শান্তিচুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ অবাস্তবায়িত- সন্তু লারমা

ঢাকায় পার্বত্যচুক্তির ১৮তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সংবাদ সম্মেলন

JSS 1

স্টাফ রিপোর্টার:

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবীতে আরো কঠোর ও কঠিন কর্মসূচির হুমকি দিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।  তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে সরকার যদি রাষ্ট্রযন্ত্র ও অস্ত্র শক্তি ব্যবহার করে, জুম্ম জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমনপীড়ন করতে থাকে, তাহলে জুম্ম জনগণের পেছনে ফেরার কোন গত্যন্তব থাকবে না। জুম্ম জনগণ তাদের অস্তিত্ব ও আবাসভূমির সংরক্ষণের স্বার্থে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বদ্ধপরিকর। তাই অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির জন্য সরকার ও শাসকগোষ্ঠীই দায়ী থাকবে।

শনিবার সকাল ১১ টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৮তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে ঢাকা হোটেল সুন্দরবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সন্তু লারমা এসব কথা বলেন বলে গনমাধ্যমকে দেওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমার স্বাক্ষরিত্ব বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির দেওয়া বিবৃতিতে সন্তু লারমা আরও বলেন, ১৯৯৭সালে ২ ডিসেম্বর  সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘ ১৮ বছর অতিক্রান্ত হতে চলছে।  সরকার দাবি করছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে।  বস্তুত ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে।  তার অর্থ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।  আর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অধিকার সংক্রান্ত, ভূমি ও অর্থনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত, পুনর্বাসনসহ চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।  ফলে পাবত্যাঞ্চলের গণমানুষের শাসনতান্ত্রিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হয়নি। অর্জিত হয়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান।

তিনি বলেন, আমরা দেখছি দীর্ঘ ১৮ বছরেও সরকারের সাথে সম্পাদিত চুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন না করে সরকার পার্বত্যবাসীকে দমিয়ে রাখার জন্য নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।  চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি বলে এত দিনেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্মলিত বিশেষ শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।  শুধু তাই নয়, পার্বত্যবাসীর ভূমি সংরক্ষণ, পার্বত্য জেলার আইন শৃঙ্খলা তত্ত্ববধায়ন, বনজ সম্পদ সংরক্ষণ, পরিবেশ ব্যবস্থাপনার উন্নতি, স্থানীয় পুলিশ নিয়োগ(যা সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত নয়), মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ পর্যটন মন্ত্রণালয় গঠন, পর্যটন কর্পোরেশনসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভূমি সমস্যা।  অথচ সরকার সেই সমস্যার আজ পর্যন্ত কোন সমাধান না করে ৮০%- ৯০% সমস্যার সমাধান করেছেন বলে যে প্রচারণা ছড়াচ্ছে তা বোগাস এবং বায়োনাট কথা। পাহাড়ি জনগণের উপর হামলার প্রসঙ্গে বক্তারা বলেন, নিরাপত্তার নামে নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে বিভিন্ন সময় অপহরণ, চাঁদাবাজি, হামলা মামলা দিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে।

এ সময় তিনি সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমরা যাতে আমাদের দাবি দাওয়া নিয়ে বিদেশী, সচেতন মহল, গণমাধ্যমের কাছে কথা বা সাক্ষাত না করতে পারি সেজন্য সরকার বিদেশীদের সাথে সাক্ষাতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।  যা অত্যন্ত দুখজনক।  সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরও বলেন, যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা তাই এটি রাজনৈতিক ও জাতীয়ভাবে সমাধানের দাবি রাখে।

এসময় তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অসহযোগ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী আগামী ২ ডিসেম্বর সকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৮তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে রাঙামাটি জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিতব্য গণসমাবেশ থেকে ঘোষণা দেয়া হবে বলে জানান।

এ সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, কলামিষ্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশ আবিাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আইইডি নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমেদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের দীপায়ন খীসা প্রমুখ।  অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা।

সংবাদ সম্মেলনে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, কি কারণে এই চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার দেরি করছে তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট করেননি।  দীর্ঘ দেড়যুগ হলেও কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না জানতে চায় জনগণ। তিনি দাবি করেন, আদিবাসী কথাটি উচ্চারণে বাঁধা দিয়ে রাষ্ট্র বার বার ধোঁকা দিচ্ছে পাহাড়ি জনগণকে।  তাই নতুন করে সংলাপের আহব্বান জানান সরকারকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মেসবাহ কামাল বলেন, পার্বত্যবাসীর স্বপ্নভঙ্গ করা সরকারের উচিত না। আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতি বাস করে। প্রত্যেকে তাদের রীতি নীতিতে অধিকার দেওয়া উচিত। আমরা দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, তারা যা চায় তা তাদের অপরাধ নয়। তাহলে কেন এত তালবাহানা করা হচ্ছে তাদের সাথে। যেহেতু তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আসছে তাই তাদের অধিকার তাদের দেওয়া উচিত ।

নুমান আহমেদ খান বলেন, এখন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমন্ময়ে জাতীয় ঐক্য দরকার। মানুষ এখন প্রশাসনের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।  তাই বিদেশীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে দেশকে আর দেশিরা দেশের ভেতর জঙ্গীয় কায়দায় হামলা করছে একের পর এক।  পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণকে আজ এই জঙ্গিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে সরকার।  পাহাড়ীদের পরবাসী বানানোর যে চক্রান্ত সরকার করছে তা হতে দেওয়া যাবে না।

সঞ্জীব দ্রং বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষাকে বেহাল অবস্থায় রেখে জুম্ম জনগণের অধিকার ও অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করতে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার নামে নতুন করে শিক্ষিত সেকুলার সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।  ‘আদিবাসীরা’ তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোন জায়গায় যেমন সরকারি কোন ভবনে, শহীদ মিনারে এমনকি কোন হোটেলে যেন সংবাদ সম্মেলন না করতে পারে সেজন্য সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।  পাহাড়ী জনগণকে এভাবে দেখার কোন সুযোগ নাই ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন