বাংলাদেশে পর্যটনের সমস্যা ও সম্ভাবনা

fec-image

আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মানুষের মধ্যে ভোগ ও বিনোদনের প্রবণতা সৃষ্টি করে। সে কারণে একদশক আগে দেশের মানুষের মধ্য ভ্রমণের যে প্রবণতা দেখা যেত, বর্তমানে তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কারণেই বিশেষ বিশেষ সময়ে পর্যটন স্পটগুলোতে হোটেল-মোটেলে রুম না পেয়ে ভ্রমণকারীদের রাস্তায় রাত কাটাতে হয়! এ বিষয়টি বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনার অপার দিগন্ত উন্মোচিত করে।

কিন্তু সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশের পর্যটন খাত সেভাবে বিকশিত হতে পারছে না। এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। যোগাযোগ, অবকাঠামো ও নিরাপত্তার কথা সব সময় আলোচিত হয়। কিন্তু আমার মতে, বাংলাদেশে পর্যটন খাত বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় গুলো হচ্ছে- আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটের অভাব, ব্যয়বহুল পর্যটন কেন্দ্র এবং পর্যটন ব্যবসায়ীদের অসাধুতা তথা মুনাফাখোরী মনোভাব।

আমরা সবাই জানি বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দেশ। এখানে ভারত, নেপাল কিম্বা পাকিস্তানের মতো আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক পর্যটন স্পট নেই। যে কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র প্রাকৃতিকভাবে রয়েছে তা দেশের মানুষের কাছে এত বেশি পরিচিত হয়ে যাচ্ছে যে, পর্যটকদের কাছে তার আকর্ষণ হারাচ্ছে। অন্যদিকে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের নামে আকর্ষণ ও সৌন্দর্য ধ্বংস করা হচ্ছে। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন ও সাজেকের দিকে তাকালে এর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ সামনে আসে। কাজেই অভ্যন্তরীণ পর্যটন বিকাশের জন্য নতুন নতুন পর্যটন স্পট আবিষ্কার এবং সেগুলোতে যোগাযোগ, নিরাপত্তা ও অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এই ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পারে একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় পর্যটন হাব।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো অনেক পর্যটন স্পট রয়েছে যেগুলো দেশীয় পর্যটকরা এখনো সেভাবে এক্সপ্লোর করতে পারেনি। থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি ও বিলাইছড়ির মত দুর্গম উপজেলাগুলোতে অবস্থিত আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলো যোগাযোগ, অবকাঠামো ও নিরাপত্তা স্বল্পতার কারণে সব ধরনের পর্যটকদের সুগম্য নয়। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যে সীমান্ত সড়কগুলো হচ্ছে তাতে যোগাযোগ ও নিরাপত্তার ঘাটতি কিছুটা হলেও মিটবে। এটি আরো বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন।

মাঝে মাঝেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পরিচিত ব্যক্তিগণ এবং পার্বত্যনিউজের পাঠকগণ আমাকে সরাসরি অথবা পার্বত্যনিউজ অফিসের কন্টাক্ট নাম্বারে ফোন করে প্রশ্ন করেন, ভাই এই মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের অমুক জেলায় ঘুরতে যেতে চাই। কোন সমস্যা নেই তো? ওখানকার পরিস্থিতি কেমন? অমুক এলাকায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা আছে কিনা? সেখানে কোন গোলাগুলি চলছে কিনা? ইত্যাদি। পর্যটকদের মনে এই যে নিরাপত্তা সংকট— এটা পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন খাতের বিকাশে প্রধান বাধা। শুধু এটাই নয়, তারা আরো জানতে চান, ভাই অমুক জেলায় গেলে কিভাবে যেতে হবে? গাড়ি ভাড়া কোথায় পাওয়া যাবে? ভালো হোটেল কোথায় পাওয়া যাবে? কীভাবে বুকিং দেয়া যাবে? খরচ কেমন? টুরিস্ট গাইড পাওয়া যাবে কিনা? ইত্যাদি প্রশ্ন তাদের কাছ থেকে শুনতে হয়। ৪.০ শিল্প বিপ্লবের এই অটোমেশন যুগে এ ধরনের প্রশ্ন বড্ড পশ্চাদপদ। পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন সুবিধাগুলোকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় এনে দেশ ও বিদেশের মানুষের কাছে সহজলভ্য ও সহজগম্য করার জন্য অন্তর্জালের সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরী। যাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণের ইচ্ছুক যেকোনো পর্যটক দেশে-বিদেশের যে কোন অবস্থানে থেকে হোটেল বুকিং, যানবাহন বুকিং, টুর গাইড বুকিং ও যোগাযোগসহ সকল প্রকার সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে।

বাংলাদেশে পর্যটন বিকাশের আরেকটি প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ব্যয়বহুলতা। একজন পর্যটক যে টাকায় তিন দিন কক্সবাজারে কাটাতে পারেন সেই একই টাকায় বা তার চেয়েও কম টাকায় খুব সহজেই দার্জিলিং বা ভারতের বেশ কিছু পর্যটন স্পট ঘুরে আসতে পারবেন। সড়কপথে নেপাল বা ভুটান ঘুরে আসতেও এর থেকে খুব বেশি টাকা লাগে না। অথচ আকর্ষণ, সেবা ও সুযোগ সুবিধার দিক দিয়ে ওইসব পর্যটন কেন্দ্রগুলো বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর থেকে অনেক এগিয়ে। কক্সবাজারে হোটেল ভাড়া, গাড়ি ভাড়া ও খাবার খরচ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষ বিশেষ সময়ে এত বেশি বৃদ্ধি পায় যে তা মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যায়। গত বছর আলু ভর্তা-ডাল ভাত তিনশ টাকায় খেতে হয়েছে পর্যটকদের— এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পর্যটন ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে হোটেল মোটেল এর ভাড়া এত বেশি বৃদ্ধি করে ফেলে যে তা সাধারণ মানুষের ঊর্ধ্বে চলে যায়। একই সাথে যানবাহন ও খাবার খরচ লজ্জাহীনভাবে কয়েক গুণ বাড়ানো হয়। ভারতীয় সূত্রের তথ্য, ২০২০ সালে ভারত পর্যটন খাতে ৪২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল। এর ২১% বাংলাদেশি পর্যটনদের কাছ থেকে। অর্থাৎ বাংলাদেশি পর্যটকরা ওই বছর প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার ভারতে ব্যয় করেছে পর্যটন খাতে। বলাবাহুল্য, ভারতীয় পর্যটন খাতের আয়ের শীর্ষে এককভাবে বাংলাদেশি পর্যটকরদের অবদান।

বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটনে আয় এর ধারে কাছেও নেই। ভারতের পাশাপাশি নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশগুলোতে বাংলাদেশি পর্যটকদের ব্যয়ের একসাথে হিসেব সাধারণ ক্যালকুলেটরে করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, এই অর্থের পুরোটাই বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশ থেকে চলে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার চরম সংকটের সময়ে এ ধরনের পরিসংখ্যান কোন দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাছে প্রীতিকর হতে পারে না। কাজেই বাংলাদেশ যদি নিজস্ব জনগণের পর্যটন খাতের বিপুল ব্যয়ের এই অর্থের বেশ খানিকটা সাশ্রয় করতে চায়, তাহলে দেশীয় পর্যটন খাত বিকাশের কোন বিকল্প নেই।

লেখক: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ, চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস, কক্সবাজার, পর্যটন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন