পাহাড়ে শরনার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন টাস্কফোর্সের কাজ কি?

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘাতকে ঘিরে উপজাতি এবং বাঙালি জনগোষ্ঠির মানুষের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির কথা আমাদের কমবেশি জানা আছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (কথিত শান্তিচুক্তি) স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্যবাসীর জন্য কিছু সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করা হয়। যার মধ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণায়ল, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, ৩ জেলায় ৩ টি শক্তিশালী তথা স্বায়ত্তশাসিত পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এবং ‘ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্স’ সৃষ্টি হয়।

আজকের মূল আলোচ্য বিষয়- ‘ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্স’।

পার্বত্য চুক্তির সূত্রে সৃষ্ট এসব অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান যে আইনদ্বারা গঠিত এবং যে আইন দ্বারা পরিচালিত সেসব আইনে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ধারা উপধারা বিদ্যামান রয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন। যা সরাসরি একক রাষ্ট্র কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক। যা ইতিমধ্যে উচ্চ আদালত অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন। এই রায়ের মূল বক্তব্য ছিল, আঞ্চলিক পরিষদের গঠন ও এর প্রদত্ত ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধানের “একক রাষ্ট্র”নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে আপিল করারপর হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়, যার ফলে পরিষদ এখনো তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে, বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।

তেমনি ভাবে চূক্তির সূত্রে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন এবং কমিশনের আইন নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে জটিল ও সংবেদনশীল ইস্যু হলো ভূমি সমস্যা। ১৯৯৭ সালের চুক্তির আলোকে সরকার প্রণয়ন করে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অসহযোগিতা ও আপত্তি, কমিশনের কার্যক্রমে বাধা ও হুমকি এবং আইনের কিছু ধারা নিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর উদ্বেগএর কারণে কিন্তু বাস্তবে এই কমিশন কার্যকর হয়নি।

শরণার্থী পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্স এর কাজ কি?

প্রশ্নে আছে ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্স এর কাজ কি?

টাস্কফোর্সের কাঠামো: বর্তমানে এই টাস্কফোর্সের কাঠামোতে দেখা যায় ১ জন চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদেরস ৩ চেয়ারম্যান অথবা প্রতিনিধিগণ, তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকগণ, তিন সার্কেল চিফগণ, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের একজন প্রতিনিধি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একজন প্রতিনিধি, প্রত্যাগত শরণার্থীদের একজন প্রতিনিধি , একজন বাঙালি প্রতিনিধি এবং সদস্য সচিব রয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার।

টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কখনো প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় এবং কখনো সচিব বা সিনিয়র সচিব মর্যাদার একজন কর্মকর্তা হন। তবে চেয়ারম্যান পদটি বাধ্যতামূলকভাবে উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। বর্তমানে এই টাস্কফোর্সে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় সুদত্ত চাকমা।

টাস্কফোর্সের দায়িত্ব ও ভূমিকা: ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে গঠিত হয় “ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্স”। এর মূল দায়িত্ব: ১৯৮৬–১৯৯৭ সালের মধ্যে ভারতে আশ্রয় নেওয়া উপজাতীয় শরণার্থীদের তালিকা নির্ধারণ। তাদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন। একই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের চিহ্নিতকরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা।

পর্যালোচনা করে দেখা যায়- এই টাস্কফোর্সকে মুলত মোটাদাগে ২ টা কাজ দেয়া হয়েছে। এক. ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন করা। দুই. অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন করা। তারা প্রথম বা ১ নং কাজটি সম্পন্ন করেছেন। ফলে বর্তমানে টাস্কফোর্সের কাছে দ্বিতীয় বা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন করার কাজটি বাকি রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো কমিশন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন করার কাজটি কতটুকু এগিয়েছেন?

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়- আসলে এ বিষয়ে এ টাস্কফোর্স আছে নানা দ্বিধাদ্বন্দে। যদিও এ টাস্কফোর্সের কার্যক্রমের আওতায় প্রতিবছর ১২,২২৩ ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী পরিবারের মধ্যে ১৫,৫১৪.২৬৯ মেট্রিক টন চাল খাদ্য শস্য হিসেবে রেশন বিতরণ করা হয়। দেশে ফেরত আসার পর প্রত্যাগত শরণার্থীদের এ রেশন বিতরণ ছয় মাসের জন্য নির্ধারিত থাকলেও গত ২৮ বছর ধরে এই রেশন বিতরণ কার্যক্রম চলছে উপজাতীয় শরণার্থীদের মাঝে। পরিবারগুলোকে রেশন বিতরণসহ ২০ দফা প্যাকেজের অধিকাংশ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

বিশ দফা প্যাকেজের আওতায় গৃহ নির্মাণ, কৃষি অনুদান ,হালের গরু ও ঢেউটিন প্রদান, ভূমিহীনদের গাভী প্রদান , কৃষি ঋণ মওকুফ, অন্যান্য সরকারি ব্যাংক, বোর্ড, সংস্থার ঋণ মওকুফ, জমি ফেরত, চাকরিতে পুনর্বহাল ও ক্ষতিপূরণ প্রদান, চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারসহ বয়স শিথিল করা, ফৌজদারী মামলা প্রত্যাহার ও সাধারণ ক্ষমা সহ অধিকাংশ দাবি পূরণ করা হয় উপজাতীয় শরণার্থীদের।

কিন্তু প্রথম অংশ নিয়ে কাজ করলেও দ্বিতীয় অংশ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি। সংশ্লিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে- এ টাস্কফোর্স অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের বিষয়ে উপজাতীয় উদ্বাস্তু পরিবারদের তালিকা অন্তর্ভুক্তকরণ ছাড়া তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি। বিশেষ করে বাঙালি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বিষয়ে টাস্কফোর্সের অনাগ্রহ এবং সন্তু লারমা তথা জনসংহতি সমিতির বারবার আপত্তি এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। পূর্ববর্তী সভাগুলোতে বাঙালি উদ্বাস্তুদের অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও পরবর্তীতে তা বাতিল করা হয়েছে। ফলে ৫৭,৬৯২ বাঙালি উদ্বাস্তু পরিবার আজও পুনর্বাসনের অপেক্ষায় রয়েছে।

এই বাস্তবতায়, টাস্কফোর্সের কার্যক্রমকে অনেকেই পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন। ভূমি কমিশনের অকার্যকারিতা এবং বাঙালি প্রতিনিধির অনুপস্থিতি এই পক্ষপাতকে আরও প্রকট করে তুলেছে। সচেতন মহল মনে করেন, টাস্কফোর্সকে কার্যকর করতে হলে—এর কাঠামো পুনর্গঠন, সকল জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত এবং ভূমি সমস্যার সমাধান জরুরি।

মূলত ভূমি কমিশন কর্তৃক ভূমি জটিলতা নিরসন করলে এই টাস্কফোর্স অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন কাজে উদ্যোগী হতে পারবে। তবে এ টাস্কফোর্স বাঙালি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পরিবারদের পুনর্বাসনের বিষয়ে আগ্রহী নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে।

টাস্কফোর্সের কার্যবিবরণী থেকে দেখা যায়- প্রাক্তন চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরার সভাপতিত্বে খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে ২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর তারিখের টাস্কফোর্স সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ৮৯,২৮০ উপজাতীয় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত পরিবার এবং ৫৭,৬৯২ অ- উপজাতীয় তথা বাঙালি উদ্বাস্তু পরিবারের তালিকার সংখ্যার বিষয়ে পুনর্বাসনের নিমিত্তে উপস্থাপন করা হয়। যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা’র উক্ত প্রথম সভায় উপস্থাপিত বাঙালি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের বিষয়ে ২০১০ সালের গত ২৭ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত তার দ্বিতীয় টাস্কফোর্স সভায় জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি লক্ষ্মীপ্রসাদ চাকমা উক্ত বাঙালি পরিবারগুলোকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করার আহ্বান জানান। যদিও এ সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, তৎকালীন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক ও জিওসির প্রতিনিধি ‘অ-উপজাতীয়দের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত হিসেবে চিহ্নিত করে এর প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব তুলে ধরে তাদের অন্তর্ভুক্তি যথাযথ হয়েছে মর্মে অভিমত প্রদান করেন। তারা আরও বলেন – যিনি বাস্তু থেকে উৎখাত হয়েছেন তিনিই উদ্বাস্তু । এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয় সকলকে অন্তর্ভুক্ত রাখা বাঞ্ছনীয়’। তারপরও এ সভায় ১১( চ )সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ” অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা কি হবে সে বিষয়ে নির্দেশনার জন্য বিষয়টি পরবর্তী পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পরিবীক্ষন কমিটির সভায় উপস্থাপন করার জন্য রাখা হয়।

২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখের  চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা’র টাস্কফোর্স ৩য় সভায়ও অ-উপজাতীয় পরিবারকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করার পুনরায় আহ্বান জানান জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি লক্ষীপ্রসাদ চাকমা। পরপর ২য় ও ৩য় টাস্কফোর্স সভায় জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধির আপত্তির পর ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা’র ৪র্থ টাস্কফোর্স সভায় জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা ) নিজে উপস্থিত থেকে পূর্ববর্তী ৩য় সভার সিদ্ধান্ত ১২(ঘ) – ‘অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত এর সংজ্ঞা কী হবে সে বিষয়ে নির্দেশনার জন্য বিষয়টি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হবে’ সিদ্ধান্তটি বাতিল করেন।

এই সভায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সংজ্ঞা নির্ণয়কল্পে সিদ্ধান্ত ৬(ক) মতে বলা হয়- ‘আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু’র সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের বিগত ২৭/৬/১৯৯৮ খ্রি. সভার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হবে।’ উল্লেখ্য ২৭/৬/ ১৯৯৮ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্স সভার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞার বিষয়ে সিদ্ধান্ত ‘ক’ মতে বলা হয়- ‘১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট হতে ১০ আগস্ট ১৯৯২ ইং পর্যন্ত (অস্ত্র বিরতির শুরুর দিন) সময় কালে পার্বত্য চট্টগ্রামে (খাগড়াছড়ি রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান) বিরাজিত অস্থিতিশীল ও অশান্ত পরিস্থিতির কারণে যে সকল উপজাতি নিজ গ্রাম, মৌজা, অঞ্চল ত্যাগ করে স্বদেশের মধ্যে অন্যত্র চলে গেছেন বা চলে যেতে বাধ্য হয়েছে তারা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে যে সকল অ-উপজাতীয় ব্যক্তিরা উপরোক্ত সময়ে বিরাজিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি একই সাথে ভিন্নভাবে বিবেচনা করা হবে।’ এই সংজ্ঞার আওতায় অ-উপজাতীয় তথা বাঙালি উদ্বাস্তু পরিবার যারা উক্ত অশান্ত অস্থিতিশীল সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে এ ৪র্থ টাস্কফোর্স সভায় ৬(খ), ৬(গ) মতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে , অ-উপজাতীয় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে (এ সভার কার্যবিবরণীতে মুদ্রণ বিভ্রাট জনিত কারণে অউপজাতীয় শরণার্থী উল্লেখ করা হয়) সরকার ভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যবস্থা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।’ কিন্তু আবারো সন্তু লারমা গত ২৯ /৯ /২০১৪ খ্রি. তারিখে পরবর্তী ৫ম সভায় উপস্থিত হয়ে ৪র্থ টাস্কফোর্স সভার ৬(খ এবং) ৬(গ) সিদ্ধান্তের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে উক্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করান।

অর্থাৎ ৮৯,২৮০ উপজাতীয় উদ্বাস্তু পরিবারের পুনর্বাসনের বিষয়টি বহাল থাকবে পাশাপাশি ৫৭,৬৯২ অ-উপজাতীয় তথা বাঙালি পরিবারের পুনর্বাসনের বিষয়টি বাতিল করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম সভাগুলোতে বাঙালি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের বিষয়ে নানা অপকৌশলে আর কোন আলোচনা করতে দেয়া হয়নি। তবে বিগত ২২/১০/২০১৯ খ্রি. তারিখে টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের ১০ম সভায় জিওসির প্রতিনিধি মেজর মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ৫ম সভায় বাদ দেয়ার বিষয়টি উত্থাপন করলে তাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে মানবিক কারণে আলাদাভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে মর্মে এ সভায় ১১(খ) সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গত ২৪/ ৯/ ২০২৩ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের ১১তম সভায় আবারো অ-উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পদক্ষেপের প্রশ্নে যৌক্তিকতা উপস্থাপিত হলে এই সভার সিদ্ধান্ত ১- এ বলা হয় ‘… অ-উপজাতীয়দের নতুন করে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত আগামী সভায় সকল সদস্যদের উপস্থিতিতে চূড়ান্ত করা হবে।’

এদিকে আগামী ২২ অক্টোবর তারিখে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সকাল ১১.০০টায় বিগত সরকারের আমলে নিয়োগকৃত চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমা’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পরবর্তী টাস্কফোর্স সভা।

১৬ সদস্যের এই টাস্কফোর্সে বাঙালি সদস্যের একমাত্র পদটি পদত্যাগজনিত কারণে বর্তমানে শূন্য রয়েছে। বাঙালি সদস্যের অনুপস্থিতিতে বাঙালি উদ্বাস্তুর অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কিভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে তা দেখার অপেক্ষায় আছে পার্বত্যবাসী। নাকি সন্তু লারমা গংদের প্রবল আপত্তি, বিরোধীতায় অপকৌশলে বাদ যাবে বাঙালি উদ্বাস্তদের পুনর্বাসনের বিষয়টি?

টাস্কফোর্সের ১২তম সভা আহ্বান ঘিরে বিতর্ক : আগামী ২২ অক্টোবর স(২০২৫ সাল) চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিতব্য টাস্কফোর্সের ১২তম সভা নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে বর্তমানে সিনিয়র সচিব মর্যাদায় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত সুদত্ত চাকমা। অথচ টাস্কফোর্সে ফ্যাসিস্ট কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় একমাত্র বাঙালি প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট মহিউদ্দীন কবীর পদত্যাগ করলে ফ্যাসিস্ট নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্যরা পদত্যাগ করেননি। অপরদিকে শূন্যপদে নতুন করে কোনো বাঙালি সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় বাঙালি প্রতিনিধিবিহীন একটি পক্ষপাতদুষ্ট সভা আহ্বান করা সংবিধান ও প্রশাসনিক ন্যায়ের পরিপন্থী।

কয়েকটি সংগঠন এ ইস্যুতে আন্দোলনের হুসিয়ারি ও বিবৃতি দিয়েছে। তারা দাবি করেন- একই সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যখন নিজেকে বৈধ মনে করেন, অথচ বাঙালি সদস্য ‘ফ্যাসিস্ট সরকারি নিয়োগ অবৈধ’ বলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, তখন এই দ্বৈতনীতি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের নীতি ফ্যাসিবাদী ও বৈষম্যমূলক।

বিবৃতিতে নেতারা দাবি করে বলেন- তাদের কাছে তথ্য আছে, আসন্ন সভায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বাঙালিদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে, যা পার্বত্য অঞ্চলে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। তারা এই নীলনকশা বন্ধের জোর দাবি জানিয়েছেন।

এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে- টাস্কফোর্সের বাঙালি প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট মহিউদ্দীন কবীর ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের নিয়োগ’ বলে পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমা এবং অন্য সদস্যও আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত। কিন্তু তারা পদত্যাগ করেননি। এই দ্বৈতনীতি প্রশ্ন তোলে—একই সরকারের নিয়োগে একজন অবৈধ, অন্যজন বৈধ কীভাবে?

বাঙালি প্রতিনিধিবিহীন এই সভায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বাঙালিদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এটি শুধু পক্ষপাত নয়, বরং সংবিধান ও প্রশাসনিক ন্যায়ের পরিপন্থী।

ছাত্রসংগঠনের প্রতিবাদ ও দাবি: পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদ, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পার্বত্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সংগঠন, এই সভার বিরুদ্ধে এক বিবৃতিতে প্রতিবাদ জানিয়ে ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। দাবিগুলো হল- ১. অবিলম্বে টাস্কফোর্স সভা স্থগিত করতে হবে। ২. ফ্যাসিস্ট নিয়োগ বাতিল করে নতুন করে টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। ৩. বাঙালি প্রতিনিধি পুনঃনিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যাবে না। ৪. অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বাঙালিদের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার পদক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল জাতিগোষ্ঠীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে—এই বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে গণআন্দোলন ও সাংবিধানিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।

পক্ষপাতের নেপথ্যে রাজনৈতিক এজেন্ডা?

বিশ্লেষকদের মতে, টাস্কফোর্সের মাধ্যমে একটি বিশেষ গোষ্ঠী নিজেদের শরণার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায় করতে চায়। অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বাঙালিদের বাদ দিয়ে ভূমি ও সুবিধা একচেটিয়া করতে চায়। পার্বত্য চুক্তির ধারা ব্যবহার করে আদিবাসী রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি তৈরি করতে চায়। এই প্রক্রিয়ায় বাঙালি জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিক করে পার্বত্য চট্টগ্রামে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।

রাষ্ট্রীয় নীতির প্রশ্নে দ্বৈতনীতি: বাংলাদেশের সংবিধান ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৭: আইনের দৃষ্টিতে সমতা, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার সকলের রয়েছে। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি তার ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি বা সামাজিক অবস্থানের কারণে আইনের নিচে আলাদা আচরণের শিকার হবেন না।

অনুচ্ছেদ ২৮: ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে বৈষম্য নিষিদ্ধ।

(১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। (২) নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হবে। (৩) ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক বিধান থাকতে পারে। (৪) রাষ্ট্র নারীদের, শিশুদের বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

অনুচ্ছেদ ২৯: সরকারি চাকরিতে সুযোগের সমতা। (১) সকল নাগরিকের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সমান সুযোগ থাকবে। (২) চাকরির ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে। (৩) পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত পদ বা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

কিন্তু টাস্কফোর্সে বাঙালি প্রতিনিধি ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ এই নীতির পরিপন্থী। এটি শুধু প্রশাসনিক নয়, রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান।

পরিশেষে উপসংহারে বলা যায়- ‘ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্স’ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাঠামো। কিন্তু এই কাঠামো যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে তা জাতীয় সংহতি ও পার্বত্য চুক্তির মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করবে। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, সাংবিধানিক ন্যায় ও মানবাধিকারের পরিপন্থী হবে।

এখনই সময়—এই টাস্কফোর্সকে পুনর্গঠন করে ন্যায়ের ভিত্তিতে সকল জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্য, সংহতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা পায়। পুনর্বাসিত হতে পারে উদ্বাস্তু উপজাতি এবং বাঙালি জনগোষ্ঠি।

লেখক: সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

 

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন