টেকনাফে ১২ মানব পাচারকারী আটক


টেকনাফের বিভিন্ন উপকূলীয় সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ত্রি-দেশীয় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চলছে মানবপাচার। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে এ পাচারকারী চক্রটি সক্রিয় রয়েছে। তারা রোহিঙ্গা ও মধ্যবিত্তদের টার্গেট করে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে পাচার করে যাচ্ছে।
প্রলোভনের মধ্যে রয়েছে উচ্চ বেতনের চাকরি, সুবিধাজনক কর্মসংস্থান, দ্রুত ধনী হওয়ার স্বপ্না, অল্প খরচে বিদেশ যাত্রা, বিনা অর্থে প্রেরণ করে পরবর্তীতে কর্মস্থলে কাজের মাধ্যমে খরচ পরিশোধের সুযোগের প্রতিশ্রুতি। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। অনেকে সাগরপথে যাত্রা করে মধ্য সাগরে মৃত্যু হয়েছে।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকাল সাড়ে চারটায় টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি)’র সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে অধিনায়ক লে. কর্ণেল আশিকুর রহমান জানান- টেকনাফ উপজেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বিশেষ অভিধান চালিয়ে ১২ জন মানব পাচারকারী আটক করেছে এবং ১১ জন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করেছে।
তিনি আরো জানান- বেশ কিছুদিন যাবৎ গভীর সাগর ও পাহাড়ী এলাকায় মানবপাচারকারীরা অবস্থান করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মানব পাচারে সক্রিয় চক্রের দৌরাত্মে স্থানীয়দের মাঝে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত জুলাই মাসে ১৫ জন, অগস্ট মাসে ৩৪ জন এবং চলতি সেপ্টেম্বর মাসে এখন পর্যন্ত ১৭ জন মানব পাচারকারীকে সীমান্তে আটকসহ মিয়ানমার হতে মানব পাচারের একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে।
বিজিবি সূত্রে জানা যায়, বেশ কিছু দিন যাবত কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় মিয়ানমার হতে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ হতে মিয়ানমার হয়ে মালয়েশিয়া পর্যন্ত মানব পাচার ও মাদক পাচারের মতো জগন্য অপরাধের সাথে জড়িত রয়েছে। পাচারকারী চক্রের বাংলাদেশে থাকা হোসেন, সাইফুল এবং নিজাম এই সংঘবদ চক্রের মূল হোতা বলে জানা গেছে।
এই তিনজনের মাধ্যামে বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় ও দলে বিভক্ত হয়ে তারা এই মানব পাচার করে থাকে। তারা বেতনভুক্ত কিছু সদস্য রেখে তাদের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যাত্রী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রলোভন দেখিয়ে টেকনাফে নিয়ে আসে।
প্রলোভনের মধ্যে রয়েছে উচ্চ বেতনের চাকরি, সুবিধাজনক কর্মসংস্থান, দ্রুত ধনী হওয়ার স্বপ্ন, অল্প খরচে বিদেশ যাত্রা, বিনা টাকায় প্রেরণ করে পরবর্তীতে কর্মস্থলে কাজের মাধ্যমে খরচ পরিশোধের সুযোগের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় ভুক্তভোগীদের। এ ধরনের প্রলোভনের মাধ্যমে টেকনাফসহ বাঃলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের নাগরিকদের মালয়েশিয়া গমনে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
পরে সংগৃহীত ভিকটিমদের মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত মূল হোতাদের নিকট সাগর পথে প্রেরণ করা হয় এবং তাদের নির্দেশ অনুযায়ী যাত্রীদের স্থানীয় পাচারকারীর নিকট হস্তান্তর করে। নতুন পাচারকারীদের নিকট হস্তান্তরের পর যাত্রীদের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ও গোপন আস্তানায় নিয়ে যায় এবং সেখানে পৌঁছার সাথে সাথে তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেয়া হয়।
এমনকি ভুক্তভোগীদের পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মিতভাবে স্বল্প পরিমাণ খাদ্য প্রদান করা হয়। মিয়ানমার-মালয়েশিয়া গমনের পূর্বের দিন স্থানীয় দালালদের নির্দেশক্রমে ভুক্তভোগীদের বাংলাদেশে অবস্থানরত মূল পাচারকারী চক্রের হতে পুনরায় হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে কিছু পাচারকারী বাংলাদেশ হতে মিয়ানমার হয়ে মালয়েশিয়া এবং কিছু পাচারকারী সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া অভিমুখে যাত্রী প্রেরণ করে।
এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন উপকূল হতে ছোট ছোট নৌযানে করে যাত্রীদের গভীর সমুদ্রে অপেক্ষারত বড় নৌযানে স্থানান্তর করেন। এছাড়া সংগৃহীত যাত্রীদের মধ্যে অর্থিক সামর্থ্যবান ব্যাক্তিদের আটক রেখে তাদের পরিবারের কাছে থেকে বড় অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
এদিকে বিজিবি গত ১৪ সেপ্টেম্বর শাহপীরদ্বীপের নাফ নদী ও মোহনায় মানব পাচারকারীদের একটি বড় প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে। সাগরপথে মিয়ানমারের প্রায় ১০০ নাগরিককে পাচারের সময় ৪ জন মানব পাচারকারীকে হাতেনাতে আটক করা হয়েছে। এই অভিযানে মানব পাচার চক্রের একটি বড় পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
বিজিবি সুত্র জানায়- অন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই চক্রগুলোর মধ্যে পাঁচজন মুলহোতা মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে তাদের স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে মানব পাচারের কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিজিবি আরো জানায়- পাচারকারী চক্রের নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত রয়েছে। যেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প, স্থানীয় ও প্রবাসী বাংলাদেশি সহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়িত।
মানব পাচারকারী চক্রগুলোর সঙ্গে মাদক পাচার, চোরাচালান, অপহরণ এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাস ও অপরাধের গভীর যোগসুত্র রয়েছে। এদিকে একটি গোপন সুত্রে বিজিবি মেরিন ড্রাইভ সড়ক সংলগ্ন কচ্ছপিয়া ও বড়ইতলী এলাকা হতে মানব পাচারকারী চক্রের ৮ জনকে আটক করা হয়। এছাড়াও চলতি বছরে বিশেষ অভিযানগুলোতে সঙ্গবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের ৬২ জনকে আটক করা হয়েছে এবং ২৪ জন আসামি এখনও পলাতক রয়েছে।
এদিকে, ধৃত ১২ পাচারকারিকে টেকনাফ সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করে টেকনাফ মডেল থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। ধৃতরা হচ্ছে টেকনাফ উপজেলার সরদ ইউনিয়নের তুলাতলি গ্রামের মৃত হোসেন আহমেদের পুত্র মো. আব্দুর রশিদ (৩৫), মৃত জহির আহমদের পুত্র জাহেদ (১৮), লেঙ্গুরবিলের নুর বসরের পুত্র মোঃ মিজানুর রহমান (২০), ১৯ নং থাইংখালী এফডিএমএন ক্যাম্পের মোঃ আইয়ুবের পুত্র মোঃ আবু তৈয়ব (২৫),
মিয়ানমারের বুচিডং থানার নুর মোহাম্মদের পুত্র মোঃ ইদ্রিস (৩৫), দক্ষিন জালিয়াপাড়ার মৃত রশিদল্লাহ মোঃ জুবায়ের (৩৩), কচ্ছপিয়া গ্রামের নূর মোহাম্মদের পুত্র নরুল আবছার (১৮), ছোট হাবিবপাড়ার মেছ ইসমাইল (৩২), বড়ডেইল গ্রামের মোহাম্মদ হোসেনের পুত্র মোঃ ইমরান (২৮), নুর ইসলামের পুত্র নুর মোহাম্মাদ (৪০),
২৭ নং এফডিএমএন ক্যাম্পের মোঃ জহিরের পুত্র মাহমুদউল্লাহ (৩০), কচ্ছপিয়া গ্রামের বছির আহমদের পুত্র খুরশিদা বেগম (৩৪)। এ ছাড়া তিনজনকে পলাতক আসামী করা হয়েছে। তারা হলেন- টেকনাফ উপজেলার কচ্ছপিয়া গ্রামের নুর আহম্মদের পুত্র মো. হোসেন (৩১), আজিম আহম্মেদের পুত্র নেজাম ও দক্ষিন লম্বরী গ্রামের হাফিজুর রহমানের পুত্র সাইফুল(৪০)। স্থানীয় সচেতন মহল মানবপাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদানের জন্য দাবী জানান।