভারত সম্পর্কে বলেন, মহাভারত মহাকাব্যের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। আসলে মহাভারত একটি মিথ মাত্র। তার এই মত বিশিষ্ট পুরাতাত্ত্বিক ও অধ্যাপক এইচ ডি সানকালিয়া সহ আরো অনেকেই সমর্থন করেন। [vii]

উপরোক্ত ঐতিহাসিক আলোচনা থেকে দেখা যায় রাজা দৈত্যের পুত্র ত্রিপুর ত্রিপুরা রাজবংশের প্রথম রাজা, যিনি তার নিজের নামানুসারে তার জাতির নাম ত্রিপুরা রাখেন। কিন্তু ড. জগদীশ গণচৌধুরী দ্রুহ্যকেই ত্রিপুরার প্রথম রাজা বলে দাবী করেছেন। এটা মেনে নিতে হলে ত্রিপুরার আরো অনেক ইতিহাস পাল্টে যায়।[viii]

বাংলাদেশে চাকমা ট্রাইবের ইতিহাস রচনায়ও মিথ, কিংবদন্তী ও পৌরাণিক গল্প-কথাকে ইতিহাস বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে এই ভ্রান্তি অনেকখানি দুর করেছেন রাজবংশেরই আরেক সদস্য অশোক কুমার দেওয়ান তাঁর ‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার’ গ্রন্থে। একইভাবে ত্রিপুরা জাতি বিষয়ক গবেষকগণ রাজমালাকেও ইতিহাস জ্ঞানে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিকই রাজমালার প্রথম খণ্ডকে ইতিহাস বলে গ্রহণ করেননি। এই কাতারে বাংলাদেশী গবেষক রয়েছেন ড. দীনেশচন্দ্র সেন। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সাথে অত্যন্ত সুসম্পর্কে জড়িত ঐতিহাসিক ড. দীনেশচন্দ্র সেন রাজমালার প্রথম খণ্ডকে ইতিহাস বলে গ্রহণ করেননি।

তাঁর মতে, ভারতবর্ষে বর্তমানকালে যত রাজা বিদ্যমান আছেন, তাহাদের মধ্যে ত্রিপুরার রাজবংশই প্রাচীনতম। আদিকাল হইতে ১৮৪ পুরুষের নাম এই বংশে আমরা পাইতেছি। রাজমালার প্রথম অংশের অনেক কথাই খাঁটি ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করা যায় না- কিন্তু পরবর্তী অংশ অধিক পরিমাণেই খাঁটি ঐতিহাসিক সত্য। ড. সেন রাজমালার প্রথম অংশকে প্রাচীন প্রবাদ ও গল্পমূলক।[ix] তিনি আরো বলেন, আমরা পূর্বেই লিখিয়াছি পুরাকাল হইতে এই রাজবংশের ১৮৪ জন রাজার নাম পাওয়া যায়। দ্রুহ্য ইহাদের মধ্যে সপ্তম স্থানীয়- সুতরাং দ্রুহ্য হইতে মহারাজ বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য পর্যন্ত ১৭৭ জন ত্রিপুরার রাজার নাম রাজ বংশাবলিতে আছে। দ্রুহ্য নামে কোন রাজা ছিলেন কিনা এবং যযাতির পুত্র দ্রুহ্য এই ত্রিপুর- রাজাদের আদিপুরুষ কিনা, এই সকল দুরুহ প্রশ্ন- সমাধানের স্থান এখানে নহে। যখন চন্দ্রসূর্যবংশীয় রাজাগণের গোড়ায়ই ঐতিহাসিক গলদ দৃষ্ট হয়(অর্থাৎ কোনো জ্যোতিষ্ক হইতে রাজাদের আবির্ভাব ব্যাপার ঐতিহাসিকগণের ধারণার অতীত),  তখন শুধু ত্রিপুর-রাজগণের কথা নহে, সেই চন্দ্রসূর্যবংশের অভিমানী সকল রাজগণের বংশাবলীরই আদি কথা ঘোর অন্ধকার অন্ধকারাবৃত্ত।[x] অন্যদিকে রাজমালার প্রথম খণ্ডকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে পুরোপুরি ফেলে দিয়েছেন ঐতিহাসিক অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়।[xi]

একইভাবে ড. শীতলচন্দ্র চক্রবর্ত্তী তাঁর ‘ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস’ গ্রন্থে আরো বলেছেন, ‘বাবু কৈলাসচন্দ্র সিংহ ও বিশ্বকোষকার দুইজনই রাজমালা হইতে ত্রিপুরার ইতিহাস সঙ্কলন করিয়াছেন। তাঁহারা রাজমালার একাংশেই আস্থাস্থাপন করিয়াছেন, অন্ত্যাংশে আস্থা স্থাপন করিতে পারেন নাই। মূলাংশেই আস্থা স্থাপন করিতে পারেন নাই, কিন্তু শাখাংশে আস্থা স্থাপন করিয়াছেন। রাজবংশের যে সমস্ত ঘটনা রাজমালার বিবৃত হইয়াছে, তত্তাবৎ তাঁহারা সত্য বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু মূলে ত্রিপুররাজগণ যে দ্রুত্যবংশ ও ক্ষত্রিয় বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন, তাহা তাহারা গ্রহণ করিতে পারেন নাই। বিশ্বকোষকার ও কৈলাসবাবু, উভয়েই ত্রিপুররাজবংশকে ‘শ্যান’ বা ‘লৌহিত্য’ আখ্যা প্রদানকরতঃ তাঁহাদিগের চন্দ্রবংশীয়ত্ব বা দ্রুহাবংশীয়ত্বের খ্যাতি সম্পূর্ণভাবে নিরাক্বত করিয়াছেন। এস্থলে আমরা বিশ্বকোষকারের মন্তব্য উদ্ধৃত করিতেছি:-“রাজমালার মতে এই রাজবংশ চন্দ্রবংশোদ্ভূত। চন্দ্রবংশে যযাতিপুত্র দ্রুহ্যু হইতে এই বংশের উৎপত্তি গণনা করা হয়। কিন্তু বহুকাল গবেষণার পর স্থির হইয়াছে যে, এই বংশ শান্‌জাতি হইতে উৎপন্ন। শান্জাতি লৌহিত্যবংশ নামে অভিহিত হন। ইংরেজেরা এই জাতির ব্যাখ্যাকালে কৈলাস বাবু ও তদীয় রাজমালায় এই শানমতই সমর্থন করিয়াছেন।[xii]

ত্রিপুরা রাজাদের বংশ লতিকা নিয়েও গবেষকগণ একমত হতে পারেননি। ড. দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ ১৮৪জন রাজার নামের তালিকা দিয়েছেন।[xiii] কিন্তু প্রভাংশু ত্রিপুরা ১৮৭জন রাজার নামের তালিকা দিয়েছেন তার পুস্তকে। [xiv] প্রভাংশু ত্রিপুরা তার পুস্তকে রাজা দৈত্যকে রাজা দ্রুহ্যের পুত্র বলে দাবী করেছেন। [xv]  কিন্তু সকল ঐতিহাসিকের দেয়া ত্রিপুরা রাজবংশের বংশ লতিকা অনুযায়ী দ্রহ্য ৭ম রাজা এবং দৈত্য ৪৫তম রাজা। তাহলে খুবই সঙ্গত প্রশ্ন, দ্রুহ্য থেকে দৈত্য পর্যন্ত মাঝখানের ৩৬জন রাজা কোথা থেকে এলো? তারা কারা? এটা অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্ন।

এ কারণেই ড. সেন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘দ্রুহ্য নামে কোন রাজা ছিলেন কিনা এবং যযাতির পুত্র দ্রুহ্য এই ত্রিপুর- রাজাদের আদিপুরুষ কিনা, ….যখন চন্দ্রসূর্যবংশীয় রাজাগণের গোড়ায়ই ঐতিহাসিক গলদ দৃষ্ট হয়(অর্থাৎ কোনো জ্যোতিষ্ক হইতে রাজাদের আবির্ভাব ব্যাপার ঐতিহাসিকগণের ধারণার অতীত),  তখন শুধু ত্রিপুর-রাজগণের কথা নহে, সেই চন্দ্রসূর্যবংশের অভিমানী সকল রাজগণের বংশাবলীরই আদি কথা ঘোর অন্ধকার অন্ধকারাবৃত্ত।’

সঙ্গত কারণে অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ত্রিপুরার রাজবংশ ভারতের আর পাঁচটা রাজবংশের মতো পৌরাণিক গৌরব দাবি করে থাকে, যা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। সম্রাট যযাতির পুত্র দ্রুহ্য চন্দ্রবংশতাবংশ ত্রিপুরা- রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা- এই আষাঢ় গল্প বাদ দিয়ে যদি আমরা ইতিহাসের স্পষ্ট প্রমাণের উপর নির্ভর করি, তাহলে স্বীকার করতে হয়, খ্রিস্টীয় ষোঢ়শ শতাব্দে কিরাতবংশজাত বিজয়মানিক্য স্বাধীন ত্রিপুরার প্রথম রাজা। আরো স্বীকার্য, মুসলমান আমলে ত্রিপুরার রাজবংশ একাধিকবার পাঠানদের হাতে নিগৃহীত ও পরাস্ত হয়েছিলেন এবং সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তথাপি ঢাকা বা গৌড়ের মুসলমান শাসন ত্রিপুরাকে চেপে রাখেনি, মোটামুটি মৌখিক আনুগত্য পেয়েই রেহাই দিয়েছে।[xvi]

একই বিষয়ে ড. জগদীশ গণরায় চৌধুরী বলেছেন, নিঃসন্দেহে ত্রিপুরা প্রাচীন দেশীয় হিন্দু রাজ্য। কিন্তু কতটা প্রাচীন? কেবলমাত্র শ্রী রাজমালা এবং শ্রী রাজরত্নাকরম নামক গ্রন্থের উপর নির্ভর করিয়া এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত করা হইতো যুক্তিযুক্ত হইবে না। এই দুই গ্রন্থ অনুসারে মহারাজ যযাতির পুত্র দ্রুহ্য হইলেন ত্রিপুরার আদি রাজা। কিন্তু আদি রাজা ও তাঁহার অধঃস্তন অনেক রাজার আয়ুষ্কাল ও রাজত্বকাল লিখিত না থাকায় তাহাদের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ থাকিয়া যায়।[xvii] 

চলবে…


  • তথ্যসূত্র:
  • [1] দেবরায়, মৃণালকান্তি ও চৌধুরী, শ্যামল,  ত্রিপুরায় মাণিক্য রাজাদের কীর্তি, প্রথম প্রকাশ, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, উপজাতি গবেষণা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র, ত্রিপুরা সরকার, আগরতলা, পৃষ্ঠা: ১৩-১৪
  • [ii]  চক্রবর্ত্তী, শ্রী শীতলচন্দ্র, ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস, আগরতলা, কোলকাতা, পৃষ্ঠা-২
  • [iii]  ত্রিপুরা, প্রভাংশু, ত্রিপুরা জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি, প্রথম প্রকাশ, স্বাধীনতা বইমেলা- ২০১১, বলাকা প্রকাশন, ঢাকা, পৃষ্ঠা- ১৫-১৭।
  • [iv] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ১৮-১৯।
  • [v] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ২৬।
  • [vi] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ২৭।
  • [vii] https://www.itihasadda.in/mahabharat
  • [viii] গণচৌধুরী, ড. জগদীশ বিভিন্ন শতাব্দীতে ত্রিপুরা, স্বস্তিকা (সংবাদ বাংলা সাপ্তাহিক), সম্পাদক, বিজয় আঢ্য, ৭০ বর্ষ, ১৬ সংখ্যা, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৭, বিধান সরণী কলকাতা, পৃষ্ঠা: ৭
  • [ix] সেন, দীনেশচন্দ্র, ত্রিপুরা রাজ্য, ত্রিপুরার ইতিহাস, সংগ্রহ ও সম্পাদনা, কমল চৌধুরী, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি, ২০১৭, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃষ্ঠা- ১৮।
  • [x] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ২০।
  • [xi] মুখোপাধ্যায়, অরুণকুমার, ত্রিপুরার উপজাতি, লোকগীতি, ত্রিপুরার ইতিহাস, সংগ্রহ ও সম্পাদনা, কমল চৌধুরী, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি, ২০১৭, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃষ্ঠা- ২৫৩
  • [xii] চক্রবর্ত্তী, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ৫-৬।
  • [xiii] সেন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ৫১-৫২।
  • [xiv] ত্রিপুরা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ৩৩-৩৪।
  • [xv] ত্রিপুরা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ১৫।
  • [xvi]  মুখোপাধ্যায়, অরুণকুমার, ত্রিপুরার উপজাতি, লোকগীতি, ত্রিপুরার ইতিহাস, সংগ্রহ ও সম্পাদনা, কমল চৌধুরী, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি, ২০১৭, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃষ্ঠা- ২৫৩
  • [xvii] গণচৌধুরী, ড. জগদীশ বিভিন্ন শতাব্দীতে ত্রিপুরা, স্বস্তিকা (সংবাদ বাংলা সাপ্তাহিক), সম্পাদক, বিজয় আঢ্য, ৭০ বর্ষ, ১৬ সংখ্যা, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৭, বিধান সরণী কলকাতা, পৃষ্ঠা: ৭

লেখকের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আরো কিছু লেখা

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদিবাসী, উপজাতি, ত্রিপুরা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন