পাহাড়ে লাভ জিহাদ এবং ধর্মান্তকরণের ফ্যাক্ট ও মিথের চিত্র

fec-image

 

পানছড়ি উপজেলার যুগোলছড়ি মৌজার হেডম্যানকে অনেক দিন থেকেই খুঁজছিলাম। লোকমুখে অনেকবার তাকে খবর দিয়েছি, কিন্তু সে আসেনি।

অরুণ ত্রিপুরা তার নাম, ভাইবোনছড়া ক্যাম্পের দক্ষিণে চেঙীনদী পাড় হলেই তার গ্রাম, হেডম্যান পাড়া। একদিন স্বাভাবিক রুটিন পেট্রোলে গিয়ে তার বাড়ির আঙ্গিনায় হাজির হই। মাটির তৈরি বেশ পরিপাটি ঘর। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার নাম ধরে ডাকি। তখনই চোখ আটকে যায় দরজা বরাবর উল্টো দিকের একটি বাঁধানো ছবির দিকে, ক্রুশবিদ্ধ যীশু। ছবির নিচে একটি কাঠের পাটাতনে কয়েকটি লাল রক্ত জবা। এবার চারপাশে লক্ষ করতেই বুঝতে পারলাম, হিন্দু বাড়ির নিশ্চিত চিহ্ন- উঁচু ঢিপির উপর যত্নে লালিত তুলসীগাছটি নেই।

লেখক: মেজর নাসিম হোসেন (অব.)

 

চল্লিশের কোঠার শক্ত-সামর্থ্য অরুণ ত্রিপুরাকে দেখে মনে হলো সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে। ঢুলু ঢুলু চোখে অনেকটা অপরাধী অপরাধী ভাব।

আগেই জানতাম, হেডম্যান কড়া দাগের ‘মদারু’, প্রতিদিন ২/১ বোতল মদ না গিললে তার ঘুম হয় না। কয়েকবার তাকে দেখা করার জন্য খবর পাঠিয়েও তার দেখা না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সে বেশ কাচুমাচু করতে থাকে।

‘স্যার, পুলিশের ভয়ে বাজারে যাই না, থানায় মামলা আছে।’

একটু অবাকই হই। পাহাড়ের মানুষ আর্মিকেই ভয় করে জানি। আর পুলিশ তো এখানে জনগণের বন্ধু। তবে থানার মামলাকে পাহাড়িরা বুলেটের চেয়েও বেশি ভয় করে, এটাও বোঝা গেলো তার কথায়। যাক, রান্নার আয়োজনের ফাঁকে ফাঁকে তার সাথে অনেক গল্প হলো।

এক ফাঁকে আমার পেট্রোল সহ-অধিনায়ক একসময় জানায়,

‘স্যার, এ বেটার কাছে অনেকেই টাকা পায়। কয়েক বোতল মদ আর টাকা পেলে সে তার মৌজার জমি জুম চাষ করার জন্য যাকে তাকে চাষ করার অনুমতি দিয়ে দেয়। মদের কারণেই সে সর্বস্বান্ত।’

কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি, ওর দুটো বউ। আমার কৌতূহল বেড়ে যায় তার সম্পর্কে, ‘বেটা এই বাঙালি শরীয়তী তরিকা কেমন করে পেল?’ কারণ, পাহাড়িদের মধ্যে দুই বউ খুব একটা দেখা যায় না।

অরুণকে তার ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণ জানতে চাই, ‘তুমি হিন্দু ধর্ম ছেড়ে দিলে কেন?’

আমার ধারণা ছিলো, সে হয়তো একটা তাত্ত্বিক জবাব দেবে।

কিন্তু তা না, সে একটা নির্ভাবনাময় উত্তর দিলো, ‘হিন্দু ধর্মে অনেক বাছ-বিচার করে চলতে হয়, খরচাপাতি বেশি, বছরে অনেক পূজো করতে হয়, পুরোহিতদের অনেক টাকা দেওয়া লাগে।’

‘আর   খ্রিস্টান হলে তো কোনো খরচ নাই। বছরে একটা মাত্র পরব, তার উপর গির্জা থেকে অনেক সাহায্য পাওয়া যায়, ছেলেদের লেখা-পড়ার খরচ দেয়। শহরের হোস্টেলে বিনে পয়সায় থাকতে পারে।’

অরুণ ত্রিপুরা খ্রিস্টীয় ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পেছনে যাবতীয় জাগতিক সুবিধার বিষয়গুলো জানাতে থাকে। ইতোমধ্যে তার যুবক ছেলে আমাদের আলোচনায় যোগ দেয়, মাইকেল জ্যাকসন তার খ্রিস্টীয় নাম। ঢাকার মোহাম্মদপুর আসাদ গেইট সংলগ্ন একটি হোস্টেলে থেকে সে পড়াশোনা করে। পড়াশোনার সুবাদে উন্নত দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে সে।

আমি হেডম্যানকে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তার দৈনন্দিন জীবনযাপন পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন এসেছে  কিনা জানতে চাই, আমি তার মদ খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করি, নতুন ধর্মের বিধিবিধান পালনে এটা কোনো বাধা কিনা সেটিও জানতে চাই।

অরুণ ত্রিপুরা এক গাল হেসে বলে, ‘না, মদ খেলেও কোনো সমস্যা নেই, আপনি সব ধরনের মাংসও খেতে পারবেন।’

আমি একটু খোঁচা দেই, ‘গরুর মাংসও!’

‘ওটা খাওয়া যায়, তবে আমি যেহেতু আগে খাইনি, তাই গরুর মাংসে আমার এখনো অভ্যাস হয়নি’ কুণ্ঠিত কণ্ঠে অরুণ  জানায়।

অরুণের ঘরে যীশু এসেছে তার ছেলের হাত ধরে। ছেলে মাইকেলই বাবাকে বুঝিয়ে মা লক্ষ্মীর ছবিটাকে যীশুর ছবি দিয়ে প্রতিস্হাপন করেছে। ত্রিপুরা পাড়া-মহল্লাগুলো চাকমা-মারমাদের মতো অতো উন্নত এবং সংঘবদ্ধ না হওয়ায় তাদের ঘরেই যীশু প্রভুর দেখা মিলে সহজে।

যীশুর আশীর্বাদে বান্দরবানের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র পাংখো, মুরং, বম ও অন্যান্য পাড়াতে পাহাড়ের চূড়ায় গির্জার ক্রুশচিহ্ন বিশাল পরিবর্তনের বার্তা দেয়। জিন্স-জ্যাকেটে ঢাকা তরুণী বা গিটার হাতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা কোনো তরুণকে দেখলে বেশ অবাক লাগে, ‘এটা কি বাংলাদেশের কোনো পাহাড়ি গ্রাম?’

আমাদের অভ্যস্ত চোখ পাহাড়ি তরুণ-তরুণীদের যেভাবে দেখে এসেছে বর্তমান বাস্তবতা তা থেকে ভিন্ন। খ্রিস্টান ধর্ম অবলম্বনে তাদের জীবনযাপনে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

পানছড়ি বাজারে মুক্তা লাইব্রেরির মালিক রিপনের কোলে বছর দেড়েকের ছেলে ‘প্রেম’কে দেখে আমার আইয়ুব বাচ্চুর সেই গানের কলিটা মনে পড়তো, ‘আমিতো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপর পড়েছে’।

দোকানের মালিক বাঙালি রিপনের কোলে পাহাড়ি চেহারার শিশু পুত্র ‘প্রেম’কে দেখে ওর কাছে জানতে চাই,

‘ছেলেটা কে?’

‘আমার ছেলে।’

রিপনের মৃদু হাসিমুখের উত্তর আমার কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়।

‘আমি পাহাড়ি মেয়ে বিয়ে করেছি স্যার, চাকমা মেয়ে।’

পানছড়ির মতো জায়গা, যেখানে পাহাড়ি-বাঙালি বড় বড় দুটো সংঘাতের ইতিহাস আছে, সেখানে আন্তঃসম্প্রদায় বিবাহতো খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। আর এসব নিয়ে তো পাহাড়ি সংগঠন ও অন্যান্য দেশি-বিদেশি মানবাধিকার গ্রুপগুলো খুবই সোচ্চার। তো কীভাবে এই রোমিও-জুলিয়েট অসাধ্য কাজটি করলো তা জানতে রিপনের চায়ের দাওয়াতটি সানন্দে গ্রহণ করি।

রিপনের বাবা পানছড়ির অনেক পুরনো বাসিন্দা। চাকরির সুবাদে পানছড়িতে এসেছিলো পাহাড়ে সংঘাত শুরু হওয়ার আগে। চাকরি শেষে আর ফিরে যায়নি, এখানেই বাজারে দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করে। আদি বাঙালি বলে স্হানীয় পাহাড়িদের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো সৌহার্দপূর্ণ।

চাকমা মেয়ে মমতা আর রিপন একই স্কুলের ছাত্রছাত্রী। পড়াশোনায় সহযোগিতা নিতে গিয়ে মমতার মনের পাতায় ভালোবাসার ছোঁয়া লাগিয়ে দেয় রিপন। এক কান দু’কান হতে হতে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় সবার মাঝে। তারপর যা হয়, পরিবারের হস্তক্ষেপে মমতাকে পানছড়ি ত্যাগ করতে হয়।  সেইফ হাউস হিসেবে চট্টগ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাখা হয় মমতাকে। ওদের প্রেমের গভীরতা দেখে কয়েকজন পাহাড়ি বন্ধুও এগিয়ে আসে সহযোগিতা নিয়ে। তাই যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। প্রেম আরো গভীরে পৌঁছালে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মমতা-রিপন।

‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’- প্রেমের এই চিরন্তন গান গাইতে গাইতে মমতা চাকমা হয়ে যায় জান্নাতুল ফেরদৌসী।

বেশ কিছু দিন চট্টগ্রামে থেকে তারা ফিরে আসে পানছড়িতে। ভাগ্য ভালো বলতে হয় মমতার। ওর বাবা-মা এ বিষয়ে কোনো রকম নালিশ নিয়ে যায়নি পাহাড়ি সংগঠনগুলোর কাছে।

‘মিয়া-বিবি রাজি তো কেয়া করে গা কাজি’- মমতার বাব-মা দুঃখ পেলেও মেয়ের সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়। তবে মমতা তার বাপের ভিটায় যাওয়ার রাস্তাটি চিরতরে হারিয়ে ফেলে।

মমতা-রিপনের প্রেমটিকে একটি কিশোর প্রেমের সফল পরিণতি বলে এক রকম ছাড় দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু নালকাটার জামাই বলে খ্যাত এক মেজর সাহেবের পাহাড়ি প্রেমের গল্প শুনে রিপনকে ওরকম অসম প্রেমের সূচনাকারী হিসাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় না।

১৯৮৬ সালের ‘Great Nalkata killing’ নামে নৃশংস পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গার সময় পাহাড়ি স্ত্রীর সগোত্রীয়দের সুরক্ষা দিতে তিনি বেশ তৎপর ছিলেন। জনশ্রুতি আছে, তিনি সেই চরম বাঙালি বিদ্বেষের সময়ও পাহাড়িদের কাছে সমাদৃত ছিলেন পাহাড়ি মেয়ের ‘দামান’ হিসেবে। সশস্ত্র শান্তিবাহিনীর সদস্যরা কোনো দিন সেই মেজর সাহেবের টহলের উপর গুলিবর্ষণ করেনি বলেই জানা যায়।

নালকাটা ক্যাম্পের জামাই সেই মেজর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এক সময় আমারও ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। ভাবির কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান শুনে উনি মুগ্ধ হয়েছিলেন বোধহয়— (ক্লাব নাইটে এ গানটি তিনি গাইতেন)-

‘সখী ভাবনা কাহারে বলে,

  যাতনা কাহারে বলে

তোমরা যে বল দিবস রজনী ভালবাসা ভালোবাসা

সখী ভালোবাসা কাহারে কয়

সেকি শুধু যাতনাময়?’

সুপুরুষ মেজর সাহেব দেওয়ানবাড়ির পাহাড়ি কন্যার ধাঁধার উওরে কী বলেছিলেন তা আমরা কোনো দিন জানতে পারিনি। তবে আমাদের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেত, উনি সামরিক উর্দি পরে, মানে এতো সব এসওপি এড়িয়ে ওই দেওয়ানবাড়ির দেওয়াল কীভাবে পার হলেন!  সে কৌশল অবশ্য তিনি তার কোনো জুনিয়রকে শেখাননি।

পাহাড়ি কন্যার সাথে সামরিক কর্তার প্রেম-বিয়ে নিয়ে ‘জাত গেল, জাত গেল বলে কোনো হৈচৈ তখন হয়নি। এমনকি এটাকে কেউ জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ বলেও রায় দেয়নি।

২০০৫ সালে পানছড়ি বাজার সংলগ্ন টিএন্ডটি টিলা নামে খ্যাত একটা পাড়ায় আমেরিকার পিস কোরের কিছু সদস্য আসলেন যীশুর বাণী নিয়ে। নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৬ জনের একটি দল। তারা নিজস্ব পদ্ধতিতে কিছু জনকল্যাণমূলক কাজ করবেন বলে সব পর্যায়ের অনুমতি নিয়েই পানছড়িতে সাময়িক আস্তানা গাড়লেন। সরাসরি কোনো আদেশ না থাকায় আমরাও তাদের কোনো ক্লোজ প্রটেকশনে যেতাম না। তবে তাদের চলাফেরার উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হতো, যেন অপহরণের মতো ঘটনা না ঘটে।

পানছড়ির সীমান্ত সংলগ্ন পুঁজগাও’র চাকমা অধ্যুষিত গ্রামে তারা যখন যীশুর শান্তির বাণী প্রচারে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং সভার আয়োজন করতে লাগলেন তা শিক্ষিত এবং সংস্কৃতি সচেতন চাকমাদের শংকিত করে তোলে।

শংকা থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে দ্রোহের আগুন। এই আগুনে এক রাতে পুড়ে গেল সদ্য নির্মিত গির্জাটি। এমনটাই যে ঘটবে তা ধারণার মধ্যেই ছিলো।

সে সময় নানাবিধ চাপের মধ্যেও পাহাড়ি বিশেষ করে অগ্রসর চাকমা-মারমা নৃগোষ্ঠি নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে বেগবান রাখতে খুবই সচেষ্ট ছিলো। পাড়ায় পাড়ায় ধর্মীয় উপাসনালয়ের কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে দেশি-বিদেশি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা তাদের অস্তিত্বের জন্য ছিলো অপরিহার্য। তবে জাপান,  মায়ানমার, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকাসহ নানান দেশের বৌদ্ধদের এক বৃহত্তর ঐক্য বা Pan Buddhism-এর সাথে আমাদের দেশের বৌদ্ধদের সম্পৃক্ততা নিয়ে কোনো ভীতিজনক কথা শোনা যায় না।

একটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী অপরিহার্যতাই সীমান্তের ওপারের ত্রিপুরাদের ব্যাপকভাবে খ্রিস্টীয় ধর্মে দীক্ষিত করছে। ভারতের ত্রিপুরাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখন খ্রিস্টান ধর্মালম্বী। অমল ত্রিপুরা নামে ভারতীয় এক যুবকের সাথে আমার কথা হতো। লোগাং বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন একটা ত্রিপুরা পাড়ার জামাই সে। এক সময় সে  ত্রিপুরা রাজ্যের একটি সশস্ত্র  বিদ্রোহী সংগঠনের সদস্য ছিলো। শিক্ষিত এই ছেলেটির সাথে ত্রিপুরাদের নানা বিষয় নিয়ে আমার কথা হতো।

তার কাছ থেকেই জানি, সে আর হিন্দু ধর্মের অনুসারী নয়। ত্রিপুরাতে ব্যাপকভাবে বাঙালি হিন্দুদের অভিবাসন ঘটায় তারা এখন সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। এটাই তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করেছে।

আমি তাকে প্রশ্ন করি, হিন্দুদের সাথে যদি তোমাদের বিরোধ থাকে তবে তোমরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত না হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম নিচ্ছো কেন?

‘স্যার, আমরা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। আপনাদের লোকগুলো তো খ্রিস্টানদের মতো পাহাড়ের অতো ভিতরে এসে তাদের মতো কাজ করে না, তাই ত্রিপুরাতে মুসলমানদের সংখ্যা কম।’

অমলের সাথে কথা বলার মাঝে মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে উঠলে পানছড়ির বাঙালি পাড়ার প্রান্ত থেকে সবগুলো মাইকে আজান ধ্বনিত হতে থাকলো। আমি নিরবে মাইকের সংখ্যা টুকতে থাকি ১, ২, ৩, —।

 আজান শেষ হলে আমি অমলকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আচ্ছা অমল, পানছড়িতে কোনো পাহাড়ি পাড়ায় মসজিদ আছে?’

‘আমি দেখি নাই’

অমলের স্বীকারোক্তিটি যদি কোনো পশ্চিমা মানবাধিকার সংগঠন শুনতে পেত, তবে নেদারল্যান্ডস ভিওিক সংগঠন ‘Life is Not Ours’ শিরোনামের রিপোর্টে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতো না। তাদের রিপোর্টের ভাষ্যমতে, অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেই সমস্যা।

রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলায় ‘রাবেতা আল ইসলাম’ নামক একটি হাসপাতাল দেখেছিলাম। পাকা হাসপাতালটিতে স্হানীয় জনসাধারণ চিকিৎসা নিতে যেত। এটা সম্ভবত কুয়েত সরকারের ফান্ডে চলতো। ওরা কোনদিন ধর্ম প্রচার করেছে বলে শুনিনি। তবে কিছু মৌলভী টাইপ ডাক্তার থাকায় ওদেরকে অনেকে খ্রিস্টান মিশনারি সমতুল্য মনে করে থাকবে হয়তো। কিন্তু রাবেতার সেবার মান কোনো খ্রিস্টান হাসপাতালের ধারে কাছেও ছিলো না, বিশেষ করে ধর্মপ্রচারের দিক থেকে।

প্রতি মাসে কাকরাইল থেকে বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে অনেক তাবলীগ টিম বের হয় ইসলামের দাওয়াত দিতে। আমি ৬ বছরের পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকরি জীবনে একটি টিমকেও কোনো পাহাড়ি এলাকায় দেখিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাডের আনাচে-কানাচে বাঙালিদের পদচারণা ছিলো অনেক আগে থেকেই। ব্যবসা এবং কৃষি কাজের নিমিত্তে কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামের অনেক এলাকা থেকে বাঙালিরা পাহাড়িদের বাড়িতে যাতায়াত করতো। এসবের মাঝে জীবনের প্রয়োজনে অনেকেই পাহাড়িদের বাড়িতে কৃষি শ্রমিক হিসেবেও নিয়োজিত হতো। ‘গাবুর’ বা কামলা নামে পরিচিত এসব কৃষি শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো ব্যাপক। অনেক পাহাড়ি সমতলের চাষবাসের পদ্ধতিতে, বিশেষ করে গরু দিয়ে জমি চাষ করা, ধান রোপণের জন্য চারা তৈরি করা, এসব কাজে পটু ছিলো না। পাহাড়ি বাড়িতে অনেক খোলামেলা পরিবেশে বাড়ির কন্যাদের সাথে যোগাযোগের সুযোগ ছিলো। এসব যুবকদের কেউ কেউ পাহাড়ি নারীদের মন ‘খেয়েছে’। বিয়ে-সাদীর অনেক ঘটনা তখনও হয়েছে। এরা কেউ কেউ ঘর জামাই হিসেবে পাহাড়ে থেকে গেছে। সমতলে ফিরে যায়নি। পাহাড়ি জনগণের সাথে তাদের আত্মিক মিশ্রণ এতো নিরবে ঘটেছে যে, তা কোনো রকম সংঘাত বা অস্হিরতার কারণ হয়নি।

আমি লংগদু জোনে (১৯৯১-৯৩) থাকার সময় ডানে আদারকছড়া ক্যাম্পের উওরে ‘আলী কারবারি (Ali karbari) পাড়া’ নামে একটি পাড়ার দেখা পাই।মানচিত্রে নামটি পড়ে আমার একটু কৌতূহল হয়, এটা কি কোনো মুসলিম নাম নাকি পাহাড়ি নামের বিবর্তন। স্হানীয় মেম্বারকে জিজ্ঞেস করলে উনি একটা গল্প শুনালেন,

‘বহু বছর আগে কুমিল্লা থেকে ১৬/১৭ বছেরের একটি কিশোরকে বাৎসরিক চুক্তিভিওিতে আনা হয়। তখনকার কারবারি বা পাড়া প্রধানের বাড়িতে সে অনেকটা আপনজনের মতো হয়ে পড়ে। পুত্রহীন কারবারির মায়াজালে বাঁধা পড়ে সে। অতঃপর কারবারির মেয়ের সাথে বিয়ে হয় বাঙালি ছেলের। বাড়ি ফেরার আর তাগিদ অনুভব করেনি সে। কারবারির মৃত্যুর পর সেই কারবারির পদ পায়। স্হানীয় নিয়মে কারবারি পাড়ার নতুন নাম হয় ‘আলী কারবারি পাড়া’। ম্যাপে ওই নামটাই রেকর্ডভুক্ত হয়। আলী কারবারির মৃত্যুর পর নতুন কারবারি নিয়োগ হলে আলী করবারি নামটা লোকমুখ থেকে মুছে যায়। তবে সরকারি ম্যাপে আলী কারবারি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারিভাবে ধর্মান্তকরণের কোনো প্রজেক্ট আমি দেখিনি। তাছাড়া এসব বিষয়ে পাহাড়ি নেতৃত্ববৃন্দ খুবই সোচ্চার। তবে বাঙালি হিন্দু ও বড়ুয়া সম্প্রাদয়ের সাথে পাহাড়িদের বিবাহে তেমন সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি করে না। বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মালম্বীদের মধ্যে সামাজিক আচার-আচরণ, পোশাক, খাদ্যাভ্যাসে মিল থাকায় আন্তঃবিবাহ সহজভাবেই ঘটে, এটাকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হিসেবে দেখা হয় না।

পাহাড়ে বাঙালিদের দুটো ধারা: আদি বাঙালি ও পুনর্বাসিত বাঙালি। আদি বাঙালি মানে যারা কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হওয়ার আগে বা ষাটের দশকে এসেছে তাদের সাথে পাহাড়িদের এক ধরনের সহমর্মিতা রয়েছে। কিন্তু সত্তর দশকের শেষ বা আশির দশকে আসা বাঙালিদের পাহাড়িরা সন্দেহ এবং হুমকির চোখে দেখে। পুনর্বাসিত বাঙালিদের সাথে আদি বাঙালিদের  সামাজিক সম্পর্কও অতটা গাঢ় নয়। ঠিক যেমনটা চরের বাসিন্দাদের সাথে মূল ভূখণ্ডের গ্রামের লোকজনদের।

বাঙালিরা অনেক কিছু নিয়েই যেমন ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়, তেমনই মসজিদও তাদের বিবাদ-বিসংবাদ থেকে বাদ যায় না।  তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, এক পাড়ার মধ্যে প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক আলাদা মসজিদও তারা তৈরি করে। এসব মসজিদের আধিক্যকে পাহাড়ি সংগঠন এবং পশ্চিমা এনজিও, মানবাধিকার সংগঠনগুলি ইসলামাইজেশন বা ধর্মান্তরকরণের প্রক্রিয়া হিসেবে চিত্রিত করে থাকে। পাহাড়ের বাঙালির জনসংখ্যাধিক্য এবং মসজিদের মাইকের আওয়াজ দুটোই পাহাড়িদের মনে অস্তিত্বের শংকাকে বাড়িয়ে তুলছে।

যাহোক, মানুষের জীবনে জীবনের প্রয়োজনেই প্রেম আসে। প্রেম তার পরিণতির পথে ধর্ম বাধা হয়ে উঠলে ধর্মান্তরের পথে হাঁটে। লাভ জিহাদ (Love Jihad) আখ্যা দিয়ে এটাকে আটকানো যায় না। দুটো চরম বৈরী সম্প্রদায় পাশাপাশি অবস্থান করলেও আন্তঃসম্প্রদায় প্রেমজনিত বিবাহ ঘটবেই।লাভ জিহাদের আইন করে তা ঠেকানো যায় না।

পরিশেষে এটাই বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টানাইজেশন যতটা ফ্যাক্ট, ইসলামাইজেশন ততটাই মিথ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন