বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী

fec-image

বাঙালিরাই বাংলাদেশের আদিবাসী, এদেশের প্রথম জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের আদিম জনগোষ্ঠী নৃতাত্ত্বিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ঐতিহাসিক নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আজকের উত্তরাধুনিক বাঙালিতে রূপান্তর ঘটেছে।

‘বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক’ বিষয়ে গত কয়েক বছর ধরে আমার গবেষণা ও লেখালেখির আগের পর্বগুলোতে আদিবাসী স্বীকৃতির আড়ালে যে রাষ্ট্রঘাতী ষড়যন্ত্র সক্রিয় রয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ বসবাসকারী উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো যে এখানকার আদিবাসী, আদিবাসিন্দা বা ভূমিজ সন্তান নয় সেটাও তাদের লেখা, গবেষণা ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এখন প্রশ্ন উঠতে, তাহলে বাংলাদেশের আদিবাসী কারা? কারা এখানকার আদিবাসিন্দা বা ভূমিজপুত্র? ঐতিহাসিক বিচার, ভূতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, বাঙালিরাই বাংলাদেশের আদিবাসী, এদেশের প্রথম জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের আদিম জনগোষ্ঠী নৃতাত্ত্বিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ঐতিহাসিক নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আজকের উত্তরাধুনিক বাঙালিতে রূপান্তর ঘটেছে।



বাংলাদেশের আদিবাসী নিরূপণে এ লেখাতে এদেশের ইতিহাস, ভূতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এবং ধর্মীয় ইতিহাসের দিকে সংক্ষিপ্তাকারে আলোকপাত যেতে পারে।

ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস

এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়াতে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও বিবর্তন বিষয়ে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে ক্যামব্রিয়ান থেকে ডিভোনিয়ান যুগের কোন শিলার সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে কার্বোনিফেরাস যুগে বঙ্গীয় অববাহিকার ভূত্বকের বিরাট এলাকা জুড়ে বিচলনের ফলে ভূতাত্ত্বিক গঠনসমূহের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রবীণ কার্বোনিফেরাস সময়ে গন্ডোয়ানাল্যান্ডে হিমবাহ যুগ ছিল। কিন্তু নবীন কার্বোনিফেরাস যুগে ক্রমাগত পার্শ্বীয় প্রসারণ এবং মহাদেশীয় ভূত্বকের একটি অংশের নিম্নগামী বাঁক নেওয়ার ফলে প্যালিয়জোয়িক মহাযুগের অভ্যন্তরীণ অগভীর নিম্নভূমির সৃষ্টি হয় এবং ভয়ানকভাবে বিচলনের ফলে গন্ডোয়ানাল্যান্ডের নিম্নগামী বাঁক প্রাক-ক্যাম্ব্রীয় ভিত্তিশিলায় চ্যুতিখাদের সৃষ্টি করে। বঙ্গীয় অববাহিকায় এই চ্যুতিখাদসমূহ পশ্চিমাঞ্চলীয় অন্তরীপ সোপান অঞ্চলে পাওয়া যায়। এই চ্যুতিখাদসমূহে গন্ডোয়ানা শিলা ও গন্ডোয়ানা কয়লাস্তর রক্ষিত আছে। বঙ্গীয় অববাহিকায় কার্বোনিফেরাস অবক্ষেপ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে মনে হয় গন্ডোয়ানা শিলাদলের নিম্নের গন্ডশিলাসমূহ নবীন কার্বোনিফেরাস যুগে অবক্ষেপিত হয়েছিল। পার্মিয়ান যুগে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘ নদী অববাহিকাসহ জলাময় ও ঘন বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির অস্তিত্ব ছিল। এ কারণে বেলেপাথর, কয়লাস্তর ও কর্দম শিলাস্তর গঠিত হয়, যা ঐ অঞ্চলের ভূগর্ভে পরিদৃশ্যমান। এইসব কয়লাস্তর উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক কয়লা মজুত ভান্ডার গড়ে তুলেছে। মেসোজোয়িক মহাযুগ আজ থেকে সাড়ে ২৪ কোটি বছর থেকে প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তিনটি যুগে এই মহাযুগ বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে ট্রায়াসিক (Triassic), জুরাসিক (Jurassic) ও ক্রিটেসিয়াস (Cretaceous)। ডায়নোসর যুগ নামে পরিচিত এই মহাযুগেই ডায়নোসররা পৃথিবী জুড়ে রাজত্ব করতো। ট্রায়াসিক শিলা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি। জুরাসিক-প্রবীণ ক্রিটেসিয়াস যুগে অদূরবর্তী এলাকায় আগ্নেয়গিরির ব্যাপক অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে জামালগঞ্জ, শিবগঞ্জ এবং বগুড়া গ্রস্ত উপত্যকা এলাকায় আগ্নেয় শিলাস্তর গঠিত হয়। এই শিলারাশিকে রাজমহল শিলাসোপান (ট্র্যাপ) বলে। ভূগর্ভে প্রাপ্ত কৃষ্ণবর্ণের ব্যাসল্টে এই শিলাসোপান গঠিত।

বিগত ছয় কোটি ৬০ লক্ষ বছর থেকে বর্তমান সময় সেনোজোয়িক মহাযুগ হিসেবে অভিহিত। এটি টারশিয়ারী (Tertiary) ও কোয়াটারনারী (Quaternary) এই দুই যুগে বিভক্ত। টারশিয়ারী যুগ (আজ থেকে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর থেকে ২০ লক্ষ বছর আগে) ৫টি উপযুগে বিভক্ত, যেমন প্যালিওসিন, ইয়োসিন, ওলিগোসিন, মায়োসিন ও প্লায়োসিন। অপরদিকে কোয়াটারনারী যুগ (২০ লক্ষ বছর থেকে বর্তমান সময়) দুইটি উপযুগে বিভক্ত, যেমন প্লাইসটোসিন ও হলোসিন (সাম্প্রতিক)। প্লাইসটোসিন উপযুগ হলো প্রবীণ উপযুগ, যার ব্যাপ্তি প্রায় ২০ লক্ষ বছর। হলোসিন উপযুগ হলো নবীন উপযুগ, যার ব্যাপ্তি আজ থেকে প্রায় ১০,০০০ বছর। সেনোজোয়িক মহাযুগ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের যুগ হিসেবে পরিচিত। এই মহাযুগে আবির্ভূত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে Elephus, Equs and Leptobos গুরুত্বপূর্ণ।

সেনোজোয়িক মহাযুগ বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, দেশের অধিকাংশ পাললিক স্তর ও ভূতাত্ত্বিক গঠনাদি এই সময়ে গঠিত হয়। বাংলাদেশের সেনোজোয়িক ভূ-গাঠনিক বিবর্তন প্রধানত সংঘটিত হয়েছিল নবীন ইয়োসিন, মধ্য মায়োসিন, নবীন প্লায়োসিন এবং প্রবীণ প্লাইসটোসিন সময়ে। প্রবীণ টারশিয়ারী আমলে (প্যালিওসিন ও ইয়োসিন উপযুগ) বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা উন্মুক্ত সামুদ্রিক পরিবেশের অধীন ছিল, যার ফলে জীবাশ্মসমৃদ্ধ চুনাপাথর ও কিছু বেলেপাথরসহ কর্দমশিলা গঠিত হয়। নবীন টারশিয়ারী যুগে (ওলিগোসিন, মায়োসিন ও প্লায়োসিন যুগ) উত্তরে হিমালয় পবর্তমালা উত্থিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় উন্মুক্ত সাগর দক্ষিণে নেমে যায় এবং নদী ব্যবস্থাদি একটি বৃহৎ বদ্বীপীয় ভূ-খন্ডের সৃষ্টি করে, যা বর্তমান কালের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের মূল কাঠামোর জন্ম দেয়। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের ভূ-পৃষ্ঠে ও ভূগর্ভে বর্তমানে যে পর্যায়ক্রমে আবর্তিত বেলেপাথর ও কর্দম শিলার স্তর দেখা যায়, সেগুলো টারশিয়ারী যুগে এই বদ্বীপীয় পরিবেশেই গঠিত হয়েছিল। কোয়াটারনারী যুগ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে পড়ে এবং হিমায়ন প্রক্রিয়ার অধীনে পৃথিবী উত্তরোত্তর ঢাকা পড়ে যায়। একারণে প্লাইসটোসিন উপযুগ তুষার যুগ নামে পরিচিত। তুষার যুগে সমুদ্রপৃষ্ঠ নেমে যায় এবং তুষার গলা যুগে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হয়। কোয়াটারনারী যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো হোমিনিডস বা হোমোসেপিয়ান এবং বিশেষ করে আধুনিক মানুষের এই পৃথিবীতে আবির্ভাব। বাংলাদেশে প্লাইসটোসিন উপযুগের হৈম-অবক্ষেপ (glacial deposit) পাওয়া যায়নি। অবশ্য বাংলাদেশ সংলগ্ন হিমালয় পর্বতমালা সে সময়ে বরফাবৃত ছিল এবং পরবর্তীতে বরফ গলা যুগে গলে যাওয়া পানি বঙ্গীয় সমভূমির উপর দিয়ে গভীরভাবে ছেদিত নদী উপত্যকার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতো। ফলে সেই সময়ের মধ্যে বঙ্গীয় সমভূমি হিমান্ত সমতলভূমির ন্যায় আচরণ করতো। বাংলাদেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এলাকা প্লাইসটোসিন নদীজ ও হলোসিন পলিজ অবক্ষেপ দ্বারা পূর্ণ। বাংলাদেশের উপর দিয়ে বর্তমান গঙ্গা নদীর গতিপথ ভূতাত্ত্বিকভাবে একটি সাম্প্রতিক ঘটনা এবং দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল কোয়াটারনারী যুগে তার বর্তমান আকৃতি লাভ করে এবং নদী প্রভাবিত এর ভূ-প্রাকৃতিক ব্যবস্থা সে সময়েই গড়ে ওঠে ।”[1]

তবে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক বিবর্তন ও সম্প্রসারণ বিষয়ে গবেষকগণ বলেছেন, “সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্রায় ১৬০০০-৪৫০০ বছর পূর্বে বাংলাদেশের ভূখণ্ড অনেকটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিল।[2] এবং এর পর থেকেই বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড পুণরায় দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত হতে থাকে। বিগত শতক বাদ দিলে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ভূখণ্ড ক্রমাণ্বয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে। আনুমানিক ৭০০০ কাছাকাছি সময়ে সমুদ্রমুখ ভূ-ভাগের অনেকটা কাছাকাছি ছিলো; এবং তখন থেকেই এ ব-দ্বীপ অঞ্চলটি দক্ষিণদিকে বিস্তৃত হয়েছে।… বাংলাদেশের অববাহিকা অঞ্চলের সুপ্রাচীন অবক্ষেপ হিসেবে সঞ্চিত লাল মাটির উঁচু ভূমি প্লাইস্টোসিন ভূমিরূপ হিসেবে পরিচিত। এ ভূমিরূপের মধ্যে বরেন্দ্র ও মধুপুর অঞ্চল দুটি প্রধান। এ অবক্ষেপনের বয়স প্রায় ৪০০০০ বছর বা তারও বেশি।”[3] অর্থাৎ ভূতাত্ত্বিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রাচীনতম ভূ-খণ্ড নয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস

বাঙালির ইতিহাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যালোচনা করা জরুরী।তবে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ইতিহাস বিস্তৃত নয় বা খুব বেশি দিনের নয়। বিশেষ করে প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অত্যন্ত সীমিত। এছাড়াও বন্যা ও নদী ভাঙন, পলিপ্রবণ হওয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষা করাও এখানে কঠিন। “অদ্যাবধি আবিস্কৃত মানব-জীবাশ্মর বয়স প্রায় ১৮ লক্ষ বছর। ভারত উপমহাদেশে প্রাচীনতম মানব-অবশেষের বয়স প্রায় ৫ লক্ষ বছর। বাংলাদেশের লালমাই-চাকলাপুঞ্জি অঞ্চলে উচ্চ-পুরোপলীয় হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে। উপমহাদেশে উচ্চ-পুরোপলীয় যুগের সময়কাল আনুমানিক ১৮০০০-২২০০০ হাজার বছর। এদেশে আবিস্কৃত হয়েছে নবপোলীয় হাতিয়ার। সম্প্রতি আবিস্কৃত হয়েছে তাম্র-প্রস্তর যুগের গর্ত-বসতি ও কৃষ্ণ-এবং-রক্তিম মৃৎপাত্র।… আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব সাত-ছয় শতকে মূলত গঙ্গা উপত্যকায় আরেকটি নগর-সভ্যতার বিকাশ ঘটে, যা দ্বিতীয় নগর সভ্যতা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের উয়ারী-বটেশ্বর ও মহাস্থানগড় দ্বিতীয় নগর সভ্যতার অন্তর্ভূক্ত।”[4]

প্রত্নতাত্ত্বিক মো. মোশারফ হোসেনের মতে, “প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর আগে শুরু হওয়া মায়োসিন যুগে এই পৃথিবীতে মানুষের পদচারণা শুরু হয়। এই যুগটি ভূতাত্ত্বিক প্লেইস্টোসিন ইপোকের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। এ ভূতাত্ত্বিক ইপো আনুমানিক ১০ লক্ষ বছর পূর্বে শুরু হয়েছিল। এই ইপোকেই সিলেট চট্টগ্রাম ময়নামতি লালমাই বগুড়া রাজশাহী দিনাজপুর সাভার মধুপুর ভাওয়ালের গড় ইত্যাদি লালমাটি অধ্যুষিত অঞ্চল গুলো গড়ে উঠেছে।”[5]

প্রাগৈতিহাসিক যুগের সংগ্রামী মানুষ লাইমাই, হবিগঞ্জ, উয়ারি-বটেশ্বর, প্রভৃতি স্থান থেকে প্রাপ্ত ফসিল উড দিয়ে হাত কুঠার, বাটালি, চাঁচুনী, ছিদ্রক, ব্লেড প্রভৃতি হাতিয়ার তৈরি করেছে। তবে কিছু পাথরের হাতিয়ারও পাওয়া যায়।[6] এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের রিপোর্টকৃত প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন সমূহের অবস্থান প্লাইস্টোসিন যুগের ল্যাটেরিটিক সোপান অঞ্চলভূক্ত কুমিল্লা জেলার লালমাই পাহাড় অঞ্চল এবং মধুপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ, রাঙামাটি ও চট্টগ্রাম জেলার উঁচু ভূমির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।… ১৯১৭-১৮ সালে জে. কগিন ব্রাউন তাঁর Prehistoric antiquities of India: Preserved in Indian Museum গ্রন্থে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে প্রাপ্ত এক প্রগৈতিহাসিক সেল্ট এর কথা উল্লেখ করেন।… ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক ডাইসন চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলায় ভূমির উপরে একটি প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ার পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু এ হাতিয়ারটি সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি। ১৯৬৩ সালে ফেনীর ছাগলনাইয়া থেকে সংগৃহীত প্রগৈতিহাসিক হাতিয়ারটি হাত-কুঠার হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে জাতীয় জাদুঘরে।

নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস

সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাংলার নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস মিশ্রিত এক প্রক্রিয়া। কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,

  • “কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
  • দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।
  • হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়-চীন
  • শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।”

নৃবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের পলিমাটির বয়স ২০ হাজার বছরের প্রাচীন। পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে সংরক্ষিত নৌকা দুটির আনুমানিক বয়স ৩ হাজার বছর বলে তারা মনে করেন। পঞ্চগড়ের ভিতরগড় দুর্গের বয়স প্রায় ২ হাজার বছর। তার চেয়েও প্রাচীন উয়ারী বটেশ্বরের সভ্যতাকে নৃবিজ্ঞানীগণ মহেঞ্জোদারো সভ্যতার সমসাময়িক বলে দাবি করেন। প্রাচীন বাংলার স্বীকৃত সভ্যতা বৌদ্ধ সভ্যতা। কিন্তু সে বৌদ্ধরা চাকমা ছিলেন না। ছিলেন বাঙালি। শক্তিশালী বৌদ্ধ রাজা ধর্মপাল ছিলেন প্রথম বাঙালি নৃপতি। বাঙালী বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা তাদের পাণ্ডিত্যে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে সুদুর চীন পর্যন্ত আলো ছড়িয়েছিলেন। বাংলা ভাষার প্রাচীন পুস্তিকা চর্যাপদও আবিস্কৃত হযেছে নেপালের রাজসভায়। উল্লেখ্য, চর্যাপদ মূলত বৌদ্ধগান।

“বাংলাদেশে কখন জনবসতি শুরু হয়েছিল তা বলা খুবই কঠিন। বাংলাদেশের জনগণের পরিচয় কি ছিল তা নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। গোলাম হোসেন সেলিম তাঁর রিয়াজ-উস-সালাতীন-এ স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন যে, প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর পূর্বে ‘বঙ’ জনগোষ্ঠী প্রাচীন বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, তারা তাদের অধ্যুষিত অঞ্চলকে বাসযোগ্য ও সুন্দর করেন। তারা তাদের অঞ্চল শাসনও করেন। তবে তারা সেখানে কতকাল শাসন করেছিলেন তা জানা যায় না।

প্রাচীনকালে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে এসেছিল। এদের মধ্যে নিগ্রোটা জনগোষ্ঠীর কথা প্রথম উল্লেখ করতে হয়। নিগ্রোটোদের পরে এসেছিল অস্ট্রোলয়েড জনগোষ্ঠী। তাদেরকে অস্ট্রো-এশিয়াটিক বা অস্ট্রিকও বলা হতো। প্রাচীন সাহিত্যে তাদেরকে ‘নিষাদ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত, তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত তাদের আদি বাসস্থান থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছিল। বলা হয় যে, তারা বর্তমান কালের কোল, ভীল, শবর, পুলিন্দ এবং অন্যান্য আদিবাসীদের পূর্বপুরুষ ছিল। পরবর্তী যুগে আর একটি জনগোষ্ঠী দেখা যায় যারা দ্রাবিড় ও মোঙ্গল ভাষায় কথা বলত। কিন্তু তারা দ্রাবিড় ও মোঙ্গল ছিল না। সম্ভবত তারা দক্ষিণ-পশ্চিম চীন থেকে ব্রহ্মদেশ ও পূর্বভারতের পাহাড়ি রাজ্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল।

অস্ট্রিক জাতির প্রায় সমকালে, সম্ভবত পাঁচ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড় জাতি বাংলায় প্রবেশ করে। জানা যায় যে, তারা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকার জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেখানে প্রাপ্ত ক্রিট দ্বীপের স্টিটাইট (Steatite) পাথরে নির্মিত একটি সিলমোহর থেকে বোঝা যায় যে, ভূমধ্যসাগরাঞ্চলীয় জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে এসেছিল এবং তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল ।

আর একটি জনগোষ্ঠী যাদেরকে পণ্ডিতগণ হোমো-আলপাইনাস (পামির ও আলপাইনের লোক) বলে অভিহিত করেন, তারা বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বাংলার অন্যান্য হিন্দুদের পূর্বপুরুষ ছিল। তারা আর্য ভাষায় কথা বলত। কিন্তু জাতিতে তারা বৈদিক আর্য ছিল না। বাংলায় আর্যদের আগমনের পূর্বে তারা উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিল। প্রাচীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আরও একটি জনগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তারা পুণ্ড্র নামে পরিচিত ছিল। জানা যায় যে, শবর, পুলিন্দ ও মুতিব জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে পুণ্ড্ররা একটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

বাংলাদেশে আর্যদের আগমন ও তাদের বিস্তারের সময় সম্পর্কে সঠিক করে কিছু বলা বেশ কঠিন। তবে একথা স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, প্রায় তিন হাজার পাঁচ শত বছর পূর্বে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ) আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করলেও তারা বাংলাদেশে এসেছিল অনেক পরে। বলা হয়ে থাকে যে, আর্যরা পশ্চিম হতে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় পাঁচ শতক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশকে আর্যায়ন করতে সময় লেগেছিল প্রায় এক হাজার বছর।” [7]

বাঙলার নৃতাত্ত্বিক পরিচয় উদঘাটন করতে গিয়ে পণ্ডিতগণ এখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জনধারার কথা বলেন। [8] এ জনধারা বা সাংস্কৃতিক ধারাগুলি হচ্ছে- ক. মঙ্গোলীয় চাইনিজ প্রবাহ, খ. প্রটো- অস্ট্রোলয়েড বা ভেড্ডিড বা অস্ট্রিক জনধারা, গ. দ্রাবিড় ভাষাভাষী বা ভূমধ্যীয় বা মেডিটেরিয়ান নৃজাতি রূপের প্রবাহ, আরো পরে ইন্দো-আর্য বা উত্তর ইন্ডিড বা ইন্দো-ভূমধ্য বা দক্ষিণ ইউরেশীয় নৃজাতিরূপ এখানে নৃ-মিশ্রণ ঘটায়। [9] পণ্ডিত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, সর্বপ্রথম নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং এদের পরে আর্য এবং আরো পরে ভোট চীনাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাঙলায়। [10]

এরপর একে একে আরো তিনটি জনগোষ্ঠী ঢেউয়ের মতো বাংলায় এসেছে। এরা হচ্ছে দীর্ঘমুণ্ড জন, গোলমুণ্ড বা এ্যালপাইন জনগোষ্ঠী এবং আদি নর্ডিক জন। সাধারণভাবে আর্য ভাষাভাষীদেরকে দু’ নরগোষ্ঠীতে দেখানো হয়ে থাকে। একটি আলপীয় এবং অন্যটি নর্ডিক। ‘আলপীয়’রা সম্ভবত এশীয়া মাইনর বা বালুচিস্তান থেকে এবং ‘নর্ডিক’রা উত্তর এশীয়া থেকে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে বাংলায় আসে। ভারতীয় নৃবৈশিষ্টে এরা উজ্জ্বল, তবে বাংলায় এদের প্রভাব ততখানি প্রবল নয় বলেই মনে হয়।[11] এরপরের ধারাগুলো মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী, মধ্যএশীয়, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপীয়রাও এসেছে বাংলায়। ফলে বাঙালির মতো এতো বেশি নৃসংমিশ্রণ বিশ্বে আর কোথাও ঘটেছে কিনা বলা মুশকিল। এই নানা সংমিশ্রণে সৃষ্ট জনগোষ্ঠীর আজকের রূপটি বাঙালি। (চলবে…)

তথ্যসূত্র

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদিবাসী, উপজাতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

5 Replies to “বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী”

  1. বাঙালিরা আদিবাসী হলে পাহাড়িরাও আদিবাসী।

  2. সঠিক ইতিহাস তুলে ধরায় মেহেদী হাসান পলাশ ভাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ

  3. বাংলাদেশে বাঙালিরা কীভাবে আদিবাসী হয় আবার আজব কথা!

  4. আদিবাসী আদিবাসী না করে মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন