পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠন ত্যাগ করলেই খুন, গুম ও অপহরণ !!!

সন্তোষ বড়ুয়া, রাংগামাটি:

পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কাছে জিম্মি সাধারণ পাহাড়িরা। তাদের কোন বাক স্বাধীনতা নেই। মূলধারার রাজনীতি করতে মানা পাহাড়িদের। ইউপিডিএফ কিংবা জেএসএস ব্যতীত মূল ধারার যে কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দিলেই তাদের উপর নেমে আসে খুন, গুম বা অপহরণের মত অরাজকতা। এমন অনেক উদাহরণ আছে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে। অতীতের ঘটনাগুলো তুলে ধরার আগে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এমন একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করছি আমার লেখা।

গত ১৪ এপ্রিল সমস্ত মানুষ যখন পহেলা বৈশাখ এবং বৈসাবীর আনন্দে মাতোয়ারা ঠিক তখনই বান্দরবানে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস ছেড়ে আওয়ামী লীগ সমর্থন করায় অংক্যচিং মারমা নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করেছে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। রাত ১০টার দিকে বান্দরবান জেলার রাজবিলা ইউনিয়নের তাইংখালী বাজারপাড়ায় এই ঘটনা ঘটে। অংক্যচিং মারমা একসময় সন্তু লারমার দল জেএসএস এর হয়ে সশস্ত্র কার্যক্রম চালাতো এবং চাঁদাবাজি করতো। তখন সে রাংগামাটি জেলার রাজস্থলী এলাকায় বসবাস করতো।

কিন্তু এক পর্যায়ে অংক্যচিং মারমা সন্তু লারমার দলের হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করার পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তখন থেকেই অংক্যচিং মারমাকে নানান ধরনের হুমকি দিতে থাকে সন্তু লারমার দল- জেএসএস। প্রাণভয়ে অংক্যচিং মারমা রাজস্থলীতে তার নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে স্বপরিবারে গত ৮ বছর আগে বান্দরবান জেলার রাজবিলা ইউনিয়নে এসে বসতি গড়ে। এরপর অংক্যচিং মারমা মূলধারার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

অংক্যচিং মারমার ছেলে বাবুল মারমা রাজবিলা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে বর্তমানে সক্রিয় আছে। সন্তু লারমার দল ‘জেএসএস’ ছেড়ে আওয়ামী লীগ সমর্থন করায় অংক্যচিং মারমাকে গুলি করে হত্যার প্রচেষ্টা চালায় জেএসএস’র সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তাদের টার্গেটে হয়তো বাবুল মারমাও ছিলো। তবে পিতা-পুত্র উভয়েরই ভাগ্য ভালো এই জন্য যে, ঘটনার সময় বাবুল মারমা বাসায় ছিলো না আর অংক্যচিং মারমা গুলিবিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যান। যদিও অংক্যচিং মারমা এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন।

তিন পার্বত্য জেলায় এরকম আরো অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা মূলধারার রাজনীতি করার অপরাধে অপহৃত হয়ে লাশ হয়ে ফিরেছেন। আবার কেউবা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন। অনেকেই আছেন যারা অপহরণের পর তাদের পরিবার এখনও জানে না তিনি বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন।

যেমনটি হয়েছে, বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা মংপ্রু মারমার ক্ষেত্রে। গত ১৩ জুন ২০১৬ তারিখে অপহৃত হন তিনি। এরপর থেকে খোঁজ নেই তার। স্বামীর অপেক্ষায় চোখের পানি ফেলেছেন মংপ্রু মারমার স্ত্রী সামা প্রু মারমা। মংপ্রু মারমা বান্দরবান সদর থানার ১ নম্বর রাজবিলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বর এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। ১৩ জুন রাত ১০টার দিকে প্রতিবেশি ক্রানু মারমার ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন মংপ্রু মারমা। এ সময় জেএসএস সন্তু গ্রুপের দুর্বৃত্তরা এসে তাকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেই থেকে আজো নিখোঁজ আছে মংপ্রু মারমা।

এই ঘটনায় মংপ্রুর জামাতা হামংচিং মারমা বাদি হয়ে বান্দরবান সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। এই মামলার সকল আসামিই সন্তু লারমার জেএসএসের সদস্য। এর মধ্যে এক নম্বর আসামি কে এস মং মারমা এবং দুই নম্বর আসামি সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন আঞ্চলিক জেলা পরিষদ সদস্য।

উল্লেখ্য, ঐ সময়ে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মংপ্রু মারমা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় দুর্বৃত্তরা নির্বাচনের আগে থেকেই তাকে হুমকি দিয়ে আসছিলো। নির্বাচনের পরেও তারা একাধিকবার হুমকি দিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত তাকে অস্ত্র ঠেকিয়ে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

সন্তু লারমার জেএসএসের মত একইভাবে সন্ত্রাসের পথে হেটেছে প্রসীত বিকাশ খীসার দল ইউপিডিএফ। এ প্রসংগে গত ২৯ নভেম্বর ২০১৬ তারিখের একটি ঘটনা তুলে ধরতে চাই। সেদিন খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের জনসভায় যোগ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন নীলবর্ণ চাকমা।

জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এই সভাপতিকে রাস্তা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায় ১০-১২ জন ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সদস্য। ওবায়দুল কাদেরের জনসভায় যোগ দেন এটাই তার অপরাধ ছিলো। ‘জীবনে আর কোনো দিন আওয়ামী লীগ করবো না‘- এমন মুচলেকা দিয়ে তিনদিন পর অপহরণকারীদের কাছ থেকে নীলবর্ণ চাকমার মুক্তি মিলেছিলো।

জেএসএস সন্তু গ্রুপের শক্তঘাঁটি হলো পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলা। সন্তু লারমা, ঊষাতন তালুকদারসহ পার্বত্যাঞ্চলের এই আঞ্চলিক সংগঠনটির প্রভাবশালী নেতাদের বাস এই জেলাতেই। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৪শত উপজাতি সম্প্রদায়ের লোক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এরপর থেকে ঐ এলাকায় তাদের উপর নেমে আসে প্রাণনাশের হুমকি।

সন্তু লারমার দলটি এসময় হামলা চালিয়ে হত্যা করে জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দু চাকমাকে। প্রাণনাশের জন্য হামলা চালিয়ে গুরুতরভাবে জখম করা হয় বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি রাসেল মার্মা, রাঙ্গামাটি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ঝর্ণা খীসাসহ অনেক নেতাকর্মীকে। জেএসএস সন্তু গ্রুপের লাগাতার সহিংসতার মুখে ঐ সময় আওয়ামী লীগ ছাড়তে বাধ্য হয় শতশত উপজাতি নেতারা।

গণতান্ত্রিক এই বাংলাদেশে সন্তু লারমার অনিবন্ধিত আঞ্চলিক দলের কাছে আর কতদিন জিম্মি হয়ে থাকবে পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় জনগণ? অংক্যাচিং মারমা, মংপ্রু মারমা, নীলবর্ণ চাকমা, অরবিন্দু চাকমা, রাসেল মার্মা, ঝর্ণা খীসার মত সহিংসতার শিকার হতে হবে আর কতজনকে?

পাহাড়ে আমরা শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চা চাই। আঞ্চলিক সশস্ত্র রাজনীতি বাঁধা পেরিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক দলের হাত ধরে উন্নয়নের রাজনীতিতে শামিল হতে চায়।  সাম্প্রদায়িক, বিভেদ ও ঘৃণাত্মক রাজনীতির বেড়া ডিঙিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে জাতীয় চেতনার মিছিলে শামিল হতে চায়। সরকার কি পারে না শান্তিপ্রিয় পার্বত্যবাসীর এই ন্যায্য দাবী পুরণের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে?

* লেখক: রাঙামাটি থেকে।


 * মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার বক্তব্য, তথ্য, সূত্র একান্তই পাঠকের। পার্বত্যনিউজের সম্পাদকীয় নীতি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, জেএসএস, দলত্যাগ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন