ইউপিডিএফ, এমএনপি, কেএনএফের সৃষ্টি শান্তিচুক্তির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান একটি জাতীয় আকাক্ষা ছিলো। শান্তিচুক্তির ১৬ বছর পূর্তির এক অনুষ্ঠানে ২০১৩ সালের ৭ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে অনুষ্ঠিত এক সভায় জেএসএস চেয়ারম্যান সন্তু লারমা নিজে বলেন, ‘শান্তিচুক্তি কোনো একক ব্যাক্তি বা একক সরকারের কৃতিত্ব নয়।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম পার্বত্য অঞ্চলের বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিরসনে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে প্রথম সংলাপের সূচনা করেছিলেন। তার সময়ের প্রধানমন্ত্রী মশিউর রহমানসহ আরো কয়েকজনের সাথে সফল আলোচনা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে এরশাদ আমলে ৬টি, বেগম খালেদা জিয়া সরকারের প্রথম আমলে ১৩টি ও শেখ হাসিনা সরকারের সাথে ৭টি মিলে মোট ২৬টি সংলাপের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।’ আমরা জানি, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সন্তু লারমাকে আটক করেছিলেন। তারপর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে বন্দি সন্তু লারমার সাথে আলোচনা করে সবাইকে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে তাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে সন্তু লারমার স্ত্রীকে সরকারি চাকরি প্রদান করেন। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইনসার্জেন্সি মোকাবিলায় শুরু থেকেই রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছিলেন।

অতঃপর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের ইনসার্জেন্সি মোকাবিলায় শান্তিচুক্তি সাক্ষরে সক্ষম হয়। এই চুক্তি সাক্ষরের মাধ্যমে দীর্ঘ দুই যুগের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আপাত অবসান হয়ে শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়। দীর্ঘ ২৬ বছরে শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা বাস্তবায়ন করেছে বলে সরকার পক্ষের দাবি। বাকিগুলো আংশিক বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়নাধীন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সরকারের এই দাবি মানতে রাজি নয়। তাদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মাত্র ২৫টি ধারা পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে।



এদিকে শান্তিচুক্তির দীর্ঘ ২৬ বছর পার হলেও যে প্রত্যাশায় অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনায়নের লক্ষ্যে যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল সেই শান্তি পাহাড়ে এখনো অধরা রয়ে গেছে। শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেক জনগোষ্ঠি বাঙালিরা এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। তাদের বক্তব্য, এই চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পড়েছে। শান্তিচুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালিদের পরিচিতি বা অবস্থিতিকে অস্বীকার করা হয়েছে। তাদেরকে বাঙালির পরিবর্তে অ-উপজাতীয় বলে পরিচিতি দেয়া হয়েছে।

ইতিহাসে আমরা মধ্যপ্রাচ্যে বেলফোর চুক্তিতে একটি জাতিকে এভাবে অস্বীকার করতে দেখি। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আর্থার জেমস বেলফো ব্রিটেনে বসবাসকারী ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের নেতা ও সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ব্যারন লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডের কাছে একটি পত্র পাঠিয়েছিলেন। ওই পত্রে তিনি সর্বপ্রথম ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি ব্রিটেনের সমর্থনের কথা প্রকাশ করেন। বেলফোর ঘোষণার পর, ইহুদি অভিবাসীরা ফিলিস্তিন অঞ্চলে ভিড় করতে থাকে। তাই ইসরাইলিরা এই বেলফোর ঘোষণাকে আজকের আধুনিক ইসরাইল গঠনের ভিত্তি বলে মনে করে। এই চিঠির একটি অংশে আর্থার বেলফো লেখেন, ‘মহামান্য ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে, তবে এটাও নিশ্চিত করা হচ্ছে যে, এমন কিছু করা উচিত হবে না, যা ফিলিস্তিনে অবস্থানরত অ-ইহুদি স¤প্রদায়ের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার কিংবা অন্য দেশে বসবাসকারী ইহুদিরা যে অধিকার এবং রাজনৈতিক মর্যাদা ভোগ করছে, তার কোনো হানি হয়।’

মূলত এই চিঠিতে তিনি ফিলিস্তিনে বসবাসকারী তৎকালীন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলিম ও খ্রিস্টানদের অ-ইহুদি বলে তাদের জাতিসত্ত্বার পরিচয় ও অবস্থানকে অস্বীকার করেছিলেন, যা তৎকালীন আরব তথা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল। এটাই ফিলিস্তিনে মুসলিম জাতিসত্ত্বা নির্মূলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে জায়োনিস্টরা। আধুনিককালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতির প্রতি একই ধরনের আচরণ করেছে মিয়ানমার সরকার। একইভাবে শান্তিচুক্তির মুখবন্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল বলে স্বীকার করে নিয়ে এবং সেখানে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালিদের অ-উপজাতীয় আখ্যা দিয়ে মূলত তাদের পরিচিতি ও স্বীকৃতি কেড়ে নেয়া হয়েছে।

অপরদিকে শান্তিচুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে সেই উন্নয়ন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সকল জাতিগোষ্ঠীর মাঝে সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায়নি। শান্তিচুক্তির ফলে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসকল সুযোগ, সুবিধা ও স্কোপ তৈরি করেছে সেগুলো সকল জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ন্যায্যভাবে বণ্টিত হয়নি। বিশেষ কওে, প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। আর বছরের পর বছর ধরে সৃষ্ট বৈষম্য এক সময় বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে। আর এই বিক্ষোভ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠনের। এছাড়াও জেএসএসের মধ্যে নেতৃত্বের দ্ব›দ্ব, আর্থিক অস্বচ্ছতা, স্বজনপ্রীতি, চাকমা সুপ্রিমেসি প্রভৃতি কারণেও নতুন নতুন সশস্ত্র সংগঠনের সৃষ্টি হচ্ছে। এসব নতুন সংগঠন জেএসএস নেতৃত্বকে শুধু চ্যালেঞ্জ জানানোই নয়, বরং নতুন নতুন দাবি নিয়ে সামনে আসে, যা শান্তিচুক্তির গ্রহণযোগ্যাতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এদের মধ্যে সর্বাগ্রে ইউপিডিএফের নাম আসে।

শান্তিচুক্তি সাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালের ১০ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র সমর্পণ করে জেএসএসের সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর কিছু সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। ঐদিন খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে জেএসএসের একটি অংশ কালো পতাকা উত্তোলন করে শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর এক প্রস্তুতি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয়, যা একটি প্রেসকনফারেন্সের মাধ্যমে জাতির সামনে আসে। এই সংগঠনটি শুরু থেকে শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে আসলেও জেএসএস ইউপিডিএফ অঘোষিত সমঝোতা হওয়ার পর ইউপিডিএফ শান্তিচুক্তির বিরোধিতা থেকে সরে আসে। এরপর বিগত ২০২২ সালের ৯ জুন খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ২ নম্বর চেঙ্গী ইউনিয়নের বড়লাক এলাকায় এক অনুষ্ঠানে ইউপিডিএফের পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা সরকারের প্রতিনিধির নিকট একটি দাবিনামা হস্তান্তর করে। চুক্তির আকারে পেশ করা ইউপিডিএফের দাবিনামায় আটটি ভাগ আছে। ৬৬ পৃষ্ঠার ওই প্রস্তাবে মোট ৮৭টি দাবি এবং প্রত্যেক দাবির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ দাবিনামার বিভিন্ন শর্তের মধ্যে আঞ্চলিক পরিষদ আইন সংস্কার, জেলা পরিষদ আইন সংস্কারসহ শান্তিচুক্তির বিভিন্ন ধারা বাতিল, সংশোধন, পরিবর্তন, সংযোজন করে একটি নতুন চুক্তির আহ্বান জানায় দলটি। এগুলো কার্যত শান্তিচুক্তির গ্রহণযোগ্যতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সমতুল্য।

এদিকে ২০১৭ সনের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ ভেঙে একই দলের এক সময়ের সামরিক কমান্ডার তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ দলটি একই সাথে ইউপিডিএফ নেতা প্রসীত বিকাশ খীসা ও জেএসএস নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে তাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনে। একই সাথে তারা শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে সেটাও জোরালোভাবে তুলে ধরে এ চুক্তির বিভিন্ন ধারা সংশোধনের দাবি করে।

অপরদিকে ২০০৭-০৮ সালের দিকে জেএসএস আবার ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। সন্তু লারমার একসময়ের সহযোগী সুধা সিন্ধু খীসার নেতৃত্বে জেএসএসের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মী দল থেকে বের হয়ে জেএসএস সংস্কার নামে নতুন একটি সংগঠন গঠন করে। জেএসএস সংস্কার নেতৃত্ব দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলে জেএসএস নেতৃত্ব সন্তু লারমাকে চ্যালেঞ্জ করে। এদিকে ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে রাজস্থলীতে প্রতিষ্ঠিত হয় মারমা ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি)। মারমা স¤প্রদায়ের দাবি-দাওয়া এবং জেএসএস ও চাকমাদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এ সংগঠনের নেতৃত্ব দেন মংক্যাচিং মারমা। বর্তমানে এই দলের নেতৃত্বে আছেন উথোয়াইচিং মারমা (সবুজ)। মূলত জেএসএস ও চাকমা সম্প্রদায় কর্তৃক মারমা সম্প্রদায়ের প্রতি নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যের প্রতিবাদেই এ সংগঠনের জন্ম। শান্তিচুক্তি সম্পর্কে তাদের মনোভাব জানতে চাইলে তারা এ লেখককে বলেন, ‘এই চুক্তি মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা রাজত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে করা হয়েছে। তারা এই চুক্তি মানেন না।’ অপরদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ না করলেও ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল পার্বত্যনিউজ অনলাইনে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের মাধ্যমে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও এর সামরিক শাখা কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) নাম আলোচনায় আসে। শুরু থেকেই সংগঠনটি জেএসএস ও এর প্রধান সন্তু লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা একই সাথে শান্তিচুক্তির অসাড়তা নিয়ে বক্তব্য রাখে। শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ের প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী স¤প্রদায়ের বৈষম্যের শিকার হওয়ার বিষয়টিই তারা জোরালোভাবে সামনে নিয়ে আসে। এরপর বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে সরকার কর্তৃক বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত একটি শান্তি কমিটি কেএনএফের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করে। দুটি অনলাইন বৈঠকের পর গত ৫ নভেম্বর রুমা উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে মুনলাইপাড়া এলাকার একটি কমিউনিটি সেন্টারে টানা কয়েক ঘণ্টা ধরে এই শান্তি কমিটি এবং কেএনএফ নেতৃত্বের মধ্যে মুখোমুখি প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে কেএনএফের তরফে সরকারের নিকট ৬ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হলো:

১. প্রান্তিক অঞ্চলের অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর বিলীয়মান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষাসহ শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সার্বিক উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে ‘কুকি-চিন টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল’ (সংক্ষেপে ‘কেটিসি’) নামে স্বায়ত্তশাসিত পরিষদ গঠন করা।

২. ভূমি ও পর্যটন বিষয়ক সংক্রান্ত সকল কর্মকাÐসমূহের সর্বময় ক্ষমতা কেটিসি’র উপর সম্পূর্ণভাবে অর্পণ করা।

৩. উক্ত অঞ্চলে পুলিশ বাহিনীর নিয়োগ প্রদানসহ সকল ক্ষমতা কেটিসির উপর অর্পণ করা।

৪. কেএনএফ’র সশস্ত্র আন্দোলনকালীন কেএনএফ’র সশস্ত্র সদস্যসহ অন্যান্য নিরীহ ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, হুলিয়া জারি অথবা অনুপস্থিতিকালীন সময়ে বিচারে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে, অস্ত্রসমর্পণ ও স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের পর যত শীঘ্রই সম্ভব তাদের বিরুদ্ধে সকল মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, হুলিয়া প্রত্যাহার করা এবং অনুপস্থিতকালীন সময়ে প্রদত্ত সাজা মওকুফ করা। কেএনএফ’র কোনো সশস্ত্র সদস্য বা কেএনএফ-এর নামে নিরীহ ব্যক্তিরা জেলে আটক থাকলে তাদেরকেও বিনাশর্তে মুক্তি প্রদান করতে হবে।

৫. ’৭১ সালের পর থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে কুকি-চিন অঞ্চলে ব্যাপক সেনা অভিযানের ফলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে তথা ভারতের মিজোরাম এবং মিয়ানমারের পালেতুয়া এলাকায় পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় গ্রহণ করা কুকি-চিন শরণার্থীদেরকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৬. কুকি-চিন আর্মড ব্যাটেলিয়ন (কেএবি) নামে সশস্ত্র পদাতিক ব্যাটালিয়ন গঠন করতে হবে।

দেশের ভূখণ্ডের স্পর্শকাতর সীমান্ত অঞ্চলের নিরীহ জনগণ তথা পাহাড়ি-বাঙালির জানমাল রক্ষা, সন্ত্রাস দমনসহ নিরপেক্ষভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার স্বার্থে এই অঞ্চলে বিশেষ প্রয়োজনে কুকি-চিন জনগোষ্ঠীদের নিয়ে পৃথকভাবে ‘কুকি-চিন আর্মড ব্যাটেলিয়ন’ বা কেএবি গঠন করা। কেএবি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার (জিওসি)’র তত্ত্বাবধানে থাকবে।

কেএনএফের এই দাবিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এগুলো যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস ও সন্তু লারমার নেতৃত্বকে প্রবলভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং একই সাথে শান্তিচুক্তির মতো একটি স্বতন্ত্র চুক্তির প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইউপিডিএফের ৮৭টি দাবি বিশ্লেষণ করলে সেটাও শান্তিচুক্তির মতো আরো একটি স্বতন্ত্র চুক্তির ইঙ্গিত করে। এসবই বর্তমান সময়ে শান্তিচুক্তির গ্রহণযোগ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বিশ্বে ইনসার্জেন্সির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, এ ধরনের সমস্যার সামরিক সমাধানের চেয়ে রাজনৈতিক সমাধান অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি নিজেও এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শান্তিচুক্তি শতভাগ ত্রুটিমুক্ত এ কথা কেউ দাবি করে না। মানবিক সীমাবদ্ধতার কারণেই মানুষের তৈরি কোনো বিধানই প্রথমবারেই ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না। কিন্তু তাই বলে শান্তিচুক্তির বিশাল অর্জনও উপেক্ষা করে যাবার উপায় নেই। এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সম্পূর্ণ অবসান না হলেও এর মাত্রা যে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কেননা, পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত বার্তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৪৩ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৭৩ জন বিজিবি ৯৬ জন পুলিশের ৬৪ জন এবং আনসার ভিডিপির ১০ জন। নিহত সেনা সদস্যদের মধ্যে অফিসার ৫ জন, জেসিও ৩ জন এবং বাকিরা সৈনিক।

এছাড়াও দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনা, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ, ভ‚মিধস প্রভৃতি কারণে মারা গেছে আরো অনেকে। এর মধ্যে শান্তি চুক্তির পূর্বে শুধু ম্যালেরিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১৬৯ জন এবং চুক্তির পরে ৮১ জন মারা গেছে। উভয় কারণে আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। তবে শান্তি চুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর মোট ২৩ জন সদস্য মারা গেছে। এর মধ্যে আঞ্চলিক উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে যুদ্ধে মারা গেছে ১৮ জন এবং ৫ জন রাঙ্গামাটির ভ‚মিধসে মারা গেছে। নিহতদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৪ জন, বিমানবাহিনীর ১ জন, বিজিবি ২ জন, পুলিশের ২ জন ও আনসার ভিডিপির ৪ জন রয়েছে। এ পরিসংখ্যানই শান্তিচুক্তির সফলতা প্রমাণ করে।

পূর্বেই বলা হয়েছে সরকারের দাবি মতে, শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়নের কতটি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, কতগুলো সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার বা কতটি প্রশাসনিক বিভাগ হস্তান্তরিত হয়েছে, এর মধ্যেই শান্তিচুক্তির সাফল্য নির্ধারিত হয় না। শান্তিচুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিশাল উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, যে সম্ভাবনা ও অর্থনৈতিক সুযোগের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে সেটাই শান্তিচুক্তির সবচেয়ে বড় সাফল্য।

তবে সময়ের সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইনসার্জেন্সি ও চ্যালেঞ্জগুলোতে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। শুধু নতুন নতুন ইনসার্জেন্ট গ্রুপ সৃষ্টিই নয়, রোহিঙ্গা ইস্যু, ভূরাজনীতিতে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার গুরুত্ব, সীমান্ত সন্নিহিত মিয়ানমার ও ভারতের রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা, আঞ্চলিক ও স্থানীয় বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সড়ক যোগাযোগ, পর্যটন নানাক্ষেত্রে নিরাপত্তার বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ১৯৯৭ সালে কৃত শান্তিচুক্তি আজ পর্যাপ্ত মনে না হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আজকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শান্তিচুক্তির গ্রহণযোগ্যতা ও সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। সে কারণেই ১৯৯৭ সালে কৃত শান্তিচুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের আজকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুগোপযোগীকরণ অত্যন্ত জরুরি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠী এবং সেখানে অবস্থানরত বা দায়িত্বপালনরত সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি করে শান্তিচুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি। এতে বিগত ২৬ বছরে শান্তিচুক্তির বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা, সাফল্য, ব্যর্থতা, চ্যলেঞ্জ, ত্রুটি, বিচ্যুতি; নতুন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে এবং সকল পক্ষের মতামত ও দাবি বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে গ্রহণযোগ্য সমাধান নির্ধারণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি আপডেট, আধুনিকায়ন বা যুগোপযোগীকরণ করা অত্যন্ত জরুরি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান এ পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। সে বিচারে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সংশোধন করা কোনো দূষণীয় বিষয় হতে পারে না।

লেখক: চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন, সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, এমএনপি, কেএনএফ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন