বঙ্গবন্ধু, বাকশাল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কিছু কথা ও কিছু স্মৃতি

fec-image

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির এক বিশেষ যুগ সন্ধিক্ষণে তৎকালীন বিরাজমান বাস্তবতা মোকাবেলার নিমিত্তে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দল, শ্রেণি পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা প্রমুখকে নিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ সংক্ষেপে বাকশাল নামে একটি জাতীয় দল গঠনের ঘোষণা দেন ১৯৭৫ সালের ৬ জুন। তিন পার্বত্য জেলায় ৩ জন জেলা গভর্নর এবং ৩ জন বাকশালের সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় গভর্নর ছিলেন মং রাজা মংপ্রু সাইন চৌধুরী (অনারারী কর্নেল, আখাউড়া রণাঙ্গন) এবং বাকশালের সেক্রেটারি ছিলেন আমার বাবা অনন্ত বিহারী খীসা। একইভাবে রাঙ্গামাটিতে ছিলেন এ.এম.এ. কাদের (তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক) এবং চারু বিকাশ চাকমা। বান্দরবানে ছিলেন বোমাং রাজা মংশোয়ে প্রু চৌধুরী এবং কে.এস. প্রু চৌধুরী।

১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এতে বঙ্গবন্ধু গভর্নরদের উদ্দেশ্যে বাকশাল সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন। একইভাবে ৮ আগস্ট হতে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাকশালের জেলা সেক্রেটারিদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। যদিও ১৪ আগস্ট ভোররাতে (১৫ আগস্ট) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ায় ১৫ আগস্ট বাকশালের সেক্রেটারিদের উদ্দেশ্যে যুগান্তকারী ভাষণ দিতে পারেন নি। নতুবা জাতি বাকশাল সম্পর্কে উনার নতুন নতুন কর্ম পরিকল্পনা জানতে পারতো।

আমার বাবা অনন্ত বিহারী খীসা যেহেতু বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিযুক্ত খাগড়াছড়ি জেলা বাকশালের সেক্রেটারি ছিলেন, তাই বাকশাল সম্পর্কে বাবার সাথে আলাপ করেছি। বাবা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু নাকি তৎকালীন সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা (মঞ্জু কাকা) কে বলেছেন, ‘লারমা আগে আমি তোমাদেরকে ভুল বুঝেছি। এখন আমি বুঝতে পেরেছি। আমি বাকশাল করতে যাচ্ছি। এতে তোমাদের (পার্বত্য চট্টগ্রামের) সমস্যা সমাধান করে দেবো। তোমাদের আর কোন সমস্যা থাকবে না।’ এখানে উল্লেখ্য যে, পাহাড়িদের মধ্যে এম.এন. লারমা (মঞ্জু কাকা) সবার আগে বাকশালে যোগ দেন। উনার পরে বাবা, চারু বিকাশ চাকমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, কে.এস. প্রু চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বাকশালে যোগ দেন।

সত্যি কথা বলতে কি, বঙ্গবন্ধু যদি পঁচাত্তরে কুচক্রীদের দ্বারা নিহত না হতেন, তবে তাঁর জীবদ্দশাই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসতো। এত রক্তপাত ও হানাহানি হতো না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাহাড়িদের জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে ‘কোটা সিস্টেম’ চালু করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু পাহাড়িদেরকে বাঙালিদের সমপর্যায়ে আনার জন্য শুধু শিক্ষা ও চাকরিতে কোটা সিস্টেম নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ ও কিউবাতে অনেক পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীকে স্কলারশিপ দিয়ে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড-এর ধারণাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মস্তিক প্রসূত। পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘যৌথ খামার সিস্টেম’ (সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা) ছিল বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লবের ধারণা প্রসূত। পাহাড়িদের অনেকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’ ও কোটা সিস্টেম বা বিদেশ স্কলারশিপের জন্য জেনারেল জিয়াকে ক্রেডিট দিতে চান, কিন্তু জেনারেল জিয়া সেগুলো করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাজের ধারাবাহিকতা হিসেবে। খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকার ‘স্বনির্ভর প্রকল্প’ বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বাকশালের কর্মসূচির ধারাবাহিক রূপ মাত্র।

বাবা ছাত্রজীবনে কমিউনিস্ট পার্টি করলেও বাকশালে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নেতা ও আদর্শ হিসেবে মনে করতেন। তাই জেনারেল জিয়া বঙ্গভবনে ডেকে বিএনপিতে যোগ দিয়ে খাগড়াছড়ি আসনে জাসদের উপেন্দ্র লাল চাকমার বিপক্ষে দাঁড়াতে অনুরোধ করলে সে অনুরোধ প্রত্যাখান করে রাজনীতি থেকে চিরতরে অবসর বা সরে দাঁড়ান। বাবার সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সাংবাদিক ও প্রধানমন্ত্রীর এক সময়কার প্রেস সচিব জাওয়াদুল করিম। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘রাজনীতি’ ও ‘ডববশষু ঐবৎধষফ’ ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শবাহী মশালস্বরূপ।

আমার আজও মনে পড়ে, যেদিন বঙ্গবন্ধু মারা যান, সেদিন রেডিওতে মেজর ডালিমের ঘোষণা বাজছিল। রাজধানী ঢাকা ছিল বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে এবং কারফিউ বলবৎ ছিল। আমার মনে পড়ে, সেদিনের কথা যখন সিনিয়র ভাইয়েরা বলতো তোমার বাবা বাকশালের ট্রেনিং শেষে সরকারি দায়িত্ব পেয়ে গাড়ি নিয়ে ফিরবেন। তখন খুশি হতাম গাড়িতে চড়তে পারবো বলে, কারণ খুব ছোট ছিলাম তাই। কিন্তু আজ সবাই ভয় দেখায়, ‘তোমার বাবা আর ঢাকা থেকে ফিরে আসবে না। আর্মিরা গুলি করে মারবে।’ ভয়ে গা শিউরে উঠতো। মাকে জিজ্ঞেস করলে মা উদাস হয়ে সকরুণ চাহনিতে বলতো, না, তোমার বাবা ঠিকই ফিরে আসবে। উপরওয়ালার অশেষ কৃপায় কারফিউ এর রাতে পুরনো ঢাকায় চারু বাবুর ছোট ভাইয়ের বন্ধুর বাসায় আত্মগোপন করে একদিন বাবা পিতৃপ্রদত্ত জান নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছিলেন একবুক হতাশা ও হাহাকার নিয়ে। কারণ বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দেয়া সেই অকুতোভয় বাঙালির মৃত্যু ঘটেছে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হাতে নয়, বরং স্বজাতি কুচক্রী, সুগভীর ষড়যন্ত্র ও কতিপয় বিপদগামী সেনা সদস্যদের অবিমৃষ্যকারিতায়।

বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড ও কিছু কথা, কিছু স্মৃতি

জেনারেল জিয়ার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড (নাম সুস্পষ্টভাবে মনে পড়ছে না) কে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ানে চাকরি ন্যস্ত করে খাগড়াছড়ি জেলার খেজুর বাগানে (উপজেলা মাঠ) পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি লোকমুখে বাবা বাকশালের সেক্রেটারি জেনে দেখা করতে আসেন এবং বাবার সাথে অনেক সুখ-দুঃখের আলাপ করেন। ড্রয়িং রুমের সেই আলাপ আমি ছোট হলেও ড্রয়িং রুমের লাগোয়া প্যাসেজে রাখা সাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনতাম। বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ পরবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে দু’টি গল্প (বাস্তব ঘটনা) বলেছিলেন, তা আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। ঘটনার সত্য মিথ্যার দায় বর্ণনাকারী বডি গার্ডের। তিনি বলেছিলেন, তার বাড়ি গোপালগঞ্জ। বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ডের কাহিনী শেয়ার করার আগে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের একটা অংশ কোট করতে চাই; তিনি বলেছেন, ‘এতো চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গেছে, কিন্তু চোর রেখে গেছে। এই চোর তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম।’ বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ পরবর্তী একটি ঘটনার কথা স্মরণ করে বলেছেন, একদিন বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বর হতে বঙ্গভবনে যাচ্ছিলেন। তখন ফ্লাগযুক্ত গাড়ি দেখে বেশি ভিক্ষা পাওয়ার আশায় ৪/৫ জন পঙ্গু ভিক্ষুক হাত ধরাধরি করে রাস্তা ব্লক করে। বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে নেমে কারণ জানতে চাইলে তারা অভাব ও অভুক্ত থাকার কথা জানায়। বঙ্গবন্ধু পাঞ্জাবীর পকেটে হাতড়ে তাৎক্ষণিক টাকা না থাকায় বঙ্গভবনে গিয়ে টাকা পাঠাবেন এবং ঐ রাস্তায় অপেক্ষা করতে বলেন। বঙ্গবন্ধু যথারীতি বঙ্গভবনে গিয়ে পাঁচজন ভিক্ষুকের জন্য ১০০ টাকা করে ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বডিগার্ডের জবানীতে জানা গেল যে, যাদের মাধ্যমে তিনি টাকা পাঠান, তারা ঐ রাস্তায় এসে লাঠিপেটা করেন এই বলে যে, তোমরা জান তোমরা কার গাড়ি আটকিয়েছ? তারা হাউমাউ করে বললো যে, তারা জানে না। এরপর বেদম প্রহার করে এদের হাতে ২৫ টাকা করে ধরিয়ে দিলে ভিক্ষুকরা খুশিতে কেঁদে ফেলে এবং পা ধরে সালাম করে সন্তুষ্টচিত্তে চলে যায়। কারণ যদি চালের সের ৮ টাকা হয়, তবে নিশ্চিত ৩ সের চাল পাওয়া যাবে। দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর পাঠানো ৫০০ টাকার মধ্যে ১২৫ টাকা দেয়া হলেও বাকি ৩৭৫ টাকা ব্যক্তিগত স্টাফরা নয় ছয় করেছে বলে অনুমান করা যায়। এরকম নীতিহীন লোকের জন্য মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর সততা, মহানুভবতা সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করতে পারতো না।

এরকম আরেকটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন বঙ্গবন্ধুর কথিত বডিগার্ড। বলাবাহুল্য সেই ঘটনাও চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ পরবর্তী ক্রান্তিকালের। তার বর্ণনা মতে, বঙ্গবন্ধু নাকি কৌশলে মানুষের সুখ দুঃখ বোঝার চেষ্টা করতেন। একদিন বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বর হতে রওনা হয়ে গাড়ি ‘স্লো মোশনে’ রেখে মার্কেট ও মানুষের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ দেখলেন, তাঁর স্কুল শিক্ষক বাজারে দরদাম করছিলেন পরক্ষণেই সেই মাল ফেরত দিচ্ছিলেন। এভাবে বেশ কয়েকবার দরদাম করে ফেরত দেয়ায় বঙ্গবন্ধু সম্ভবত তাঁর স্যারের আর্থিক দূরবস্থা উপলব্ধি করলেন। তিনি আবারও ব্যক্তিগত স্টাফ পাঠিয়ে ঐ স্যারকে ১০০০ টাকা পাঠিয়ে দিলেন। যথারীতি ব্যক্তিগত স্টাফরা তাঁর শিক্ষককে ৬০০ টাকা দিলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেও পারলেন না। শিক্ষক মানুষ টাকা না থাকলেও ‘ইগো’ সমস্যা থাকায় ৩২ নম্বরে চলে আসলেন। বঙ্গবন্ধু যথারীতি কদমবুচি করে যথেষ্ট খাতির যতœ করলেন। তাঁর শিক্ষক চলে যাবার সময় পাঞ্জাবীর পকেট হতে ৬০০ টাকা বের করে দিয়ে বললেন, মুজিব তুমি যে ৬০০ টাকা পাঠিয়েছো, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমিতো শিক্ষক মানুষ। আমার অত টাকার দরকার নেই। বলে উনি চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুতো হতভম্ব। তাঁর শিক্ষক এ কি বলেন? দিলাম হাজার টাকা, হয়ে গেলো ছয়শত টাকা। তারপর উনি সমস্ত ব্যক্তিগত স্টাফদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এখান হতে গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার দূরত্ব কত? স্টাফরা দূরত্ব জানালে তিনি বঙ্গভবন হতে অমুক জায়গায় যদি একহাজার টাকা ছয়শত টাকা হয়, তবে আমার গ্রামের বাড়িতে একহাজার টাকা পাঠালে ঐ টাকা কত হবে তোমরা বলো? সবাই হতভম্ব। কিন্তু যারা করেছে তারা নিশ্চয় বুঝেছে। বিশাল হৃদয়ের মানুষ সেদিনও কাউকে শাস্তি দেননি। শুধু উদাহরণ দিয়ে লজ্জা দিতে চেয়েছেন মাত্র।

লেখক: প্রিন্সিপাল, কক্সবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও কারিগরি শিক্ষা বিষয়ক গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন