উপজেলা পরিষদ নির্বাচন

খাগড়াছড়ির তিন উপজেলায় নানা সমীকরণ, পানছড়িতে চেয়ারম্যান পদে নেই আ.লীগের প্রার্থী

fec-image

নির্বাচনি প্রচারণায় সরগরম হয়ে উঠেছে খাগড়াছড়ি সদর, পানছড়ি ও দীঘিনালাসহ তিন উপজেলার প্রতিটি জনপদ। তিন উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৯ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১১ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভোটারদের মন জয় করতে প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পোস্টারে ছেয়ে গেছে। চলছে গণসংযোগ ও মাইকিং।

তবে পানছড়িতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই। আঞ্চলিক সংগঠনের দুই প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিএনপির ভোট বর্জন ও আওয়ামী লীগেরও প্রার্থী না থাকায় ভোট নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই ভোটারদের মাঝে।

বিএনপির ভোট বর্জনের মুখে প্রচণ্ড তাপদাহ, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিতব্য খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পরিষদে প্রার্থীদের প্রচারণা চলছে। আগামী ২১ মে অনুষ্ঠিতব্য খাগড়াছড়ি সদরসহ উপজেলার নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪ জন এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় ভোট কেন্দ্র ৪১টি। মোট ভোটার ৯২ হাজার ৮৬৪ জন। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৪৭ হাজার ৮৯৫ ও নারী ভোটার ৪৪ হাজার ৯৬৯ জন।

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দিদারুল আলম (আনারস), সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মো. আকতার হোসেন (মোটরসাইকেল), গোলাবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জ্ঞান রঞ্জন ত্রিপুরা (কৈ মাছ) জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম (লাঙ্গল), বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুশীল জীবন ত্রিপুরা (টেলিফোন) ও ভারত প্রত্যাগত নেতা সন্তোষিত চাকমা (দোয়াত কলম) প্রতীকে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন।

ভাইস চেয়ারম্যান পদে মো. আসাদ উল্লাহ (বই), ক্যাউচিং মারমা (তালা), মো. আবু হানিফ (টিয়াপাখি), মো. এরশাদ হোসেন (চশমা) ও শাহাবুদ্দিন সরকার পেয়েছেন (টিউবওয়েল) প্রতীক।

মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে কল্যাণী ত্রিপুরা (কলস), নিউসা মগ (প্রজাপতি) ও নিপু ত্রিপুরা (ফুটবল) নিয়ে নির্বাচন করছেন।

দিদারুল আলম ৩২ বছরের রাজনীতি ক্যারিয়ারে দুই মেয়াদে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার বড় ভাই জাহেদুল আলম টানা ২৭ বছর খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। অপর বড় ভাই মো. রফিকুল আলম খাগড়াছড়ি পৌরসভায় দুই মেয়াদে মেয়র ছিলেন।
দিদারুল আলম বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে দিন-রাত নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তিনি বিজয়ে আশাবাদী এবং নির্বাচিত হলে উপজেলা পরিষদকে সেবা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে জানান।

দিদারুল আলম রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও জড়িত। মিশুক ও সামাজিক প্রকৃতির দিদারুল আলম আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক পরিবারের পাশাপাশি পাহাড়ি সম্প্রদায়ের কাছেও তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

প্রয়াত খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রদল ও যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিলের হাত ধরে মো. আকতার হোসেনের রাজনীতিতে আসা। পরবর্তীতে মো. আকতার হোসেন খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। ২০১১ সালের ১০ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন দীপ্ত ও প্রয়াত জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল এ কমিটি অনুমোদন দেন। পরবর্তীতে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন এবং সাবেক মেয়র মো. রফিকুল আলমের সাথে বালুসহ বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মো. আক্তার হোসেন ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হন। এ সময় সাবেক মেয়র রফিকুল আলমকে আকতার হোসেনের পক্ষে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে।

আকতার হোসেন দিন-রাত প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বিজয়ে আশাবাদব্যক্ত করে বলেন, অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য তিনি প্রার্থী হয়েছেন। ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন।

গোলাবাড়ী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা জ্ঞান রঞ্জন ত্রিপুরা (কৈ মাছ) প্রচার চালাচ্ছেন প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায়। তিনি বিগত ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালীন বাস্তবায়িত উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। প্রচারণায় পিছিয়ে সুশীল জীবন ত্রিপুরা (টেলিফোন) ও ভারত প্রত্যাগত নেতা সন্তোষিত চাকমাও (দোয়াত-কলম)। তবে নীরব লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী নজরুল ইসলাম।

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পরিষদে কতিপয় প্রার্থী তার পক্ষে বিএনপির সমর্থন রয়েছে এমন প্রচারণা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম এন আবছার বলেন, বিএনপি ভোট বর্জন করেছে। ভোটাররা যাতে ভোট কেন্দ্রে না যান তার জন্য লিফলেট বিতরণসহ নানা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কাজেই কোন প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালানো সুযোগ নেই। কোন বিএনপির নেতার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে বহিষ্কার করা হবে।

দীঘিনালা উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে দুই জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। দীঘিনালা উপজেলার ভোট কেন্দ্র ৩৬টি। মোট ভোটার ৯০ হাজার ১৯৪। পুরুষ ভোটার ৪৬ হাজার ৮১ জন ও নারী ভোটার ৪৪ হাজার ১১২ জন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দীঘিনালা উপজেলায় তিনটি কেন্দ্র ভোট শূন্য ও পাঁচটি কেন্দ্রে ১৮ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। দুর্গম নাড়াইছড়িতে ভোটার সরঞ্জাম যাবে হেলিকাপ্টারে।

দীঘিনালায় চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মো. কাশেম (আনারস) ও ইউপিডিএফ প্রসীত সমর্থিত প্রার্থী ধর্ম জ্যোতি চাকমা (মোটরসাইকেল)। দুই প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণায় সরগরম দীঘিনালার প্রত্যন্ত জনপদ। উভয় প্রার্থীই জয়ে আশাবাদী। ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীরাও বসে নেই।

দীঘিনালায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে মোস্তফা কামাল মিন্টু (টিউবওয়েল), সোলাইমান (টিয়াপাখি ) ও সুসময় চাকমা (চশমা)। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সীমা দেওয়ান (কলসী) ও বিলকিছ বেগম পেয়েছেন (প্রজাপতি) প্রতীক।

পানছড়ি উপজেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের কোন নেতাকর্মী চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়নি। সেখানে দুই আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ প্রসীত ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পানছড়ি উপজেলার ২৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ১১টিতে শূন্য ভোট ও অপর কেন্দ্রে মাত্র একটি ভোট পড়ে। পানছড়িতে মোট ভোটার ৫৬ হাজার ৫ ভোট। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার ২৮ হাজার ২৪ ভোট ও নারী ভোটার ২৭ হাজার ৯৮০ ভোট।

পানছড়িতে চেয়ারম্যান পদে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক সমর্থিত প্রার্থী মিটন চাকমা (আনারস) ও বর্তমান উপজেলা পরিষদের ইউপিডিএফ প্রসীত সমর্থিত চন্দ দেব চাকমা (কাপ-পিরিচ) নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।

ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ সমর্থিত প্রার্থী পানছড়ির প্রত্যন্ত এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালালেও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রচারণা বাজার কেন্দ্রিক। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই আঞ্চলিক দলের প্রার্থীর কারণে এ উপজেলার সাধারণ ভোটাররা নির্বাচনের দিন সংঘাতে আশঙ্কায় আতঙ্কিত। দুই আঞ্চলিক দলের প্রার্থী নিজেদের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হলেও বিএনপির বর্জন ও আওয়ামী লীগেরও প্রার্থী না থাকায় ভোট নিয়ে আগ্রহ নেই ভোটারদের মাঝে।

মিটন চাকমা তিনি নির্বাচিত হলে সহাবস্থান ও উন্নয়ন নিশ্চিত করবেন। অপরদিকে চন্দ্র দেব চাকমা বলেন, অবাধ,সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে তিনিই নির্বাচিত হবে।

পানছড়িতে ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) পদে লোকমান হোসেন (বৈদ্যুতিক বাল্ব), জয়নাথ দেব (তালা), সৈকত চাকমা (টিউবওয়েল) ও কিরণ ত্রিপুরা পেয়েছেন (চশমা)। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনিতা ত্রিপুরা (ফুটবল) ও সুজাতা চাকমা (কলস) প্রতীক নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।

রির্টানিং অফিসার ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জোনায়েদ কবীর সোহাগ বলেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে প্রশাসনের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। এ ব্যাপারে সকল প্রার্থীর সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

প্রার্থীদের নির্বাচনের আচরণবিধি মেনে প্রচারণা চালানোর অনুরোধ জানিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, আচরণ বিধি লঙ্ঘিত হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু করতে প্রতিটি উপজেলাতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সমন্বয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

পাহাড়ে জাতীয় রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নানা ভাবে আলোচিত। খাগড়াছড়ি উপজেলা নির্বাচনেও কাজ করে নানামুখী সমীকরণ। তাই নির্বাচনে কোন-কোন প্রার্থী নির্বাচিত হবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে শেষ দিন পর্যন্ত।

 

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, খাগড়াছড়ি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন