পাহাড় এখন চাঁদাবাজদের নিরাপদ আবাসভুমি: অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে শান্তিচুক্তির ১৬ বছরে ৩৪৪ নেতাকর্মী নিহত

arun

দুলাল হোসেন, পার্বত্যনিউজ ডটকম:
পাহাড় এখন চাঁদাবাজদের নিরাপদ আবাসভূমি। মুখে ও কাগজ কলমে আদর্শেও কথা বললেও পার্বত্যাঞ্চলের আঞ্চলিক কার্যত চাঁদা আদায় ও চাঁদা মহাল দখলের যুদ্ধে পার্বত্যাঞ্চলের আঞ্চলিক দলগুলো পারস্পারিক দ্বন্দ্বে শান্তিচুক্তির ১৬ বছরে ৩৪৪ নেতাকর্মী নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। এসর্ম্পকে ইউপিডিএফ’র প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নিরন চাকমা প্রতিবেদককে বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকে গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের ২৫৪ জন নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের সশস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন বলে দাবী জানান। অন্যদিকে জেএসএস’র কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা জানান, শান্তিচুক্তির পর থেকে তাদের ৯০ জন নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়েছে।
 
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ১৬ বছর ফেরিয়ে গেলেও এখনো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চলছে পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষ। পার্বত্য চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে দিনদিন বেড়ে চলছে অপহরণ, গুম, রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষের মতো ঘটনা। পাহাড় এখন চাঁদাবাজদের নিরাপদ আবাসভুমি। চাঁদাবাজদের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা সরকারী বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ সরকারী প্রতিষ্ঠান টেলিটকের ৫ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অপহরণ করে ৩ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবী করেছে। ফলে পাহাড়ে বসবাসরত সাধারণ পাহাড়ী ও বাঙালীরা ভুগছে চরম আতঙ্কে।

১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এখনো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি পার্বত্যাঞ্চলে। এখানকার আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো নানাভাবে বিভক্ত হয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চালাচ্ছে রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষ। এসব সংর্ঘষে পক্ষ-প্রতিপক্ষের নেতাকর্মী ও সর্মথকরা নিহত ও আহত হচ্ছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে বর্তমান সরকার(আওয়ামীলীগ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(জেএসএস) এর জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার(সন্তু লারমা) সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যেটি পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি নামে পরিচিত। শান্তিচুক্তির পক্ষে তৎকালীন সময়ে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ পার্বত্য শান্তিচুক্তির স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীতে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। কিন্তু র্দীঘ ১৬ বছর পরও শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো চলছে সরকারের সাথে জেএসএস ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ। শান্তিচুক্তিকে কালো চুক্তি বলে সেই থেকে(চুক্তি স¦াক্ষরের পর) এর বিরোধীতা করে যাচ্ছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)। অন্যদিকে মূলধারার জেএসএস ভেঙ্গে সংস্কারপন্থী (এমএন লারমা গ্রুপ) নামে অপর একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। জেএসএস, সংস্কারপন্থী এমএন লারমা ও ইউপিডিএফ এই তিনটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই করছে প্রতিনিয়ত।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় যে, পার্বত্য শান্তিচুক্তির ১৬ বছরে পাহাড়ী আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ৩৪৪ নেতাকর্মী নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। এসর্ম্পকে ইউপিডিএফ’র প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নিরন চাকমা প্রতিবেদককে বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকে গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের ২৫৪জন নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের সশস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন বলে দাবী জানান। অন্যদিকে জেএসএস’র কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা জানান, শান্তিচুক্তির পর থেকে তাদের ৯০ জন নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়েছে।

 অন্যদিকে পার্বত্যাঞ্চলে সক্রিয় বাঙালী সংগঠনগুলোও শান্তিচুক্তির বিভিন্ন ধারার বিরোধীতা করছে। পার্বত্যাঞ্চলে সক্রিয় বাঙালী সংগঠন গুলো হচ্ছে সমঅধিকার আন্দোলন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাঙালী ছাত্র পরিষদ, বাঙালী কৃষক শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ ও পার্বত্য নাগরিক পরিষদ। সম্প্রতি সরকার পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধন করে মন্ত্রী পরিষদে অনুমোদন হবার পর থেকে পাহাড়ে বাঙালী সংগঠনগুলো হরতাল, অবরোধ কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে। পার্বত্যাঞ্চলের বাঙালীদের মূল বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হল ভূমি বিরোধ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৯ ও ১৯৯২সাল এবং পরে কয়েক দফায় বাঙালীদের পার্বত্যাঞ্চলে সরকার বসবাস করতে পূর্ণবাসিত করেন। পূর্ণবাসিত লোকদের সমাজ পার্বত্যাঞ্চলে গুচ্ছগ্রাম নামে পরিচিত। এইসব গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের সরকার প্রতি পরিবার প্রতি ৫একর করে ভূমি বন্দোবস্তী দিলেও অধিকাংশ পরিবারই তাদের ৫একর ভূমি পুরোপুরি পাননি। তাই এইখানে বসবাসরত বাঙালীরা তাদের ভূমির অধিকার ফিরে পেতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। গুচ্ছগ্রামের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করে বলেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের আইন সংশোধনের পূর্বে যেন ভূমির জরিপ চালিয়ে এখানকার ভূমির সমস্যার সমাধান করেন। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির সমস্যা সমাধান হবে। পার্বত্যাঞ্চলে বাঙালী ও পাহাড়ী সংগঠনগুলো তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে নানা কর্মসূচী পালন করে চলেছে প্রতিনিয়ত।

গত ৮ জুলাই বাংলাদেশ সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি পার্বত্য রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পরিদর্শন করেন। উচ্চ পর্যায়ের কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর বলেন, পার্বত্যাঞ্চলের সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার আন্তরিক। খাগড়াছড়িতে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় পার্বত্যাঞ্চলে চাদাঁবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই রাষ্ট্রয়াত্ত মোবাইল কোম্পানী টেলিটকের টাওয়ার বসাতে গিয়ে ৪ জন ব্যাক্তি অপহরণের শিকার হন। এর পর থেকে ১৩দিন পার হয়ে গেলেও সরকার অপহৃতদের উদ্ধারে কোনো কূল কিনারা করতে পারেনি।
 
১৯৯৭ সালে সরকার শান্তির পায়রা উড়িয়ে শান্তিচুক্তি করেছিল। কিন্তু শান্তি আসেনি পার্বত্য চট্টগ্রামে। বরং পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে দৃশ্যমান। কাজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এমনটাই আশা করে পাবর্ত্যাঞ্চলের অধিবাসীরা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন