অস্ত্র উদ্ধার করলেই শান্তি আসবে না, প্রয়োজন পুনর্বাসন

ইউপিডিএফ চাঁদাবাজির টাকায় কিনছে ভারি অস্ত্র

fec-image

পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় এক কনফারেন্সের মধ্যে দিয়ে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর জন্ম হয়েছিল। সন্তু লারমার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) থেকে তরুণদের একটি দল বের হয়ে এসে সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠা করে।

প্রতিষ্ঠার গত বিশ বছর ধরে ইউপিডিএফ পার্বত্য এলাকায় শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করলেও হঠাৎ পাহাড়ের প্রভাবশালী এ সংগঠনটির ছন্দ পতন ঘটে। গণতন্ত্রের চর্চা নেই দাবি জানিয়ে ২০১৭ সালে নভেম্বর মাসে ইউপিডিএফ ভেঙ্গে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ইউপিডিএফ আগ্রাসী হয়ে উঠে। ৬ আগষ্ট ইউপিডিএফ রাঙামাটি শহরের রাজপথ দখলের জন্য সড়ক ও নৌ পথে নিয়ে তাদের কয়েক হাজার কর্মী নিয়ে হাজির হয়ে ছিলো। তাদের দাবি ছিলো-অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের শাসনামলের সকল হত্যাকান্ডের বিচার, অন্তর্বর্তী সরকারে সকল দলের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত এবং সকল রাজবন্দির মুক্তি নিশ্চিত করা।

তবে রাঙামাটি শহরে ইউডিডিএফ’র এমন উপস্থিতি মেনে নিতে পারেনি সন্তু লারমার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। সংগঠনটি ওই দিন তাদের শত শত নেতা-কর্মী নিয়ে ইউপিডিএফ’র যাত্রা প্রতিহত করলে উভয় দল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।

ইউপিডিএফ পর্যটন নগরী সাজেকে নিজেদের প্রভাব বিস্তার ধরে রাখতে কিছু দিন পর পর তাদের বিপরীত দলের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এতে সাজেকের পরিস্থিতি বেশির ভাগ সময় উত্তপ্ত থাকে। জানমালের নিরাপত্তায় প্রশাসন পর্যটক ভ্রমণে বিধি-নিষেধ দিয়ে থাকে প্রায় সময়।

সম্প্রতি চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি সাজেকে ভয়াবহ আগুনে দেড় শতাধিক রিসোর্ট পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের একশো কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগার কথা বলা হলেও একটি সূত্র বলছে ইউপিডিএফ বেশ কিছুদিন আগে থেকে সাজেকের পর্যটন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দশ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলো। চাঁদা না পাওয়ায় স্বশস্ত্র এ সংগঠনটি এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছে নিরাপত্তা বাহিনী।

এককালীন ৫ কোটি এবং প্রতি মাসে ৩৪ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে না পেয়ে বেসরকারি মোবাইল অপারেটর রবির অন্তত ২১টি মোবাইল টাওয়ার নষ্ট করে দিয়েছে ইউডিডিএফ’র সশস্ত্র সদস্যরা। এ ছাড়াও নির্ধারিত সময়ে চাঁদা পরিশোধ না করায় রাঙামাটি থেকে টাওয়ার ঠিক করতে যাওয়া এক শ্রমিককে তুলে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। অপহৃত শ্রমিকের বাড়ি রাঙামাটি শহরেই।

জানা গেছে, টেলিযোগাযোগ সংস্থা রবিকে পাহাড়ে নেটওয়ার্ক সচল রাখার জন্য ইউপিডিএফকে প্রতি মাসে সত্তর লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ইউপিডিএফ হঠাৎ করে বেসরকারি এ টেলিযোগাযোগ সংস্থাটি থেকে নিয়মিত চাঁদা পরিশোধের পাশাপাশি এককালীন পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে বসে।

এতে কোম্পানীটি চাঁদা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সংগঠনটির সন্ত্রাসীরা দুই পার্বত্য জেলার (খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি) রবি’র ২১টি টাওয়ারের লাইন কেটে দিয়েছে। মোবাইল টাওয়ার স্টেশনের ব্যাটারি লুট, জেনারেটর পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে ১০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে রবি ও তার অংশীদার কোম্পানিগুলো।

টাওয়ার পরিচালনাকারী কোম্পানির স্থানীয় একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে পাহাড়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার পরিচালনা করছি।

সংশ্লিষ্ট মোবাইল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড়ের আঞ্চলিক স্বশস্ত্র দলগুলো মোবাইল অপারেটর কোম্পানীগুলোর কাছ থেকে প্রতি মাসে তিন কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে থাকে।

ইউপিডিএফ চাঁদা আদায়ের টাকায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কিনছে ভারী ভারী অস্ত্র। সম্প্রতি মিজোরামে ও ত্রিপুরায় ইউপিডিএফ এর বেশ কয়েকজন কালেক্টর অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র একে-৪৭ রাইফেলসহ গোলাবারুদ নিয়ে সেখানকার পুলিশ ও বিএসএফ’র হাতে আটক হওয়ার পর ইউপিডিএফ’র অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়টি সামনে আসে।

চলতি বছরের মার্চের ৭ তারিখে রাঙামাটির কাউখালি উপজেলায় অভিযান চালিয়ে সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ’র গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম জব্দ করেছে সেনাবাহিনী।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক লেখক ও গবেষক সাংবাদিক সৈয়দ ইবনে রহমত বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে প্রদান বাধা সশস্ত্র সন্ত্রাস। দেশি-বিদেশি চক্রের পক্ষ থেকে অব্যাহতভাবে সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয়, উসকানি এবং সার্বিক সহযোগিতা প্রদানও পাহাড়ে শান্তির পথে অন্যতম অন্তরায়। তাই পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সকল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হস্তক্ষেপ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র সাংবাদিক আনোয়ার আল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের প্রদান সমস্যা সমন্বয় এবং অস্ত্রধারীদের চাাঁদাবাজি। শুধু অস্ত্র উদ্ধার করলেই শান্তি আসবে বলা যায় না। এ জন্য প্রযোজন ধারাবাহিক ডায়লগ এবং পুনবার্সন প্রোগ্রাম।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: রাঙামাটি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন