আরাকান আর্মির নির্যাতনে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী স্রোতের শঙ্কা

fec-image

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত চলছে এক বছরের বেশি সময়। রাখাইনের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হাতে। রাখাইন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের বড় শহর বুথিডং। সেখানে কিছু দিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর ফের নির্যাতন শুরু হয়েছে। এতে ভয়ে ভিটেমাটি ছাড়ছেন রোহিঙ্গারা।

জীবন বাঁচাতে অনেকে পরিবার নিয়ে পালাচ্ছেন। বাংলাদেশমুখী যাত্রা করছেন কেউ কেউ। এরই মধ্যে ঘরবাড়ি ছেড়ে রোহিঙ্গা পালানোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় নতুন করে রোহিঙ্গা স্রোতের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সীমান্তের ওপারে চলমান ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর রাখছে বাংলাদেশ। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা সীমান্তে সতর্কতা বাড়িয়েছেন।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, বুথিডংয়ে আরাকান আর্মি অনেকের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ঘরে ঘরে গিয়ে আরসা সদস্যদের খুঁজছে আরাকান আর্মি। তাদের ধারণা, সাধারণ রোহিঙ্গারা আরসা সদস্যদের আশ্রয় দিচ্ছে। এমন অজুহাতে অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাকে আটক করে প্রখর রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে অনেক রোহিঙ্গা পরিবার নিয়ে গহিন পাহাড়ি পথে বাংলাদেশমুখী যাত্রা করছে। এরই মধ্যে অনেকে মংডু থেকে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। দালালের মাধ্যমে অনেকে ঢুকছে। অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে উঠছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নিয়ে আগে থেকেই নানামুখী সংকটে বাংলাদেশ। অনেক দেনদরবারের পরও তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। যৌথ সাড়াদান কর্মসূচির (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান- জেআরপি) আওতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তবে প্রতি বছরই প্রতিশ্রুত সহায়তার চেয়ে বরাদ্দ আসছে কম। এমন পটভূমিতে নতুনভাবে রোহিঙ্গা প্রবেশ বাংলাদেশের জন্য নতুন চাপ সৃষ্টি করছে।

এ ব্যাপারে গতকাল মঙ্গলবার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন (আরআরআরসি) কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, বুথিডংয়ে রোহিঙ্গার ওপর আরাকান আর্মির নির্যাতনের তথ্য আমরা পাচ্ছি। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে না। রাখাইনে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকছে। এর মধ্যে তালিকাভুক্ত ৭০ হাজার।

তিনি আরও বলেন, যারা নতুন করে ঢুকছে, তারা অনেকে এসে ক্যাম্পে আত্মীয়স্বজনের বাসায় উঠছে। তবে তাদের জন্য ঘর তৈরি করে দেওয়ার ঝুঁকি আছে। এতে সীমান্তের ওপারে যারা রয়েছে, তারা উৎসাহিত হবে। তারা বিশ্বাস করবে, এপারে আসতে পারলেই নতুন ঘর পাওয়া যাবে। আবার খোলা আকাশের নিচে থাকলে বিষয়টি অমানবিক হয়ে যায়। তাই নতুন রোহিঙ্গার ব্যাপারে দোটানায় আছি আমরা।

বিজিবির রামুর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে বিজিবি সতর্ক রয়েছে।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতির ওপর দীর্ঘ দিন ধরে নজর রাখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম। গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, বুথিডং, মংডুসহ রাখাইনের পুরো এলাকায় আরাকান আর্মির কাছে পরাস্ত হয়ে সব কিছু প্রায় গুটিয়ে নিয়েছে জান্তা সরকার। সংঘাতের সময় রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে জান্তা। এখন রোহিঙ্গার ওপর এক ধরনের প্রতিশোধ নিচ্ছে আরাকান আর্মি। এতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জটিল হয়ে উঠছে। চীনের শক্ত পদক্ষেপ ছাড়া রোহিঙ্গা ফেরানো কঠিন হবে। জান্তা সরকার চাইলেও এখন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে বলা হয়– কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া তালিকাভুক্ত আট লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার যোগ্য বলে জানিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে আছে আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানকে এ কথা জানিয়েছেন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ইউ থান শিউ।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর কথা ছিল। তবে প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে, তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। পরে প্রত্যাবাসনও শুরু করা যায়নি। সে সময় নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমিতে ফেরার নিশ্চয়তাসহ আট দফা দাবি জানিয়েছিল রোহিঙ্গারা। ২০২৩ সালের অক্টোবরে চীনের মধ্যস্থতায় ১ হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে আলাদা পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করে ডিসেম্বরে প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে বর্তমানে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গেল প্রায় আট বছরে একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
সূত্র : সমকাল

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গাদের
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন