চন্দ্রপাহাড় রিসোর্টে স্থানীয় উপজাতিদের আর্থসামাজিক ও জীবনমান উন্নয়ন ঘটবে

fec-image

বান্দরবান-থানচি সড়কের নীলগিরির কাছাকাছি এলাকায় চন্দ্রপাহাড়। চিম্বুক রেঞ্জের অংশ হওয়ায় পাহাড়ীদের কাছে এটি ‘চিম্বুক পাহাড়’ নামেই পরিচিত। আবার অনেকে চন্দ্রপাহাড় নামে চেনে। জেলার লামা উপজেলার আওতাধীন চন্দ্রপাহাড়ের পূর্বদিকে থানচি সড়ক, পশ্চিমে নিচু পাহাড়, উত্তরে পাহাড় এবং দক্ষিণে ৯০ডিগ্রী পাহাড়ের ঢাল।

বান্দরবান সদর থেকে ৫০কিলোমিটার পর থানচি প্রধান সড়ক ও লামা উপজেলা সীমানা লাগোয়া ওই পাহাড়ের আশপাশে নেই কোন বসতী বা বনায়ন। বর্তমানে সরকারী খাস খতিয়ানের ওই ২০ একর জায়গায় ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। পাহাড়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ও প্রকৃতি ঠিক রেখে উন্নত বিশ্বের মতো তৈরি করা হবে এই ফাইভ স্টার হোটেল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চন্দ্রপাহাড়ে আর্ন্তজাতিক মানের রিসোর্ট ও ক্যাবল কার নির্মাণের এই প্রকল্পে বিনিয়োগ হবে ২শ থেকে ২৫০ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে পাহাড়ের উপর দিয়ে ওই এলাকায় বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে। চলছে ভবন নির্মাণের সার্ভে কাজ এবং পানির সংযোগ স্থাপন। আর্মি ওয়েল ট্রাস্ট, সিকদার গ্রুপ এবং জেলা পরিষদ যৌথ উদ্যোগে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে।

এই প্রকল্পের বেশ কিছু পরিকল্পানার মধ্যে রয়েছে- পর্যটকদের জন্য আর্ন্তজাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা। ২০০ থেকে ২৫০ পরিবার থাকার ব্যবস্থা। এছাড়া সুইমিংপুল, জিমনেশিয়াম, বিভিন্ন ধরেনের রাইডস, বাচ্চাদের খেলার জায়গাসহ বিনোদনের ব্যবস্থা, নীলগিরির সাথে ক্যাবলকার সংযোগ স্থাপন। জেলা সদর থেকে রিসোর্টেও নিজস্ব পরিবহণ, নিজস্ব হেলিপ্যাড স্থাপন হবে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এয়ারপোর্ট, ট্রেন স্টেশন, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে পর্যটকদের আনতে নিজস্ব পরিবহন সুবিধা থাকবে। নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা পর্যটকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

প্রকল্পটিতে তিন ক্যাটাগরি সুযোগ সুবিধা থাকবে। সাধারণ, মিড লেভেল এবং হাই এন্ড। সাধারণ হোটেল ছাড়াও ২৫টি কটেজ থাকবে। প্রত্যেক জোনের জন্য আলাদা সুমিংপুল, রেস্টুরেন্ট, কিডস জোন, হর্স রাইডিং থাকবে। এছাড়াও লোকাল গাইড, উপজাতীয় সংস্কৃতির মাধ্যমে পর্যটকদের স্বাগত জানানো, নিয়মিত উপজাতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকবে। চন্দ্রপাহাড় রিসোর্ট থেকে নীলগিরি পর্যন্ত ২ কি. মি. দীর্ঘ দ্বিমুখী ক্যাবল কার, মিডল স্টপেজে কফিশট, গিফট শপ থাকবে, রিসোর্ট থেকে সাঙ্গু নদী পর্যন্ত ক্যাবল কারের মাধ্যমে যাতায়াতের সুবিধা, সাঙ্গু নদীতে ওয়াটার স্পোর্টস সুবিধাও থাকবে। সব মিলিয়ে প্রকল্পটি একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের কথা বিবেচনায় ২০১৬ সনের ১৬জুন খাস খতিয়ানের পরিত্যক্ত চন্দ্রপাহাড়ে ২০ একর জায়গায় আর্ন্তজাতিক মানের রিসোর্ট নির্মাণের জন্য সরকারের কাছ থেকে ৩৫ বছরের জন্য লীজ নিয়েছিল আর্মি ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট ও সিকদার গ্রুপ।

কিন্তু চার বছর পরে এসে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে গিয়ে আপত্তির মুখে পড়েছে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। গত দু’সপ্তাহ ধরে এই প্রকল্পের পক্ষে-বিপক্ষে একাধিক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। প্রকল্পের কাজ থেকে সরে আসার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা, সিএইচটি কমিশন, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

ওই প্রকল্পের পাশের গ্রাম ধোলাইপাড়া, কোণাইপাড়া, কাপ্রুপাড়া এলাকার উপজাতীদের পক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবী, সিকদার গ্রুপ সেনা কল্যাণ ট্রাস্টকে নিয়ে কাপ্রুপাড়া থেকে নাইতং পাহাড় হয়ে জীবননগর পর্যন্ত স্থাপনা নির্মাণের জন্য জমি দখলের পাঁয়তারা করছে। যার ফলে  ম্রোদের চারটি গ্রামের ৭০ থেকে ১১৬টি পাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ১০ হাজারের মতো জুমচাষি উদ্বাস্তু হওয়ারও শঙ্কার কথা জানান।

প্রকৃতপক্ষে সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্প এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে কোন জনবসতি নেই। দূরের কলাইপাড়া, ধলাইপাড়াসহ তিনটি গ্রাম থাকলেও সেখানে সবমিলিয়ে ম্রো জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৬-৭শ। বর্তমানে সেসব গ্রামের অনেকে প্রকল্প এলাকায় মজুরী ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। এতে করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে তারা।

চন্দ্র পাহাড় রিসোর্ট প্রকল্পের চিফ কো অর্ডিনেটর ফরিদ উদ্দীন খান রুমী পার্বত্যনিউজকে বলেন, এই রিসোর্টটি বাংলাদেশের একটি ল্যান্ড মার্ক রিসোর্টে পরিণত হবে। আমরা এটাকে এমনবাবে গড়ে তুলতে চায় যাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কোনো বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধান এলে তিনি যেন সরাসরি এখানে আসেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে এখানেই বৈঠক, সম্মেলন করেন- এমন সুবিধা ও আকর্ষণীয় হবে এই রিসোর্টটি। এটির ব্যবস্থাপনায় থাকবে আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন ম্যারিয়ট।

তিনি আরো বলেন, এই প্রকল্পে প্রত্যক্ষভাবে ২০০-২৫০জন মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এই বেশিরভাগই হবে স্থানীয়। আমরা তাদের ঢাকায় এনে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলবো।

অন্যদিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, পরিত্যাক্ত চন্দ্রপাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত হাজেরখানেক উপজাতীয় বাসিন্দার কর্মসংস্থান হবে। অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত যাতায়াত নিশ্চিত হবে, পাহাড়ী জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। এতে করে পাহাড়ী জনগণ তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য পর্যটকদের কাছে নায্যমূল্যে বিক্রি করার সুযোগ হবে। এছাড়া রাস্তার দুই ধারে ফলের দোকান, রেস্তোরার মাধ্যমে উপজাতীয় জনগণ তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করতে পারবে।

এদিকে এই প্রতিবেদক গত ১৫ ও ২০ নভেম্বর পৃথকভাবে সরেজমিনে পরিদর্শন করার পর পাওয়া গেছে ভিন্ন চিত্র। কথা হয় আন্দোলনরত একাধিক ম্রো জনগোষ্টীর লোকের সাথে। তাদের মধ্যে দুইজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রসহ বিভিন্ন বয়সী কৃষক ও বেকার যুবক ছিল। তারা এই পর্যটনের বিরুদ্ধে নন। কিন্তু তাদের অধিকাংশের দাবী, পর্যটনের আগে তারা নীলগিরি এলাকায় স্কুল, হাসপাতাল ও বিদ্যুৎ চান।

সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন এর বান্দরবান জেলা সভাপতি ডনাই প্রু নেলী বলেন, নেপালে সংষ্কৃতি ধ্বংস করে উন্নয়ন করা হয়নি। প্রকৃতি, ঐতিহ্য, সংষ্কৃতি ধরে রাখা হয়েছে। বান্দরবানেও সেরকম উন্নয়ন চান তিনি।

এই প্রসঙ্গে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন,  বর্তমান সরকার পাহাড়ের মানুষের আর্থ- সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে। তবে রাজনৈতি স্বার্থ হাসিলের এখানে অনেক কিছু আছে। তৃতীয় পক্ষ, চতুর্থপক্ষ এখানে জড়িয়ে পড়েছে। তারা চায় না পাহাড়ে উন্নয়ন হউক। কিন্তু একটি পক্ষ চায় না পার্বত্য বান্দরবানে আন্তর্জাতিক মানের কোন হোটেল মোটেল বা পর্যটন হোক। স্বার্থান্বেষী এই মহলটি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমা বলেন, পর্যটন কেন্দ্র উন্নয়ন নিয়ে কোনো নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবেনা।

সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আরো বলেন, হোটেল নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত জায়গাটির আশেপাশে কোন পাড়া বা অতীতে কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। এরপরও সম্প্রতি সময়ে একটি মহল মানববন্ধন কর্মসূচিসহ বিভিন্ন অযৌক্তিক প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন।

এদিকে নীলগিরিতে উন্নয়নের পক্ষে সম্প্রতি বান্দরবানে মানববন্ধন করেছেন ম্রো সম্প্রদায়। ওই মানববন্ধনে ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের স্বার্থে পাহাড়ে উন্নয়ন চান তারা। কিন্তু পাহাড়ের একটি স্বার্থনেষী মহল এর বিরোধিতা করছে দাবী করা হয়।

মানববন্ধনে বক্তৃতায় ম্রো সম্প্রদায়ের নেতা মাংসাং ম্রো বলেছেন, ম্রো সম্প্রদায় নিরীহ একটা জনগোষ্ঠী। আমরা সেনাবাহিনীর সাথে বিরোধ চাই না। কিন্তু একটি স্বার্থনেষী মহল ম্রো সম্প্রদায়ের পক্ষে স্মারকলিপিসহ আন্দোলনের নামে বিরোধ সৃষ্টি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এই বিরোধের কারণে বান্দরবানের উন্নয়নের ধারা ব্যহত হবে।

অংলা গা ম্রো বলেন- স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাস দমনে সেনাবাহিনীর সাথে ম্রো সম্প্রদায় একাত্ম হয়ে কাজ করার ফলে সেনাবাহিনী এবং ম্রোদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরী হয়েছে। সেনাবাহিনী ম্রো ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল ও হোস্টেল তৈরী করেছে, শিক্ষা উপকরণ, আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সেনাবাহিনীর বিপক্ষে দাঁড় করানো হয়েছে ম্রো জনগোষ্ঠীকে। আমরা বিরোধ চাই না। পাহাড়ে উন্নয়ন চাই।

ম্রো নেতা মেনরো ম্রো বলেন, সেনাবাহিনী কর্তৃক ৮শ থেকে ১হাজার একর জায়গা দখল করার কথা সত্য নয়। মূলত ২০ একর জায়গায় আধুনিক হোটেল হচ্ছে শুনেছি। এতে করে ওই এলাকার যোগাযোগ, বিদ্যুতায়নসহ নাগরিক সুবিধা বাড়বে।

স্থানীয় নেতা জীবন ত্রিপুরা বলেন, চন্দ্রপাহাড়ের পার্শ্ববর্তী নীলগিরি পর্যটন হওয়ার কারনে আশপাশের মানুষের জীবন জীবিকার উন্নয়ন হয়েছে। আশপাশের মানুষ ফলমূল বিক্রি ও ব্যবসা করার সুযোগ পেয়েছে। এই অবস্থায় চন্দ্রপাহাড়ে আধুনিক হোটেল হলে ম্রো সম্প্রদায়ের উন্নয়ন হবে। কিন্তু এই উন্নয়ন চায়না পাহাড়ের একটি মহল।

পাহাড়ে উন্নয়নের বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, সহজ সরল সাধারণ পাহাড়ীদের ভুল বুঝিয়ে মূলত সেনাবাহিনীকে বির্তকিত করতে ষড়যন্ত্র করছে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। বান্দরবানের দ্বিতীয় বৃহৎ এই ম্রো সম্প্রদায়ের সহজ সরল মানুষগুলোকে ব্যবহার করে নিজেদের ফায়দা হাসিলের ষড়যন্ত্র করছে তারা। জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের মতে, চন্দ্রপাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল হলে ম্রো জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত-অশিক্ষিত ছেলে মেয়ের কর্মসংস্থান হবে। বর্তমানে সেখানে একটা পরিবারেরও বসতবাড়ি নেই। কেউ উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন