পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষাবৃত্তি এবং বাঙালি-অবাঙালির বৈষম্য সমাচার

fec-image

গত ৩ ডিসেম্বর ২০২০ ‘পার্ব্যত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’র ফেসবুক পেইজে শিক্ষাবৃত্তির ফলাফল (অর্থবছর ২০১৯-২০২০) প্রকাশিত হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। শিক্ষাবৃত্তির ফলাফল এবং তার কিছু প্রতিক্রিয়া দেখে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার চিন্তা মাথায় আসে।

উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে বাঙালি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেতিবাচক মন্তব্য ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখলাম, অবাঙালি শিক্ষার্থীরাও নেতিবাচক মন্তব্য করছে। ব্যাপারটি বেশ কৌতূহলের।

পাহাড়ের যে কোনো বিষয়ে অবাঙালিদের অগ্রাধিকার প্রদান করার প্রবণতা আছে। ফলে বাঙালিরা তাদের সংখ্যানুপাত, মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে কম মূল্যায়িত হয়। তাই তাদের মধ্যে ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এর বিপরীতে যারা তাদের সংখ্যা, মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে তুলনামূলক বেশি মূল্যায়িত হয় তারা কেন নেতিবাচক মন্তব্য করছে, সেটা, জানার আগ্রহকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

১১ ডিসেম্বর ২০২০ সন্ধ্যা পর্যন্ত উন্নয়ন বোর্ডের ফেসবুক পেইজে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, শিক্ষাবৃত্তির ফলাফল ঘোষণার নিচে ১৬২টি মন্তব্য জমা হয়েছে। তার মধ্য থেকে কয়েকটি মন্তব্য:

Shoilen Dey লিখেছেন, ‘বাঘাইছড়ি তে কি বাঙ্গালী নাই‘ MD Shohel Islam লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের পড়ে আমি পায় নি আমার এলাকায় কতগুলো মানুষ কলেজে ডিগ্রিতে পড়ে পায়তাছে। এটাই বিচার রে ভাই’ Hlasa Marma লিখেছেন, ‘sob to tripura gosti re delo, akane k gorib k medha keo deke na, sodo deke nejer jat’ Ashikur Rahman Manik লিখেছেন, ‘আমি প্রতি বছর পাই… কিন্তু গত ২২ বছর ধরে পাচ্ছি না.. ‘ ত্রিপুরা সোহেল লিখেছেন, ‘আমি প্রতিবছর পায় কিন্তু টাকা আসে না আমার কাছে হাহাহাহা চার বছর হলো টাকা আসে না…সব কূকপাল ’ SU Mon লিখেছেন, ‘গরীবেরা সব কিছু থেকে বঞ্চিত ‘ Venerable Bishuddha Nondo লিখেছেন, ‘তিন বছর পর্যন্ত চেষ্টা করে যাচ্ছি।। কিন্তু একবার ও নাম আসলাম না। পুরা কপাল কুট্টা ভাগ্য ‘ Ukhai Marma লিখেছেন, ‘ Ami tana 3 year dhore aply krtase…akber o pailam na. ‘ Ushai Nung Marma লিখেছেন, ‘আমাদের কপালে নেই এসব।যারা ভালো ভালো কলেজে পড়ে তাদের জন্য ‘ Doyel Chakma লিখেছেন, ‘গত এইচএসসি ১ম বর্ষ ২০১৪ সাল থেকে আজ ২০২০ স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বৃত্তি আবেদন করেছিলাম। এখনো একবার ও পাই নি। একজন ছাত্র হিসেবে কি আর বলবো, আজ পোষ্য পুত্র আর পরিচিত থাকতো হতো আর কি। আমাদের মত ছাত্রদের বিবেচনা করা হয় না, তবুও শুভেচ্ছা যারা বৃত্তি তালিকায় আছেন। কিন্তু নিম্নবিত্তরা আজ সঠিক তদন্ত মাধ্যমে তারা তালিকা থেকে বাদ পড়ে যান  আর লেখাপড়া থেকে তারাই বঞ্চিত হয়। ‘

এবার উন্নয়ন বোর্ড পার্বত্য তিন জেলা থেকে মোট ২২১৮ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়েছে। এর মধ্যে কলেজ পর্যায়ে বৃত্তি পেয়েছে ১০০০ শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ১২১৮ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। অনেকেই হয়তো আশাহত হয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছে সেখানে, কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, বৃত্তি পেয়ে একজনকেও সেখানে বোর্ডের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেখলাম না। এর কারণ কী? জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ, তাই ইতিবাচক মন্তব্য করতে পারি না। নাকি এখানে উন্নয়ন বোর্ড নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে আসলেই ব্যর্থ, সেকারণে ইতিবাচক মন্তব্য করে কেউ তার দায় নিতে রাজি হয়নি?

কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে রাঙ্গামাটি জেলা থেকে বৃত্তি পেয়েছে ৭৩৬ (৩৩৬, ৪০০), খাগড়াছড়ি থেকে ৭৭০ (৩৫০, ৪২০) এবং বান্দরবান থেকে ৭১২ (৩১৪, ৩৯৮) শিক্ষার্থী। ১০ ডিসেম্বর ২০২০ রাঙ্গামাটির ৭৩৬ জনের মধ্যে কলেজ পর্যায়ের ৩৩৬ জনকে ৭০০০ টাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েরর ৪০০ জনকে ১০০০০ টাকা করে বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে।

এবার বাঙালি এবং অবাঙালি প্রশ্নে কিছু বিশ্লেষণ তুলে ধরা যাক।

তিন জেলার ২৬টি উপজেলার কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের আলাদা আলাদা করে মোট ৫২টি তালিকা প্রকাশ করেছে উন্নয়ন বোর্ড। এর মধ্যে তিন জেলার বাঙালিপ্রধান তিনটি উপজেলার তালিকা যাচাই করে বিষয়টি অনুধাবনের চেষ্টা করছি। এর জন্য আমরা বান্দরবান থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি, রাঙ্গামাটি থেকে লংগদু এবং খাগড়াছড়ি থেকে মাটিরাঙ্গা উপজেলাকে বেছে নিয়েছি।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার জনসংখ্যার ৮১.২৬ শতাংশ বাঙালি আর ১৮.৭৪ শতাংশ অবাঙালি। নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মোট ৪২ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে বাঙালি ১০ (২৩.৮৯ শতাংশ) আর অবাঙালি ৩২ (৭৬.১১ শতাংশ) শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার জনসংখ্যার ৭৫.২৮ শতাংশ বাঙালি আর অবাঙালি ২৪.৭২ শতাংশ। লংগদু উপজেলা থেকে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মোট ৩৭ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে বাঙালি ২২ (৫৯.৪৬ শতাংশ) আর অবাঙালি ১৫ (৪০.৫৪ শতাংশ) শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার জনসংখ্যার ৬৮.৩৬ শতাংশ বাঙালি আর অবাঙালি ৩১.৬৪ শতাংশ। মাটিরাঙ্গা উপজেলা থেকে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মোট ৭১ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে বাঙালি ৩৪ (৪৭.৮৯ শতাংশ) আর অবাঙালি ৩৭ (৫২.১১ শতাংশ) শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে।

বাঙালিপ্রধান উপজেলাগুলোতেই যেহেতু এই অবস্থা, তখন যেখানে তারা সংখ্যায় কম সেখানকার অবস্থা কী হতে পারে সেটা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না।

এখন প্রশ্ন তো স্বাভাবিকভাবেই উঠতে পারে যে, বাঙালি শিক্ষার্থীরা বৃত্তিপ্রাপ্তির তালিকায় কেন সংখ্যায় এতটা কম? বৃত্তির জন্য যথেষ্ট সংখ্যক আবেদন তাদের পক্ষ থেকে করা হয়নি? নাকি উন্নয়ন বোর্ডের নির্ধারিত মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়ার মতো যথেষ্ট সংখ্যক বাঙালি শিক্ষার্থীর আবেদন পাওয়া যায়নি? নাকি তারা জাতিগত বৈষম্যের শিকার?

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষাবৃত্তি কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্যই ইতিবাচক সহায়তা হিসেবেই গণ্য হবে, এতে সন্দেহ নেই। আর এই উদ্যোগটিও এ অঞ্চলের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

এমন উদ্যোগ জেলা পরিষদসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও নেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই বাঙালি এবং অবাঙালির মধ্যকার বৈষম্যটা থাকেই। কিন্তু একই আলো-বাতাসে বড় হওয়া শিক্ষার্থীদের সামনে এটা ভালো কোনো উদাহরণ নয়, বরং এটা তাদের মনে বঞ্চনার স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে, যা তাদের ভবিষ্যতের কর্মজীবনেও থেকে যায়।

পাহাড়ের যারা শান্তির স্বপ্ন দেখেন তাদের এখন ভাবার সময় এসেছে, কাউকে বঞ্চিত করে নয়, বরং যার যার যথাযথ প্রাপ্য দিয়েই সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সকলের চিন্তা, চেতনা, মননশীলতায় এটা প্রোথিত করে দেয়ার সময় হয়েছে যে, জন্মগত কারণে কেউ বঞ্চনার শিকার হতে পারে না। এখানে আমাদের বড় পরিচয় হোক, আমরা সবাই মানুষ, একই রাষ্ট্রের সমমর্যাদার নাগরিক, রাষ্ট্রীয় অধিকারও প্রত্যেকের সমান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন