কুকি-চিন জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের আদিবাসী নয়

fec-image

আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে আলোচিত জনগোষ্ঠীর নাম কুকি-চিন। তবে কুকি-চিন কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর নাম নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ৬টি জনগোষ্ঠী যথা- বম, মুরং, খিয়াং, পাঙ্খো, লুসাই ও খুমী জনগোষ্ঠীকে কুকি জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে একত্র করে বলা হচ্ছে কুকি-চিন। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার ও ভারতে এই জাতিগোষ্ঠীভুক্ত আরো বেশকিছু জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের ৬টিসহ ভারত ও মিয়ানমারের ছোট-বড় প্রায় ৫০টি জনগোষ্ঠীর একত্র নাম কুকি-চিন। ভারতের মিজোরাম প্রদেশে তারা ‘মিজো’ জনগোষ্ঠী নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। ‘মি’ অর্থ মানুষ এবং ‘জো’ বা জৌ অর্থ পাহাড়। ‘মিজো’ অর্থ ‘পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষ’। এই মিজো জনগোষ্ঠীর কারণেই প্রদেশের নাম মিজোরাম বলে অনেক ঐতিহাসিকের ধারণা। ২০২২ সালের আদমশুমার অনুযায়ী বাংলাদেশে কুকি-চিন সম্প্রদায়ভুক্ত ৬ জাতির জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭৬৫৮১ জন।

২০২২ সালের এপ্রিল মাসে হঠাৎ করেই এই কুকি-চিন জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯টি উপজেলাকে তাদের নিয়ন্ত্রিত একটি স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি করে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। কুকি-চিনের দাবি পার্বত্য চট্টগ্রামের এই অঞ্চলগুলো তাদের আদিবাস। এই অঞ্চলটি স্মরণাতীত কাল থেকে তাদের পূর্বপুরুষের বসতি ছিল। এই দাবির সময় তারা এই অঞ্চলটিকে তাদের ‘Ancestral Land ’ বলে দাবি করে থাকে। অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে ‘Ancestral’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘Connected with or that belonged to people in your family who lived a long time ago.’

এই আলোচনায় আমরা অনুসন্ধান করবো পার্বত্য চট্টগ্রাম কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষের আদিবাস কিনা? আলোচনার গ্রহণযোগ্যতা রক্ষায় আমরা যেসকল রেকর্ড উপস্থাপন করবো তা মূলত, কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর লেখক ও গবেষকদের লেখা বা তাদের কিম্বা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী কর্তৃক স্বীকৃত লেখক, গবেষক ও সম্পাদকদের দ্বারা প্রমাণিকরণকৃত (ভেরিফাইড) ইতিহাস। সে কারণে এ আলোচনায় বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা ৫ খন্ড (আদিবাসী জনগোষ্ঠী খন্ড) এবং বাংলাদেশের আদিবাসী এথনোগ্রাফিয় গবেষণা, ১ম খন্ডে রেফারেন্সগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।

বম
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদর উপজেলায় এবং রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় বম সম্প্রদায়ের বসবাস। ২০২২ সালের আদমশুমার অনুযায়ী বাংলাদেশে বম জনগোষ্ঠীর সদস্য ১৩১৯৩ জন।

বম সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকে বম সম্প্রদায়ের লেখক ও গবেষক জির কুং সাহু লিখেছেন, ‘ঊনবিংশ শতকের পূর্বে এবং বিংশ শতকের বিভিন্ন লেখালেখিসমূহে বমদেরকে চীন (Chin) জাতির উপশাখা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ফায়ের, বার্বি, লুইন, গ্রীয়েরসন, হাচিনসন, মিলস্ ও অন্যান্য লেখকগণ অনুরূপ মত পোষণ করেন। বলা হয়, চীনের চিনলুং এলাকার এক গুহা থেকে তারা এসেছে। ধারণা করা হয়, এই কাহিনী মনে রাখার জন্য বান্দরবান জেলার একটি বম গ্রামের নাম চিনলুং রাখা হয়েছে।

বর্তমান স্থানে বমদের আগমন সপ্তদশ দশকে। ফ্রান্সিস বুকানন দক্ষিণপূর্ব বাংলায় (কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম) তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে চমৎকার ঐতিহাসিক ঘটনাবলি উল্লেখ করেছেন। তিনি ১৮ এপ্রিল ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে বাজালিয়া (বোমাং হাট) নামক স্থানে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থানকালে ৬ জন ‘জৌ’ নারীপুরুষের দেখা পান।

অন্যদিকে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৫, আদিবাসী জনগোষ্ঠী খন্ডে বম সম্প্রদায়ের আরেক গবেষক জিং আলহ্ বম লিখেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বমদের আগমন সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সম্ভবত তাদের আদিনিবাস ছিল ব্রহ্মদেশের চিন পর্বত এলাকার দক্ষিণে তসন ও উত্তরে জৌ উপত্যকা ভূমির মধ্যবর্তী অঞ্চলে। আবার মায়নমারের (বার্মার) চিন্দুইন ও ইরাবতী নদীর উপত্যকা অঞ্চলেও আদিবাসী বমদের বসবাস দেখা যায়। জানা যায় যে, এখানকার খুমী জনগোষ্ঠীর লোকদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে অতি প্রাচীনকাল থেকেই বমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় এসে বসতি স্থাপন শুরু করেছিলেন। অপরপক্ষে এও জানা যায় যে, নানা রকম দুর্যোগ, বিশৃঙ্খলা ও পরিস্থিতির শিকার হয়ে বমরা ভাগ্যান্বষণে জীবিকা অর্জনের লক্ষ্যে সুদূর চিন পর্বত এলাকা থেকে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন।’

খিয়াং
পার্বত্য জেলা রাঙামাটির রাজস্থলী, কাপ্তাই এবং বান্দরবান জেলার সদর, রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় খিয়াং জনগোষ্ঠীর বসবাস। ২০২২ সালের জনশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে খিয়াংদের জনসংখ্যা ৪৮২৬ জন। খিয়াং সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে উৎস প্রকাশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকে খিয়াং সম্প্রদায়ের লেখক বাছা খিয়াং লিখেছেন, ‘দক্ষিণের টেম-চিন বা উত্তরের ওয়াইল্ড চিন’ নামে অভিহিত আরাকান-ইয়োমা উপত্যকার অববাহিকায় খিয়াংদের আদিনিবাস ছিল বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

প্রথম মতবাদ: খিয়াংরা আরাকানের উত্তর ও দক্ষিণের ইয়োমা (Yoma) পর্বত হতে জীবন-জীবিকা আরম্ভ করে। বার্মার (বর্তমান মায়ানমারে) আকিয়াব, ক্যম্পু এবং সানডোওয়ে ২ জেলার পশ্চিমে তাদের বসবাস রয়েছে বলে জানা যায় ।

দ্বিতীয় মতবাদ: বার্মার চীন হিলসের অধিবাসীদের খিয়াং বলা হয়। বার্মিজরা এদের ‘চিনস’ আর আরাকানিরা খিয়াং বলে ডাকে। কালের আবর্তে চীন হিলসের এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা অংশ জীবন-জীবিকার তাগিদে বা গোষ্ঠীপ্রধানের অনুচর হয়ে বর্তমান পার্বত্যাঞ্চলের দিকে ধাবিত হতে থাকে।

তৃতীয় জনশ্রুতি হচ্ছে: একসময় বার্মা এবং আরাকান রাজ্যের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে যুদ্ধে খিয়াং জনগোষ্ঠীসহ অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নানাভাবে ক্ষতির শিকার হয়। যুদ্ধের কারণে খিয়াংরা সেই অঞ্চল ত্যাগ করে বর্তমান পার্বত্য ভূখন্ডে দিকে অগ্রসর হয়। সেসময় তাদের নেতা থোউ-এর নেতৃত্বে তাদের আগমন ঘটে। কেউ কেউ ১৬০০-১৭০০ শতকে খিয়াংরা এ অঞ্চলে এসেছে বলে মনে করেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৫, আদিবাসী জনগোষ্ঠী খন্ডে খিয়াং সম্প্রদায়ের আরেক গবেষক থয়সাপ্রু খিয়াং লিখেছেন, ‘খিয়াংরা নিজেদের বলে হাউ (Hiou)। হাউ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে- একটির অর্থ ভাসমান, আর অন্যটির অর্থ হচ্ছে কাছাকাছি। কাছাকাছি কোনো অজানা দেশ হতে ভাসতে ভাসতে এসেছে বলে এটির অর্থ হাউ হয়েছে বলে ধারণা করা হয় ।

খিয়াংদের আগমন: দক্ষিণের টেম-চিন (Tame Chin) বা উত্তরের Wild Chin নামে অভিহিত আরাকান-ইয়োমা উপত্যকার অববাহিকা হতে খিয়াংদের আগমন বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিভিন্ন তথ্য বা মতবাদ অনুযায়ী খিয়াংদের সম্পর্কে নি¤েœ তথ্য উপস্থাপন করা গেল- ১. খিয়াংরা আরাকানের উত্তর ও দক্ষিণের ইয়োমা (Yoma) পর্বত হতে জীবনযাত্রা আরম্ভ করেন। বার্মার (বর্তমান মায়ানমারে) আকিয়াব (Akyab), ক্যপা (Kzaukpyu) এবং সানডোওয়ে (Sandoway) জেলার পশ্চিমে তাদের বসবাস রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া মিনবু (Minbu), দেয়েতমোয়ো (Theyetmyo), প্রোম (Prome) এবং হেনজাডা (Henzada) জেলার পূর্বে তাদের বসবাস রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। হডসন-এর মতে, খিয়াং, খুমী এবং ম্রোরা এদেশের আদি অধিবাসী। এরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। ২. চিন হিল্সের অধিবাসীদের খিয়াং বলা হয়। বার্মিজরা এদের ‘চিন্স’ আর আরাকানিরা খিয়াং বলে ডাকেন। ৩. অন্য এক জনশ্রুতি মতে, বার্মা এবং আরাকান রাজ্যের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কারণে তারা এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। ভাষ্যমতে, সেসময় তাদের নেতা থোউ-এর নেতৃত্বে নাকি তাদের আগমন ঘটে। চিন্দুইন (Chindwin) নদীর অববাহিকা হতে তাদের জীবন সংস্কৃতির আরম্ভ হয়েছে বলে ধারণা করা হয় এবং ৪. অনেকের মতে, বোমাং রাজা বার্মা হতে এ অঞ্চলে আসার সময় খিয়াংদেরও আগমন ঘটে বলে ধারণা করেন। সম্ভবত উত্তর ব্রহ্মের কাচিন পার্বত্য এলাকায় কাচিন বা কাখ্যেং জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে খিয়াং জনগোষ্ঠী নামে পরিচিত হতে পারেন ।

খিয়াংদের বসতি স্থাপন: বান্দরবান পার্বত্য জেলার পশ্চিমাংশে রয়েছে মুরানজা পর্বতশ্রেণী। কক্সবাজার জেলার হারভাং বাজার থেকে তিন মাইল পূর্বদিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলার অভ্যন্তরে চুনতি পর্বত হতে শুরু করে দক্ষিণ পূর্বদিকে যে পর্বতশ্রেণী বিস্তৃত হয়েছে তার নাম মুরানজা পর্বতশ্রেণী। মুরানজা পর্বতের কয়েকটি শাখার মধ্যে- ১. মুরানজা পর্বতশৃঙ্গ ২. নাসপটং ৩. বসিটং উল্লেখযোগ্য। মুরানজা পর্বতশ্রেণীর সাথে সমান্তরালভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে দক্ষিণে ওয়াইলাটং পর্বতশ্রেণী। এটি মায়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সকল বন জঙ্গল, পাহাড়, পর্বত শৃঙ্গ আর ঝর্না পেরিয়ে পার্বত্যাঞ্চলে খিয়াংরা এখন বর্তমান আবাসস্থলে বসবাস করছে বলে ধারণা করা হয়।

খুমী
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি এই তিন উপজেলায় খুমীরা বসবাস করে। খুমীরা সাধারণত শহর থেকে অনেক দূরে উঁচু পাহাড়ে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে। ২০২২ সালের জনশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে খুমীদের জনসংখ্যা ৩৮৭০ জন। খুমী সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে উৎস প্রকাশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকে খুমী সম্প্রদায়ের লেখক লেলুং খুমী লিখেছেন, বাংলাদেশের বাইরে বার্মার চীন প্রদেশে (Chin Hills আরাকান রাজ্যের অংশ হিসেবে পরিচিত ছিল) পালেটওয়া (Paletwa) অঞ্চলে ১ লাখ বেশি খুমী বসবাস করে বলে জানা যায় এবং ভারতের মিজোরাম অঙ্গরাজ্যেও প্রায় ৩,০০০ (তিন হাজার) খুমী বসবাস করে বলে অনুমান করা হয়। খুমীরা মূলত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত একটি দল। তারা তিব্বতি- বার্মিজ-কুকি-চীন ভাষায় কথা বলে।

বাংলাদেশে অনেক সময় এই বংশোদ্ভূত দলকে ‘কুকি’ নামেও ডাকা হয়ে থাকে। তবে বার্মায় তাদেরকে ‘জৌমি’ (Zomi) এবং ভারতে মিজোরাম অঙ্গ-রাজ্যে মিজো নামে ডাকা হয়। এই কঁশর, তড়সর এবং গরুড় শব্দ বা নামগুলি ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে সমষ্টিগত অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে খুমী নৃগোষ্ঠীর আগমন হলো বার্মার চীন প্রদেশ থেকে। এই চীন হিলস প্রদেশ ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ সালে আরাকান প্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে নামকরণ করা হয় চীন হিলস। সতের শতকের মাঝামাঝি সময়ে খুমীরা চীন হিল (তৎকালীন আরাকান প্রদেশ নামে পরিচিত) থেকে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। খুমীরা বাংলাদেশে আট পুরুষ (বংশধর) ধরে বসবাস করছে। বোমাং সার্কেলের রাজা অংশৈপ্রু চৌধুরীর মতে, প্রথম বোমাং রাজা (১৭৬০ খ্রি.) আসার পরেই খুমীরা এই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি শুরু করে (সূত্র : ইত্তুকগুল চাঙমা, খুমী ই অমনাই রাইতা ২০০৫-২০০৬)।

অন্যদিকে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৫, আদিবাসী জনগোষ্ঠী খন্ডে মুহাম্মদ আবদুল বাতেন লিখেছেন, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, খুমী জনগোষ্ঠী মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাসমূহ বিশেষ করে বান্দরবান জেলার থানছি, রোয়াংছড়ি, লামা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের আরাকানে বসবাস করেন। ডব্লিউ.ডব্লিউ. হান্টারের বর্ণনানুযায়ী, এরা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ন্যায় পার্বত্যাঞ্চলে এসে বসবাস করছে। শারীরিক কাঠামোর দিক থেকে খুমীরা মঙ্গোলয়েড শ্রেণীভুক্ত।

পাংখোয়া
রাঙামাটি জেলার রাঙামাটি সদর, বিলাইছড়ি, বরকল, বাঘাইছড়ি, কাপ্তাই উপজেলায় পাংখোয়াদের বসবাস। ২০২২ সালের জনশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে পাঙ্খোয়াদের জনসংখ্যা ১৮৫৭ জন। পাঙ্খোয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে উৎস প্রকাশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকে পাঙ্খোয়া সম্প্রদায়ের লেখক লাল ছোয়াক লিয়ানা পাংখোয়া লিখেছেন, পাংখোয়ারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, তারা বার্মার শান জাতির অংশ এবং দক্ষিণ দিক থেকে তারা এসেছিল। পাংখোয়াদের বিশ্বাস সুদূর অতীতে তারা লুসাই পাহাড়ের পাংখোয়া নামক কোনো এক গ্রাম থেকে এসেছিল। পাংখোয়া ভাষায় ‘পাং’ অর্থ শিমুল ফুল আর ‘খোয়া’ অর্থ গ্রাম। কথিত আছে যে, শিমুল গাছে পরিপূর্ণ একটা গ্রাম ছিল পাংখোয়াদের আদি গ্রাম।

ভারতের মিজোরাম প্রদেশের ‘ছিমতুই পুই’ নামে একটি জেলার প্রধান শহরের নাম সা-ঙাও। পাংখোয়া ভাষায় ‘সা’ মানে বন্যপশু আর ‘ঙাও’ অর্থ বানর। সেই শহরের অনতিদূরে পাংখোয়া নামক একটি গ্রাম আছে। মিজোরাম প্রাদেশিক সরকারের দলিলপত্র ও মানচিত্রে ৫৬১১ নং পাংখোয়া গ্রামটির চিহ্ন উল্লেখ পাওয়া যায় । এছাড়া লুংলাই প্রশাসনিক জেলায় ‘পাংজল’ নামে আরো একটি গ্রাম আছে।

পাংখোয়ারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, তারা বার্মার শান জাতির অংশ এবং দক্ষিণ দিক থেকে তারা এসেছিল । পাংখোয়া জনগোষ্ঠীর মূল আবাসভ‚মি বর্তমান মায়ানমারের চীন প্রদেশে। চীন পর্বতমালার দক্ষিণে তসন ও উত্তরে জৌ উপত্যকার মধ্যবর্তী অঞ্চলসমূহে তাদের বসবাস ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষান্তে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে চীন পর্বতমালার অন্তর্গত ফালাম-হাকা অঞ্চল থেকে অন্যত্র জনঅভিবাসন শুরু হয়। পন্ডিতদের মতে, পাংখোয়ারা সেই অঞ্চল থেকে সরে এসে ক্রমান্বয়ে আরাকান ও লুসাই হিলে বসতি স্থাপন করে এবং কালক্রমে জীবন-জীবিকার সন্ধানে পাংখোয়াদের একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। টি এইচ লুইনের মতে, খুমী জনগোষ্ঠী কর্তৃক আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে পাংখোয়ারা সপ্তদশ শতাব্দীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৫, আদিবাসী জনগোষ্ঠী খন্ডে গবেষক হাফিজ রশিদ খান লিখেছেন, নৃবিজ্ঞানীদের মতে, পাংখোয়াদের আদি বাসভ‚মি ছিল ব্রহ্মদেশে অবস্থিত চিন পর্বতমালার দক্ষিণে তসন ও উত্তরে জৌ-উপত্যকা ভ‚মির মধ্যবর্তী অঞ্চলসমূহে। তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, আঠারো শতকের শেষে চিন পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্গত ফালাম-হাকা অঞ্চলে এক বিশেষ জনসঞ্চালন শুরু হয়। মূল গোষ্ঠী থেকে আদিবাসীদের নানা শাখা-প্রশাখা এবং কয়েকটি উপদল বিচ্ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে আসেন। তারা মূল গোষ্ঠী থেকে খাদ্যাভাব, বিভিন্ন উপ-গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্কলহ, গ্রামবাসীর মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ ও আক্রমণাত্মক মনোভাব এবং আরও নানা কারণে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়। কোনো কোনো পন্ডিত মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা অনেকে আরাকান ও লুসাই পাহাড় থেকে এসেছেন। আবার অনেক পন্ডিত বলেন যে, তারা গাঙ্গেয় উপত্যকা থেকে এসেছে। টি.এইচ. লুইনের মতে, এরা সেখানকার খুমী জাতি কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে সতেরো শতকে পার্বত্য চট্টগ্রামে দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করেন। ঐ সময়ে চিন পার্বত্য অঞ্চলে লুসাইরাও প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলেন। তারা পাংখোয়াদের উপর যথেষ্ট কর্তৃত্ব করেছিল। জাতিগত দিক, ভাষাগত ও প্রত্নতাত্তিক উপাদানের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, চিন জাতির অন্তর্ভুক্ত সমস্ত জনগোষ্ঠীই উত্তর থেকে এসেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্যান্য জনগোষ্ঠীর অভিবাসনের সাথে পাংখোয়াদের অভিবাসন ইতিহাস পর্যালোচনায় এটা প্রতীয়মান হয় যে, এখানকার বিভিন্ন জাতির বসতি স্থাপন একদিনের ঘটনা নয়। বিভিন্ন সময়ের নানা ঘটনার ফলে বিভিন্নভাবে এ অঞ্চলে পাংখোয়াদের জনবসতি স্থাপিত হয়।

ম্রো
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে ম্রোরা শুধু বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বসবাস করে। ম্রোরা সাধারণত বাংলাদেশে মুরং নামে বেশি পরিচিত। ২০২২ সালের জনশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে ম্রো জনসংখ্যা ৫২,৪৫৫ জন। ম্রো সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে উৎস প্রকাশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকে সিংহয়ং ম্রো লিখেছেন, আনুমানিক পনেরো শ’ শতাব্দীর শেষার্ধে গোটা আরাকান প্রদেশ রাজনৈতিক চরম সংকটে পতিত হয়। ফলে সেখানে সৃষ্টি হয় গোষ্ঠী দাঙ্গা ও গৃহ-যুদ্ধ। এ সুযোগে দুর্বল ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর উপর শুরু হয় আক্রমণ ও সম্পত্তির লুটপাট। সে সময় ম্রোরা খুমী জনগোষ্ঠীর অত্যাচারের শিকার হয়। আরাকান ইতিহাসে এটির সাক্ষ্য মেলে। এসময় আরাকানে কালাডন নদীর তীরদেশে ম্রো ও খুমীদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সেখানে ম্রোরা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করলে একাংশ আরাকানের পশ্চিমে বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে ।

মারায়ো রাজার রাজত্বকাল থেকে শুরু করে শেষ রাজা পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার বছর ধরে ম্রো রাজাগণ আরাকান শাসন করেছে বলে আরাকানের ইতিহাস থেকে জানা যায়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক জনাব আব্দুল হক চৌধুরী তাঁর ‘প্রাচীন আরাকানে রোয়াইঙ্গা হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসী’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ব্রহ্ম দেশের ‘রাজোয়াং’ নামক কাহিনীর সূত্রে জানা যায় যে, মারু (Mro) বংশীয় রাজাগণের সিংহাসন আরোহণকাল খ্রিস্ট-পূর্ব ২৬৬৬ বছর পূর্বে। এই বংশের রাজাগণ বংশ পরম্পরায় ১৮৩০ বছরকাল আরাকানে রাজত্ব করেন। এ বংশের শেষ রাজার আমলে আরাকানে প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে রাজাকে হত্যা করে। তখন রাণী দুই কন্যাসহ ‘কাউক পান্ডায়ূং’ পর্বতমালায় আশ্রয় গ্রহণ করে। ম্রো বংশীয় রাজাদের সম্পর্কে বিশিষ্ট লেখক জনাব আব্দুল মাবুদ খান তাঁর “The Mogh (A Buddhist Community in Bangladesh)’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ‘রাজুয়াং অনুযায়ী, মারায়ু (মারু) কর্তৃক আরাকানে সর্বপ্রথম একটি স্বাধীন রাজ্য পত্তন করা হয়, যার রাজধানী গা-সা-বা নদী বর্তমান নাম কালাদন নদীর তীরবর্তী ধান্যাওয়ার্দী নামক স্থানে বসতি স্থাপন করে এবং এই রাজবংশকে ধান্যাওয়ার্দীর প্রথম রাজবংশ হিসেবে জানা যায়: এই রাজ্যের গোড়াপত্তন ২৬৬৬ খ্রিস্টপূর্বে হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় এবং এই বংশের রাজাগণ বংশপরম্পরায় ১৮০০ বছরকাল আরাকানে রাজত্ব করেন। ম্রোরা চতুর্দশ শতাব্দীতে আরাকানে সহিংসতা বাঁধলে পুনরায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আসেন।

ম্রোদের উপর খুমীদের আক্রমণের কাহিনী বিভিন্ন লেখক ও গবেষকদের গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। ডব্লিউ .ডব্লিউ হান্টার-এর মতে ম্রো (মুরুং) নামে একটি জনজাতি যারা পূর্বে আরাকান হিলস্-এ বাস করতো তারা প্রধানত এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সাঙ্গু নদীর পশ্চিমে এবং মাতামুহুরী নদী বরাবর বাস করে তারা নিশ্চিত করে যে, খুমীরা তাদেরকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে অনেক বছর আগে খুমীদের সাথে তাদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। মুরুংরা বর্তমানে বোমাং রাজার প্রজা।

এ সম্পর্কে বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক স্যার আর্থার ফেইরি তাঁর বিখ্যাত ‘বার্মার ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এটা একটি জনজাতি বর্তমানে তাদের প্রাচীন রাজ্য থেকে কমে গেছে। তারা এক সময় কোলদান নদী ও এর উপ-নদীতে বসবাস করতো, কিন্তু খুমী জনজাতি কর্তৃক ধীরে ধীরে বিতাড়িত হয়েছিল। তারা সেখান থেকে পশ্চিমে স্থানান্তর হয়েছিল এবং আরাকান ও চট্টগ্রাম সীমান্তবর্তী এলাকায় বসতি গড়ে তোলে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৫, আদিবাসী জনগোষ্ঠী খন্ডে মুহাম্মদ আবদুল বাতেন লিখেছেন, ম্রোরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায়ই অধিক সংখ্যায় বাস করেন। এককালে ম্রোরা আরাকানের অধিবাসী ছিল। টি.এইচ. লিউইন (T.H. Lewin)-এর লেখা থেকে জানা যায় যে, ম্রোরা আরাকানের খুমী উপজাতি কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। ব্রহ্মসম্রাটের একটি চিঠি থেকেও স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, ম্রোরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভ‚মিজসন্তান নয় এবং যে কোনো কারণেই হোক তারা আরাকান থেকে চলে এসে এখানে বসতি স্থাপন করে অবাধে বসবাস করছেন।

লুসাই
লুসাইগণ বর্তমানে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি থানার সাজেক উপত্যকায় বাস করে। তবে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায়ও খুব অল্পসংখ্যক লুসাই বাস করে। সিলেট জেলাতেও সামান্য সংখ্যক লুসাই বসবাস করে বলে জানা গেছে। ২০২২ সালের জনশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে লুসাইদের জনসংখ্যা ৩৮০ জন। লুসাই সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে উৎস প্রকাশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকে জনি লুসাই লিখেছেন, ‘লুসাই হিল’ লুসাই জনগোষ্ঠীর মূল আবাসভ‚মি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এককালের লুসাই হিল বর্তমানে মিজোরাম নামে পরিচিত। মিজো নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত অন্যতম জনগোষ্ঠী হচ্ছে লুসাই জনগোষ্ঠী। লুসাইদের পূর্ব-পুরুষেরা চিনলুং (Rock with a lid) থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয় এবং নিজেদেরকে তারা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর বলেই পরিচয় দেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৫, আদিবাসী জনগোষ্ঠী খন্ডে একই লেখক অর্থাৎ জনি লুসাই আরো লিখেছেন, লুসাইদের পূর্বপুরুষের ‘চিনলুং’ (Rock with a Lid) থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয় এবং নিজেদেরকে মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর বলেও পরিচয় দেন। তাদের চেহারা, শারীরিক গঠন, গায়ের রং, চোখ ইত্যাদি অনেক কিছু মঙ্গোলীয়দের সাথে মিল রয়েছে। কিংবদন্তী অনুসারে চিন দেশের রাজা ‘চিনলুং’ তার বাবার সাথে মতের অমিল থাকার কারণে তার লোকজনদের নিয়ে (তিব্বত হয়ে) বার্মায় (মিয়ানমারে) চলে আসেন এবং সেখানে গ্রাম তৈরি করে বসতি স্থাপন করেন। সে গ্রামটির নাম ছিল ‘অক্সাতলাং’ গ্রাম। পরবর্তীকালে উক্ত রাজার বংশধর রাজা যাম্হুয়াকা অনেক বছর রাজত্ব করেন এবং তার নাতি পরবর্তীকালে রাজা হয়েছিলেন। তিনি খুবই সাহসী যোদ্ধা ও প্রভাবশালী রাজা ছিলেন। তার আমল থেকে শুরু করে চিনহিলস্, মণিপুর, কাছাড়, মিজৌরাম, সাতিকাং (চিটাগাং) এসব পূর্ব অঞ্চলগুলিতে তার বংশধরেরা পালাক্রমে প্রায় দু’শত বছর রাজত্ব করেছিলেন।

কুকি-চিন জনগোষ্ঠী সবসময় নিজেদের আদিবাসী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিজেদের ‘Ancestral Land ’ বলে দাবি করলেও গত ২৪ এপ্রিল ২০২৩ কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি বা কেএনএ ইনফরমেশন এন্ড ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ক্যাপ্টেন ইম্মানুয়েল কেএনএফ এর অফিসিয়াল পেইজে প্রচারিত এক লেখায় লেখেন, ‘প্রাচীন কালে খ্রিষ্টীয় নবম ও দশম শতাব্দীর দিকে চইন্ডউইন উপত্যকা হয়ে ১৩০০-১৪০০ সালের বর্তমান চিন রাজ্যে বসতি স্থাপন করে। চীন-কুকি-লুসাই বর্তমান ভারত, মায়ানমার ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। উপরোক্ত লেখনী দ্বারা বুঝা যায় আদিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকিরা সংখ্যালঘু ছিল। পরিস্থিতি শিকার হয়ে অনান্য পার্শ্ববর্তী দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখন তারা ফিরে আসতে চাচ্ছে। তারা এখন একত্র হয়ে নিজ পিতৃ পরিচয়ে, পিতৃ পুরুষদের আদি নিবাস রক্ষায় সোচ্চার হয়েছে।’ ভারতের মনিপুরের আজকের অস্থিরতার মূল কারণ হচ্ছে, সেখানকার কুকি জনগোষ্ঠী(৪৭%) দীর্ঘদিন তফসিলি বা ট্রাইবাল স্টাটাস পেতো, কিন্তু মনিপুরের উচ্চ আদালত সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মেইতি উপজাতিকে(৫৩%) ট্রাইবাল বা তফসিলি স্ট্যাটাস দেয়ায় কুকি জনগোষ্ঠী এর বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামে। এর সাথে মিজোরাম ও মিয়ানমারের কুকিরাও অংশ নিয়েছে বলে মেইতেইদের অভিযোগ। এতে বোঝা যায়, কুকিরা সেখানে অর্থাৎ ভারতে আদিবাসী নয়, তফসিলি বা ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত এবং এককভাবে সেটা রক্ষার জন্যই আন্দোলন করছে। এককথায়, যে ভারত ও মিয়ানমার তাদের আদিবাস সেখানেই তারা ট্রাইবাল ও তফসিলি জনজাতি হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু সেখান থেকে যে বাংলাদেশে তারা মাইগ্রেট করেছে সেই বাংলাদেশে তারা আদিবাসী স্বীকৃতি দাবী করছে।

তবে উপর্যুক্ত আলোচনায় এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর ‘Ancestral Land’ নয় এবং তারা বাংলাদেশের আদিবাসী নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মতো কুকি-চিন জনগোষ্ঠীও বাংলাদেশে বহিরাগত।

মেহেদী হাসান পলাশ: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ; চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন।


Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদিবাসী, কুকি-চিন, বাংলাদেশ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন