অমানবিক!

দিল্লি থেকে ৪০ রোহিঙ্গাকে ধরে যেভাবে আন্দামান সাগরে ফেলে দিল ভারত

fec-image

৮ মে সন্ধ্যায় দিল্লির এক তরুণ রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার থেকে একটি ফোনকল পান। ফোনের অন্য পাশে ছিলেন তার বাবা-মা। তিনি বলেন, আমার বাবা-মা আমাকে জানানা যে তাদের সমুদ্রের মাঝখানে ফেলে দেয়া হয়েছিল।

মাত্র দুই দিন আগেই তিনি দেখেছিলেন পুলিশ তাদের বাড়ি থেকে তার বাবা-মাসহ আরও ৪১ জনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর ফোনে তার বাবা-মা তাকে এক নির্মম অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেন।

যেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের আন্দামান সাগরে একটি নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে নামিয়ে দিয়ে কেবল লাইফ জ্যাকেট দিয়ে সাঁতরে মিয়ানমারের ভূখণ্ডে পৌঁছাতে বাধ্য করে।

তারা যখন উপকূলে পৌঁছান তখন এক জেলের কাছ থেকে ফোন নিয়ে ছেলেকে কল করেন। ছেলেটি বলেন, তারা ভয় পাচ্ছিলেন যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের যে কোনো সময় ধরে নিয়ে যেতে পারে।

তবে ভাগ্যক্রমে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নয়, বরং ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে নির্বাসনে থাকা মিয়ানমারের বেসামরিক সরকার ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’ (এনইউজি)-এর নিয়ন্ত্রণাধীন এক এলাকায় উঠে পড়েছিলেন।

এনইউজি জানিয়েছে, তাদের সশস্ত্র শাখা ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’-এর হেফাজতে ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে।

তাদের মানবাধিকার বিষয়ক উপমন্ত্রী এবং সরকারের একমাত্র রোহিঙ্গা সদস্য আউং কিয়াও মোয়ে জানান, উদ্ধার হওয়া শরণার্থীরা বলেছে যে তাদের জোরপূর্বক সমুদ্রে নামিয়ে দিয়ে ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা নিশ্চিত করছি যে তারা নিরাপদ এবং প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা পাচ্ছেন। তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাও করা হবে।

সংবাদমাধ্যম স্ক্রোল ফোনকলের রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখেছে, যেখানে রোহিঙ্গারা তাদের সমুদ্রপথে জোরপূর্বক বিতাড়নের কথা জানিয়েছে।

এক কল রেকর্ডিং-এ একজন শরণার্থী অভিযোগ করেন, তাদের মারধর করা হয়েছিল এবং ভুলভাবে অভিযোগ করা হয় যে তারা পাহেলগামের সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িত এবং হিন্দুদের হত্যা করেছে। যার কোনো প্রমাণ নেই।

স্ক্রোল এনইউজি এর দেওয়া ৪০ জনের একটি তালিকা এবং দিল্লিতে আটক ৪৩ জনের তালিকা মিলিয়ে দেখে ৩৬ জনের পরিচয় মিলে গেছে।

একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী দিল্লিতে থাকা তার পরিবারের পাঁচ সদস্যের ছবি চিনে স্বস্তি প্রকাশ করেন। বিশেষজ্ঞারা জানিয়েছে, এই পদ্ধতিতে বিতাড়ন ভারতের আইন ও আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনের লঙ্ঘন।

এ সব শরণার্থীরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থায় (ইউএনএইচসিআর) নথিভুক্ত ছিলেন এবং আইডেন্টিটি কার্ড বহন করতেন।

পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিভারিটিজ এক বিবৃতিতে বলেছে, এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং ভারতের নিজস্ব আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।

আউং কিয়াও মোয়ে বলেন, যেখানে তারা গণহত্যা থেকে পালিয়ে এসেছিল, সেখানে আবার পাঠানো হচ্ছে। এটা তাদের আবার সেই নরকে ফেলার মতো অবস্থা।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদনকারী থমাস অ্যান্ড্রুজ বলেন, শরণার্থীদের নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার চিন্তাই অগ্রহণযোগ্য। তিনি জানান, জাতিসংঘ এই অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে।

দিল্লির দুই রোহিঙ্গা শরণার্থী সুপ্রিমকোর্টে একটি আবেদন দায়ের করেছেন, যাতে এই বিতাড়নের পদ্ধতি এবং তাদের ফিরিয়ে আনার দাবি জানানো হয়েছে।

ভারত সরকার এই বিতাড়নের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ৬ মে সন্ধ্যায় দিল্লি পুলিশের অভিযানে মুসলিম ও খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের বাড়িতে হানা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। সুপ্রিমকোর্টে দায়ের করা আবেদনে বলা হয়েছে, ৪৩ জনকে আটক করা হয়েছিল।

একজন বলেন, আমার স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, পুলিশ জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। বাড়িতে গিয়ে আমার বাবা-মাকে আমাদের সন্তানদের সামনে ধরে নিয়ে যায়, কিছু না জানিয়ে।

আরেকজন অভিযোগ করেন, পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তারা নারীদের ধরে নিয়ে যায়। যেখানে নারী পুলিশ থাকা উচিত ছিল। আটকদের মধ্যে ১৩ জন নারী, ৪ জন প্রবীণ, একজন ক্যান্সার রোগী ও ৯ জন কিশোর-কিশোরী ছিল।

৭ মে তাদের ইন্দরলোক ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। একজন বলেন, তাদের বলা হয়েছিল বায়োমেট্রিক নেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এক পর্যায়ে তাদের দিল্লির এক বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পাঠানো হয়। যা মিয়ানমারের কাছাকাছি।

পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছে, তাদের ইউএনএইচসিআর-এর পরিচয়পত্র, অর্থ ও মালপত্র কেড়ে নেওয়া হয়। একটি জাহাজে তোলা হয়, চোখ বেঁধে, হাত বাঁধা অবস্থায়।

জাহাজে আবারও মারধর এবং পাহেলগাম হামলার সঙ্গে মিথ্যা সংযোগের অভিযোগ তোলা হয়। পরে বলা হয়, তারা চাইলেই ইন্দোনেশিয়া যেতে পারে। মিয়ানমারে নয়। শেষে, তাদের লাইফ জ্যাকেট দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। তারা সাঁতরে মায়ানমারের উপকূলে পৌঁছান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন