কাপ্তাইয়ে প্রতিবন্ধী মারমা নারীর গণধর্ষণের শাস্তি শূকর জরিমানা প্রথাগত বিচারে


সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে এক মারমা কিশোরীর কথিত ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে পার্বত্যনিউজের সম্পাদক মেহেদী হাসান পলাশ উল্লেখ করেছিলেন, পাহাড়ী নারীরা ধর্ষিত হলে ন্যায় বিচার পান না। সামাজিক প্রথার নামে শূকরের বিনিময়ে দায়মুক্তি পেয়ে যায় ধর্ষক। বিষয়টি নিয়ে তখন তোলপাড় শুরু হয়; পাহাড়ে এবং সমতলের অনেকেই পার্বত্যনিউজ সম্পাদকের তীব্র সমালোচনা করে তার মন্তব্য প্রত্যাহারে দাবিও জানান।
সে ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই এমন আরো একটি ঘটনা জনসম্মুখে এসেছে। যেখানে সামাজিক প্রথার নামে আবারো ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এক প্রতিবন্ধী মারমা নারী। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার ওই প্রতিবন্ধী নারী প্রভাবশালী আঞ্চলিক দলের স্থানীয় তিন সদস্যের লাগাতার ধর্ষণের শিকার হয়ে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরও বিচারের দাবি করতে পারছেন না। এমনকি তার অনাগত সন্তানের পিতা কে, সেটাও বলতে পারছেন না। সামাজিক প্রথার নামে স্থানীয় কার্বারী ও মারমা সমাজ নেতারা দোষীদের কিছু অর্থ এবং তিনজনকে তিনটি শূকর জরিমানা করে দায়মুক্তি দিয়েছেন। একই অপরাধে অপরাধী ঘোষণা করে ভিকটিম ওই নারীকেও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন তারা।
কাপ্তাইয়ের চিৎমরম এলাকার ওই প্রতিবন্ধী মারমা নারীর ধর্ষিত হওয়া থেকে অন্তঃসত্ত্বা এবং সামাজিক প্রথার নামে অর্থ ও শূকরের বিনিময়ে তিন ধর্ষককে দায়মুক্তি দেয়ার ঘটনাটি ১৯ অক্টোবর রোববার রাঙামাটির সাংবাদিক আলমগীর মানিক তার অনলাইন পোর্টাল সিএইচটিটাইমস২৪.কম-এ এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।
সিএইচটিটাইমস২৪.কম-এ ‘রাঙামাটিতে ৩ জনের ধর্ষণে প্রতিবন্ধী মারমা নারী অন্তঃসত্ত্বা; প্রথা আইনে রেহাই’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটি পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো:
পাহাড়ে ‘সামাজিক বিচার’-এর নামে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বিচারবহির্ভূত প্রথার ভয়াবহ দৃষ্টান্ত আবারো উঠে এসেছে। এবার সামাজিক বিচারের নামে এক প্রতিবন্ধী মারমা এক নারীকে ধারাবাহিক ধর্ষণের মাধ্যমে ৫ মাসের গর্ভবতী করে দেওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত তিনজনকে মাত্র ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করে রেহাই দেয়া হয়েছে। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলাধীন চিৎমরম ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের চংড়াছড়ি মুখ এলাকায় শুক্রবার ১৭ অক্টোবর এই বিচারের ঘটনা ঘটে।
বিচারকদের রায়ে বলা হয়েছে, জরিমানার অর্থের মধ্যে ৩ লাখ টাকা ভিকটিমের অনাগত সন্তানের জন্য ব্যাংকে রাখা হবে এবং বাকি টাকা দিয়ে প্রথানুসারে সমাজের জন্য বন্যা বা শূকর ক্রয়ের জন্য ব্যয় করা হবে। এই ক্ষেত্রে ভিকটিম নারীর কাছ থেকেও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় সামাজিক বিচারে।
মারমা নারীকে ধর্ষকাণ্ডে অভিযুক্তরা হলেন ১. অনুচিং মারমা(৫০), ২. কালা মারমা (৫৫) ও ৩. মং উ মারমা (৩৫)। অভিযুক্ত তিনজন এবং ভিকটিম সকলেই মারমা সম্প্রদায়ের বলে প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সিং থোয়াই উ মারমা।
অভিযুক্তদের ধর্ষণে উক্ত প্রতিবন্ধী মারমা নারী বর্তমানে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হলেও সন্তানের পিতা কে সেটি নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি। ভিকটিম বিচারকদের জানিয়েছেন, তার সাথে অভিযুক্ত তিনজনই প্রতিনিয়ত রাত কাটিয়েছে।
৩নং চিৎমরম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবু ওয়েশ্লি মং চৌধূরীর কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে প্রতিবেদককে বলেন, বিচার হয়ে যাওয়ার পরে আমি ঘটনাটি শুনেছি। এলাকার কার্বারীরা এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন।
স্থানীয় আমছড়ি পাড়ার সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কার্বারী থুইচা প্রু মারমা প্রতিবেদককে বলেন, প্রথম বৈঠকের দিন আমাকে ডেকে নেওয়া হয়েছিলো। সেই বৈঠকে সকলের তথ্য সঠিক মনে না হওয়ায় আমি তাদেরকে তিনদিন সময় বেঁধে দিয়ে চলে এসেছিলাম। পরবর্তীতে আমি আর যেতে পারিনি। কিন্তু আমার এই ঘটনায় বিচার করে দিয়েছে বলে আমি জেনেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বেসরকারিভাবে বোমাং সার্কেল কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত কার্বারী অংমা খৈ মারমা, প্যানেল চেয়ারম্যান সাবেক মেম্বার ও কার্বারী সিং থোয়াই উ মারমা ও মংনু চিং মারমা এই তিনজনের নেতৃত্বে এই সামাজিক বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
বিচারকারি কার্বারী ও প্যানেল চেয়ারম্যান সিং থোয়াই উ মারমার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, আমরা বিষয়টি সামাজিকভাবে সমাধান করে ফেলেছি। বিস্তারিত জানতে চাইলে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ভিকটিম মহিলাটি ষোলআনা সুস্থ নয়; বারো আনার মতো সুস্থ। একজনের সাথে সম্পর্ক করতে দেখে অন্য আরেকজনে তার সাথে সম্পর্ক করে; এভাবে তিনজনের সাথেই উক্ত নারীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। একপর্যায়ে মহিলাটি গর্ভবর্তী হয়ে পড়ে।
চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে উক্ত ভিকটিম নারীর পেট ব্যথা শুরু হলে তার পেটে টিউমার হয়েছে বলে জানালেও এক পর্যায়ে একজন গ্রাম্য ধাত্রী উক্ত ভিকটিম গর্ভবর্তী বলে জানালে বিষয়টি জনসম্মুখে উঠে আসে। এরপর আমরা স্থানীয় তরুণ-তরুণীদের সম্পৃক্ত করে ১৫ জনের কমিটি করে সামাজিকভাবে বসে ভিকটিমকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তিনজন অভিযুক্তকে শনাক্ত করে দেখান। এরপর সংশ্লিষ্টরা সকলে তাদের অপরাধ স্বীকার করলে আমরা সকলেই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে অপরাধকারী তিনজনকে প্রতিজন এক লাখ ১০ হাজার টাকা করে মোট তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করে রায় দিই।
এই ঘটনায় উক্ত ভিকটিমকেও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে জানিয়ে সিং থোয়াই উ মারমা কার্বারী বলেন, উক্ত জরিমানার অর্থগুলো থেকে তিন লাখ টাকা অনাগত বাচ্চাটির জন্য ব্যাংকে ডিপোজিট করে রাখা হবে। আর আমাদের সমাজের প্রথা-রীতিমতো বন্যা (শূকর) দিতে হয় তাই সমাজের জন্য তিন অপরাধীর কাছ থেকে ৩০ হাজার এবং ভিকটিমের কাছ থেকে ৫ হাজার মোট ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছি।
এই ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে সমাজের জন্য শূকর কেনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, অনাগত বাচ্চাটির কোনো দোষ নাই। তাই তার সুস্থভাবে ডেলিভারির পাশাপাশি ভবিষ্যৎ লালনপালনের জন্য আমরা তিন লাখ টাকা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই জরিমানা টাকাগুলো আদায়ে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের তিনমাস সময় দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
নির্মম এই ঘটনাটি শুনেই চন্দ্রঘোনা থানা পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিকটিম ও তার পরিবারকে থানায় এসে লিখিত অভিযোগ দিতে অনুরোধ করলেও অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত তারা থানায় অভিযোগ দায়ের করেনি বলে প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন চন্দ্রঘোনা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শাহজাহান কামাল।
উক্ত এলাকাটি পাহাড়ের একটি প্রভাবশালী আঞ্চলিক দলের সশস্ত্রবাহিনীর দখলে থাকায় তাদের চাপে ভিকটিম পরিবারটি আইনের আশ্রয় নিতে পারছে না বলে জানিয়েছে স্থানীয় একটি সূত্র। নিরাপত্তা বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনা জানার পর প্রথমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি টিম ঘটনাস্থলে গেলেও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ব্যাপক উপস্থিতি এবং তাদের প্রত্যক্ষ বাধার কারণে ভিকটিমকে উদ্ধার করে থানায় আনা যায়নি।
মা ও ভাই ছাড়া আর কেউই ওই প্রতিবন্ধী নারী ভিকটিমের পাশে নেই একজন স্থানীয় বাসিন্দা প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, অভিযুক্তরা সকলেই প্রভাবশালী আঞ্চলিক দলের রাজনীতির সাথে জড়িত। তাই দলটির প্রত্যক্ষ চাপে ভিকটিম অন্তঃসত্ত্বা নারী ৫ মাসের পেটের সন্তানের পিতা কে চিহ্নিত করতে পারছেন না। তাকে ধারাবাহিকভাবে ধর্ষণকারী তিন অভিযুক্তের বিচারের দাবিও করতে পারছেন না।
স্থানীয় মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এই ঘটনা পাহাড়ে ‘সামাজিক বিচার’-এর নামে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বিচারবহির্ভূত প্রথার ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এবং প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ ছাড়া এমন অনৈতিক বিচার সংস্কৃতি বন্ধ করা সম্ভব নয়।

















