পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফের ক্যাম্পে চলে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ

fec-image

চলতি বছরের শুরুতে কেএনএফের ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু। ওই ক্যাম্পে ৫০–এর অধিক জঙ্গি থাকার সম্ভাবনা। মে মাসে আরেক গোষ্ঠীর গুলিতে নিহত একজন

দুর্গম পাহাড়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ক্যাম্পে প্রশিক্ষণশিবির স্থাপন করেছে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। পাহাড়ি এই সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফ টাকার বিনিময়ে জামাতুল আনসারকে প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছে। বান্দরবানে সেই শিবিরকে লক্ষ্য করেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত অভিযান চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। খবর প্রথম আলোর

কেএনএফ পাহাড়ে অপেক্ষাকৃত নতুন সংগঠন। বম জাতিগোষ্ঠীর একটা অংশের উদ্যোগে এটি গঠিত হলেও তাদের দাবি, ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা।

নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের ১৯টি জেলা থেকে ‘হিজরতের’ নামে ৫৫ জন তরুণ ঘর ছেড়েছেন বলে গত সোমবার র্যাবের এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়। ৫৫ জনের মধ্যে ৩৮ জনের পূর্ণ নাম-ঠিকানার একটা তালিকাও প্রকাশ করা হয়। ‘নিরুদ্দেশ’ বা ‘নিখোঁজ’ থাকা এই তরুণদের অনেকে বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় কেএনএফের ক্যাম্পে স্থাপন করা প্রশিক্ষণশিবিরে আছেন।

এ ঘটনায় তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত এক সপ্তাহে জামাতুল আনসারের যে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে পাহাড়ের ওই জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেছে। সেখানে এখনো জামাতুল আনসারের ৫০–এর অধিক সদস্য রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, নিষিদ্ধ তিন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের কিছু নেতার উদ্যোগে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া (যার বাংলা অর্থ: পূর্ববর্তী হিন্দের সাহায্যকারী দল) গঠন করা হয়। ২০১৭ সালে এরা সংগঠিত হতে শুরু করলেও সংগঠনের নাম ঠিক করে ২০১৯ সালে।

অতীতেও দেশের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন পাহাড়ে আস্তানা বা ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করেছিল। কেউ জমি কিনে, কেউ ছোটখাটো মাদ্রাসা স্থাপন করে চেষ্টাটি করে। আবার কখনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের (এনজিও) আড়ালে সে চেষ্টা হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর আস্তানায় ধর্মভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ নেওয়ার এমন খবর আগে জানা যায়নি।

নতুন জঙ্গি সংগঠন নিয়ে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জামাতুল আনসার তাদের বাছাই করা তরুণদের ছোট ছোট গ্রুপে জ্যেষ্ঠ সদস্যের হেফাজতে রাখে। যেসব বাড়িতে রাখা হয়, সেটাকে তারা ‘আনসার হাউস’ (সাহায্যকারীর বাড়ি) বলে। এরপর চরাঞ্চলে শারীরিক কসরতসহ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে উত্তীর্ণদের প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানে কেএনএফের ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

স্ত্রী হাজেরা আক্তার বলেন, তাঁর স্বামী আসলে কোথায় আছেন, তিনি জানেন না। তিনি মাঝেমধ্যে ইমোতে কল করতেন। কিন্তু তাঁরা ফোন করলে তাতে কল যায় না। মাসে মাসে বিকাশে টাকা পাঠান। কখনো ৫ হাজার, কখনো ১০ হাজার। সর্বশেষ গত ৭ সেপ্টেম্বর ১০ হাজার টাকা আসে। আর স্বামীর সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছে ২২ মে। এরপর প্রায় পাঁচ মাস যোগাযোগ নেই।

ওয়াকিবহাল একটি সূত্র জানায়, কেএনএফের ক্যাম্পের এই জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় চলতি বছরের শুরুতে। সেখানে একে-৪৭ রাইফেল, পিস্তল ও কাটা বন্দুক চালানো, বোমা (আইইডি) তৈরি এবং চোরাগোপ্তা হামলার (অ্যাম্বুশ) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মূলত টাকার বিনিময়ে কেএনএফ জঙ্গিদের এই সুবিধা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় কাজ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপর একটি সূত্র বলছে, তাঁদের ধারণা, নতুন করে জঙ্গি তৎপরতার যে খবর এখন জানা যাচ্ছে, এই তৎপরতা আরও কয়েক বছর আগেই শুরু হয়েছে। কারণ, কয়েক বছর আগে হরকাতুল জিহাদসহ বিভিন্ন সংগঠনের গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের কাছ থেকে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। বিশেষ করে কেএনএফের সঙ্গে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সংযোগ স্থাপন করে দিয়েছেন বলে যাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে, তিনি পাহাড়ে সন্দেহভাজন তৎপরতার অভিযোগে ২০১১ সালে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জামিনে বের হওয়ার পর আরও কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

গুলিতে মারা গেছেন একজন:
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ডা. আহমদ ছদ্মনাম। তাঁর প্রকৃত নাম জহির উদ্দিন (৩৩)। তাঁর বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানার বিজয়নগরে। তিনি দুই সন্তানের জনক। তিনি কাউকে কিছু না বলে বছরখানেক আগে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যান। পরবর্তী সময়ে ইমো অ্যাপে কল করে স্ত্রী হাজেরা আক্তারকে জানান যে তিনি অবৈধ পথে তুরস্কে গেছেন।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে কেএনএফের প্রতিপক্ষ পাহাড়ি আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর গুলিতে জহির উদ্দিন নিহত হয়েছেন। পরিবারকে সেটা জানানো হয়নি। তবে সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে পরিবারকে টাকা পাঠানো অব্যাহত আছে।

জহির উদ্দিনের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়েছেন তাঁর বন্ধু নিজামউদ্দিন ওরফে হিরণ। তাঁর বাড়িও সোনাইমুড়ী উপজেলার মুকিল্লা গ্রামে। তাঁর স্ত্রীর কাছেও মাসে মাসে বিকাশে ৫ হাজার করে টাকা পাঠানো হয়। নিজামের স্ত্রী ফারজানা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, নিজামও হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে যান। কদিন পর জহিরের ফোন থেকে কল করে জানান তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে আছেন।

পরে ইমোতে কল দিয়ে বলেন তিনি চোরাই পথে ওমানে গেছেন। এরপর মাঝেমধ্যে ইমোতে ফোন দেন। তবে আসলে কোথায় আছেন, সেটা তিনি জানেন না। এ কথা বলতে বলতে ফারজানা কেঁদে ফেলেন।

কেএনএফ কারা:
চলতি বছরের শুরুতে কেএনএফ নামের এক নতুন সশস্ত্র সংগঠনের নাম শোনা যায়। বান্দরবানের বম জাতিগোষ্ঠীর কিছু ব্যক্তি এটি গড়ে তুলেছেন বলে জানা গেছে।

কেএনএফ সংগঠনের নামে ফেসবুকে একটি পেজ খুলে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম—এই উপজেলাগুলো নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করার পর এরা আলোচনায় আসে। তাদের দাবি, তারা বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি—এই ছয় জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে।

কেএনএফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা একাধিক বিবৃতিতে জানায়, কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামে একটি সশস্ত্র দল গঠন করেছে তারা। তাদের দাবি, তাদের সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে পাড়ি জমান বছর তিনেক আগে। ২০২১ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল ফিরে আসে। চলতি বছর তাঁরা আত্মগোপনে যান।

রুমা উপজেলার এডেন পাড়ার নাথান বম এই সংগঠনের প্রধান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের স্নাতক। তিনি নিজ এলাকায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি বেসরকারি সংগঠন প্রতিষ্ঠাতা করেছিলেন। এখন তিনি আত্মগোপনে।

এদিকে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণশিবির লক্ষ্য করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরুর পর কেএনএফের একটি ফেসবুক পেজে হুমকি দিয়ে বলা হয়, ‘ফিয়াংপাদুং পাড়ার পাশে আমাদের হেডকোয়ার্টারে কোনোভাবে যদি আক্রমণের চেষ্টা চালানো হয়, তবে সেটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে ১-২ মিনিটের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।’

জঙ্গিবিরোধী অভিযানে যুক্ত র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন গতকাল মঙ্গলবার রাতে বলেছেন, পাহাড়ি সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় যেখানে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল, সেখানে সমন্বিত অভিযান শুরু হয়েছে। খুবই দুর্গম এলাকা হওয়ায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। অভিযান চলছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কেএনএফ, জঙ্গি, পাহাড়ি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন