পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিরতার নেপথ্যে মাইকেল চাকমা


চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সশস্ত্র রাজনীতি, চাঁদাবাজি ও হত্যার সংস্কৃতি। এই অস্থিরতার পেছনে বারবার উঠে আসছে মাইকেল চাকমার নাম। যিনি সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর মুখপাত্র।
নির্বিচারে হত্যা, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র চোরাচালানসহ একাধিক মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও তিনি পাহাড়ে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র আধিপত্য কায়েমে সক্রিয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, তাঁর নেতৃত্বেই চলছে পার্বত্যাঞ্চলে নাশকতা ও ভয়ভীতির রাজনীতি।
সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে ঘটে যাওয়া তথাকথিত ধর্ষণ ঘটনার পেছনেও মাইকেল চাকমার পরিকল্পনা রয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের দাবি। মাঝে মধ্যেই উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ভাবে শান্ত পাহাড় কে অশান্ত করেন মাইকেল চাকমা। তার নেতৃত্বে হীন কোন অপরাধ নেই যা পাহাড়ে হয়নি। মূলত ১৯৯৭ সালের পর থেকেই এই পরিকল্পনা শুরু করেন মাইকেল চাকমা। এমনকি ইউপিডিএফ শুরুর পর থেকেই তারা পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতাও করে আসছে।
১৯৯৭ সালের চুক্তির সময় ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’-এর স্লোগান তুলে ইউপিডিএফ পাহাড়ে সশস্ত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। দুই দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই সশস্ত্র অবস্থানই পার্বত্য অঞ্চলের স্থিতিশীলতার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় ও গোয়েন্দা তথ্য মতে, ইউপিডিএফের হাতে এখনো রয়েছে শান্তিচুক্তির সময় জমা না দেওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মিয়ানমারের সীমান্তপথ দিয়ে আনা নতুন ভারী অস্ত্র। এই অস্ত্র কেনার পেছনে রয়েছে ‘চাঁদাবাজি ও মাদক লেনদেন’-এর বিশাল আর্থিক জোগান। ঠিকাদার, ব্যবসায়ী এমনকি সাধারণ পর্যটকরাও ইউপিডিএফের চাঁদার লক্ষ্যবস্তু। স্থানীয়ভাবে এটি এখন ওপেন সিক্রেট।
শক্তিমান চাকমা ও মাইকেল চাকমা—দুজনই এক সময় ছিলেন ইউপিডিএফের সক্রিয় কর্মী। কিন্তু রাজনৈতিক মতভেদ ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব তাদের সংঘাতে জড়ায়। ২০১১ সালে অস্ত্রসহ মাইকেল চাকমার গ্রেফতারের পর শক্তিমান চাকমা নানিয়ারচর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন মাইকেল।
২০১৮ সালের ৩ মে শক্তিমানকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দিতে আসা তপন জ্যোতি (বর্মা) ও আরও দুইজনকেও সশস্ত্র হামলায় হত্যা করা হয়। দু’টি হত্যাকাণ্ডেই মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মাইকেল চাকমার নাম উঠে আসে এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়।
২০১৯ সালে হঠাৎ ‘গুম’ হন মাইকেল চাকমা। পরিবার ও ইউপিডিএফ দাবি করে, সরকার তাঁকে গুম করেছে। তবে একাধিক সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতেই ছিলেন তিনি।
২০২৪ সালে সরকারের পরিবর্তনের পর তিনি আবার প্রকাশ্যে আসেন। এরপর নিজেকে ‘ভিকটিম’ হিসাবে উপস্থাপন করে আবারও পার্বত্য রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তবে এই প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই পাহাড়ে আবার শুরু হয় উত্তেজনা, বিভাজন ও সহিংসতার পরিকল্পনা।
প্রশাসন সূত্রে জানা যায় র্তমানে মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে রয়েছে ১১টি নিশ্চিত মামলা। যদিও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রকৃত সংখ্যা ২০টিরও বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শান্তিচুক্তির দুই যুগ পরও যদি পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা ও আভ্যন্তরীণ হত্যাকাণ্ড থামানো না যায়, তবে তা শুধু পার্বত্য নয়—সারাদেশের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
গুম নাটক দিয়ে সহানুভূতি আদায় করে, আবার সহিংস রাজনীতিতে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় না আনলে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে।