জুম জীবিকা ও বাস্তবতা


মির্জা রাসেল::
সবুজ অরণ্যঘেরা পাহাড় দেখে আমারা পুলকিত হই, মেঘের মিতালি দেখে হই বিমোহিত। আর যখন মেঘ আর সবুজ অরণ্য ঘেরা পাহাড়ে চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ঘর একাকি দাঁড়িয়ে, তখন ভাবনা আর ভাললাগার মাত্রাটি বৃদ্ধি পেয়ে যায় বহুগুণ। অজান্তেই আকাক্সক্ষা জাগে মনে- আহ! যদি একবার স্পর্শ করতে পারতাম, থাকতে পারতাম এই স্বর্গে।

পাহাড়ে যারা ঘুরে বেড়াই তাদের কাছে এই ছোট্ট ঘরটি খুব পরিচিত। সাধারণের কাছে যা জুমঘর নামেই পরিচিত। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে জুমচাষই হচ্ছে কৃষির অন্যতম জনপ্রিয় পদ্ধতি। পাহাড়ের ঢালে বহুমাত্রিক বীজ বপণের মাধ্যমে চাষাবাদের নামই জুমচাষ। পর্যায়ক্রমে জুমের ফসল উৎপন্ন ও সংগ্রহ করা হয়। সেজন্য জুমের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে অস্থায়ী ঘর তৈরি করা হয় সেটাই আমাদের কাছে জুমঘর। জুমঘর কখনই সৌন্দর্য অবলোকন করার জন্য তৈরি হয় না। পাহাড়িদের কাছে এর বহুমাত্রিক ব্যবহার আছে । এমনকি পর্যটক, অভিযাত্রীদের কাছেও। যারা পার্বত্য অঞ্চলের গহীনে ভ্রমণ করেছেন আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে হাল সময়ের ট্রেইল/অফট্রেইলে ঘুরাঘুরি করেন বা করেছেন তাদের কাছে জুমঘর পান্থশালা হিসেবে জীবনে একবার হলেও উপস্থিত হয়েছে। যারা আরও দুঃসাহসী রাতের আঁধারকে জয় করে অচেনা পথের অভিযাত্রী হয়ে হেঁটেছেন পাহাড়ের পথে, তাদের কাছে জুমঘরের স্মৃতি বিশেষ একটা জায়গা দখল করে আছে।

জুম ও জুমঘর অধিকাংশের কাছে এভাবেই ধরা দেয়। কিন্তু জুম ও জুমঘরের সাথে ঐতিহ্য, প্রথা, বিশ্বাস, উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান, জীবন-জীবিকা, হাসি-কান্না, স্বপ্ন ও লড়াইয়ের এক ভিন্ন চিত্র চিত্রিত হয়। যা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। সেই সাথে হাজার বছরের এই কৃষি পদ্ধতিটির নেতিবাচক দিকও আছে। বাংলাদেশের পাহাড় পর্বতময় অঞ্চল খুব সীমিত। তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম জেলা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেটের কিছু অংশ উল্লেযোগ্য। এর বাহিরে কুমিল্লার কিছু জায়গা নামেমাত্র পাহাড় হিসেবে পরিচিত। এদের ভিতর শুধুমাত্র পার্বত্য তিন জেলাতেই জুমচাষের অধিক দেখা মেলে। সিলেটে স্বল্প পরিমাণে জুমচাষ হয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো পাহাড়ে (মান্দি) গারো ও হাজং এবং শ্রীপুর, কুলাউড়া ও মৌলভীবাজার সীমান্তের খাসিয়া পাহাড়ে খাসিয়ারাও জুমে আবাদ করতেন। কিন্তু বৃটিশ শাসনামলে বন বিভাগ গারো পাহাড় এবং মধুপুর-গাজীপুর ভাওয়াল গড় এলাকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে জুম চাষ। বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে গারো ও হাজংরা দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে সমতলের অধিবাসীদের মতই কৃষিকাজে অভ্যস্ত হয়েছে নয়তো অন্যপেশা গ্রহণ করেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে তাই জুমচাষ অপরিচিত। বনভূমি বলতে যা তা কেবল রোপণকৃত বৃক্ষ। পাহাড়ি এলাকায় প্রাকৃতিক বন প্রায় বৃক্ষশূন্য। নামেমাত্র টিকে আছে মধুপুর আর ভাওয়াল গড়। সিলেটেও একই সময়ে জুম নিষিদ্ধ হয় খাসিয়াদের জন্য।

বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সকলেই কমবেশি জুমচাষের উপর নির্ভরশীল। জুমচাষের বেশকিছু ধাপ থাকে। তার ভেতর প্রথম ধাপটি হচ্ছে জমি নির্বাচন করা। একটি পাহাড়ে ১/৩ বছর টানা জুম করা হয়। তারপর সেই পাহাড়টিকে আবার পতিত ফেলে রাখতে হয় তার উর্বরা শক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য এবং নতুন একটি পাহাড়কে আবার জুমচাষের উপযোগী করে তৈরি করতে হয়। এই প্রক্রিয়াটিতে পাহাড়ের ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সাধারণত শীতের শেষে চাষের উপযুক্ত পাহাড় বেছে নিয়ে তার ঝোপ-জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়। কেটে রাখা জঙ্গল শুকিয়ে এলে তাতে দেয়া হয় আগুন। ফ্লাগুন-চৈত্র মাসেই প্রধানত আগুন দেয়ার কাজ শুরু হয়। অনেকে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান শেষ করে আগুন দেয়া শুরু করেন। আগুনে জঙ্গল পোড়ে তৈরি হয় ছাইয়ের স্তূপ। তারপর অপেক্ষায় থাকতে হয় বৃষ্টির। বৃষ্টি হলে শুরু হয় বীজ রোপণের পালা। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে জুমের ফসল বড় হয়ে ওঠে, তখন ফসল রক্ষার জন্য তৈরি করা হয় জুমঘর। জুমঘর একটি অস্থায়ী নিবাস, প্রাথমিক শষ্য ভান্ডার, শষ্য মাড়াইয়ের স্থান, নিরাপত্তা চৌকি ও বিনোদনেরও কাজে লাগে। যে সকল পরিবারের পাড়া (পাহাড়ি গ্রামকে পাড়া বলে) জুম থেকে বেশ দূরে তারা এই সময়টাতে জুমঘরেই পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ফসল তোলা শেষ করে ফিরে আসেন স্থায়ী বাড়িতে। জুমের ফসল হয় পর্যায়ক্রমে। প্রথমে জুন-জুলাই (আষাঢ়-শ্রাবণ) মাসের দিকে মারফা (কাঁকুড় জাতীয় ফল)। জুলাই-আগস্ট মাসে তোলা হয় ভুট্টা আর সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসের দিকে ধান তোলার কাজ শুরু হয়।

বমদের সাথে অধিক সময় কাটানোর সুবাদে তাদের বেশ কিছু জুম কেন্দ্রিক কাজ-কর্ম ও আচার অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। চমৎকার সব শব্দ ব্যবহার করেন তারা। তার ভিতর আছে, যে দিন জুমে প্রথম বীজ বোনা শুরু হয় সেদিনটিকে বম’রা বলেন ‘কুইতুহ’ আর তাদের ভাষায় জুমঘর হচ্ছে ‘থ্লাম’। জুমে বীজ বোনার জন্য যে দ্যা ব্যবহার করেন সেটাকে বলেন ‘নামতাং’। ফসল সংগ্রহ ও পরিবহনের জন্য যে ঝুড়িটি ব্যবহার করেন সেটাকে বলেন ‘স্যাই’। আর ফসল তোলার নবান্ন কে বলে থাকেন ‘থলাইথার’। বমেরা যেসব সামগ্রী উৎপাদন করে তাদের মাঝে আছে কোয়াল মুম (ভুট্টা), চংমা (মারফা), মাইসেন (মিষ্টি কুমড়া), মাইপল (জালি কুমড়া/সাদা কুমড়া), আইথিং (আদা), আইয়েং (হলুদ), বালয় (শিম), মারসিয়া (মরিচ), ফাং (ধান), বা (কচু), লা (তুলা) ইত্যাদি। এছাড়া কাচআলু নামে একটা আলু হয় যা মিষ্টি আলুর মতো স্বাদ। দেখতে দন্ডাকার। শীতের সকালে জলখাবারের মতই আগুনে গা গরম করতে করতে সেই আগুনেই পুড়িয়ে কাচআলু খাওয়ার আলাদা একটা আমেজ আছে।

জুমচাষের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে- সব ফসল তোলে নেয়ার পর আপনা থেকেই কিছু ফসল হতে থাকে সেটাকে বম’রা বলেন ‘লওচুল’। এমনিতে ‘রান্যা’ শব্দটি আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। তাছাড়া মারমারা বলেন ‘পুঙঃছো’। প্রতিটি জাতিসত্তার মানুষদের জুম কেন্দ্রিক স্বতন্ত্র আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে। শত বছর ধরে পূর্ব পুরুষ থেকে মেনে আশা বিশ্বাস ও নিয়ম জাতি ও গোত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। জুমের মূল কাজ সকলের প্রায় একই রকম। সারিবদ্ধভাবে নারী-পুরুষ বীজ বোনার কাজটা শুরু করেন। সাধারণত বীজ নীচ থেকে উপরের দিকে লাগানো হয়। দ্যা দিয়ে গর্ত করে এক সঙ্গে সব ফসলের বীজ সেই গর্তে দিয়ে দেয়া হয়। কেবলমাত্র তিল ও মেস্তাপাতা (টক জাতীয় এক প্রকার সবজি) পুরো ক্ষেতে ছড়িয়ে দেয়া হয়। মূলত কন্দ জাতীয় ফসলগুলো জুমের প্রান্তবর্তী স্থানে রোপণ করা হয় যেমন: হলুদ ও আদা। জুমক্ষেতটিকে মনলোভা করার জন্য অনেকে বুনো ফুলের গাছও রোপণ করে থাকেন। আমি গাঁদা ফুলসহ বেশ কিছু গার্ডেন ফ্লাওয়ারেরও দেখা পেয়েছি।

জুমের অন্যতম প্রধান ফসল ধান। জুমচাষীরা বিভিন্ন জাতের ধান চাষ করে থাকেন। তার ভিতর কামরাং, বাধোইয়া, কবরক, তুরগী, মেহলে, কাউন, বিরণী/বিন্নী, আমে সোরী ইত্যাদি মোটামোটি বেশ পরিবিত নাম। এই ধানগুলোর আবার অনেকগুলো উপজাত আছে। কবরক ধান এপ্রিলের মাঝামাঝি বোনা হয়। মেহলে, নাবোদা, রাংগী, কাউন ও গেলং আগস্ট মাসে, সোরী ও আমে সোরী সেপ্টেম্বর মাসে পাকে। কামরাংগা ধান মে মাসে আর সবার শেষে বিরণী ধান বোনা হয়। রেংপুই নামের একটি জাতের ধান চাষ করে থাকেন বম’রা। হাল্কা লালচে রঙের চাল হয়। খেতেও সুস্বাদু। আমি স্থানীয়দের কাছে দেখেছি এবং খেয়েছি কিন্তু কোন বইয়ে এ নামের ধানের কথা পাইনি। হয়তো ভিন্ন নামে ডাকা হয় অন্য ভাষায়। এছাড়া গ্যালং, বুক্কই, লেংদাচিগোন, দেলং, ফান্তে, চাকার্মা, ফ্রে, কুংদুম, নাইকং, তংদোসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির ধানের নাম পাওয়া যায়। বমদের কাছে আরও কিছু ধানের নাম শুনেছি যেমন: kungda, mongthong, reng- -pui, baa, vathao ইত্যাদি। ধান হয়তো একই কিন্তু জাতি ভেদে নাম ভিন্ন হয়। জুমে নানা জাতের সবজি, কন্দ (নানা প্রকারের আলু, নানা জাতের কচু, হলুদ, আদা), তিল, তুলা এমনকি কলাও চাষ করা হয়ে থাকে। তুলার চাষ ইদানীং কম করা হয়। বাণিজ্যিক উৎপাদন এখন আর হয় না। অথচ এক সময় প্রধান অর্থকরি ফসল ছিল তুলা। তামাক চাষ নিষিদ্ধ করে আবারও তুলার বাণিজ্যিক চাষে উৎসাহিত করা উচিত। জেদেনা (ইক্ষু/আখ গাছের মতো দেখতে এবং এর রসও আখের রসের মতো মিষ্টি। বম’রা বলেন কংচাং) ও মরিচ চাষ করা হয়। তবে চিকন মরিচ (বমেরা বলেন মারসিয়াতে) নামে ছোট এক ধরনের মরিচ আছে যা পাহাড়ে এমনিতেই জন্মে, চাষের প্রয়োজন হয় না। পাহাড়িরা রান্নায় এ মরিচই ব্যবহার করেন। তাই জুমচাষকে বহুফসলী কৃষিও বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে জুমচাষীদের অধিকাংশই প্রান্তিক চাষী। পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য ভূমির প্রকৃত মালিক তারা নন। পাহাড়ে বিকল্প কোন পেশার উপায় না থাকায় জুমচাষই এদের প্রধান জীবিকা। আরও একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে একই জমিতে এক চাষেই বছরজুড়ে নানা ফসল পাওয়া যায় তাই জুমচাষই তাদের পছন্দের শীর্ষে থাকে।

জুম, জুমঘর, ফসল, উৎসব, ঐতিহ্য সম্পর্কে আমার দেখা ও জানা বিষয়গুলো শেয়ার করলাম। তবে বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। জুমচাষ পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর। নির্মম হলেও কথাটা বহুলাংশে সত্য। জুমের জমি তৈরি করার প্রক্রিয়াটি পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের পাহাড়গুলোর প্রাণ হচ্ছে গাছ। গাছ শূন্য ন্যাড়া পাহাড় কারও জন্য সুখকর নয়। জুম চাষের পক্ষে-বিপক্ষের অনেক মত আছে। যে যার মতো করে যুক্তি উপস্থাপন করে থাকেন। এমনকি জুমচাষ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের একটি বিভাগও আছে। ১৯৬১ সালে ‘জুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল জুম চাষ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ ও বনভূমি রক্ষা, বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি। কিন্তু এই বিভাগের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য দুটোই ব্যর্থতার মুখ দেখেছে। জুমের ক্ষতিকর দিকগুলো হচ্ছে ভূমিক্ষয়; মাটির পুষ্টি উপাদান হ্রাস; ঝিরি, খাল, নদী ও লেক ভরাট এবং নাব্য হ্রাস; জীব বৈচিত্র্য হ্রাস; জমির উর্বরতা হ্রাস; এলাকার প্রতিবেশ নষ্ট করা; বন্য প্রাণির চারণভূমি হ্রাস; ভূমিধস; উষ্ণতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।

সনাতন পদ্ধতির জুমচাষে পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব আছে, এটা মানতেই হবে। জুমের জমি পোড়নোর জন্য অণুজীব ও কীটপতঙ্গ ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে। যার ফলে খাদ্য-শৃঙ্খলের উপর এর বিরূপ প্রভাব এড়ানো যায় না। জমির স্বল্পতা ও চাহিদার দ্রুত বৃদ্ধি এসব কারণে পূর্বের মতো এখন আর ১০/১৫ বছরের জন্য পাহাড়কে বিশ্রাম দেয়া যায় না। এমনকি গত ২ দশক আগে পর্যন্ত জুম আর্বতন চক্রের বিরতি দেয়া হতো ৫/৭ বছর। বর্তমানে ২/৩ বছর বিরতি দিয়েই বার বার জুমচাষ করতে বাধ্য হচ্ছেন পাহাড়িরা। সবচাইতে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। পূর্বে যার একদমই ব্যবহার ছিল না। আগের মতো নিজেদের বীজ ব্যবহারের প্রথাও কমে আসছে। এখন জুমচাষীরা উচ্চফলনশীল (হাইব্রিড) জাতের বীজ ব্যবহারে আগ্রহী।

প্রাকৃতিকভাবেই জুমঘর শিকারের টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটা আমার ব্যক্তিগত মত এবং এই বিষয়টা বিশেষভাবে লক্ষ করেছি যে, পার্বত্য অঞ্চলে বর্তমান সময়ে অধিকাংশ শিকার জুমের আশ-পাশে ফাঁদ পেতে ধরা হয়ে থাকে। জুমের ফসল পাকতে শুরু করলে স্বভাবগত কারণেই কিছু প্রাণি ফসলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফসল বাঁচাতে জুমচাষীদের জুম পাহারা ও রক্ষার পাশাপাশি সহজলভ্য শিকারকেও হাতছাড়া করতে চান না। আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য সীমিত শিকারকে হয়তো মেনে নেয়া যেতে পারে। পাহাড়ে বসবাসকারী জাতিসত্তার মানুষেরা স্বভাব ও ঐতিহ্যগতভাবেই কমবেশি শিকারে অভ্যস্ত। তার উপর ক্রমবর্ধমান জনবসতির দ্রুত বৃদ্ধি এবং চাহিদার যোগানের জন্য অবাধে শিকার তো হচ্ছেই এবং জুমে শিকারের একটা রেওয়াজ প্রকট আকার ধারণ করেছে। অতীতেও যে ছিল না তা নয়। তখন মানুষ ছিল কম, জুমও কম করা হতো। শিকারের প্রাচুর্য ছিল বেশি। এক্ষেত্রে ভূচর পাখি (মথুরা, বন মোরগ ইত্যাদি), পাখি, মায়া হরিণ, কাঠবিড়ালি, সজারু, বাঁশ ইঁদুর/গর্তবাসী ইঁদুর (বম’রা ‘যুবই’ বলেন), ভল্লুক (মহাবিপন্ন) বেশি শিকার হয়। আর অন্যান্য প্রাণির অস্তিত্ব তো এখন নেই বললেই চলে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রভাবটা আরও বেশি। স্থল ও জলের উভয় জায়গাতেই এর ক্ষতিকর দিক আছে। বিশেষত পাখি ও ঝিরির জলজ প্রাণিকুল সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও জুমচাষীরা জুমের জন্য বড় গাছ কাটেন না এবং আগুনেও পোড়ানো হয় না তবে আগুনের জন্য ক্ষতি হতেই পারে। বাঁশ পোড়া ছাই জুমচাষের জন্য উত্তম ,তাই বাঁশ প্রধান পাহাড়ের ঢালকেই চাষীরা বেশি পছন্দ করেন। এতে বাঁশের প্রাকৃতিক বংশবৃদ্ধি ব্যহত হয়।

জুমচাষের পক্ষেও যুক্তি আছে। সরাসরি জুমচাষীদের বলেছি জুমের জন্য কী কী ক্ষতি হতে পারে। তাদের সহজ সরল উত্তর, ‘দাদা তাহলে খাবো কী?’ যখন আরও একটু বিস্তারিতভাবে বলি তখন উত্তর আসে, জঙ্গল তো দাদা আবার হয়ে যায়, বড় গাছ তো পোড়াই না। ভূমিক্ষয়ের বিষয়টি ওরা বুঝতেই পারে না। তাদের যুক্তি এভাবে জলাশয় ভরাট হতে থাকলে তো কোন ঝর্না-ঝিরিই থাকতো না। আর আজ পর্যন্ত ভরাটের উদাহরণও নেই। উপরন্তু হাল সময়ে ঝিরির পাথর ব্যবহার করে রাস্তা, কালভার্ট নির্মাণ করা এবং অবৈধ পাথর ব্যবসার জন্য ঝিরিগুলো হুমকীর মুখে পড়েছে।

সনাতন পদ্ধতির জুম পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এটা অপ্রিয় হলেও সত্য। তাই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও আবিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সেভেন সিস্টার্স, চীন, নেপাল, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওস, ভূটান, শ্রীলংকা এসব দেশেও জুমচাষের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকাতে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। নেপাল ও বাংলাদেশের দুটো প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে SALT (Sloping Agricultural Land Technology) নামে পাহাড়ে চাষের জন্য একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু এটি জুমচাষীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এছাড়া MATH (Modren Agricultural Technology in the Hill) নামে আরও একটা পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি থাকলেও তা মাঠ পর্যায়ে পৌঁছাতেই পারেনি।

পাহাড়কে বাঁচাতে হলে পাহাড়িদেরকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে শুধু পরিবেশের দোহাই দিয়ে জুমচাষ বন্ধ করা ঠিক হবে না। কারণ অতীতে ময়মনসিংহের গারো ও হাজংদের জুমচাষ বন্ধ করার পর তাদের জীবনে নেমে এসেছে তীব্র সংকট। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হওয়ায় তারা দ্রুতই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে কোন রকমে টিকে আছে। কিন্তু বনভূমি উজার হওয়া থেমে থাকেনি বরং দ্রুত গতিতেই বন উজাড় হয়ে গেছে। তেমনি পার্বত্য তিন জেলায় জুম নিয়ন্ত্রণের আগে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ জরুরি। খুব দ্রুততার সাথেই পাহাড়ের লোক সংখ্যা বেড়ে চলেছে। আর এই বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মিটাতে নতুন নতুন পাহাড় জুমের আওতায় আনা হচ্ছে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পাহাড়ে বিশেষ জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে আধুনিক পদ্ধতিগুলো পাহাড়িদের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং তা পালনে উৎসাহিত করা দরকার। তাহলেই হয়তো নব্য প্রস্তর যুগের শৈল্পিক চাষ পদ্ধতিটিকে আধুনিকায়ন করে টিকিয়ে রাখা যাবে। বাচিঁয়ে রাখা যাবে পাহাড় এবং জীববৈচিত্র্যকেও।

লেখক: পরিব্রাজক

সূত্র: পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ, বর্ষ ১, সংখ্যা ০৬-০৭

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন