যেসব আমলে রমজানকে বিদায় জানাব

fec-image

বিদায় নিচ্ছে মহিমান্বিত মাস রমজান। রমজানের বিদায়বেলায় মুমিনের হৃদয়ে জাগ্রত হয় আশা ও ভয়। একদিকে সে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ লাভে আশাবাদী হয়, অন্যদিকে সে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে ভীত থাকে। রমজানের বিদায়বেলায় মুমিন তার অর্জন ও ব্যর্থতার হিসাব করে। সে বিনীত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে ক্ষমা ও দয়া প্রার্থনা করে।

মুমিন কেন চিন্তিত হয় : রমজানের বিদায়লগ্নে মুমিন চিন্তিত হয়। কেননা মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলাধূসরিত হোক, যে রমজান পেল এবং তার গুনাহ মাফ করার আগেই তা বিদায় নিল।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৪৫)

অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে বরকতময় মাস রমজান আগমন করল। আল্লাহ তোমাদের ওপর এই মাসের রোজা ফরজ করেছেন, এই মাসে জান্নাতের দরজা খোলা হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে সত্যিই বঞ্চিত হলো।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২১০৮)

পূর্বসূরিদের চিন্তা : রমজানের শেষভাগে পূর্বসূরি আলেমরা চিন্তিত হতেন। বিশেষত রমজানের শেষভাগে তাদের ব্যাপারে উদ্বেগ বেড়ে যেত। রমজানের শেষভাগে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন, ‘আমাদের মধ্যে কার রোজা কবুল হলো, আমরা তাঁকে অভিনন্দন জানাব এবং কে বঞ্চিত হলো তাঁর জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করব। হে সৌভাগ্যবান, যার রোজা কবুল হয়েছে তোমাকে অভিনন্দন এবং হে হতভাগা, যার রোজা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, আল্লাহ তোমার পাপ মার্জনা করুন।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ২১০)

একটি মুহূর্ত যেন নষ্ট না হয় : রমজানের বিদায়লগ্নে মুমিনের প্রধান লক্ষ্য থাকে অবশিষ্ট সময়ের একটি মুহূর্তও যেন নষ্ট না হয়। বিশেষত রমজানের ফল ও ফসল ঘরে তোলার চেষ্টা করতে হবে। যেমন কোনো এক আরব কবি বলেছেন, ‘হে উদাসীন ব্যক্তি, রমজানের রাত অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে আর তোমার পাপের পরিমাণ বাড়ছে! তুমি এখনই থামো এবং অনুতপ্ত হয়ে কান্না করো/রমজানের অবশিষ্ট সময়টুকুকে তুমি মূল্যবান মনে করো, কল্যাণের যে ফল তুমি চাষাবাদ করেছ তা ঝরে পড়া থেকে রক্ষা করো।’ (আর-রাউদুল ফায়িক, পৃষ্ঠা ৫৭

মুমিন ব্যক্তি রমজানের শেষভাগে নিম্নোক্ত আমলের মাধ্যমে তাকে বিদায় জানাবে।

১. ক্ষমাপ্রার্থনা করা : মুমিন রমজানে হয়ে যাওয়া ভুল-ত্রুটি ও বিচ্যুতির জন্য অনুতপ্ত হবে এবং আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। বিশেষত রাতের শেষভাগে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা রাতের খুব সামান্য অংশই ঘুমাত এবং শেষ রাতে (সাহরির সময়) তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত ১৭-১৮)

২. সাহায্য চাওয়া : পার্থিব ও পরকালীন জীবনের সাফল্য বান্দার প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে না; বরং আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করে। তাই মুমিন রমজানের শেষভাগে প্রার্থনা করে যেন কল্যাণের পথে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। সে দোয়া করে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্য লঙ্ঘনপ্রবণ করবে না এবং তোমার কাছ থেকে আমাদের করুণা দান করো। নিশ্চয়ই তুমি মহাদাতা।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৮)

৩. আল্লাহভীতির অঙ্গীকার : রমজানের শেষভাগে মুমিন আল্লাহর দরবারে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতির জীবন যাপনের অঙ্গীকার করবে। কেননা তাকওয়া অর্জন রোজা পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)

৪. ভালো কাজের অঙ্গীকার : রমজানের বিদায়লগ্নে মুমিন নেককাজ করা এবং পাপকাজ পরিহার করার অঙ্গীকার করবে। কেননা হাদিসে এসেছে, ‘(এ মাসে) একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেন—হে কল্যাণ অন্বেষণকারী, অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত, বিরত হও।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬৮২)

৫. নৈতিক জীবনের অঙ্গীকার : চারিত্রিক উন্নয়ন ও নৈতিক জীবন লাভও রমজানের রোজা পালনের একটি উদ্দেশ্য। তাই ব্যক্তি রমজানের শেষভাগে নৈতিক জীবনযাপনের অঙ্গীকার করবে। রমজানের পর সে সংযত জীবন যাপন করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)

৬. অন্তরে ভয় ও আশা রাখা : ঈমান ভয় ও আশার মধ্যবর্তী। মুমিন আল্লাহর অনুগ্রহের আশা করে, অন্যদিকে তাঁর শাস্তিকেও ভয় পায়। রমজানের শেষভাগে মুমিন ব্যক্তি রমজানের আমল কবুল হওয়ার আশা করবে। একইভাবে আল্লাহর ভয়ে ভীতও থাকবে। কেননা একদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) যেমন বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে রমজানের রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী পাপ ক্ষমা করা হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০১)

অন্যদিকে তিনি সতর্ক করেছেন, ‘কত রোজাদার এমন, যাদের রোজা ক্ষুধা-পিপাসা ছাড়া আর কিছুই না এবং কত তাহাজ্জুদ আদায়কারী এমন, যাদের তাহাজ্জুদ রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই না।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ২০১৪)

৭. সদকাতুল ফিতরের প্রস্তুতি : রমজানের শেষভাগে মুমিন ব্যক্তি সদকাতুল ফিতরের প্রস্তুতি নেবে। সে হিসাব করে রাখবে যে কী পরিমাণ অর্থ বা খাদ্য তাকে দান করতে হবে, দানের অর্থ বা খাদ্য সে কাকে দেবে, কিভাবে দেবে ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ (সা.) সদকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন অশ্লীল কথা ও অনর্থক কাজ থেকে (রমাজানের) রোজাকে পবিত্র করতে এবং মিসকিনদের খাদ্যের ব্যবস্থার জন্য। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে তা আদায় করে সেটা কবুল দান হিসেবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি নামাজের পর আদায় করে, তা সাধারণ দান হিসেবে গৃহীত হবে। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৬০৯)

আল্লাহ সবাইকে রমজানের বরকত দান করুন। আমিন

লেখক: মো. আবদুল মজিদ মোল্লা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন