পানি সংকটে পাড়া ছেড়ে যাবার অপেক্ষায় বান্দরবানের খুমী জনগোষ্ঠী

fec-image

পানি সংগ্রহ করতে প্রতিদিন এক ঘন্টা সময় চলে যায়। ওই পানিটাও ঘোলা এবং ময়লা। বর্ষাকাল ছাড়া পাড়ার আশপাশে কোথাও পানি থাকে না।

বনের বাঁশ, কাঠ ও শন দিয়ে বাঁধানো সারি সারি ঘর। বেশির ভাগ ঘরে রয়েছে সোলার প্যানেল। প্রতিটি ঘর মাচাংয়ের আদলে তৈরি। ঘরের পাশেই ছোট করে তৈরি করা হয়েছে আরেকটি ঘর। যেখানে রয়েছে সারা বছরের খোরাকি জ্বালানি কাঠের স্তুপ। কিছুটা দুর্গম হলেও বেঁচে থাকার জন্য এমন আয়োজন গড়ে তুলেছেন বাসিন্দারা নিজেরাই।

বান্দরবানে সবচেয়ে নিকটতম উপজেলা রোয়াংছড়ির তারাছা ইউনিয়নে একটি দুর্গম পাহাড়ের অবস্থান এই সাংকিং খুমী পাড়া। কিন্তু এ জেলার ১১টি উপজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে কম লোকসংখ্যার এই খুমী জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পানি।

বহুদিন ধরে এ পাড়ার সকলকে ভোগাচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। নোংরা পানি খেয়ে পানিবাহিত নানারকম রোগবালাই লেগে থাকে সারাবছর। ফলে সুপেয় পানি পাওয়া যায় এমন কোনো জায়গা পেলে যে কোন মুর্হুতে পাড়া ছেড়ে অন্য চলে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী এ পাড়াবাসী।

এ পাড়ার ষাট বছর বয়সী বৃদ্ধ রেলুং খুমী গণমাধ্যমকে জানান, ‘আধঘন্টা পাঁয়ে হেঁটে একটি মৃতপ্রায় ছড়ায় কোন রকমে গোসল করা যায়। কিন্তু খাওয়ার পানি মারাত্মক সমস্যা। কাড়াকাড়ি করে একটা ছোট কুয়ার থেকে পানি সংগ্রহ করে খেয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে’।

‘পানি সংগ্রহ ও গোসল করতে আসা যাওয়ার মধ্যে প্রতিদিন এক ঘন্টা সময় চলে যায়। ওই পানিটাও বিশুদ্ধ নয়। ঘোলা এবং ময়লা। খেয়ে আতঙ্কে থাকি-কোন মুর্হুতে কী হয় । বর্ষাকাল ছাড়া পাড়ার আশপাশে কোথাও পানি থাকে না। এভাবে বছরের আট মাস কষ্ট করে খুব অমানবিকভাবে বেঁচে থাকতে হয়’।

পাড়ার আরেক বাসিন্দা লোসাই খুমী জানান, ‘ময়লা ও দুর্গন্ধ পানি ব্যবহার করলে রোগ হবে। এটা জেনেও উপায় না পেয়ে খেতে হচ্ছে। কিছু করার নেই আমাদের। তবে গোসলের জন্য না হলেও অন্তত বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি পেলে এত দুশ্চিন্তা থাকত না’।

ফাইল ছবি: ছড়ার পানি ঘোলা; এখানে পাড়াবাসীরা গোসল করে থাকে

লুংপা খুমী নামে এক নারী বাসিন্দা বলেন, ‘সবাই পানির সংকটে ভুগলেও নারীদের সমস্যা আলাদা। সংসারে রান্নার কাজ থেকে শুরু করে বাচ্চা লালন-পালনের দায়িত্ব নারীদেরই করতে হয়। এক্ষেত্রে পানির সমস্যায় এক ধরণের তিক্ততার পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়’।

‘পাড়া থেকে দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়।পানির অভাবে নারী ও শিশুদের ভয়ঙ্কর সমস্যা পড়তে হয়’।

সম্প্রতি এ পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ১৮টি পরিবারের এ পাড়ার পাশে দুটি ছড়া রয়েছে। দুটো ছড়ায় হাঁটুর সমান পানি। ময়লা, কালো সে পানি থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়ায়। পানির উপরের স্তর বিভিন্ন পচা বুনো লতাপাতায় ঢাকা। এই পানিতেই সারাদিনের পরিশ্রম শেষে গোসল সারেন তারা।

পাড়ার দু’জন বাসিন্দা থংসাই ও সোনে খুমী জানান, ‘শীতের দিনে পানির অভাবে হাত-পা ধুয়ে থাকা যায়। গরমের দিনে তা সম্ভব নয়। জুমক্ষেতে কাজ করে প্রচুর ঘাম ঝরে। দিন শেষে গোসল না করলে হয় না। বাধ্য হয়ে এই পানিতে গোসল করতে হয় আমাদের। ময়লা ও দুর্গন্ধ হলেও একমাত্র ভরসা ছড়ার এই সামান্য পানি’।

‘এছাড়া ছড়ার পাশে সামান্য একটা কুয়া রয়েছে। সেটাও ঘোলা ও অপরিষ্কার। সেখান থেকেই সংগ্রহ করা পানি খাওয়া হয় পাড়াবাসীর। এ কুয়ার পানি নোংরা ও স্বাস্থ্যসম্মত নয় জেনেও খেতে হয়’।

বড় পাথর ও বুনো গাছগাছালি থাকার সত্বেও শুষ্ক মৌসুমে এই ছড়ায় পানি নেই কেন এমন প্রশ্নের জবাবে এ দুই পাড়াবাসী জানান, ছোটবেলা থেকে বর্ষাকাল ছাড়া একে এভাবেই পানিশূণ্য দেখে আসছেন তারা। এরপরও বিশ-ত্রিশ বছর আগে পানি বেশি ও পরিষ্কার ছিল। এখন দিন দিন পানির পরিমাণ কমছে।

‘এভাবে চলতে থাকলে এ পাড়ায় আমরা বেশিদিন টিকতে পারব না। এজন্য সবাই মিলে জায়গা খুঁজছি অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য’, বললেন থংসাই ও সোনে খুমী।

পাড়ার এ পানির সংকট ‘দীর্ঘদিনের সমস্যা’ উল্লেখ করে সাংকিং পাড়ার কারবারী (পাড়াপ্রধান) নংলং খুমী গণমাধ্যমকে  বলেন, ‘বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে শুনেছি পাড়ার সৃষ্টির সময় থেকে পানির সংকট ছিল। তবে তখনকার সংকট আজকের মত এত তীব্র ছিল না। এখন বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে’।

‘পূর্বপুরুষরা আগে থেকে অন্য কোন পাড়ায় চলে গেলে নিরাপদে বাঁচতে পারতাম। আশপাশে আর জায়গাও নেই। তারপরও পানি আছে এমন কোনো জায়গা খুঁজে পেলে আমরা পাড়া ছেড়ে চলে যাব’।

এ পাড়ার পাশে ২২টি পরিবারের আরেক পাড়া অংতং খুমীও একইভাবে পানির সমস্যায় ভুগছেন বলে জানান সাংকিং পাড়ার কারবারী।

বর্তমানে এ পানি সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে পরিবেশ বিপর্যয় ও মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করছেন বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই।

গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘পাথর ও গাছ থাকলে যে ছড়া ও ঝিরি-ঝরণায় পানি থাকবে এমন কথা নেই। ছড়ার আশপাশে পানির উৎস ধরে রাখে এমন কতগুলো গাছ থাকতে হবে। সেই সঙ্গে অবশ্যই পাথরও থাকতে হবে’।

‘ছড়ার পাশে ডুমুর, চালতা ও চম্পার মত এমন কতগুলো গাছ রয়েছে যেগুলো থাকলে পানির উৎস সহজে নষ্ট হয় না। এমন হতে পারে অনেক আগে না জেনে কেউ এগুলো কেটে ফেলেছে। পানির সমস্যা তো একদিনের তৈরি হয় না’।

তবে পানির উৎস নষ্ট না হওয়ার জন্য পরিপক্ক হতে সময় লাগলেও পানিবান্ধব গাছ লাগানো দরকার। পাশাপাশি ছড়া অথবা যে কোনো ঝিরি-ঝরণার পাশে গাছ কাটা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী খোরশেদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভৌগোলিকভাবে পাহাড়ি অনেক এলাকা পাথুরে হওয়ায় গভীর নলকূপ ও রিংওয়েল বসানো যায় না। এছাড়া পানি সরবরাহের অন্য উপায় হল গ্র্যাভিটি ফ্লোর সিস্টেম (জিএফএস)। তাও উপযুক্ত জায়গায় পানির উৎস থাকতে হবে’। পানির সংকটগ্রস্ত এসব এলাকা পরিদর্শন করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

সূত্র: দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন