বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী (দ্বিতীয় পর্ব)

fec-image

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পৌরাণিক মিথ ও দলিল

প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে বৈদিক বাংলা। পূর্বের আলোচনায় বলা হয়েছে, আর্যরা ভারতে আগমণের অনেক পরে বাংলায় এসেছে। তবু আর্য যুগের কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য বাংলাদেশে দৃশ্যমান নয়। তবে আর্য যুগ নিয়ে রচিত বিভিন্ন পৌরাণিক পুস্তক ও কাহিনীতে এ অঞ্চলে বঙ্গ নামে একটি দেশ ও জাতির অবস্থান জানা যায়। ঐতরেয় আরণ্যক-এ সর্বপ্রথম মগধের সঙ্গে বঙ্গ নামক একটি জনগোষ্ঠীর কথা বর্ণিত হয়েছে। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে বঙ্গের উল্লেখ মেলে একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে, যারা আর্য সভ্যতার বাইরে বসবাস করত। তাদের অবস্থান ছিল কলিঙ্গের পাশে। পুরাণে এদের উল্লেখ রয়েছে পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য জনগোষ্ঠী – যেমন, অঙ্গ, মগধ, মুদগরক, পুণ্ড্র, বিদেহ, তাম্রলিপ্তি ও প্রাগজ্যোতিষের সঙ্গে। রামায়ণে অযোধ্যার সঙ্গে বঙ্গের মৈত্রীবন্ধনের উল্লেখ রয়েছে।



মহাভারতের ‘দ্বিগ্বিজয়’ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে ভীম মোদগিরির রাজাকে হত্যা করেন এবং পুণ্ড্রের শাসক ও কৌশিকী নদীর তীরবর্তী এলাকা শাসনকারী অপর একজন শাসককে দমন করেন। এরপর তিনি তাম্রলিপ্তি, করবট, সুহ্ম এবং সমুদ্রতীরবর্তী এলাকার জনগোষ্ঠীকে দমন করে লৌহিত্যের (ব্রহ্মপুত্র) তীরে পৌঁছেন। মহাভারতের পরবর্তী অধ্যায় থেকে জানা যায়, বঙ্গদের রাজ্য সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। ‘বঙ্গে’র সর্বপ্রাচীন উল্লেখ রয়েছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে একটি ভৌগোলিক ইউনিট হিসেবে। এখানে বলা হয়েছে যে, এই অঞ্চলে উৎকৃষ্ট সাদা ও নরম সুতি বস্ত্র উৎপন্ন হতো (শ্বেতম্ স্নিগ্ধম্ দুকূলম্) । মহানিদ্দেশ (আনু. খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী) প্রদত্ত তথ্যে ইঙ্গিত মেলে বঙ্গ-অন্তর্গত এলাকা সমুদ্রতীরবর্তী ছিল। উল্লিখিত তথ্যানুযায়ী পুণ্ড্র, সুহ্ম, তাম্রলিপ্তি, অঙ্গ, মুদগরক, মগধ ও প্রাগজ্যোতিষের সান্নিধ্যে বঙ্গ ছিল পূর্বাঞ্চলীয় একটি দেশ, যার বিস্তৃতি ছিল সমুদ্র পর্যন্ত। কালিদাসের রঘুবংশে (খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দী) বঙ্গের অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ৷ রঘুর বিজয়াভিযান বর্ণনার সময় উল্লেখ করা হয় যে, সুহ্মদের পরাজিত করার পর নৌ-বিদ্যায় (নৌসাধনোদ্ধতান্) বিশেষ পারদর্শী বঙ্গীয়দেরকেও তিনি পরাজিত করেন। তিনি গঙ্গার দুই মোহনার অন্ত বর্তী। (গঙ্গাস্রোতোন্তরেষু) বদ্বীপে বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন। এই বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, গঙ্গার দুই প্রধান স্রোতোধারা ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যবর্তী ত্রিভুজাকৃতির ভূখণ্ডটিই বঙ্গ । আর এমন জলমগ্ন প্লাবনভূমির অধিবাসীদের পক্ষে নৌ-বিদ্যায় দক্ষ হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন ক্ল্যাসিক্যাল লেখকগণ এই অঞ্চলকেই গঙ্গারিডাই বলে আখ্যা দিয়েছেন। চৈনিক গ্রন্থ Wei-hueh (খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী)-তে বঙ্গ (Pan-yueh)-কে Han-yueh ( Xan-gy wat) বা গঙ্গার একটি দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।



প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে প্রথম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লিখিত জৈন উপাঙ্গ পন্যবণা (প্রজ্ঞাপনা)-তে কিছুটা বিস্তৃতভাবে বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে তাম্রলিপ্তিকে (তমলুক, মেদিনীপুর জেলা) বঙ্গের অন্তর্গত হিসেবে দেখানো হয়েছে। শক্তিসঙ্গমতন্ত্র-এর সৎপঞ্চাশোদ্দেশবিভাগ-এ বলা হয়েছে যে, সমুদ্র থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত বঙ্গের বিস্তৃতি ছিল। বাৎস্যায়নের কামসূত্র সম্পর্কে যশোধর প্রদত্ত মন্তব্য অনুযায়ী বঙ্গের অবস্থান ছিল লৌহিত্যের পূর্বে। বঙ্গের রাজনৈতিক সম্প্রসারণের কারণে এর বিস্তৃতি ছিল ব্যাপক ।

সেন যুগের লিপি সাক্ষ্যে বঙ্গের ‘বিক্রমপুরভাগ’ ও ‘নাব্যভাগে’র উল্লেখ রয়েছে, যা বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকা, ফরিদপুর ও বরিশাল এলাকা নির্দেশ করে। বৈদ্যদেবের কমৌলি তাম্রশাসনে ‘অনুত্তর বঙ্গ’ অথবা দক্ষিণ বঙ্গের উল্লেখ আছে। বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য পরিষদ তাম্রশাসনে বঙ্গের নাব্য এলাকার রামসিদ্ধি পাটকের ‘বঙ্গাল-বড়াভূ’-এর কথা বলা হয়েছে। রামসিদ্ধিকে বৃহত্তর বরিশাল জেলার গৌরনদীর সঙ্গে অভিন্ন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশ বঙ্গের নাব্যভাগ দ্বারাই গঠিত । চন্দ্র তাম্রশাসনে উল্লিখিত চন্দ্রদ্বীপও একই এলাকা নির্দেশ করে এবং এটিও বঙ্গেরই একটি অংশ ছিল ।

বৃহৎসংহিতায় প্রদত্ত দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের দেশগুলির তালিকায় ‘উপবঙ্গে’র উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর দিগ্বিজয় প্রকাশ-এ ‘উপবঙ্গ’কে যশোর ও তৎসংলগ্ন বনাঞ্চলের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত এটি ছিল সুন্দরবনের অংশ। বঙ্গের দক্ষিণ অংশের সমুদ্র তীরবর্তী অংশটি ছিল বঙ্গাল, ইতিহাসের কোন এক সময়ে যার পৃথক ভৌগোলিক অস্তিত্ব ছিল।[1] ঐতরেয় আরণ্যক এ বঙ্গদেশের লোকের নিন্দাসূচক উল্লেখ আছে। যে সময়ে ঐতরের ব্রাহ্মণে বা আরণ্যকে আমরা বঙ্গ অথবা পুণ্ড্রজাতির উল্লেখ দেখিতে পাই সে সময়ে অঙ্গে, বঙ্গে অথবা মগধে আর্য্য জাতির বাস ছিল না। পবিত্র ঋগ্বেদে একইভাবে এই অঞ্চলে বঙ্গ নামে জাতির উল্লেখ আছে এবং এইসব কম-বেশি তিন হাজার বছর আগের কথা।[2] মহাভারতে বাংলার কয়েকটি রাজ্যের কথা উল্লেখ আছে। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত রাজাগণের মধ্যে বঙ্গরাজ সমুদ্র সেন এর পুত্র প্রতাপ চন্দ্র সেন পবন রাজ বাসুদেব ও তাম্রলিপির রাজার উল্লেখ আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বঙ্গরাজ দুর্যোধনকে সমর্থন করেন।

বৌদ্ধ মিথ ও দলিল

বাঙালির প্রাচীন সভ্যতা মানেই বৌদ্ধ সভ্যতা। উয়ারী-বটেশ্বর থেকে শুরু করে মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, পুণ্ডবর্ধন কিম্বা শালবন বিহার, আনন্দ বিহার সবই বৌদ্ধ সভ্যতার প্রামাণিক দলিল। কাজেই বাঙালির ইতিহাস পর্যালোচনায় বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস ও সভ্যতা পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, বাঙালিরা যখনই নিজেদের আদিবাসী দাবী করে তখনই পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গা, রাখাইন প্রভৃতি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উপজাতীয় জনগোষ্ঠী এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পুণ্ডবর্ধন, মহাস্থানগড় কিম্বা ময়নামতির প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখিয়ে নিজেদের বাংলাদেশের আদিবাসী দাবী করে থাকে। কাজেই বাংলাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিহাসের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সম্প্রদায়ের সম্পর্ক বা সংযুক্তি কতটুকু সেটা পর্যালোচনার দাবী রাখে।

প্রথমেই বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের আগমণ নিয়ে চকিত আলোকপাত করা যাক। বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের আগমন ইতিহাসে মিমাংসিত বিষয় নয়। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ ৫৬৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে নেপালের লুম্বিনীতে জন্মগ্রহণ করেন। অনেকের মতে, তিনি স্বয়ং আজকের বাংলাদেশে এসেছিলেন। ’বঙ্গদেশে কখন বৌদ্ধধর্মপ্রচার হয়েছিল তার সঠিক তথ্য এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে অনুমান করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধের সময়কাল হতেই সদ্ধর্মের আলো অবিভক্ত বাংলায় বিকীর্ণহয়েছিল। ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. নীহার রঞ্জন রায় প্রমুখ মনে করেন, অশোকের আগেই বৌদ্ধধর্মপ্রাচীন বাংলায় কোনো কোনো স্থানে বিস্তার লাভ করেছিল (মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৯; রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯৪-৯৬)। নলিনীনাথ দাশগুপ্ত মনে করেন, মগধ ও বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান এত কাছাকাছি যে, বুদ্ধের জীবিতকালেই মগধ হতে বৌদ্ধধর্মের ঢেউ এসে বাংলাকে প্লাবিত করা মোটেই অসম্ভব নয়।[3] বংশ সাহিত্য অনুসারে (মহাস্থবির, ধর্মাধার; অনুঃ শাসনবংস পৃঃ ৫৫) গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধত্ব লাভের আট বছর পর গবম্পতি স্থবিরের আরাধনায় অধুনা মায়ানমারের প্রাচীন রামঞ্চ রাষ্ট্রের সুধর্মপুরে উপনীত হয়ে সেখানে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। মায়ানমারে প্রাপ্ত এক শিলালিপিতে উল্লেখ আছে, (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৫) বুদ্ধের সাথে বিশ হাজার অর্হৎ ভিক্ষুসেদেশে গমণ করেছিলেন। বুদ্ধ যদি স্বয়ং বার্মায় গমণ করে থাকেন তাহলে বুদ্ধকে অধুনা বাংলা দেশের চট্টগ্রাম হয়েই যেতে হয়েছিল, কেননা তখন এটাই ছিল মায়ানমারে যাবার প্রশস্ত ও সহজ পথ। কাজেই তখন চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্মপ্রচারিত হওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া, কিংবদন্তী আছে যে, বুদ্ধ স্বয়ং একবার অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চট্টগ্রামের হস্তীগ্রামে এসে পক্ষকাল অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। সেই হস্তীগ্রাম পটিয়ার হাইদগাঁও বলে পণ্ডিতগণ ধারণা করেন। এ সম্পর্কেছোট্ট মতভেদও রয়েছে, সে মতভেদ অনুসারে বুদ্ধের আগমন ঘটেছিল হস্তিপৃষ্ঠে এবং গ্রাম হিসেবে হাইদচকিয়া গ্রাম কথিত। এখানে একটি বিহার বা কেয়্যাংও ছিল (আলম, ওহিদুল; চট্টগ্রামের ইতিহাস ‘প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল’ চট্টগ্রাম, ১৯৮২, পৃঃ ৮)। অন্যদিকে বাংলা যেহেতু মগধ সীমান্তের পাশেই ছিল সেহেতু এরূপ অনুমান ভিত্তিহীন নয় যে, বুদ্ধ বাংলার কোথাও কোথাও পদচিহ্ন রেখেছিলেন।  হিউয়েন-সাং উল্লেখ করেছেন যে, বুদ্ধ বাংলা ও বিহারের বহু জায়গা ভ্রমণ করেছেন এবং সম্রাট অশোক সেই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সেসব স্থানে স্তূপ নির্মাণ করিয়েছেন।[4] তবে প্রখ্যাত ঐতিহাসকি ড. নীহাররঞ্জন রায় গৌতম বুদ্ধের বাংলাদেশে আগমণের তথ্যটি স্বীকার করতে চাননি। কিন্তু তিনি এ কথা স্বীকার করেছেন যে, বুদ্ধদেব স্বয়ং বাঙলাদেশে আসুন বা না আসুন, মৌর্য সম্রাট অশোকের আগেই বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন বাঙলায় কোনও কোনও স্থানে বিস্তার লাভ করিয়াছিল। অন্তত খৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে বৌদ্ধধর্ম যে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছিল মহাস্থান-শিলাখন্ড লিপিতে তো তাহার পাথুরে প্রমাণও বিদ্যমান।”[5]

তবে এটা সর্বজন স্বীকৃত, বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সম্রাট অশোকের মৌর্য শাসনামলে এবং বিস্তার ঘটে পাল আমলে। বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রথম প্রবেশ ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে। এ সময় মৌর্য সম্রাট মহামতি অশোক উত্তর বাংলা দখল করে একটি প্রদেশ বা ভুক্তিতে পরিণত করেন। এই পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির রাজধানী ছিল পুণ্ড্রনগর। আজকের মহাস্থানগড়। এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে সে যুগের বৌদ্ধ নিদর্শন পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রবলভাবে বিকাশ লাভ করে খ্রিষ্টীয় আট শতক থেকে। এ সময় বাংলা দক্ষিণ-পূর্ব অংশ ছাড়া বাকি অঞ্চল পাল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১১ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল এ দেশে। একই যুগপর্বে দেবপর্বতকে ঘিরে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় দেব, চন্দ্র, খড়গ প্রভৃতি রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজারাও ছিলেন বৌদ্ধধর্মাশ্রয়ী। ফলে বলা যায়, আট শতক থেকে এগারো শতক পর্যন্ত পুরো বাংলায় বৌদ্ধ সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে।[6]

এ ব্যাপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মেদিনিপুরে অবস্থিত বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক  রাজকুমার পণ্ডিত বলেছেন, মৌর্য যুগে পৌণ্ড্র রাজ্য সম্রাট অশোকের (রাজত্বকাল: ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শাসনাধীন ছিল এবং সেই সময় বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম বিদ্যমান ছিল। তিনি বুদ্ধের পৌণ্ড্ররাজ্যে শুভাগমন ও ধর্মদেশনা চিরজাগ্রত করার জন্য একটি স্তূপ ও বিহার নির্মাণ করিয়েছিলেন। এছাড়াও সমগ্র বঙ্গদেশে মোট ৭০ টি বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করিয়েছিলেন, তন্মধ্যে ২২ টি ছিল শুধু তাম্রলিপ্ততেই। ভিক্ষু ছাড়া ভিক্ষুনীরাও সেই সময় বিহারে থাকতেন।

দশম থেকে একাদশ শতাব্দীর আরেক বাঙালী কৃতী সন্তানের এবং তৎকালীন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক সদৃশ সুপণ্ডিত ও দার্শনিক, বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান আচার্য “অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’। তিব্বতের রাজার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে তিনি অত্যন্ত দুর্গম হিমালয় পর্বতমালা অতিক্রম করে তিব্বত প্রদেশে এসে পৌঁছান। সেখানে তিনি দীর্ঘ ১৩ বৎসর কাল অতিবাহিত করে বৌদ্ধধর্মের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাঙালী অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন। তাঁর লেখনীর ছোঁয়ায় ১৭৫ টির অধিক দার্শনিক গ্রন্থসমূহের আবির্ভাব হয় এবং তিনি বৌদ্ধ ধর্মের এক মানবতাবাদী ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন। তিব্বতী ও চৈনিক বৌদ্ধদের কাছ থেকে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এখনও পর্যন্ত দ্বিতীয় বুদ্ধের ন্যায় পূজিত হয়ে থাকেন। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বঙ্গদেশে চন্দ্র ও পাল রাজাদের রাজত্বকালে মহাযান বৌদ্ধধর্মের সুবর্ণযুগে পর্যবসিত হয়েছিল। সোমপুরী, ওদন্তপুরী, বিক্রমশীলা মহাবিহার রাজা মহিপাল ও জয়পালের উল্লেখযোগ্য ও সুমহান কীর্তি। ধর্মপাল বঙ্গদেশে পঞ্চাশোর্ধ বৌদ্ধধর্ম-বিদ্যায়তন সুপ্রতিষ্ঠত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার উল্লেখ তিব্বতী সাহিত্যে রয়েছে।[7] এককথায় সম্রাট অশোক বা তার অনুসারীদের কেউ চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গা, রাখাইন, চাক উপজাতির ছিলেন না। অন্যদিকে অতীশ দীপঙ্কর ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত।

পাল রাজারা ছিলেন বাঙালি। সেকারণে সম্রাট ধর্মপালকে ইতিহাসে প্রথম বাঙালি নৃপতি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। পালদের আমলে বাংলা ভাষার ব্যাপক সমৃদ্ধি ঘটে। বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত গ্রন্থ চর্যাপদ এ সময়েই লিখিত হয়। কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যা লয়ের অধ্যাপক, বহু ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার লাইব্রেরির পুঁথিশালায় ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯০৭ সা লে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণসম্ভার ভূর্জপত্রে (তালপাতা) হাতে লেখা চর্যাপদের পুঁথি ‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়’ খুঁজে পান। এ চর্যাগীতির ভাষা বিশ্লেষণ করে তিনি প্রমাণ করেন,এটি বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন, যা হাজার বছরের পুরনো। চর্যাপদ বাং লা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন। নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা এটি। খৃষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ।[8]

এ প্রসঙ্গে উপরে আলোচিত সময়কালের বাংলাদেশের সবেচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্যগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে গুপ্ত, মৌর্য ও পাল আমলের। আদি ঐতিহাসিক যুগে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৩০০ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় নগরায়ন ঘটেছিল। তবে সুনির্দিষ্ট কোন দশকে বা শতকে কোন অঞ্চলে নগরায়ন হয়েছিল তা বলা সম্ভব নয়।[9]

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন নগর সভ্যতার অন্যতম মহাস্থানগড়। মহাস্থানগড়ের অবস্থান বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় । বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৮ কি. মি. উত্তরে করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে গেলে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়৷। বরেন্দ্র অঞ্চলে অবস্থিত মহাস্থানগড়ের প্রাচীন নাম পুণ্ড্রনগর। পুণ্ড্রনগর ছিল পুণ্ডবর্ধনের রাজধানী। প্রাচীন ব্রাহ্মীলিপির উপর ভিত্তি করে পুণ্ড্র নগরের সময়সীমা ধরা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩-২ শতক। উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎ পাত্রের উপর ভিত্তি করে রহমান অভিমত প্রদান করেন যে, মহাস্থানগড়ের বয়স খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দ।[10] ফ্রান্স- বাংলাদেশ কার্বন-১৪ ভিত্তিতে মহাস্থানের সাংস্কৃতিক স্তরের বয়স নির্ধারণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১ অব্দ। ফ্রান্সের উৎখনন দলনেতা স্যালের মতে মহাস্থান নগরটি বিকশিত হয়েছিল মৌর্য যুগে। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কারণে নগরটির জন্ম হয়েছিল।[11] কিন্তু দিলীপ কুমার চক্রবর্তী এ প্রসঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, মৌর্য যুগের অনেক আগে এখানে মানব বসতি শুরু হয়েছিল।[12] তারই ধারাবাহিকতায় এখানে নগরায়ন শুরু হয়। সম্প্রতি মহাস্থানের অদূরে উয়ারী-বটেশ্বরে কৃষ্ণ এবং রক্তিমৃত মাত্র আবিষ্কৃত হওয়ায় চক্রবর্তী অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়।

অন্যদিকে উয়ারী-বটেশ্বর নরসিংদী জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। ইতোমধ্যে উয়ারী- বটেশ্বরের মানব বসতিকে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতক (কার্বন- ১৪ পরীক্ষার মাধ্যমে) বলে নির্ধারণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য উয়ারী-বটেশ্বরের প্রাপ্ত জনপদ সিরিজের ছাপাঙ্কিত রূপ্য মুদ্রা প্রমাণ করে যে, এটি একটি প্রাচীন জনপদ বা জনপদের অংশ (খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ মহাজনপদ সিরিজের) ছিল যার নাম আমরা এখনো জানিনা।[13] এখানে জনপদ স্থাপনের পূর্বের-তাম্রপ্রস্তর সংস্কৃতির নিদর্শন কৃষ্ণ- এবং- রক্তিম মৃতপাত্র ও গর্ত বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে।

এদিকে সোমপুর মহাবিহার প্রাচীন বাংলার একটি বৌদ্ধ বিহার। পাহাড়পুরের উৎখননকৃত বিহার কমপ্লেক্সের সঙ্গে সোমপুর মহাবিহারকে অভিন্ন মনে করা হয়। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন। পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল (আনু. ৭৮১-৮২১ খ্রি) এ বিহার স্থাপন করেন। ধ্বংসাবশেষ হতে কিছু মাটির সিল পাওয়া গেছে, যেখানে উৎকীর্ণ রয়েছে  ‘ শ্রী-সোমপুরে-শ্রী-ধর্মপালদেব-মহাবিহারিয়ার্য-ভিক্ষু-সংঘস্য’।  লামা তারনাথ এবং অন্যান্য তিববতীয় উৎস থেকে জানা যায় যে,  বরেন্দ্র জয়ের পর  দেবপাল এটি নির্মাণ করেন। সম্ভবত ধর্মপালের অসমাপ্ত কাজগুলিই তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি দেবপালের সময়ে শেষ হয়। পাল শাসকগণ ছিলেন বৌদ্ধধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী।[14] ইউনেস্কোর মতে পাহাড়পুর বিহার বা সোমপুর বৌদ্ধ বিহার দক্ষিণ হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার। আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে। এর দৈর্ঘ্য পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট এবং উত্তর-দক্ষিণে ৯২২ ফুট। মূল ভবনে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য ১৭৭টি কক্ষ ছিল। ৮০০ জন ভিক্ষুর বাসপোযোগী ছিল। এ বিহারে ১২৫নং কক্ষে মাটির পাত্রে খলিফা হারুন-অর-রশিদের শাসনামলের রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া যায়। কোন সাধক বা ধর্ম প্রচারক মুদ্রাগুলি এখানে এনেছিলেন বলে অনুমান করা হয়।

অর্থাৎ উল্লিখিত আলোচনা থেকে আমরা এ কথা বলতে পারি, প্রাচীন বাংলার এসকল স্থাপত্য ও জনবসতির সাথে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, পাঙ্খো, লুসাই, তঞ্চঙ্গা, রাখাইন, গারো, সাঁওতাল প্রভৃতি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাচীন বৌদ্ধ জনগণের সাথেও এসকল উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক ছিলো না। প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ছিলো বাঙালি বা বাঙালির পূর্বসূরী।

 (চলবে…)

  • তথ্যসূত্র:
  • [1] প্রাগুক্ত, ভূমিকা ১ম খণ্ড।
  • [2] রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, প্রথমখণ্ড।
  • [3]  রানা চক্রবর্তী, অবিভক্ত বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিবৃত, উত্থান ও পতন- এক অজানা ইতিহাস, littlemag.org.
  • [4] চাকমা, নীরু কুমার, বৌদ্ধ ধর্ম, বাংলাপিডিয়া, প্রাগুক্ত।
  • [5] রায়, ড. নীহাররঞ্জন, প্রাগুক্ত।
  • [6] শাহনাওয়াজ, এ কে এম, বাংলাদেশে বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সুলুক সন্ধান, প্রথম আলো, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬।
  • [7] পণ্ডিত, রাজকুমার, বাংলায় বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিকাশ, A Peer-Reviewed Bi-monthly Bi-lingual Research Journal Volume-VII, Issue-1, January 2021, Page No. 65-70, International Journal of Humanities & Social Science Studies (IJHSSS), Scholar Publications, Karimganj, Assam, India.
  • [8] প্রাগুক্ত
  • [9] রহমান, সুফি মুস্তাফিজুর, নগরায়ন: আদি ঐতিহাসিক ও প্রাক-মধ্যযুগ, প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-১, প্রাগুক্ত।
  • [10] Rahman, Sufi Mostafizur, Archaeological Investigation in Bogra District (From Early Historic to Early Mediaeval Period), (Dhaka-2000), 243.
  • [11] Salles, Jean-Frincois, North Bengal In The Mauryan and Post-Mauryan Periods: Reflections on The Ancient History of Mahasthan, Journal of Bengal Art, (1998), page- 187-197, For more, IBID.
  • [12] Chakrabarti, Dilip K, Anciant Bangladesh, (Dhaka-2000)
  • [13] রহমান, সুফি মুস্তাফিজুর, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৫০৩।
  • [14] বাংলাপিডিয়া, প্রাগুক্ত।

♦ লেখক: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ, চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন।


Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন