‘এই জুলাই যোদ্ধা’ কারা?

fec-image

সরকারিভাবে ‘জুলাই যোদ্ধা’ বলতে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সরকারি বাহিনীর হামলায় যারা আহত হয়েছিলেন, তারাই ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জুলাই যোদ্ধাদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছে। তাদের পরিচয়পত্র প্রদান করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ইতিপূর্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানগুলো যেমন ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব এবং ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে যারা জড়িত ছিলেন বা আহত হয়েছিলেন তাদের কাউকে সরকার এভাবে অভ্যুত্থান যোদ্ধা বলে স্বীকৃতি দেয়নি বা তারাও এ ধরনের দাবি করেনি। তারা কেউ এ ধরনের সরকারি ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের দাবিও করেনি। আবার এটাও সত্য সেসময় এবারের মতো বিপুল পরিমাণ হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। জুলাই যোদ্ধারা নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ে জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করতে রাজপথে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিল। আমরা জাতি হিসেবে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের আত্মত্যাগের কারণেই দেশ আজ ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ মুক্ত হয়েছে। তাদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম।

তবে গতকাল জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কয়েকশত তরুণ নিজেদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ দাবি করে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের নিরাপত্তা বেষ্টনী টপকে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। একসময় তাদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে এবং পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। মূলত তিন দফা দাবি নিয়ে আগের দিন রাত থেকেই তারা জাতীয় সংসদ এলাকার আশেপাশে অবস্থান নিয়েছিল। এক পর্যায়ে সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়ে জুলাই সনদে পরিবর্তন আনে। কিন্তু এতেও তারা সন্তুষ্ট হননি। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন জুলাই যোদ্ধা দুঃখজনকভাবে আহত হয়েছেন। জুলাই যোদ্ধাদের এভাবে পুলিশি নির্যাতনে আহত হতে দেখা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশেষ করে আহত জুলাই যোদ্ধা আতিকুল গাজীর জুলাই আন্দোলনে হারানো হাতের পরিবর্তে লাগানো কৃত্রিম হাতের রাজপথে পড়ে থাকা ছবি অনেককেই আপ্লুত করেছে। প্রতিবাদে ও তিন দফা দাবিতে রবিবার সারা দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ফলে সামগ্রিক বিষয়টা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা, সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

প্রথমেই দেখে নেয়া প্রয়োজন, চব্বিশের জুলাই যোদ্ধারা কোথা থেকে এসেছেন? শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ বিরোধী শাসন উৎখাতে জুলাই ২৪ মাসের আন্দোলনে যে সকল রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল তাদের বেনামী নেতা-কর্মীগণ ও সাধারণ ছাত্র-জনগণের মধ্য থেকেই এই জুলাই যোদ্ধারা এসেছে। অর্থাৎ এই শ্রেণির মধ্য থেকেই জুলাই যোদ্ধা সৃষ্টি হয়েছে। এই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ২৫ টি রাজনৈতিক দল গতকাল জুলাই সনদ স্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ ধরে নেয়া যেতে পারে তারা এই সনদ মেনে নিয়েছে। স্বাভাবিক যুক্তিতে মনে হতে পারে, যারা সনদ মেনে নিয়েছে তারা এর প্রতিবাদে হামলা করবে না। তাহলে গতকাল যারা জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে হামলা করল তারা কারা? কোন অংশ থেকে এসেছে? তারা কোন দলের কর্মী? কারা তাদের সংগঠিত করেছে? কারা তাদের পেছন থেকে মদদ দিয়েছে? তারা কি কেবলই অরাজনৈতিক সাধারণ জুলাই যোদ্ধা? অরাজনৈতিক সাধারণ জুলাই যোদ্ধাদের পক্ষে এ ধরনের সংগঠিত হামলা করা কি সম্ভব? কারা তাদেরকে এভাবে শতশত একই ধরনের টি শার্ট তৈরি করে দিয়েছে? এদের মধ্যে কতজন প্রকৃত জুলাই যোদ্ধা রয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা জরুরি।

এদিকে এনসিপি নামক রাজনৈতিক দলটি যারা মূলত নিজেদেরকে জুলাই আন্দোলনের প্রধান স্টেক হোল্ডার দাবি করেন, তারা এই সনদে স্বাক্ষর করেননি। স্বাভাবিক কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, এন সি পি সমর্থিত জুলাই যোদ্ধারা এই হামলা পরিচালনা করতে পারে? তবে এনসিপির পক্ষে কি এভাবে হাজার হাজার জুলাই যোদ্ধা সংগঠিত করা সম্ভব? আমরা এনসিপির একক বিভিন্ন দলীয় কার্যক্রম দেখেছি। সেখানে দলীয় কর্মীর থেকে মিডিয়াকর্মীর সংখ্যা বেশি হতে দেখেছি। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা ও ট্রল হয়েছে। যাদের একক দলীয় সমাবেশগুলোতেই কর্মী সংখ্যার এরকম অবস্থা তাদের পক্ষে হাজার হাজার জুলাই যোদ্ধা সংগঠিত করা কতটা সম্ভব? এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? এই যে সারাদেশে মহাসড়কগুলোতে অবরোধ ডাকা হল, কেবলমাত্র এনসিপি সমর্থিত জুলাই যোদ্ধাদের পক্ষ থেকে একসাথে সারাদেশে এই অবরোধ পালন করা কতটা সম্ভব? তাহলে কারা তাদেরকে এ ধরনের কর্মসূচি ঘোষণায় উৎসাহিত করেছে? কারা লোক সাপ্লাই দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে- যাদের উপর ভর করে তারা এ ধরনের বড় কর্মসূচি ঘোষণার সাহস পেয়েছে? একটি জাতীয় নির্বাচনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে নির্বিঘ্ন নির্বাচনের স্বার্থে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া জরুরি।

এমনিতেই জাতীয় সংসদ ভবনকে পি আই ভুক্ত এলাকা। এখানে সার্বক্ষণিক কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকে। তার ওপর প্রধান উপদেষ্টার সমাবেশ স্থল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দ্বারা বেষ্টিত থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সকল ধরণের গোয়েন্দা সংস্থা, এসএসএফ, পিজিআরসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা থাকে। তাহলে এভাবে হাজারখানেক কিভাবে সেই সমাবেশ স্থলে ঢুকে গেল? তারা তো অকস্মাৎ হামলা করেনি। পূর্ব রাত থেকেই তারা সেখানে সংগঠিত হয়েছিল। তারপরও কি করে প্রধান উপদেষ্টার সমাবেশস্থলে তারা ঢুকে ভাঙচুর করলো? কেন তাদের ঢুকতে দেয়া হলো? কেন তাদের আগেই সরিয়ে দেয়া হলো না? প্রধান উপদেষ্টার অনুষ্ঠানে ঢুকে এ ধরণের নৈরাজ্য সৃষ্টি গুরুতর অপরাধ। এর নিরাপত্তায় যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের অবশ্যই এর জন্য জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আসা উচিত। কিন্তু এজন্য সরকার এখন পর্যন্ত এ ধরণের কোনো অ্যাকশন নিয়েছে শোনা যায়নি। এতোবড় একটা ঘটনায় কেন অ্যাকশন নেয়া হলো না?

দায়িত্বশীলরা সরাসরি সেখানে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে পারতেন। তাদের প্রতিনিধিদের ডেকে নিতে পারতেন। আবার এই ঘটনার পর তাদের দাবি মেনে নেয়া হলো। তাহলে আগেই মেনে নেয়া হলো না কেন? অর্থাৎ কোনোভাবে কি তাদেরকে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেয়া হয়েছে? ‘আমি খাড়াইয়া যাবো- আপনি বসাইয়া দেবেন’ জাতীয় কোনো বিষয় এখানে ছিল কি? সরিষার মধ্যে কোথাও ভূতের অবস্থান ছিল কি- যারা সীমিত পর্যায়ে এটা করতে চেয়েছিলেন? কাদের পক্ষে এমন কন্ট্রোলড নৈরাজ্য সৃষ্টি সম্ভব? এত টি শার্ট তারা কিভাবে বানালো? কে বানিয়ে দিয়েছে? কোথায় বানানো হয়েছে? কেন আগে থেকে তা জানা গেল না? তারা যে প্রধান উপদেষ্টার সমাবেশ স্থলে হামলা করতে পারে এ ধরনের তথ্য রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা কি আগাম জানিয়েছিল? জানিয়ে থাকলে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়নি কেন? নাকি সরিষার ভূত সরকারের ঘাড়ে চেপে বসেছিল?

অন্যদিকে আবার এটাও ভেবে দেখা যায় যে, কোনো তৃতীয় পক্ষ কি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করছে? কারা হতে পারে তারা? যারা জুলাই স্বাক্ষরের জন্য বিভিন্ন শর্ত আরোপ করছিল এবং শর্ত পালন না করলে স্বাক্ষর করবে না বলে হুমকি দিচ্ছিল, তারা কি কোন ভাবে এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে? কোনো দল সংগঠন বা গোষ্ঠী কি তাদের গুপ্ত সদস্যদের জুলাই যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করে তাদের দাবি পূরণ বা লক্ষ সাধনের জন্য জুলাই যোদ্ধাদের প্রতি দেশবাসীর যে সহানুভূতি রয়েছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে? তাদের কোন বিশেষ দাবী দাওয়া বা লক্ষ্য পূরণে কিছু জুলাই যোদ্ধা এবং তাদের সাথে উনাদের কর্মীদের গুপ্ত অংশকে যুক্ত করে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে? সরকারের ভেতরে ও বাইরের একটি অংশ এখনো নির্বাচন পেছানোর জন্য তলে তলে অত্যন্ত সক্রিয় ও তৎপর বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। এই ঘটনায় কি তাদের কোন গোপন হাত কাজ করছে? তারা কি জুলাইয়ের আবগে ব্যবহার করে নির্বাচনকে অনিশ্চিত করতে চাইছে?

খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ একটি জাতীয় নির্বাচনের সম্মুখীন হতে চলেছে। অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তাই একটি নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ নিষ্কণ্টক করতে উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া সরকারের জন্যই অত্যন্ত জরুরি। দেশবাসীর প্রত্যাশা সরকার সে ব্যাপারে কোনো গাফলতি দেখাবে না।

 

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন