প্রবল চাপের মুখে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত

সাভার ট্রাজেডিতে চাপের মুখে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো

নিউইয়র্ক: সাভার ট্রাজেডির পর স্বস্তিতে নেই পশ্চিমা দেশগুলোর বড় বড় কোম্পানিগুলো। ভবন ধসে চার শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর বড় বড় ব্র্যান্ডের খুচরা বিক্রেতারা সাধারণ ক্রেতাদের চাপের মুখে পড়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে কাপড় বানিয়ে এনে এইসব কোম্পানি তাদের বিশাল ক্রেতার বাজার থেকে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে। এখন সেসব ফ্যাক্টরির কাজের পরিবেশ নিয়েই উদ্বিগ্ন ক্রেতারা।

বেনেটন, গ্যাপ, চিলড্রেন’স প্লেসসহ অন্য খুচরা বিক্রেতারা এখন কিভাবে এই পরিস্থিতি সামলে সামলে ওঠা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেনেটন এরই মধ্যে কয়েক দফায় বৈঠক করেছে এমন কর্মপরিবেশের কারখানা থেকে আর পণ্য বানিয়ে আনবে কি না তার সিদ্ধান্তের জন্য।

গত বছরের তাজরীন ফ্যাক্টরির ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ১১২ শ্রমিকের প্রাণহানির পর যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় কোম্পানি আরও আগেই বাংলাদেশ থেকে পণ্য না বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি গত মার্চেই তাদের শেষ কথা বলে দিয়েছে। বলেছে বাংলাদেশ থেকে তারা আর কোনো পণ্য বানাবে না। বিশ্বখ্যাত এই কোম্পানি প্রতিবছর ৪০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক বিক্রি করে।

ডিজনি’র একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে গত ৪ মার্চ তাদের কয়েক হাজার লাইসেন্সি ও ভেন্ডরকে বিদেশ থেকে পোশাক বানিয়ে আনার ক্ষেত্রে তাদের নতুন রীতির কথা জানিয়ে দিয়েছে। ডিজনি’র জন্য বাংলাদেশ প্রতিবছর ৪০ কোটি ডলারের কাপড় বানাতো। বাংলাদেশি অর্থে যার পরিমান ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। মার্চ থেকে এই বড় অংকের অর্ডার আর পাচ্ছে না বাংলাদেশ। তাজরীন ফ্যাক্টরিতে ডিজনির পোশাক তৈরি হতো এমন তথ্য গোটা বিশ্বে সমালোচনার ঝড় ওঠার পরই তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়াল্ট ডিজনি। বাংলাদেশ ছাড়া পাকিস্তান থেকেও ডিজনি তার পোশাক বানানো বন্ধ করেছে। ওই দেশে গত সেপ্টেম্বরে ২৬২ গার্মেন্ট শ্রমিক নিহত হওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানিটি।  

এ ধরনের দুর্ঘটনার পর বড় কোম্পানিগুলোর সরে পড়ার ঘটনা বাংলাদেশকে আরও বিপদগ্রস্ত করবে বলেই মনে করছেন শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলো। সরে পড়া নয়, বরং দেশটির কারখানাগুলো কর্মপরিবেশ উন্নত করার লক্ষ্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়াই কাম্য বলে মনে করছেন তারা। বাংলাদেশ সরকারও চায় কোনোভাবেই যেনো তৈরি পোশাকের এই বড় বড় ক্রেতা চলে না যায়।

তবে সবশেষ সাভার ট্রাজেডির পর এসব কোম্পানির পক্ষে বাংলাদেশে থাকা এবং পোশাক বানিয়ে আনা নিয়ে অস্বস্তিতেই পড়েছে বড় বড় কোম্পানিগুলো।

ওয়াল্ট ডিজনির কনজুমার প্রডাক্ট বিভাগের প্রেসিডেন্ট বব চাপেকের মতে সমস্যা মোকাবেলার একক কোনো সমাধান নেই। তিনি বলেন, অন্যদের মতো একই অবস্থা ডিজনির নয়। ডিজনী একটি বহুমালিকানার কোম্পানি। একে তার শেয়ারহোল্ডারদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। আমরা বিষয়টি নিয়ে অনেক ভেবেছি, আলোচনা করেছি। এবং মনে করছি আমাদের সাপ্লাই চেইনে বিরাজমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এটিই সবচেয়ে দায়িত্বশীল ব্যবস্থা।

ডিজনি যেদিন এই সিদ্ধান্ত নেয় তার ঠিক দুই দিন আগে ওয়ালমার্ট, গ্যাপ, কেয়ারফোর, লি অ্যান্ড ফাং এর মতো বাঘা বাঘা ডজন খানেক খুচরা বিক্রেতা জার্মানের ফ্রাঙ্কফুর্টে বৈঠক করে বাংলাদেশের চার হাজারেরও বেশি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে একটি কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। জার্মান সরকার ও দেশটির বেসরকারি সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরাও ওই বৈঠকে অংশ নেন।

একটি হিসাবে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের ৩৬ লাখ তৈরি পোশাক কর্মীর বানানো ১৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের পোশাক প্রতিবছর রপ্তানি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের পরেই বাংলাদেশই দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।

এনিয়ে ওয়ালমার্ট ও গ্যাপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা পত্রিকাটিকে জানায় এরই মধ্যে তারা বাংলাদেশের ফ্যাক্টরি পরিচালনাকারীদের অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এখানকার শ্রমিক অধিকার গ্রুপগুলো মনে করছে এই প্রশিক্ষণই যথেষ্ঠ নয়। তারা চাইছে কারখানার কাঠামোগত উন্নয়ন করে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধ এবং দুর্ঘটনায় দ্রুত নির্গমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিক এসব কোম্পানি। ওয়ালমার্টের কাছে তাজরীন গার্মেন্টেসের হতাহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণও দাবি করছেন তারা। গত এপ্রিল জুড়ে তাজরীনের আহত শ্রমিক সুমি আবেদীন ও শ্রমিক অধিকার কর্মী কল্পনা আখতারকে যুক্তরাষ্ট্রে এনে ওয়াশিংটনের প্রাণকেন্দ্রে, আরকানসাসে ওয়ালমার্ট সদরদপ্তরের সামনে এবং সানফ্রান্সিসকোতে গ্যাপ এর সদরদপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।

ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম নামে একটি ওয়াশিংটনভিত্তিক ফ্যাক্টরি মনিটরিং গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক স্কট নোভার মতে, কোম্পানিগুলো এখন চাপের মুখে রয়েছে। তাদের সুনাম দারুণভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। কারণ তারা বাংলাদেশের যেসব কারখানা থেকে পণ্য তৈরি করে এনে বিক্রি করছে সেখানে শ্রমিকরা চরম অবহেলা ও দুর্দশার মধ্যে কাজ করে।

বাংলাদেশে শ্রমিকের অধিকারহীনতার এই চরম দুর্দশার জন্য রোমে পোপ ফ্রান্সিসও তার সমবেদনা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন এই জেনে যে মাসে মাত্র ৪০ ডলারের বিনিময়ে তারা পোশাক বানায়। এ অবস্থাকে ¯্রফে শ্রমদাসত্ব বলেই মত দিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস। 

 বাংলা নিউজের সৌজন্যে

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *