পার্বত্যচুক্তির বিতর্কিত ধারাগুলো রহিত বা সংশোধন করতে হবে

fec-image

দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের বিচ্ছিন্নতাবাদী রক্তক্ষয়ী তৎপরতা দমানোর লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। শুরু থেকে এ চুক্তিকে শান্তিচুক্তি হিসেবে প্রচার করা হলেও আজো কাক্সিক্ষত শান্তি পাহাড়ে আসেনি। অন্যদিকে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলসহ পার্বত্যবাসী বাঙালিরা এই চুক্তিকে কালো চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি পার্বত্য চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করার পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণ ছিল। চুক্তিটি করা হয়েছিল সংসদকে পাশ কাটিয়ে। তাই প্রথম থেকেই আশংকা ছিল চুক্তিতে এমন কিছু থাকতে পারে, যা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী।

চুক্তির বিবরণ প্রকাশিত হলে দেখা যায়, ভূমিকাতে লেখা রয়েছে, ‘বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে পার্র্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিম্নে বর্ণিত চারিখন্ড (ক, খ, গ, ঘ) সম্বলিত চুক্তিতে উপনীত হইলেন।’ ভূমিকাতে সুন্দর সুন্দর শব্দের ব্যঞ্জনায় ভরপুর থাকলেও চুক্তির প্রথম খন্ডের প্রথম ধারা থেকেই শুরু হয়েছে দেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো।

চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১নং ধারায় বলা হয়েছে, “উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসাবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছে।” এখানে লক্ষনীয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের কোনো বিশেষ জেলা বা বিভাগ বলে ঘোষণা করা হয়নি, উল্লেখ করা হয়েছে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে, যা দেশের প্রচলিত প্রশাসনিক অবকাঠামোতে পড়ে না। ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হতে বাধ্য, হচ্ছেও তাই। তা ছাড়া শুরু থেকে জনসংহতি সমিতির মূল পরিকল্পনা ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠা করা। তাদের ওই পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের প্রচলিত শাসন কাঠামোর বাইরে এই বিশেষ নামে বিশেষায়িত করেছে, যাতে চুক্তি করে অস্ত্র জমা দেওয়ার পরেও তারা প্রশাসনিক জটিলতার আড়ালে ‘স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে পারে।

বাংলাদেশের ৪৫টি উপজাতি তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি (পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী) উপজাতির লোক বসবাস করে। সারাদেশের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের এমন আহামরি কোনো অবস্থান নেই যে, তাদের জন্য সব কিছুই বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। তাছাড়া, নানা কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা’ দেশের অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ, এমনকি চুক্তির ভূমিকার সাথেই সাংঘর্ষিক। এছাড়াও ভূমিকার সাথে সাংঘর্ষিক অনেক ধারা এবং উপ-ধারাই পার্বত্য চুক্তিতে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী পার্বত্য চুক্তিকে বিশ্লেষণ করেছেন ৫৩ (তিপ্পান্ন) খন্ডে, যা ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি সংবিধান স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব’ শিরোনামের বই আকারে প্রকাশ করেছেন। অনুসন্ধানী পাঠক পার্বত্য চুক্তির স্বরূপ বুঝতে চাইলে বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট স্টাডিজ ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত উপরোক্ত শিরোনামের বইটি পড়ে দেখতে পারেন। চুক্তির ভূমিকায় আরো একটি বিষয় লক্ষনীয়। উল্লেখ করা হয়েছে যে চুক্তির লক্ষ্য, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা।’ ভূমিকায় উপর্যুক্ত কথাগুলোর সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কারণ, চুক্তিটির বিবরণে এটা সুস্পষ্ট যে, এটি করাই হয়েছে মূলত ‘অ-উপজাতীয়’দের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার সঙ্কুচিত বা রহিত করে সব কিছুতে ‘উপজাতীয়’দের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তনচ্যৈঙ্গ্যা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমী, চাক এবং খিয়াং এই ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘উপজাতি’ হিসেবে। অন্যদিকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠি বাঙালির পাশাপাশি সাওতাল, নেপালি, রোহিঙ্গা, গারো, মনিপুরি, কুকি, ভুটানি, আসামি, রিয়াং, সেন্দুজসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষকে ‘অ-উপজাতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। চুক্তির অভিধা মোতাবেক হিসাব করলে এই অঞ্চলে ‘উপজাতি’র চেয়ে ‘অ-উপজাতি’র মানুষের সংখ্যা বেশি। অথচ, চুক্তিতে ‘উপজাতি’ এবং ‘উপজাতীয়’ শব্দ ৪২ বার ব্যবহার করার পাশাপাশি ১০ বার তাদের অগ্রাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে ‘অ-উপজাতি’ এবং ‘অ-উজাতীয়’ শব্দ এসেছে ১১ বার এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার হয়েছে মূলত তাদের অধিকারকে সীমাবদ্ধ বা সঙ্কুচিত করার উদ্দেশ্যেই। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, চুক্তির ঘ খণ্ডের ধারা ৭-এ বলা হয়েছে, ‘যে উপজাতীয় শরণার্থীরা সরকারের সংস্থা হইতে ঋণ গ্রহণ করিয়াছেন অথচ, বিবদমান পরিস্থিতির কারণে ঋণকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করিতে পারেন নাই সেই ঋণ সুদসহ মওকুফ করা হইবে।’ অন্যদিকে ধারা ৮-এ বলা হয়েছে, ‘রাবার চাষের ও অন্যান্য জমি বরাদ্দ: যে সকল অ-উপজাতীয় ও অ-স্থানীয় ব্যক্তিদের রাবার বা অন্যান্য প্লান্টেশনের জন্য জমি বরাদ্দ করা হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে যাহারা গত দশ বছরের মধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করেন নাই বা জমি সঠিক ব্যবহার করেন নাই সে সকল জমি বন্দোবস্ত বাতিল করা হইবে।’ অর্থাৎ চুক্তিপূর্ব অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে ‘উপজাতীয়রা’ ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি বলে অনুকম্পা দেখিয়ে তাদের ঋণ সুদসহ মওকুফ করে দিতে হবে। অন্যদিকে একই পরিস্থিতিতে ‘অ-উপজাতীয়’দের জমি কাজে লাগাতে না পারাকে দণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে তাদের জমির বন্দোবস্তই বাতিল করে দিতে হবে! এমনই এক যাত্রায় দুই ফল ছড়িয়ে আছে চুক্তির প্রতি পরতে পরতে।

ভূমিকায় সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত রাখার কথা একই সাথে সমান গুরুত্ব দিয়ে বলা হলেও চুক্তির শুরু থেকেই পার্বত্যাঞ্চলের জনসাধারণকে ‘উপজাতি’ এবং ‘অ-উপজাতি’’ এ দুটি বিশেষণে আখ্যায়িত করে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। ‘উপজাতি’ হিসেবে চিহ্নিত ১১টি জনগোষ্ঠির মানুষের চেয়ে বাঙালিসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার পরও ‘অ-উপজাতি’দের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারকে রহিত করা হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ‘অ-উপাজাতি’দের বঞ্চিত করে শুধুমাত্র ‘উজাতীয়’দের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। জেলা পরিষদগুলোর সদস্য পদে ‘অ-উপজাতি’দের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক-তৃতীয়াংশ পদ। অন্যদিকে ২৫ জনের আঞ্চলিক পরিষদে ‘অ-উপজাতি’ সদস্য মাত্র ৭ জন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, মুখ্য নির্বাহী, আঞ্চলিক পরিষদের মুখ্য নির্বাহী, জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী এবং অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রেও ‘উজাতীয়’দের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ডসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে স্থানীয় নিয়োগগুলোতে ‘উপাজাতীয়’দের অগ্রাধিকারের মাত্রা কোনো কোনো ক্ষেত্রে শতভাগেও গিয়ে ঠেকতে দেখা যায়। ভোটাধিকারের ব্যাপারে ‘অ-উপজাতীয়’দের ক্ষেত্রে স্থায়ী বাসিন্দার শর্ত জুড়ে তাদের ভোটাধিকারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ‘উপজাতি’দের ভোটাধিকারের ব্যাপারে কোনো শর্তারোপ না করে স্বেচ্ছাচারের সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে করে পার্শ্ববর্তী দেশের ‘উপজাতীয়’দের অবৈধভাবে বাংলাদেশে ভোটার হওয়ার আশংকা রয়েছে।

মেডিকেল, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘উপজাতীয়’ ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু আছে বহু আগে থেকেই। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর ‘উপজাতীয়’ ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোটার সংখ্যা বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন থেকে ক্যাডেটসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর শত শত ‘উপজাতীয়’ ছাত্রছাত্রীকে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। নতুন স্থাপিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সাথে সাথে ‘উপজাতি’ কোটা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি করা হচ্ছে। অন্যদিকে পার্বত্যাঞ্চলের ‘অ-উপজাতি’ ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য কোথাও কোনো কোটা দেওয়ার কথা চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ‘উপজাতি’ কোটা বরাদ্দ রাখাকে নিজেদের জন্য গর্বের বিষয় মনে করলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামের একই পরিবেশে বেড়ে ওঠা ‘অ-উপজাতি’ ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোনো কিছু ভাবার গরজ অনুভব করে না। উচ্চশিক্ষায় কোটা পেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন নিয়োগে অগ্রাধিকারের পাশাপাশি সারাদেশের বিভিন্ন নিয়োগে কোটা পেয়ে ‘উপজাতি’রা একচেটিয়াভাবে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাচ্ছে। অন্যদিকে ‘অ-উজপাতি’ শিক্ষার্থীরা না পাচ্ছে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ, না পাচ্ছে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানীয় নিয়োগগুলোতেও বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে। এভাবে কোনো জনগোষ্ঠিকে বঞ্চিত করে, সাংবিধানিক অধিকার থেকে দূরে রেখে কোনো অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন আশা করা বাতুলতা মাত্র।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘উপজাতি’দের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ‘উপজাতীয়’দের সকল প্রকার লেনদেন আয়কর মুক্ত। পার্বত্য এলাকায় যেসব উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দ দু’লক্ষ টাকার মধ্যে সেগুলোর ঠিকাদারী সম্পূর্ণরূপে ‘উপজাতীয়’দের জন্য সংরক্ষিত। দু’লাখ টাকার ঊর্ধ্বে বরাদ্দকৃত প্রকল্পের ১০% ‘উপজাতীয়’দের জন্য সংরক্ষিত। বাকি ৯০% ঠিকাদারীর সিংহভাগ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ‘উপজাতীয়’রাই দখল করে নেন। কারণ, আয়কর দিতে হয় না বলে তারা অন্যদের চাইতে কম দরে কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। ‘উপজাতীয়’রা ব্যাংক ঋণ নিলে তাদের সুদ দিতে হয় শতকরা মাত্র ৫ টাকা। আর অন্যদের সুদ দিতে হয় সারা দেশবাসীর মতই উচ্চ হারে। সরকারিভাবে গৃহীত এ দ্বৈত ভ্রান্তনীতির কারণে পার্বত্যাঞ্চলের বাঙালি তথা ‘অ-উপজাতীয়’রা ‘উপজাতীয়’দের তুলনায় প্রতিনিয়তই পিছিয়ে পড়ছে। দিনে দিনে ‘উপজাতীয়’রা এলিট শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছে আর অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হতে হতে বাঙালি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষ আজ অবহেলিত এবং ‘উপজাতীয়’দের অনুগত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। সরকারিভাবে এ ধরনের জাতিগত বৈষম্য তৈরি কখনোই কাম্য হতে পারে না।

চুক্তিপূর্ব বিশৃঙ্খল অবস্থায় যেসব ‘উপজাতীয়’ নাগরিক ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, তাদের ফিরিয়ে এনে ২০ দফা প্যাকেজ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এভাবে ৬০ হাজারেরও বেশি ‘উপজাতীয়’ জনগণ বর্তমানে পুনর্বাসিত হয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন। অন্যদিকে ১৯৮৬ সাল থেকে ২৮ হাজারের বেশি বাঙালি পরিবারকে অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে গুচ্ছ গ্রামে এনে কার্যত বন্দি অবস্থায় রাখা হয়েছে। গুচ্ছ গ্রামগুলোতে পরিবার প্রতি একটি মাত্র ঘর তোলার জায়গা আর মাসিক ৮৬ কেজি চাল অথবা গম তাদের একমাত্র অবলম্বন। ৩৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এসব গুচ্ছ গ্রামের এক একটি পরিবার ভেঙ্গে বর্তমানে ২টি, ৩টি বা তার চেয়েও বেশি পরিবারে বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু বাড়েনি তাদের ঘর তোলার জায়গা। মাসিক রেশনের পরিমাণও বাড়ানো হয়নি। তাছাড়া গুচ্ছ গ্রামগুলোতে সেনিটেশন ব্যবস্থাও নেই। নেই ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা। চাষাবাদের জমিও তাদের নেই। ফলে তারা একমাত্র মাসিক ৮৬ কেজি রেশনের উপর নির্ভরশীল হয়ে কোনো রকমে জীবন ধারণ করছেন। মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ছেলের বউ, মেয়ের জামাই, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলসহ একই ঘরে গাঁদাগাঁদি করে মানবেতর জীবনযাপন করছে গুচ্ছ গ্রামবাসী বাঙালি পরিবারগুলো। অথচ, তাদের কবুলিয়তভুক্ত জমি-জমাগুলো দুষ্কৃতিকারীরা দখল করছে নানা কৌশলে। কখনও রাতারাতি কেয়াং নির্মাণ করে আবার কখনও চাষ করে দখল করা হচ্ছে বাঙালিদের জমি। সব কিছু দেখেও সরকার এবং প্রশাসন নির্বিকার। তাদের যেন কিছুই করার নেই। বাঙালিরা গুচ্ছগ্রামে আবদ্ধ হয়ে যুগ যুগ ধরে বসবাস করতে থাকবে এটাই যেন স্বাভাবিক। কিন্তু এ অমানবিক অবস্থা দীর্ঘ দিন চলতে পারে না।

পার্বত্য চুক্তির ভূমিকার সাথে এর ধারা, উপধারা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক অবস্থার মধ্যে সাংঘর্ষিক আরও অনেক বিষয় রয়েছে। আর এসব কিছুর ফলেই পার্বত্য চুক্তিকে শুরু থেকে সচেতন দেশবাসী মেনে নিতে পারেনি। ভবিষ্যতেও মেনে নেয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে গত দুই যুগের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সরকার চুক্তির বিতর্কিত ধারা-উপধারাগুলি নতুনভাবে বিবেচনা করতে পারে। এতে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয় সারাদেশই উপকৃত হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন