খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সহিংস ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ ও তার অংগ সংগঠনগুলো দায়ী : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ


বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতি গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে সেনাবাহিনী তৈরি আছে বলে জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ। তিনি বলেছেন, খাগড়াছড়ি এবং গুইমারায় সংঘটিত সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ ও তার অংগ সংগঠনগুলো দায়ী। পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠন তাদের বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ। এ ব্যাপারে সকল প্রমাণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আছে বলেও জানান তিনি।
গণমাধ্যম কর্মীদের দেয়া এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, ধর্ষণ ঘটনাকে পুঁজি করে সাধারণ পাহাড়ি নারী ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা করছে সংগঠনটি। এসব কর্মসূচিতে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে দেশীয় ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করে ফায়ারিং করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালে খাগড়াছড়ির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ আরও বলেন, সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব ও অবিচ্ছেদ্য অংশ রক্ষায় সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবে। তিনি ইউপিডিএফকে দেশের স্বার্থে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানান।
ব্রিফিংয়ে জেনারেল হাসান মাহমুদ বলেন, ইউপিডিএফ এবং তাদের অংগ সংগঠন খাগড়াছড়িতে সফল হতে না পেরে ২৮ সেপ্টেম্বর গুইমারাতে চলে গেল। সেখানে গিয়ে একইভাবে পরিস্থিতির উদ্ভব করল, ৩ জন মারা গেল, অনেক আহত হলো। এই টেকনিক তারা সব সময় ফলো করে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে তাদের আরো পরিকল্পনা রয়েছে। এতে বহিঃশক্তি অথবা এখানকারই একটা মহল তাদেরকে পেছন থেকে সাহায্য করছে। ইউপিডিএফ বোঝানোর চেষ্টা করছে একমাত্র তারাই এখানে সকল কিছু কন্ট্রোল করবে।
খাগড়াছড়ির মতো রাঙামাটি এবং বান্দরবানে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ইউপিডিএফ’র এ রকম ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করে তিনি বলেন, এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমি বলতে চাই তিন পার্বত্য জেলায় এটার প্রভাব পড়তে পারে। খাগড়াছড়ি অলরেডি এটা ফেইস করে ফেলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন এজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। সর্বপরি এই ঘটনাটি গভীর ষড়যন্ত্র বলে তিনি মনে করছেন।
ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠন বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ। এ ব্যাপারে সকল প্রমাণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আছে। একই সাথে সকল ধরণের অপপ্রচার বা উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড সত্যেও বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ রক্ষায় নিবেদিত এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতি গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে সেনাবাহিনী তৈরি আছে।
তিনি বলেন, এই ঘটনাটি গভীর ষড়যন্ত্র এবং সামনের দিকে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিকে যাচ্ছে সেটা যাতে নস্যাৎ করতে পারে সেই ধরণের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এই ঘটনা দিয়ে যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল দেখানো যায় যে, বাংলাদেশ এখন স্থিতিশীল নেই, তাহলে এটা অন্য দিকে মোড় নিতে পারে। এজন্য বলব, আমাদের সকলে এক সাথে কাজ করতে হবে। যাতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকে এবং আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
ইউপিডিএফ ও তার সকল অংগ সংগঠনকে আহবান জানিয়ে বলেন, পরিস্থিতি শান্ত রাখুন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময়ই এই অঞ্চলকে স্থিতিশীল রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। মহিলা এবং কোমলমতি শিশুদেরকে সামনে ঠেলে দেয়া এটা কোনো কিছুই ভালো বার্তা বহন করে না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠনের সময় বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে এসে দেশীয় এবং অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে এভাবে ফায়ার করা এ ব্যাপারটিও ভালো দেখায় না। উপদেষ্টা মহোদয় বলেছেন, কারো হাতে অস্ত্র থাকবে না। কথাটি মিডিয়ায় এসেছে।
কাপ্তাই চেকপোস্টে ইউপিডিএফ’র জন্য আনা দেশীয় অস্ত্র জব্দ ও বহণকারীদের আটক করতে সক্ষম হওয়ায় তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, বর্তমান প্রশাসন কর্তৃক খাগড়াছড়িতে আরোপিত ১৪৪ ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এটা অব্যাহত রাখার জন্য আমরা প্রশাসনকে অনুরোধ করব। প্রশাসন যখন মনে করবে যে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, তখন তারা এটা তুলে নেবেন। তাদের সাথে সম্পূর্ণ সমন্বয় আমাদের থাকবে। সনাতন ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব চলছে। এতে যাতে সবাই স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ করতে পারে। আমরা চেষ্টা করছি সকল ধরণের সাহায্য করার। সকল ধর্মালম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা নিজেরাই তাদেরকে এই সহায়তা দিচ্ছি। যাতে তারা এই সময়টাতে আনন্দ উপভোগ করতে পারে।
তিনি খাগড়াছড়ি ঘটনার পরম্পরা উল্লেখ করে বলেন, আপনারা সকলেই জানেন, খাগড়াছড়িতে ২৩ সেপ্টেম্বরের একটি ঘর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আমরা সাথে সাথেই ২৪ সেপ্টেম্বর কথিত ধর্ষককে গ্রেপ্তার করি। তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করি। তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এখানকার জুম্ম ছাত্র জনতার ব্যানারে এটা সম্পূর্ণভাবে ইউপিডিএফ এবং তাদের অংগসংগঠনসমূহ প্রথমে শান্তিপ্রিয় খাগড়াছড়িবাসীকে সাথে নিয়ে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে ২৫ সেপ্টেম্বর আধা বেলা হরতাল এবং ২৬ সেপ্টেম্বর অবরোধ কর্মসূচির দিকে চলে যায়। এটা যাওয়ার সাথে সাথে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের সাথে কোনো প্রকার কোনো কিছুতে জড়ায়নি। তারা হঠাৎ করে আমাদের একটি দলের পিকআপ আক্রমণ করে। যেখানে আমাদের ৩ জন সেনা সদস্য আহত হন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত মানবিকতার পরিচয় দিয়ে ধৈর্য্যের সাথে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। তাদের সাথে কোনো প্রকার বাক-বিতন্ডায় না গিয়ে কোনো প্রকার বল প্রয়োগ ছাড়াই চলে আসে। তাদেরকে জানানো হয় যে আপনারা এ ধরনের কোনো কিছুই করবেন না। তাদের যে ইউপিডিএফ সমর্থিত নেতা উক্যনু মারমা তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। তারা পুরো খাগড়াছড়িতে সমাবেশ ডেকে পুরো জিনিসটাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করে। তার পেছনে ইউপিডিএফ এবং অন্যান্য অংগ সংগঠনসমূহ সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে তারা খাগড়াছড়িতে ২৭ সেপ্টেম্বর অবরোধ ডাকে এবং অ্যাম্বুলেন্স ভাঙ্চুর করে। সাধারণ জনগণের উপর চড়াও হয়। এই সব কিছুর পরে এই পরিস্থিতিকে অন্য দিকে মোড় নিয়ে নেয়। ছোট্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বনির্ভর এলাকায় তারা এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যেখানে সেনাবাহিনী যেতে বাধ্য হয়। সেনাবাহিনী যদি ওখানে না যেত তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত। ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দিনটিকে আমাদের মনে করিয়ে দেয়। যেখানে একই এলাকায় তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সেখানেও চেষ্টা করেছিলো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরি করার জন্য। যেখানে ৩ থেকে ৪ জন মৃত্যুবরণ করেছিলো। তাদেরই দল এবং তাদের বহিরাগত সন্ত্রাসীরাই অস্ত্রের দেশীয় অস্ত্র এবং অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে তাদেরকে হত্যা করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় এবারেও তাদের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল আমাদের ত্বরিৎ একশনের ফলে ওইখানে কোনো কিছু ঘটেনি। সম্পূর্ণ এটা শহরে ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল।
জেনারেল হাসান মাহমুদ বলেন, মহাজন পাড়া, য়ংডং বৈদ্ধবিহারে সন্ধ্যার সময়ে আপনারা দেখেছেন যে, এক পার্টি আরেক পার্টিকে আক্রমণ করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানে কয়েকজন আহত হয়েছে। সেই আহতদের সেনাবাহিনী সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, খাগড়াছড়িতে ২৩ সেপ্টেম্বর প্রথম যখন ধর্ষণের অভিযোগটি উঠে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এখানে কথিত ধর্ষককে আইনের আওতায় আনা হলেও আইনী প্রক্রিয়া ফলো না করে ওরা সরাসরি চলে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রকার প্রতিবাদ মিছিল, যেটা পুরো খাগড়াছড়িকে অচল করে দেয়ার চেষ্টা করে এবং সেটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। পরবর্তীতে পুলিশ এবং প্রশাসনের তেমন কিছু করার থাকে না। প্রশাসন এবং পুলিশ খুবই ত্বরিৎভাবে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং ১৪৪ ধারা পুলিশ এবং এপিবিএন একই সাথে বিজিবিকে কল করা হয়। আমরা বিজিবি, পুলিশ, আনসার-ভিডিপি সবাই একসাথে খাগড়াছড়িতে আমরা পুরোপুরি সহায়তা দিই এবং পুরো পরিস্থিতি ২৭ সেপ্টেম্বর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চলে আসে। এখানে পুরো কৃতিত্ব যাদের নাম বললাম তাদের সবার।
হাসান মাহমুদ বলেন, বারবার চেষ্টা করেছি জেলা প্রশাসন এবং পুলিশের মাধ্যমে পুরো বিষয়টিকে সমাধান করার। এখানে আমি বলতে চাই, এখানকার স্থানীয় যারা মুরুব্বি শ্রেণি আছেন, দলমত নির্বিশেষে সন্ধ্যায় সকলকে ডেকে আমি তাদেরকে অনুরোধ করেছি। তারা বলেছেন যে, তাদের ছাত্র জনতা যে গ্রুপটা আছে তাদেরকে কনভিন্স করার চেষ্টা করবে। তারা ফেরত গিয়ে অনেক চেষ্টা করেছেন। ইউপিডিএফের বাধার কারণে তারা সফল হননি।
উৎস : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদের ব্রিফিং ভিডিও থেকে অনূলিখিত