একটি অস্ত্রের সন্ধানে: ডেটলাইন অক্টোবর ৪, ২০০৪- বান্দরবান

fec-image

কঠিন চীবর দানের অনুষ্ঠান হচ্ছে বান্দরবানের বাগমারায়। এখানেই একটি মেলা প্রাঙ্গণে নিয়োজিত আছে সেনাবাহিনীর একটি টহল। মেলা প্রান্তরে আলোর ঝলকানি, মাইকের শব্দ, নারী পুরুষের ভিড়, চিৎকার সব মিলিয়ে অন্যরকম আবহাওয়া। অবশ্যই উৎসবের।

টহল দল কাজে নিয়োজিত আছে ১৯ বীরের একটা দল। এই দলের কর্পোরাল সামাদ মাঠের এক প্রান্তে চলে যায়, সম্ভবত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। বেশ কিছুক্ষণ পর মেলার লোকজনের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে যায় কর্পোরাল সামাদের রক্তস্নাত মৃতদেহ দেখে। কেমন করে মরলো? কে মারলো? ওখানে সে কেমন করে একা গেল? ইত্যাদি সব প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়লো সবার মনে।

তখনও বান্দরবান ছিল একটা মোটামুটি শান্তিপূর্ণ এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের শান্তিবাহিনীর চলমান সংঘাতের বাইরের এক প্রান্তর। এখানে মুরংসহ বেশকিছু পাহাড়ি সম্প্রদায় নিজেরাই তাদের এলাকায় ভিডিপি হিসেবে কাজ করতো। একটা ট্র্যাডিশনাল ফোর্স সরকারের সাথে সহযোগিতা করে চলে। তাই এখানে শান্তিবাহিনী মোটেই ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারেনি।  এখানে বার্মার আরসার কিছু সদস্য স্হানীয়দের মাঝে মিশে থাকলেও তেমন জোরালো কোনো অপতৎপরতা চালাতে পারতো না। সে হিসেবে বান্দরবানের রুমা এবং রোয়াংছড়ির কিছু পকেট বাদে একটা শান্তিপূর্ণ এলাকাই ছিল।

এখানে সেনাসদস্যদের উপর আক্রমণ তাই অপ্রত্যাশিত না হলেও হুমকি অতোটা জোরালো ছিল না। অনুসন্ধানে জানা গেল কর্পোরাল সামাদকে অকস্মাৎ পিছন থেকে কেউ জাপটে ধরে তার অসতর্ক অবস্থায় এবং তার অস্ত্র কেড়ে নিতে ধস্তাধস্তি শুরু করে দুর্বৃত্তরা।  সে ফায়ার করার চেষ্টা করে। কিন্তু ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তার অস্ত্রের গুলি তার বুকে বিদ্ধ হলে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। মেলার মাইকের শব্দে তাৎক্ষণিকভাবে গুলির শব্দকে কেউ খেয়াল করেননি। ফলাফল কর্পোরাল সামাদের একে-৪৭ এসএমজি খোয়া যায়।

সদর দপ্তর ২৪ পদাতিক ডিভিশন : তখন জিওসি জেনারেল ইকবাল করিম ভূইয়া। তিনি সকল ব্রিগেড থেকে ৫টি করে ‘এ’-টাইপ পেট্রোল পাঠাতে বললেন বান্দরবানে। বিশটি পেট্রোলের প্রায় ছয়শ’ সৈনিকের বিশেষ দল যোগ দিলো বান্দরবানের ব্যাটালিয়নগুলোর সাথে। দুই দিনের মধ্যে সকল দল এসে মিলিত হলো বান্দরবানে। খাগড়াছড়ি থেকে সিনিয়রিটি বলে আমি টিমের নেতা। বান্দরবান রিজিয়ন হেডকোয়ার্টারে অপারেশন ব্রিফিং দিলেন ব্রিগেড কমান্ডার।

জিওসি আইকেবি’র নির্দেশ : ওই হারানো অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এই স্পেশাল টিমের কেউ নিজ নিজ ব্যারাকে ফেরত যাবে না। পেট্রোল টিমের বয়ে নেওয়া রেশন ফুরিয়ে গেলে তারা হেলিসর্টি দিয়ে আমাদের পকেট পুরো করবেন। নিজের পিঠের প্যাকে ব্যবহার্য সব আইটেম নেওয়ার পর তিন দিনের শুকনো খাবার।  পিঠের উপর ন্যূনতম ২৫ কেজির ছোট পাহাড়। পথ চলতে হবে প্রায় গড়ে হাজার মিটার উচ্চতার বান্দরবানের পাহাড়ের রেঞ্জে। পাহাড় বাইতে গিয়ে এক কেজি তিন কেজিতে পরিণত হয়।

শুরু হলো খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার অভিযান। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু বাগমারাকে উৎক্ষেপণের মঞ্চ হিসাবে নিয়ে ছড়িয়ে পড়লাম চারিদিকে। স্থানীয় জনগণের আস্থা অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু বিপুল সেনাবাহিনীর টহল দেখে তারাও শঙ্কিত। আমরাও উভয় সংকটে, কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখা যাচ্ছে না আবার তার বাড়িঘরে তল্লাশি বা তাকে কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখিও করা যায় না। কারণ, এতে দীর্ঘ দিনের একটা মোটামুটি আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হবে। বান্দরবানের খ্রিষ্টান অধ্যুষিত পাড়াগুলো শিক্ষায়, পোশাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। তাদের যেনতেন ভাবে হ্যান্ডেল করা যায় না। স্থানীয় নেতাদের কানে কানে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জানানো হলো।

প্রতিদিন ভোর সকালে নিজেদের গতিপথ নির্ধারণ করে পরবর্তী লক্ষ্য বস্তুতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হতাম। সকালের খিচুড়ির শক্তিতে বলীয়ান হয়ে রওনা দিতাম। দুপুরের দিকে বিরতি। কারণ, এরপর পাহাড়ে হাঁটা অত্যন্ত কষ্টকর। শেষ বিকালে কোনো পাড়ার কাছাকাছি যেখানে পানির উৎস আছে, সেখানেই রাত্রিযাপনের বিরতি। পাহাড়ি বাড়ি থেকে হাঁড়ি পাতিল ধার নিয়ে আবার খিচুড়ি রান্না। খাবারের পর রাত্রিযাপনের চূড়ান্ত আরভিতে নিঃশব্দে গমন। রাতের ঘুমানোর স্থানটি হতো কোনো চলাচলের পথের উপর পলিথিন শিট বিছিয়ে। তাই হাতির পদতলে পিষ্ট হওয়ার আশংকাটিই বেশি কাজ করতো।  আমরা ওদের দেখে যতটা না ভয় পাই, ওরা রাতে সেনাবাহিনীর কমব্যাট পোশাককে আরো বেশি ডরায়। উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড় দেয়। তখনই পদতলে পিষ্ট হওয়ার ভয়।

মাথার নিচে চাউলের পুটলিকে বালিশ হিসাবে রেখে আধোঘুমে কেটে যেত রাত। সারাদিনের ক্লান্তিতে প্রহরী ঘুমায় গেল কিনা জানতে তার নাম ধরে ডাকি। প্রথম ডাকে সাড়া না দিলে বুঝি বেটা ঝিমাচ্ছে!!  রাতে কখনো কখনো ঝটিকা অ্যাম্বুশ নিয়ে ঝিরিতে ছড়িয়ে পড়ে থাকতাম। ঝিরিপথের পানি ভেঙে কেউ চলাচল করে কিনা সে শব্দ শোনার অধীর আগ্রহে। ওয়ারলেস সেটে পার্শ্ববর্তী কোন পেট্রোল কোথায় আছে তা জানতে হতো, যেন ‘সেম সাইড’ না হয়।

দিন দশেক এভাবেই চলে গেল।  ভাবছি অপারেশন ‘কলড অফ’ করে কিনা-জিওসি’র জোশ যদি একটু কমে!

একদিন রাতে মেসেজ এলো জিওসি আসবেন আমার টহল পয়েন্টে দেখা করতে। লোকেশন জানতে চাইলো, বললো, যেন হেলিপ্যাড বানাই।

ভোর বেলা হেলিপ্যাডের জন্য যুতসই পাহাড়ের চূড়া নির্বাচন করতে বের হলাম। পরিত্যক্ত জুম ক্ষেতের কাছে পেয়ে গেলাম একটি জায়গা। জুম করার কারণে পাহাড়িরা আগেই আশেপাশের সব বড় গাছ কেটে ফেলেছে।  অতএব, একটু কম পরিশ্রমেই ভালো নিরাপদ হেলিপ্যাড তৈরি হলো।

জিওসি এলেন বাতাসে ধুলার ঝড় উড়িয়ে। নেমেই ইতিউতি তাকালেন, হেলিপ্যাডের সিকিউরিটি পোস্ট কোথায় দেখতে চাইলেন। দ্রুত কিছু রসদ নামলো হেলিকপ্টার থেকে, অন্যতম আকর্ষণ ওয়েল ফুডের কেকের বড় দুটো প্যাকেট।

আরো কিছু দিন চলে গেল ব্যর্থ অ্যাম্বুশ, ব্যর্থ তল্লাশিতে। কিন্তু আমি একাদশীর চাঁদ দেখতে না পেলেও আমার অবস্থান থেকে অনেক দূরে রুমার এক প্রত্যন্ত পাড়ায় মেজর মোয়াজ্জেম পেলেন সেই চরম আকাঙ্ক্ষিত ‘সূঁচ’ সেই হারানো এসএমজি- ‌‌'(৭৯)- ডি: কো.’ অঙ্কিত, যা গুলিবিদ্ধ কর্পোরালের বুক থেকে টেনে নেওয়া হয়েছিল একুশ দিন আগে।

কর্পোরাল সামাদের জীবন হানির কারণ এই এসএমজি, সৈনিকের মর্যাদার চূড়ান্ত প্রতীক তার হাতিয়ার।  সে সহজে দিতে চায়নি বলেই মরেছে। আমরাও সহজে ছেড়ে দিবো না বলেই গত একুশ দিন একটানা পাহাড়ে আছি। বিছানা বালিশ কেউ দেখেনি, কাঁচা পেঁপে আর কাঁচা হলুদের রঙের খিচুড়ি ছিল ‘ফিস্ট অফ দ্য ডে’!

দুষ্কৃতিকারীরা সামাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার পর একটি এলাকায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে সেনাবাহিনীর টহলের কারণে। আমাদের চেয়ে বেশি নির্ঘুম রাত তারাও পার করে। ওরা শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর টহল নেটের বাইরে যেতে পারেনি, আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় একাদশীর চাঁদের দেখা পেয়েছিল সহযোদ্ধা।

রুমার সাম্প্রতিক ঘটনার পর আসলে হিসাব মিলাতে পারছি না, ২০ বছর আগের ঘটনার।

‘আল্লাহ তে যার পূর্ণ ইমান কোথা সে মুসলমান আজি কোথা সে মুসলমান’!!! ‘সৈনিক আর মুসলমান দুটোই কি আজ দুর্লভ?’

লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সামরিক বিশ্লেষক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন