চীন-বাংলাদেশ নতুন অধ্যায়ের সূচনা

fec-image

বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সক্রিয়ভাবে সাড়া দিয়েছে বাংলাদেশ।

বৃহৎ জনগোষ্ঠী, একই রকম জাতীয় পরিস্থিতি, অভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্য এবং উচ্চ মাত্রায় ‘কমপ্লিমেন্টারি’ শিল্প নিয়ে চীন ও বাংলাদেশ উভয়েই উন্নয়নশীল দেশ। বেল্ট এন্ড রোড উদ্যোগ একত্রে গড়ে তোলার জন্য আমরা প্রাকৃতিক অংশীদার।

২০১৬ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এ সময় উভয় পক্ষ বিআরআইয়ের অধীনে সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর করে। কৌশলগত অংশীদারিত্বে সহযোগিতার জন্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে উন্নত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এতে উভয় দেশের জন্য ‘বিজয়-বিজয়’ ভিত্তিক সহযোগিতার নতুন এক সুযোগ আসে। তখন থেকেই, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গতি পেয়েছে।

দ্রুত ত্বরান্বিত হচ্ছে উন্নয়ন। একটানা বহু বছর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হলো চীন। আর বর্তমানে এই পারস্পরিক সুবিধাসম্বলিত সহযোগিতা ঐতিহাসিক এক নতুন উচ্চতায় উঠে গেছে।

কোভিড-১৯ মহামারি মানবতায় এক বিরল হতাশা নিয়ে এসেছে। করোনা ভাইরাসের দ্রুত বিস্তারের ফলে বাংলাদেশও বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। চীন ও বাংলাদেশ একে অন্যকে ‘সাপোর্ট’ দিয়েছে। একে অন্যকে সাহায্য করেছে।

এই সঙ্কটের কঠিন সময়ে একে অন্যের সঙ্গে ইতিবাচক ভূমিকায় সাড়া দিয়েছে। সহযোগিতা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের চলমান ধারায় একটি মডেল হিসেবে বিশদভাবে চিত্রিত করা হয়েছে বেল্ট এন্ড রোড উদ্যোগকে।

ঐক্যমত গঠনের পথ: বিআরআই হলো ঐকমত এবং সহযোগিতা গড়ে তোলার একটি পন্থা। ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময়ে, দুই দেশের শীর্ষ নেতারা সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন এবং সহযোগিতার এক নিরেট ভিত্তি গড়ে তুলেছেন।

ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া করোনা মহামারির বিরুদ্ধে চীনকে শক্ত সমর্থন দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সক্ষমতার অধীনে চীনকে সহযোগিতা প্রস্তাব করা হয়েছে।

২০ শে মে দুই দেশের নেতারা ‘টেলিফোন কূটনীতি’র আশ্রয় নিয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারিকালে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে পারস্পরিক সমর্থনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন তারা।

এই মহামারির প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক যে প্রতিক্রিয়া তার প্রতি তাদের যৌথ প্রতিশ্রুতি পুনরায় নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যুতে একমত হয়েছেন। যেমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক যৌথ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও সহযোগিতা চর্চার মতো ইস্যু রয়েছে।

জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা: সব সময়ই হেলথ সিল্ক রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মেডিকেল সহযোগিতা। সাংহাইয়ের হুয়াশান হাসপাতালের সুপরিচিত সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ঝাং ওয়েনহংকে এপ্রিলে আমন্ত্রণ জানায় বাংলাদেশে অবস্থিত চীনা দূতাবাস।

এর উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অনলাইনে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা। এটা হলো কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীনের অভিজ্ঞতা শেয়ারের একটি উত্তম সূচনা।

জুনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ফোনকলে কথা হয়। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল হলো, চীনা সরকার বাংলাদেশে মেডিকেল বিশেষজ্ঞদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

উদ্দেশ্য ওই টিমটি স্থানীয় চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করবেন এবং কীভাবে পেশাদারী গাইডেন্সের অধীনে মহামারির বিরুদ্ধে অধিক টার্গেটেড ব্যবস্থা নিতে পারে বাংলাদেশ সরকার, সে বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক লিখিত প্রস্তাব জমা দেয়া।

বর্তমানে উভয় দেশই সক্রিয়ভাবে করোনা টিকা নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন সহযোগিতা নিয়ে প্রযুক্তিগত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছে । প্রাসঙ্গিক এসব প্রাকটিক্যাল পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে চীন ও বাংলাদেশের মানুষের উপকারে আসবে। অবশ্যই উভয় দেশের মানুষের স্বাস্থ্যখাতে অপরিমিত অবদান রাখবে চায়না-বাংলাদেশ কমিউনিটি অব পাবলিক হেলথ।

সমৃদ্ধির অভিন্ন পথ: মহামারিকালে, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বেল্ট এন্ড রোড সহযোগিতামূলক প্রকল্পগুলো কখনো বন্ধ হয়ে থাকে নি। এর মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্প ও কর্ণফুলি নদীর টানেল নির্মাণ।

মে মাসে পায়রায় দেশের বৃহত্তম ২৬৬০ মেগাওয়াটের কয়লা চালিত বিদ্যুতকেন্দ্রের একটি ইউনিটের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এটি চালু করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সেখান থেকে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত সরবরাহ শুরু হয়েছে।

২রা আগস্ট কর্ণফুলি টানেল প্রজেক্টে বাম লাইন সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে একটি বড় সফলতা অর্জন করেছে। জুলাই মাসে বাংলাদেশের জন্য শতকরা ৯৭ ভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা অনুমোদন করেছে চীন। এর ফলে চীনে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটি নতুন স্বর্ণালি যুগের সূচনা হয়েছে।

অবকাঠামো খাতে বেল্ট এন্ড রোড সহযোগিতা সুস্পষ্টভাবে উভয় দেশের জনগণকে উপকৃত করেছে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধার দিক দিয়ে। বছরের দ্বিতীয় চতুর্ভাগে চীনের জাতীয় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে শতকরা ৩.২ ভাগ। চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য মতে, মাস থেকে মাসের হিসাবে এটা ছিল শতকরা ১১.৫ ভাগ।

বৈশ্বিক অর্থনীতির অবনতিশীল পরিস্থিতিতে, এটা খুশির খবর। এটা চীনের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করে। এসব কিছুর ফলে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশের কাছে নিঃসন্দেহে আস্থা ও আশা বহন করে এনেছে চীন।

করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে কাজ ও উৎপাদন শুরুর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা বিনিময়ে বাংলাদেশ ও চীন উভয় দেশের রয়েছে সংকল্প ও সক্ষমতা। এ ছাড়া বিআরআইয়ের অধীনে যৌথ উন্নয়ন কর্মকান্ডকে সামনে এগিয়ে নেয়ার সক্ষমতা রয়েছে।

জটিল এক পরিস্থিতিতে জটিলতাকে কাটিয়ে উঠে স্থিতিশীল উন্নয়ন অর্জনের মতো আস্থা ও প্রজ্ঞা রয়েছে বাংলাদেশ ও চীনের। এর ফলে ভবিষ্যতে অবিচল ও টেকসই সহযোগিতা নিশ্চিত করবে।

চীন ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪৫তম বর্ষ এ বছর পালিত হচ্ছে। গত ৪৫ বছর ধরে চীন ও বাংলাদেশ একে অন্যের প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। একে অন্যকে অনুধাবন করেছে এবং সমর্থন দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বকে সামনে এগিয়ে নিয়েছে। একে অন্যের মূল উদ্বেগে সক্রিয়ভাবে সাড়া দিয়েছে।

চীন এবং বাংলাদেশ ব্যাপক সম্ভাবনাময় বিআরআইয়ের পুরোপুরি সুবিধা নেয়া অব্যাহত রাখবে। এ উদ্যোগের যৌথ পদক্ষেপ অনুমোদন করবে। অনুমোদন করবে তাদের উন্নয়ন কৌশল। দুই দেশের উচ্চ মানের লক্ষ্য, স্থিতিশীলতা এবং জনকেন্দ্রীকতাকে সামনে রেখে এগিয়ে যাবে দুই দেশ।

(লেখক বাংলাদেশে নিয়োজিত চীনা রাষ্ট্রদূত। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে)

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: গ্লোবাল টাইমস, চীন, বাংলাদেশ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন