“থলছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিনয় ত্রিপুরা বিনয় জানান, প্রধান শিক্ষক সূর্য্যলাল ত্রিপুরা বিদ্যালয়ে আসেন না। তবে প্রধান শিক্ষক ২/৪ মাসে কোন দিন বিদ্যালয়ে গেলেও তিনি কর্মক্ষেত্রে অনিয়মিত। তাদের প্রধান শিক্ষক যে দীঘিনালার ইউপি সদস্য সেটা জানেন অন্য শিক্ষকরা। তবে সূর্য্যলালের ক্ষমতার প্রভাবে কিছুই বলতে পারেন না অন্য শিক্ষকরা।”
একই সাথে সরকারি দুই দায়িত্বে সূর্য্যলাল

খাগড়াছড়িতে ইউপি সদস্য, রাঙ্গামাটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক

fec-image

প্রধান শিক্ষকের চেয়ার টেকাতে রেখেছেন বর্গা শিক্ষক। পার্বত্য এলাকায় এক জেলার বাসিন্দা অন্য জেলায় চাকরির সুযোগ না থাকায় চাকরির শুরুতে রাঙ্গামাটি জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে ভূয়া সনদ তৈরি করেছেন অবৈধ পন্থায়। ফলে একই ব্যক্তি হয়েছেন দুই জেলার বাসিন্দা!

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বোয়াখালি সদর ইউনিয়নে নির্বাচিত ইউপি সদস্য হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। একই ব্যক্তি আবার রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে বেতন গ্রহণ করছেন।

এদিকে ইউপি সদস্য হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়মিত উপস্থিত থাকলেও বিদ্যালয়ে তিনি বরাবরই অনুপস্থিত; তবুও টিকে আছে চাকরি। তবে নিজ কর্মস্থলে একজন বর্গা শিক্ষক দিয়ে রেখেছেন তিনি।

অনুসন্ধানে এমনি তথ্য পাওয়ার পর বিষয়টি শুনে রীতিমতো হতবাক হয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা। অবশ্য তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষা কর্মকর্তা।

দ্বৈত সরকারি পদে একইসাথে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তির নাম সূর্য্যলাল ত্রিপুরা।

দীঘিনালা উপজেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভোটার তালিকা অনুযায়ী সূর্য্যলাল ত্রিপুরা বোয়ালখালি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রাজেন্দ্র কার্বারী পাড়ার ভোটার। ভোটার ক্রমিক ০২৭, আইডি ৪৬০০৭১৬০১৬৬৩, পিতা- মৃত নীতি রায় ত্রিপুরা, মাতা- সাতেন্দ্রী ত্রিপুরা। তবে তিনি বাড়ি স্থানান্তর করে বর্তমানে থাকছেন উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের ভৈরফা নোওয়া পাড়াতে।

দীঘিনালার বোয়ালখালি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি সদস্য সূর্য্যলাল খাগড়াছড়ি জেলা কৃষকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বেও রয়েছেন।

অপরদিকে সূর্য্যলাল ত্রিপুরার চাকরির কর্মস্থল রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের দূর্গম লংকার এলাকায় থলছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তিনি। বিদ্যালয়টিতে যেতে হয় সাজেক পর্যটন এলাকা থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পায়ে হেটে। এত দূর্গম এলাকায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তৃপক্ষের তদারকিও প্রায় অসম্ভব; আর এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছেন সূর্যলাল।

দীঘিনালার স্থায়ি বাসিন্দা হিসেবে ইউপি সদস্যের দায়িত্ব পালন করলেও সূর্য্যলাল ত্রিপুরা রাঙ্গামাটির স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে ভূয়া সনদে চাকরি গ্রহণেরও অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাঘাইছড়ির অনেকের দাবি, পার্বত্য এলাকায় এক জেলার বাসিন্দা হয়ে অন্য জেলায় চাকরিতে আবেদনেরই কোন সুযোগ নেই; সেক্ষেত্রে সূর্য্যলাল অবশ্যই স্থায়ী বাসিন্দার সনদে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

থলছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিনয় ত্রিপুরা বিনয় জানান, প্রধান শিক্ষক সূর্য্যলাল ত্রিপুরা বিদ্যালয়ে আসেন না। বিদ্যালয়টিতে প্রধান শিক্ষকসহ মোট শিক্ষক রয়েছেন ৪ জন। তবে প্রধান শিক্ষক ২/৪ মাসে কোন দিন বিদ্যালয়ে গেলেও তিনি কর্মক্ষেত্রে অনিয়মিত।

বিনয় জানান, তাদের প্রধান শিক্ষক যে দীঘিনালার ইউপি সদস্য সেটা জানেন অন্য শিক্ষকরা। তবে সূর্য্যলালের ক্ষমতার প্রভাবে কিছুই বলতে পারেন না অন্য শিক্ষকরা।

বিনয় আরও জানান, বিদ্যালয়টি আগে বেসরকারি থাকলেও ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয়করণ করা হয়।

সাজেক ইউনিয়নের অপর এক ইউপি সদস্য জয়পুইথাং ত্রিপুরা জানান, শিক্ষকতা করার জন্য এ এলাকায় শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন চাকমা সম্প্রদায়ের লোকের অভাব নেই; কিন্তু নেই ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোক। তাই বিদ্যালয়টি বেসরকারিভাবে স্থাপনের পর দীঘিনালার সূর্য্যলাল ত্রিপুরাকে এনে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

নিয়োগের জন্য স্বজেলার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হয়। এ কারণে সূর্য্যলালের জন্য স্থায়ী বাসিন্দার জাল সনদ দেখানো হয়েছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে জয়পুইথাং বলেন, এত কিছু বললে তো সমস্যা বেড়ে যাবে! ভাই আপনি দেখা করেন, একটা নিকুইজিশন করে ফেলি’। তবে কর্মক্ষেত্রে সূর্য্যলাল অনুপস্থিত থাকেন এবং একই সাথে দীঘিনালায় তিনি যে বর্তমান ইউপি সদস্য সেটাও জানেন বলে স্বীকার করেছেন জয়পুইথাং।

থলছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি রবামোহন ত্রিপুরার মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে রিসিভ করেন তাঁর বড় ছেলে কলিন ত্রিপুরা।

তার বড় ছেলে কলিন জানান, তার পিতা দূরে কাজে গেছেন।

কলিন আরও জানান, থলছড়া পাড়ায় বিদ্যালয়ের পাশেই তাদের বাড়ি। প্রধান শিক্ষক সূর্য্যলাল দীঘিনালার ইউপি সদস্য এবং তিনি বিদ্যালয়ে যান না সবই তারা জানেন। তবে প্রধান শিক্ষকের পরিবর্তে পাঠদানের জন্য স্বপন ত্রিপুরা নামে একজন স্থানীয়কে বর্গা শিক্ষক রাখা হয়েছে। বিনিময়ে স্বপনকে বছরে ১২ হাজার টাকা দেয় প্রধান শিক্ষক সূর্যলাল।

এদিকে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বোয়ালখালি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চয়ন বিকাশ চাকমা ওরফে কালাধন জানান, সূর্য্যলাল ত্রিপুরা তাঁর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি সদস্য। সূর্য্যলাল নিয়মিত ইউনিয়ন পরিষদে উপস্থিত থেকে বরাদ্দ, উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ সকল কাজেই অংশ গ্রহণ করছেন। তবে, রাঙ্গামাটিতে সূর্য্যলাল চাকরি করছেন কি না  সেটা তার জানা নেই।

সূর্য্যলাল ত্রিপুরা জানান, তিনি যখন চাকরিতে যোগদান করেন তখন বিদ্যালয়টি বেসরকারি ছিল। পরে সরকরারি হলেও এখনো গেজেট হয়নি তাই তিনি ইউপি সদস্যের পদটি ছাড়েননি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে সূর্য্যলাল জানান, প্রথম যোগদানের সময় নিয়োগ দিয়েছিল বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি; তখন রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের নিকট থেকে জাতীয়তার সনদপত্র নিয়ে সেটি জমা দিয়েই নিয়োগ পেয়েছিলেন।

বাঘাইছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, এরকম বিষয় আগে জানা ছিল না। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলির জন্য শিথিলতা থাকলেও নিয়োগের সুযোগ নেই। আর তিনি এক জেলার শিক্ষক একই সাথে আরেক জেলার ইউপি সদস্য এটিতো অসম্ভব কর্মকান্ড।’ তবে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবিব জিতু জানান, একসাথে দুই জেলায় দুই দায়িত্ব পালনের কোন সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা বিভাগের সাথে কথা বলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপি সদস্য, দীঘিনালা, প্রধান শিক্ষক
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন